ঐ ২০১২। রাস্তার কোল ঘেঁষে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে লেনিন। কার্ল মার্ক্স আর এঙ্গেলস খাবি খাচ্ছে পিছনের নর্দমার হাঁটু ভর্তি জলে। ফোট ফ্রেম সহ স্তালিন হামাগুড়ি দিচ্ছে রাস্তায়। জ্যোতি বসুর মুখে লেপা আলকাতরা। সাদা-কালো কাকাবাবুর ছবিতে পেচ্ছাবের বিশ্রী গন্ধ। সাবল দিয়ে ভাঙ্গা গেটের তালাটা ছুঁড়েই ভাঙ্গা হয়েছে টিভিটা। মেঝে ভর্তি ভাঙ্গা চেয়ার-টেবিল। উপরের তাকটা থেকে মাঝে মাঝে গায়ে এসে পড়ছে মেম্বারশিপ ফর্মের টুকরো গুলো। গোটা ঘর তছনছ। আর বাইরে, এককোণে, তখনও, আগুনে পুড়ছে কিছু জরুরী কাগজপত্র আর গোটাকতক লাল পতাকা। হার্মাদ সিপিএমে'র ৩৪ বছরের বা তারও আগের 'গণহত্যা'র বদলা নিয়ে, জোনাল পার্টি অফিসে, 'গণতন্ত্রে'র নিদর্শন রেখে গেছেন, একালের 'সততা'র পূজারীরা। পাড়ার মোড়, রাস্তা-ঘাট, চায়ের ঠেক স্পিকটি নট। লোকাল পুলিশ আরও স্পিকটি নট। অ্যাপলিটিক্যাল, নিরপেক্ষ, মধ্যপন্থী, সুশীল, বুদ্ধিজীবী,কবি, টেক্সাসের বাঙালি টেকনোক্র্যাট, ম্যানচেস্টারের প্রবাসী চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, আরও আরও স্পিকটি নট। আসলে নন্দীগ্রাম থেকে মরিচঝাঁপি, আনন্দমার্গী থেকে নেতাই'র 'গণহত্যার' কাণ্ডারি সিপিএম'র প্রতি নিখাদ জনরোষ দাদা। 'গণহত্যা' বলে 'গণহত্যা'? সেই সাঁইবাড়ি দিয়ে শুরু। ভয়ানয়-ভয়ঙ্কর। সে কি মশাই আপনার সাঁইবাড়ি মনে নেই? সাঁ-ই-বা-ড়ি?
৭০'র উত্তাল বাংলা।একদিকে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার বাংলা। 'লাঙ্গল যার জমি তার' আর 'বেনামি জমি দখল রাখো, দখল রেখে চাষ কর' শ্লোগানে মুখরিত বাংলা। আর অন্যদিকে, যুক্তফ্রন্ট সরকার, রাষ্ট্রপতি শাসন, মুক্তিযুদ্ধের তাপে তেতে ওঠা বাংলা। বিকল্প জোটের সুশীল ধাড়া কে সঙ্গে নিয়ে, ১৬'ই মার্চ পদত্যাগ করলেন অজয় মুখার্জি। সিপিএম'র নেতৃত্বাধীন সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্তফ্রন্ট কে সমর্থন করতে অস্বীকার করল ফরওয়ার্ড ব্লক, এসইউসিও। ১৩ মাসের মধ্যেই আবারও মুখ থুবড়ে পড়ল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। বাংলা কংগ্রেসের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদে, বিপিটিউসি সহ অন্যান্য গণ সংগঠনের ডাকে, পরেরদিন রাজ্য জুড়ে ধর্মঘট পালিত হবে।
ধর্মঘটের সমর্থনে, ১৭'ই মার্চ সকালে বর্ধমানে তখন আদিবাসী ও কৃষকদের লাল ঝাণ্ডার লম্বা মিছিলে হঠাৎ আক্রমণ। শুরু হল ব্যাপক বোমাবাজি। ছত্রভঙ্গ জনতা প্রতিরোধের রুদ্ররূপ দেখে গুণ্ডারা তখন ঐ সাঁইবাড়ি'র আশ্রিত। জনতার সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে নিহত হলেন মলয় সাঁই, প্রণব সাঁই এবং জিতেন রায়। অবশ্যই নিন্দনীয় এবং অনভিপ্রেত। কিন্তু কারা এই মলয় সাঁই, প্রণব সাঁই? রবীন্দ্র-নজরুল-বিবেকানন্দ নাকি? না ধোয়া তুলসী পাতা? না, বরং, কংগ্রেস জমানাতেই পিডি অ্যাক্টে অভিযুক্ত জেল ফেরত দাগী আসামী। তাঁদের জামিনের প্রাক শর্তই তো ছিল বর্ধমান শহরে প্রবেশ নিষিদ্ধতা? তাহলে কেন এবং কার মদতে তাঁরা সেদিন এসেছিলেন বর্ধমান শহরে? কোন পুণ্য কাজটা করতে এসেছিলেন?
তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমবীর অবশ্য সেদিন সন্ধ্যেতেই ছুটে গিয়েছিলেন সাঁইবাড়ি তে। সিপিএম'র 'গণহত্যা'। জব্বর ব্যাপার। তা বেশ, সাঁইবাড়ি, না হয় 'গণহত্যা'। আর ঐ দিনই হুগলির ত্রিবেণীর কেশোরাম রেয়নে শ্রমিক নেতা ননী দেবনাথ সহ পাঁচজনের এনকাউন্টার? টুকরো টুকরো করে ফার্নেসে ছুঁড়ে ফেলা লাশ? রাজ্য জুড়ে আরও ১৫ জন বাম কর্মীদের খুনের জমাট রক্ত? হবে নাকি 'গণহত্যা' নিয়ে একটা ঘণ্টা খানেক স্যার? ২২'শে এপ্রিল, মঙ্গলকোটের গরিব খেতমজুর মীরপাড়াতে গর্ভবতী পুস্পরানি মাঝির উপর সিআরপিএফ'র নির্মম অত্যাচার, তুলসী মাঝির কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলা শিশুর আর্তনাদ, ডাব বাগদী থেকে শুরু করে ৮০ বছরের ইন্দুমতী মাঝির শ্লীলতা হানি, কুয়োয় ফেলা শ্যাম দাসীর চার বছরের সন্তানের নিথর মৃতদেহ। তখনও আঁতুড় ঘরের চৌকাঠ না ডিঙানো কিম্বা দুগ্ধপোষ্য, আজকের 'সততা'র পূজারী ভাইরা, হোক না 'গণহত্যার' একটা হিসেব-নিকেশ।
সাঁইবাড়ি কাণ্ডে, ঐ দিনই, দুপুর সাড়ে বারোটায়, দিলীপ কুমার ভট্টাচার্যর অভিযোগের ভিত্তিতে, বর্ধমান থানায় প্রায় ১৫০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রুজু হয়। ঐ অভিযোগে নাম না থাকলেও, ডিডিআই আসানসোল পরে বিনয় কোঙার নাম যুক্ত করে, মোট ১১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ৭৩'এ রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বর্ধমান আদালত মামলাটি আলিপুরের সাব ডিভিশনাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে স্থানান্তরিত হয়। ৭৭'এ সরকার ফৌজদারি কার্যবিধির ৩২১ ধারা মতে আবেদন করলেও বিচারপতি গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্য মাত্র চারজন অভিযুক্তর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের অনুমতি দেন। পরে পাবলিক প্রসিকিউটার একটি চিঠি এনেক্সচার রূপে জমা দেন তাতে দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য পরিষ্কার লেখেন যে- তিনি প্রত্যক্ষদর্শী নন। তৎকালীন কংগ্রেসের জেলা সম্পাদক নুরুল ইসলামের অভিযোগ পত্রে সাক্ষর করেছেন মাত্র। চার্জশিটের অপর সাক্ষী ইতিকা দত্ত আদালত কে জানান তিনি ঐ সময় শহরেই ছিলেন না। মৃত মলয় সাঁই ও প্রণব সাঁই'র জীবিত ভাই বিজয় সাঁই, ভগ্নী স্বর্ণলতা যশ ও ভগ্নীপতি অমলকান্ত যশও বিচারপতি কে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করলে, বিচারপতি আবেদন মঞ্জুর করে সমস্ত অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস করেন।
প্রতীকী তে কিম্বা পৌত্তলিকতায় আমার কোন বিশ্বাস নেই। তাই স্তালিনের হামাগুড়ি, লেনিনের ডিগবাজি, মার্ক্সের খাবি খাওয়াতেও আমার কিছুই যায় আসে না। ছবি টাঙ্গালেই যেমন পার্টি অফিসে যেমন জ্যোতি বসুর আত্মা ভর করে না, দাঁড়ি রাখলেই যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত আসে না, চে'র টি শার্ট পরলেই যেমন বলিভিয়ার জঙ্গলে বিপ্লব হয় না, হাওয়াই চটি পরে ঘুরলেই যেমন কেউ 'সততার প্রতীক' হয়ে যায় না, ২১শে জুলাই'র মঞ্চে পাগলু নাচিয়ে যেমন 'শহীদ দিবস' পালন হয় না, চোখ বন্ধ করে ট্রাফিক লাইটের নিচে নাচতে শুরু করলে যেমন সেটা ডিস্কো লাইট হয়ে যায় না, ঠিক তেমনই গলার জোরে 'সাঁইবাড়িও 'গণহত্যা' হয় না। গণহত্যার হিসেব-নিকেশ যদি করতেই হয়, তাহলে হোক সেটা, ইতিহাসের পাতা থেকে। যে ইতিহাস আত্মবলিদানের। যে ইতিহাসের পাতা বামপন্থীদেরই রক্তে ভেজা। যেখানে জমাট রক্তের রং লাল। শুধুই লাল...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন