ইমাম আলি কে চেনেন? আজকের এই তৌহিদুল ইসলাম, ফজলে হক, দুখিঃরাম ডালের মতই ইমাম আলি কেও সেদিন মোড়া হয়েছিলো ঐ কাস্তে হাতুড়ির লাল শালুতেই। তখন বিহারের কলিয়ারির শ্রমিক বস্তি গুলোতে লাল ঝাণ্ডার দাপট বাড়ছে ক্রমশ। ঝরিয়া, কেশারিয়া, পিপড়ার অলিগলিতে তখন 'কমরেড' ডাক কানে বাজছে। সকাল আটটার ট্রেনে জ্যোতি বসু কে স্বাগত জানাতে সেদিন পাটনা প্লাটফর্মেই হাজারো মানুষ। পোস্টার-ফেস্টুন আর 'ই-কি-লা-ব'র তুমুল শ্লোগানে ছয়লাপ ষ্টেশন চত্বর। হঠাৎ চলল গুলি। লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট গিয়ে বিঁধল ইমাম আলির বুকে। আততায়ী মিলিয়ে গেলো জনস্রোতে। হাসপাতাল যাবার আগেই শহীদ হলেন ইমাম আলি। 'কমরেড' ইমাম আলি। পরে গোয়েন্দা দপ্তর জানালো, আততায়ী ছিলেন 'আনন্দমার্গী'। কদিন পর পাঞ্জাব সীমান্তে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে গিতে বিএসএফের হাতে ধৃত দুই মার্গী যুবকের স্বীকারোক্তি, তাঁদের সংগঠনই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত। আসলে গেঁয়ো যোগী যেমন ভিখ পায় না, লাল শালুতে মোড়া লাশেরও তেমন, 'সিপিএম'র গণহত্যার' মত, প্রথম পাতায় ৬০ পয়েন্টের হেডিং হয় না।
১৯৫৫'র ৯'ই জানুয়ারি বিহারের জামালপুর অঞ্চলে প্রভাত রঞ্জন সরকার ওরফে 'আনন্দমূর্তি' ওরফে 'বাবা'র হাত ধরে জন্ম এই 'আনন্দমার্গ'র। স্বঘোষিত ধর্মগুরু প্রমাণের তাগিদে শুরু হল বাবার নিত্য বচন। বাবার শিব দর্শন, শৈশবে বাঘের পিঠে জঙ্গল ভ্রমণের অলৌকিক সব কাহিনী। আনন্দমার্গ'র সর্বক্ষণের কর্মী হতে তখন দীক্ষা লাগে। পোশাকি নাম পড়ল 'অবধূত'। মার্গের রাজনৈতিক কর্মসূচী পরিচালনার জন্য তৈরি হল, 'প্রাউটিস্ট ব্লক অফ ইন্ডিয়া'। তাদের মুখপত্র 'প্রাউট' ঘেঁটে জানা যায় বাবা'র অনন্য বিচারধারা। "অহিংসা উপর ভিত্তি করে আধ্যাত্মিকতা মানবতার কোন উপকারেই আসবে না", "ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে নিরক্ষর ও অশিক্ষিতদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত", "কমিউনিজম মানুষ কে জন্তুতে পরিণত করে" ইত্যাদি। স্বৈরতান্ত্রিক এবং ধর্মগোঁড়া এই বাবার লালিত পালিত গুপ্ত আধ্যাত্মিক সংগঠন যে পরবর্তী সময় জ্যোতি বসু ছাড়াও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী আব্দুল গফুর, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন এন রায় কে হত্যার ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের করবে , এমনকি রেলমন্ত্রী ললিতনারায়ন মিশ্র হত্যাও করবে এতে আর আশ্চর্য কি? বলদ দিয়ে তো আর হাল চাষ হয় না ।
ক্রমশ ভক্ত এবং মার্গের অভ্যন্তরেও বাবা'র বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়। ১৯৭১'এ কলকাতার 'ধর্ম মহাচক্র'র পর 'আনন্দমূর্তি'র স্ত্রী উমা সরকার ও প্রাক্তন অবধূত, 'প্রাউটের' অর্থসচিব নওল কিশোর আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন। নওল কিশোর তাঁর 'আনন্দমার্গঃ সয়েলিং দি সাফরন রব' বইয়ে লেখেন 'গুরুর বিরুদ্ধে জেহাদের অপরাধে ৩৬ জন আনন্দমার্গী কে ছোটনাগপুরের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে পেট চিরে, চোখ উপড়ে হত্যা করা হয়।' পরে ঐ মামলায় অভিযুক্ত অন্য এক অবধূত মাধবানন্দ'ও আদালতে জানান 'গুরুর নির্দেশে তিনি নিজেই ১৮ জন অবধূত কে হত্যা করেছেন।' আবার ১৯৭৩'র ৯'ই এপ্রিল মার্গের পক্ষে থেকে প্রচার করা হল যে বিহারের বিধানসভার সামনে দিভিয়ানন্দ অবধূত 'স্বেচ্ছা আহুতি' দিয়েছেন। ২৪শে এপ্রিল দিল্লিতেও আবার 'স্বেচ্ছা আহুতি'। পরে পুলিশি তদন্তে অবশ্য প্রমাণ হয় তাঁদের আসলে জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারা হয়েছিল।
পুরুলিয়া ও বিহার সীমান্তে জয়পুর ও ঝালদা ২ নং ব্লকের আদিবাসী, সরকারী ও রায়তি জমি মিলিয়ে হাজার একর জমি বেআইনি ভাবে দখল করতে উদ্ধ্যত হয় এই মার্গীরা। ১৯৯০'র ১৮ই এপ্রিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সঈদ লোকসভা তে এক বিবৃতিতে মার্গীদের বিরুদ্ধে জমি হাতিয়ে নেওয়ার এই সত্যতা স্বীকার তো করেনই সাথে পুরুলিয়ার বাঁশগড়ের জঙ্গলে বিদেশ থেকে আমদানি করা বে-আইনি অস্ত্র মজুতের অভিযোগও করেন। ১৯৯৫'র ডিসেম্বরর বিমান থেকে পুরুলিয়া অস্ত্র-বর্ষণ কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত কিম ডেভি তাঁর সাক্ষ্যতেও আনন্দমার্গীর বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিপুল বে-আইনি অস্ত্রের কথা উল্লেখ করেন এবং জানান ঐ বিমানেই ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক আনন্দমার্গী দয়ানন্দ অবধূত।
এতো কিছু পরও ১৯৮২'র ৩০শে এপ্রিল বিজন সেতুতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১৭ জন মার্গী মারা যাওয়ার ঘটনা ন্যক্কারজনক। 'ছোট্ট' , 'সাজানো ঘটনা' বা 'বিরোধীদের চক্রান্ত' নয় বরং ৪ঠা মে, সিপিএম রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত জানান "আনন্দমার্গীর ঘটনাতে আমরা গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। প্রকৃত ঘটনার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক।" সিপিএম বিধায়ক শচিন সেন, কান্তি গাঙ্গুলি প্রমুখের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়, বিচারও শুরু হয়। কিন্তু ঠিক কি কারণে আনন্দমার্গীরা সেদিন ঢাল তরোয়াল মড়ার খুলি নিয়ে মিছিলের অনুমতি চেয়েছিল? অনুমতি না থাকলেও তাহলে কেন সেদিন ঐ মিছিল হয়েছিলো? কেন পরবর্তী সময় আনন্দমার্গীরা আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে অস্বীকার করলেন? তাঁদের ধারাবাহিক অনুপস্থিতির কারণে যে মামলা বাতিল হল তাঁর দায় কার? 'সিপিএমের গণহত্যা' প্রমাণের এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারালেন কেন? না এটাও ছিল ছোটনাগপুরের জঙ্গলের মতই অন্তর্দলীয় হত্যালীলা? কিম্বা দিল্লী-পাটনার অবধূত'দের মত 'স্বেচ্ছা আহুতি'?
২০১১'র আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলার শিরা ফুলিয়ে প্রতিশ্রুতি দিতেন "৩৪ বছরের সমস্ত গণহত্যার তদন্ত করবেন। কমিশন বসাবো"। তাহলে কেন "বিজনসেতুর সিপিএম'র গণহত্যার" প্রায়শ্চিত্ত হল না? কেন ১৭ জন মার্গীর 'অতৃপ্ত আত্মা' বিচার পেল না? কেন সিপিএম'র কেউ জেলে গেলো না? হোক না একটা গণহত্যার সাচ্চা হিসেব নিকেশ। তৌহিদুল ইসলাম থেকে ইমাম আলি। অজিত লোহার থেকে শালকু সরেন। ঝর্না মান্ডি থেকে রোহিত ভামুলা। হোক সেটা, ইতিহাসের পাতা থেকেই। যে ইতিহাস আত্মবলিদানের। যে ইতিহাসের পাতা বামপন্থীদেরই রক্তে ভেজা। যেখানে জমাট রক্তের রং লাল। শুধুই লাল...
শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৬
আনন্দমার্গী ~ সুশোভন পাত্র
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন