‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবীরের রাগে অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।”-------- জসীমউদ্দিন।
বাংলা ভাষায় একটা শব্দ আছে “ভালো ছেলে।” অত্যন্ত ভারী শব্দ, বিশেষত যখন এই শব্দটা কারো ঘাড়ে চেপে বসে একবার। ভুক্তভোগী, তাই জানি।”ভালো ছেলে” আর পোষা কুকুর এর পার্থক্য করাটাও মাঝে মাঝে সমস্যা হয়। “ভালো ছেলে” মানেই যেন গলায় চেন বাঁধা পোষা কুকুর! খালি মনিবের শিখিয়ে দেওয়া কাজগুলোই করবে আর তারপর পুরস্কার ছুড়ে দেওয়া রুটি।
ভালো ছেলে গালি দেয় না, পড়াশোনা করে, প্রেম-এ পড়ে না।ভালো ছেলে রাজনীতি করে না।
শুরুটা করেছিলেন বিদ্যাসাগর মশায়। সেই যে ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’ দিয়ে শুরু! সে শুরুর আর শেষ নেই। সব বাবা -মা একটি গোপাল খোঁজেন নিজের সন্তানের মধ্যে। শিক্ষক খোঁজেন ইস্কুল এ। আর সমাজ খোঁজে সর্বত্র। অন্যায়ের প্রতিবাদ করো না, তাহলে তুমি ভালো ছেলে।যদি একটু প্রতিবাদ করো, গতানুগতিকতার বাইরে তাহলে শুনতে হবে “উছ্যন্যে গিয়েছে ছোঁড়া!” কারণ ভালো ছেলেরা শিখিয়ে দেওয়া পথেই চলে। তাদের প্রশ্ন করা মানা।
ইডেন হোস্টেল-এ থাকার সময় দেখেছি সমাজের তথাকথিত ভালো ছেলেদের। যারা প্রেসিডেন্সি কলেজ, গোয়েনকা কলেজ-এ পড়াশুনো করে। দেখেছি ইউনিভার্সিটি-র প্রথম হওয়া ছাত্রকে রোজ সকালে বাংলা মদে মুখ ধুতে। দেখেছি শুধু সময় কাটানোর ছলে একে অন্য কে বাপ-বাপান্ত করতে। কারোর বাবা-মা হোস্টেল এ দেখা করতে এলে তাকে আগে প্রায় হাত-জোর করে সবাই কে অনুরোধ করতে হত, “আমার বাবা-মা হোস্টেল এ ঢোকার আর বেরোনোর সময় একটু দয়া করে ঘরের ভেতরে থেকো।” হাঁক পাড়তে হত “এবার বেরিয়ে এস, লাইন ক্লিয়ার।”
একদিন এক অগ্রজ কে প্রশ্ন করেছিলাম, “আচ্ছা আমরা এরকম করি কেন?”
“মানুষ আসলে তো জানোয়ার রে! তাই পাশবিক প্রবৃত্তি আমাদের সবার আছে। ভালো ছেলের লেবেল লাগিয়ে দেওয়ায় আমরা সেটাকে লোকসমাজের সামনে আনতে পারি না। তাই হোস্টেল-এ বসে এসব করি।”
উত্তরটা আজও মনে আছে।
কে যেন বলেছিলেন “life is not black and white, it is composed of different shades of grey”..... কিন্তু বিদ্যাসাগর মশায় থেকে শুরু। জীবনটাকে সাদা-কালো ভাগ করে দেওয়ার একটা চেষ্টা। একদিকে “ভলো ছেলে” গোপাল এর দল , অন্য দিকে রাখল-রা। কিন্তু কেন? ভালো ছেলে কেন রাজনীতি করবে না? ভালো ছেলে কেন প্রেমিকাকে চুমু খেতে পারবে না? ভালো ছেলে কেন ইচ্ছে হলে কোমর দুলিয়ে নাচবে না? কেন এত রুটিন বাঁধা জীবন?
ভালো রিডিং পড়তে পারতুম ছোটবেলা থেকে। সেটা বোধহয় ক্লাস নাইন। এক সহপাঠী কোনো প্রাপ্তবয়স্ক-দের বই নিয়ে ইস্কুল এ হাজির। জনগনের ইচ্ছে, তাই রিডিং পরা শুরু করলাম।উফফ, কি শিহরণ জাগানো কথাবার্তা!...... পরেই চলেছি। বাংলার মাস্টার মশায় বিমানবাবু ক্লাসরুম এ ঢুকে পড়েছেন। কারো হুঁশ নেই। ঘটনা-টা হলো, বকা খেলুম আমি একা। একটাই কারণ। আমি বিমানবাবুর ভাষায় “ভালো ছেলে”!
“তমাল, তুমি না আমাদের গর্ব! তোমায় নিয়ে আমাদের, তোমার বাবা-মা এর কত আশা! আর শেষে তুমি কিনা .....? ছিঃ ছিঃ .... তমাল আমি ভাবতেও পারছি না।”
শালা ক্লাস এর বাকি পঞ্চাশ-টা ছেলে যেন বনের জলে ভেসে এসেছিল! ওদের বাপ-মা বুঝি ওদের কে অনাথ ঘোষণা করে দিয়েছেন! সেদিন যা রাগ আর দুঃখ হযেছিল তা বলে বোঝানোর নয়। নিজের ওপরে ঘেন্না হযেছিল। কারণ আমি “ভালো ছেলে।” সবার থেকে আমায় আলাদা করে রাখার একটা চক্রান্ত। মধ্যবিত্ত বাবার মধ্যবিত্ত মানসিকতার ছেলে তো! তাই সেদিন বিদ্রোহ করে উঠতে পারি নি।
আবার উল্টোটাও হযেছে অনেক সময়েই। “ভালো ছেলে”র তকমা থাকায় অন্যায় করেও রেহাই পাওয়া গেছে।আজ তার জন্যে আত্মশ্লাঘা হয় বৈকি!
The deal was never a fair one.....
আজ ফিরে দেখতে গিয়ে মনে হয় যে এই তকমাটার জন্যে কত কিছু হারাতে হেছে। বন্ধুদের মা-বাবা কে বলতে শুনতাম “তমাল কে দেখে শেখ।” ফলে বন্ধু বিয়োগ! আমি ওই বয়সে কারোর বন্ধু হয়ে উঠতে পারি নি। ভালো ছেলে হয়েই থেকে গেছি।
তাই কলেজ জীবনে আর কোনো সুযোগই ছাড়ার ইচ্ছে হত না। কেউ চেনে না আমায় এই বিরাট কলকাতা শহরে। একটু মন্দ হলে ক্ষতি কি? আমার মত মন্দ হওয়ার টানে মাতাল বেশ কিছু সঙ্গী-সাথিও জুটল। কিন্তু “ভালো ছেলে” হওয়ার পিছুটান যাবে কোথায়? যতই মন্দ হওয়ার চেষ্টা করি, সেই “ভালো ছেলে” জামা টেনে ধরে বলে “সাবধান, সাবধান।” সব কিছুই চেষ্টা করা হলো। কলাবাগান বস্তি থেকে কেনা নিষিদ্ধ মাংস, ড্রাই-ডে র দিনে কিনে আনা ভিস্কি, অথবা ইস্ট বেঙ্গল মাঠে উত্তমকুমার এর বানিয়ে দেওয়া গাঁজার ছিলিম! কিন্তু ওই “ভালো ছেলে” রাস্তা আগলে দাড়ালো। অগত্যা .............
কলেজ জীবন -টা কেটেছে অদ্ভূত এক দো-টানা র মধ্যে। ছোট্ট শহর দুর্গাপুর এ বয়োজ্যস্ট মানেই অভিভাবক .... আর সেখান থেকে না জানা শহর কলকাতায় এসে “গোপাল” এর কাছে “রাখাল” হওয়ার হাতছানি ...... ইস্কুল জীবনে মেয়েদের পাশাপাশি দাঁড়ানোর সংকোচ আর কলেজ জীবনে তাদেরই পাশে বসে উষ্ম ছোঁয়া-য় ক্লাস করার ভালো লাগা .... ক্যান্টিন এর রাজনৈতিক তর্ক, সমাজ বদলের স্বপ্ন।
.... আবার এরই মাঝে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বাসনা। দ্বন্দ-টা ছিল সমাজ বদলের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাফল্যের মেল-বন্ধন ঘটানোর। আজ হাসি পায়। বুঝতে পারি লক্ষ্য ছিল একটাই। সমাজের চোখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। বাকি টা ঢপ। ওই যে শিকড় যাবে কোথায়? মধ্যবিত্ত বাবার মধ্যবিত্ত মানসিকতার “ভালো ছেলে” যে!
এরপর বাকি গল্পটা তো খুব সোজা। আর পাঁচটা ভালো ছেলের মত। বাবা-মা এর প্রতি দায়ীত্ব, সংসারের প্রতি দায়ীত্ব, সন্তানের প্রতি দায়ীত্ব। যখন সখ ছিল তখন সঙ্গতি ছিল না। আর যখন সঙ্গতি হলো, তখন শখ আর রইলো না। অন্যের শখ-ই আমার শখ, অন্যের ভালো লাগায় আমার ভালো লাগা। বিদ্যাসাগর মশায় কি শুনতে পারছেন? আমি সেই “ভালো ছেলে”, খালি বাবা নামটাই গোপাল রাখেন নি।আমি কিন্তু আপনার গোপাল-এর আদর্শ উদাহরণ!
হুমায়ুন আহমেদ এর কবিতা-টা তাই বারবার মনে হয় ........ ঠিক যেন গোপালের রাখাল না হ’তে পারার আফসোস।
…........ আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন