চার – মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দরবেশে এসেছ
১৯১৪ সালে লণ্ডনের সেন্ট মার্টিন'স্ স্ট্রীটের ম্যাকমিলান অ্যাণ্ড কোম্পানী প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির (হ্যাঁ, এটাই মূল নাম, নীচে ব্র্যাকেটে সং অফারিংস) এক কপি থেকে এই তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে –
১। বইটির কিছু সীমিত সংস্করণ ১৯১২ সালে 'ইস্যু' করেছিল ইণ্ডিয়া সোসাইটি।
২। বইটির প্রথম মুদ্রণ হয় ম্যাকমলান অ্যাণ্ড কোম্পানী দ্বারাই, ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে।
৩। ১৯১৩ সালেই বইটির পুনর্মুদ্রণের প্রয়োজন হয় – চমকে যাবেন না – একবার দুবার নয়, আরো তেরো বার। এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই (দুবার), সেপ্টেম্বর, অক্টোবর (তিনবার), নভেম্বর (দুবার) ও ডিসেম্বরে (দুবার)।
৪। পুনর্মুদ্রণের এই ধারা চলতে থাকে পরের বছরেও। জানুয়ারি (দুবার), ফেব্রুয়ারি, এপ্রিল (দুবার) ও জুন মাসে। এর পরে কী ফ্রিকোয়েন্সিতে বইটা ছাপার দরকার হয়েছিল, সে তথ্য আমার কাছে আর নেই। তার দরকারও নেই।
৫। বইটাকে বলা হয়েছে মূল বাংলা থেকে লেখকদ্বারা কৃত গদ্য-অনুবাদের সংকলন। তার নীচে লেখা – ডব্লিউ বি ইয়েট্সের ভূমিকা সহ।
৬। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে উইলিয়াম রোদেনস্টাইনকে।
গীতাঞ্জলি ও নোবেল প্রাইজের ব্যাপারে রোদেনস্টাইন ও ইয়েট্সের বেশ অবদান ছিল, সে নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। আমি দু একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে ব্যাপারটা প্রাঞ্জল করার একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা করি।
রোদেনস্টাইনের সঙ্গেই কবির আলাপ হয়েছিল আগে। গীতাঞ্জলি ইংরাজীতে ছাপা হওয়ার আগে রোদেনস্টাইন ইংল্যাণ্ডে ইয়েট্সের কাছে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিয়েছিলেন এই বলে – What the poems are he is. For years I have believed this to be a necessary relation between the artist and the work of art, and have suffered greatly both in my own struggles and because it has been difficult for me to accept much that is admired by many good men. When I first met Rabindranath it was like a personal reward, and the renewal of intimacy has been one of the prizes of my life. Above all, the poems have nothing in them which any man must feel to reject, as is the case with so much of the great mystical poetry of the world, where here and there are stated things which offend that perfect balance of visions which great art must show.
বলা বাহুল্য ইয়েট্স্ এই পরিচয় পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কবিতার বিষয়ে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথের ইংরাজী কবিতার পাণ্ডুলিপি তার হাতে আসা মাত্র তিনি সেটা নিয়েই মজে ছিলেন অনেক দিন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ইয়েট্স্ রবীন্দ্রনাথকে অনুপ্রেরণা দেন আরও কবিতা অনুবাদ করার জন্যে। ইয়েট্স নিজে খুবই জনপ্রিয় কবি, রোদেনস্টাইনের সুবাদে তার সাথে আলাপ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যাণ্ডে তাঁর পরিচিতির গণ্ডি অনেক বাড়িয়ে নিতে পারলেন।
কিন্তু কে এই রোদেনস্টাইন? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হল কী করে?
আইনস্টাইনের সঙ্গে নামের মিল, চিত্রশিল্পী রোদেনস্টাইন জাতিতে ছিলেন জার্মান ইহুদী। তার সবচেয়ে বড় খ্যাতি বিখ্যাত ব্যক্তিদের পোর্ট্রেট আঁকিয়ে হিসেবে, আর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিনি ছিলেন অফিশিয়াল ওয়ার আর্টিস্ট। 'প্রভাতে বিচ্ছেদ', 'মা ও শিশু', 'সিনাগগে ইহুদী বিলাপ' প্রভৃতি তার অমর সৃষ্টি। পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের ব্র্যাডফোর্ডে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। লণ্ডন ও প্যারিসে চিত্রশিল্প নিয়ে পড়াশুনা করে অচিরেই তার শিল্পী হিসাবে খ্যাতিলাভ হয়। চিত্র ও সাহিত্যজগতের নামীদামি ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন তিনি। এই তালিকায় ছিলেন এইচ জি ওয়েল্স্, ম্যাক্স বীয়রবম, অগস্তাস জন, জোসেফ কনরাডের মত সেলিব্রিটিরা। লণ্ডনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কারফ্যাক্স গ্যালারি, সেখানে সমসাময়িক চিত্রকরদের ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়। পরিস্থিতি এমন হতে থাকে যে তার সান্নিধ্যে আসার ফলেই বেশ কিছু শিল্পীর প্রতিষ্ঠালাভ শুরু হয়, যেমন ওয়াইন্ডহ্যাম লুইস, মার্ক গ্রেটলার, পল ন্যাশ, অগস্ত রডিন। ক্রমে তার উৎসাহ পাশ্চাত্য চিত্রের গণ্ডি অতিক্রম করে প্রাচ্য বিশেষ করে ভারতবর্ষের শিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়।
ফরাসী বংশোদ্ভূত আর্নেস্ট হ্যাভেল ছিলেন একজন চিত্রবোদ্ধা, যিনি ১৮৮৪ সালে ভারতে এসে মাদ্রাজ স্কুল অফ আর্টে সুপারিন্টেডেন্ট ছিলেন দশ বছর। ১৮৯৬ সালে তিনি কলকাতায় গিয়ে গভর্ণমেন্ট আর্ট স্কুলে যোগ দেন একই পদে। সেখানে ইওরোপীয় ও ভারতীয় চিত্রের চর্চা হত। হ্যাভেল বললেন, ভারতে চিত্রকলার শিক্ষা ভারতীয়দের মত করেই হওয়া উচিত। তার মত ছিল প্রাচ্য বিশেষ করে ভারতীয় শিল্পকলার এক নিজস্ব রীতি আছে, তা অত্যন্ত মৌলিক ও সৃজনশীল, বিশ্বের অন্যতম সেরাদের তালিকায় আসার উপযুক্ত। তার পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় চিত্রকলা শিক্ষায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন হল। ঠাকুরবাড়ির দুই যুবক, অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট। ভারতীয় নিজস্ব ঘরানা, বিশেষ করে মোগল ও রাজপুতদের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করল এই শিক্ষাকেন্দ্র। কলকাতায় দশ বছর কাটিয়ে হ্যাভেল ইংল্যাণ্ডে ফিরে গেলেন।
১৯১০ সালের ১৩ই জানুয়ারি লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অফ আর্টের ভারতীয় শাখায় হ্যাভেল ভারতের চিত্র-প্রশাসনের ওপর এক বক্তৃতা দেন। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন রোদেনস্টাইন। ইতিমধ্যে রোদেনস্টাইন ভারতীয় চিত্রকলা সম্বন্ধে অনেক জ্ঞানলাভ করেছেন। সভার চেয়ারম্যান জর্জ বার্ডউড ভারতীয় চিত্রকলায় 'ফাইন আর্টস' বলে কিছু নেই মন্তব্য করায় রোদেনস্টাইন তার শুধু তীব্র প্রতিবাদই করেননি, স্বনামধন্য টাইম্স্ পত্রিকায় ২৮শে ফেব্রুয়ারি একটা চিঠিও ছাপিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, ভারতীয় চিত্রকলা ও তার বিভিন্ন দিক নিয়ে চর্চার প্রয়োজন নিয়ে তিনি একটা সোসাইটি তৈরীর প্রস্তাব জানিয়ে একটা গোটা প্রবন্ধ তিনি ছাপিয়ে দিলেন ঐ ম্যাগাজিনেরই ১১ই জুন সংখ্যায়।
এর ফল হল সুদূরপ্রসারী। মাত্র চারদিনের মধ্যেই তার তত্ত্বাবধানে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে তৈরী হয় ইণ্ডিয়া সোসাইটি। আনন্দ কুমারস্বামী, যিনি জন্মসূত্রে তামিল শ্রীলঙ্কান, কিন্তু প্রাচ্য বিশেষ করে ভারতীয় চিত্র ও শিল্পকলাকে পশ্চিমে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টায় যার অবদান অনস্বীকার্য হলেন এই সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বছর ঘোরার আগেই ভারত, আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে এর সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ১৯৩-এ। এই ইণ্ডিয়া সোসাইটিই প্রথম প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী, ১৯১২ সালে।
ভারতীয় কলা ও স্থাপত্যশৈলী নিজের চোখে দেখার বাসনায় রোদেনস্টাইন ১৯১০ সালের নভেম্বরে ভারতে আসেন। উদ্দেশ্য ধর্মীয় ও চারুকলাসম্পন্ন স্থানগুলো পরিদর্শন করবেন। প্রথমেই গেলেন অজন্তার গুহাচিত্র দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখলেন লেডি ক্রিশ্চিনা হেরিঙ্ঘাম আর নন্দলাল বসু জলরঙে সেই ছবিগুলোর কপি করছে। অজন্তার পরে গেলেন বেনারস। সেখানে গঙ্গার ঘাটের বিভিন্ন দৃশ্য তার এত ভাল লেগে গেল যে আগে থেকে স্থির করে রাখা কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান তিনি বাতিল করে দিলেন। হ্যাভেল তাকে বলেছিলেন ঠাকুর পরিবার আর তাদের বিপুল আর্ট কালেকশনের কথা, তাই ফেরার পথে কলকাতা (আর পারলে দার্জিলিং ও পুরী) হয়ে ফিরবেন, এমনই পরিকল্পনা ছিল। দশাশ্বমেধ ঘাটের বাঙ্ময় চিত্রে মোহিত হয়ে তিনি অবনীন্দ্রনাথকে তার করে বলে দিলেন তিনি কলকাতা যাবেন না, অবন যেন তার ছাত্রদের নিয়ে বেনারসে তার সঙ্গে দেখা করেন। ১৬ই ডিসেম্বর অবন ঠাকুর রোদেনস্টাইনকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন, তার পক্ষে বেনারস যাওয়া তখন কঠিন, তবে রোদেনস্টাইন কলকাতা গেলে তিনি তাকে পুরনো ভারতীয় ছবি আর ভারতের স্বকীয় ব্রোঞ্জের স্থাপত্যের নিদর্শন দেখাবেন। ঠাকুর পরিবারের সংগ্রহশালা অতিশয় বিখ্যাত, বহু বিশিষ্ট ইওরোপীয় অতিথিদের নিত্য আনাগোনা সেই বাড়িতে। কলাপিপাসু লেফটেন্যান্ট গভর্ণর কারমাইকেল ঠাকুরবাড়ির বন্ধুবিশেষ। একবার লেফটেন্যান্ট গভর্ণর লর্ড রীডিং ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট এডুইন মন্টেগুকে নিয়ে সে বাড়ি গেলেন, তিনি অবনীন্দ্রনাথের বিখ্যাত 'শাহজাহানের মৃত্যু' ছবিটা এত পছন্দ করলেন, যে ওটা তাকে দিয়ে দেওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। পারিবারিক সম্পত্তি, ওটা কাউকে দিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। মন্টেগুর জন্যে অবনীন্দ্রনাথ সেই ছবিটার কপি করা শুরু করলেন। বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই কোন বিখ্যাত চিত্রকরের ছবি নিজে কপি করার একমাত্র উদাহরণ। অবন ঠাকুরের চিঠি পেয়ে রোদেনস্টাইন কলকাতা চলে এলেন কালক্ষয় না করে। পরে তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, আমি যদি বেনারসের গঙ্গার ঘাটে বসে থাকতাম আরো কিছু দিন, যদি সেখানে আমার আরো কিছু ছবি আঁকার নেশা কাটিয়ে না উঠতে পারতাম আর কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান সত্যিই বাতিল করে দিতাম, রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার এ জন্মে হয়ত দেখা হত না।
না না, রবীন্দ্রনাথকে দেখতে তিনি কলকাতা আসেন নি মোটেও। তখনও রবীন্দ্রনাথের নামও জানতেন না তিনি। কলকাতা এসে উঠলেন হাইকোর্টের জাজ স্যার হ্যারি স্টিফেনের ক্যামাক স্ট্রিটের বাড়িতে, স্যার হ্যারি তখন বেনারসে বেড়াতে গেছেন। সেখান থেকে বেশ কয়েকদিন তিনি ঢুঁ মারলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, আর ওদের কালেকশন দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলেন। কিন্তু আর্ট কালেকশনের চেয়েও তাকে বেশি মোহিত করল অবন-গগনের কাকাকে। রোদেনস্টাইন লিখছেন, আমরা গল্প করতাম, দেখতাম দূরে এক চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতেন এক অত্যন্ত সুপুরুষ মানুষ, পরণে তার শ্বেতশুভ্র ধুতি আর চাদর। আমার ইচ্ছে করত, ঐ দেবকান্তি পুরুষটার একটা পেন্সিল স্কেচ আঁকি। যখন শুনলেন অবন-গগনের কাকা ঐ ভদ্রলোকটি একজন নামকরা কবি, রোদেনস্টাইন ওদের অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার অনুবাদ ওকে জোগাড় করে দিতে। রবীন্দ্রনাথ বাংলায় কবিতা লেখেন, তার অনুবাদ তিনি করেন না। কোথায় মিলবে তবে অনুবাদ? মডার্ণ রিভিউ পত্রিকায় তখন রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে, অনুবাদক স্বয়ং কবি নন। সেগুলো পড়েই রোদেনস্টাইন অভিভূত হয়ে যান। ইংল্যান্ডে তিনি এত নামকরা কবিদের সাথে ওঠাবসা করেন, উইলিয়াম ইয়েট্স্ আর এজরা পাউন্ডও সেই দলে, কই তাদের কবিতা তো এমন প্রাণস্পর্শী নয়! এঁর এক একটা কবিতায় যে গভীর আত্মনিবেদন, তা পাঠ করলে চেতনার যে গভীর তন্ত্রী আন্দোলিত হয়, তা তো হয়না বিখ্যাত সাম্প্রতিক ইংরেজ কবিদের লেখা পড়লে। ইনি তবে শুধু কবি নন, দার্শনিক, এর সাথে আলাপ না করে ফিরে যাওয়ার কোন মানেই হয় না।
পরের কিছু দিন অবন-গগনকে ছেড়ে রোদেনস্টাইন কথা বললেন শুধু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। জানলেন, কবির মন ব্যস্ত রয়েছে এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুতিতে। রোদেনস্টাইন অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রনাথ যেন ইংরাজীতে কিছু কবিতা লেখেন। তিনি তো পড়তে চান বটেই, পড়াতে চান তার দেশের অন্যান্য কবিদের। রবীন্দ্রনাথ এই শুনে অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে গেলেন। ইংরাজীতে কবিতা লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব না!
রোদেনস্টাইন তার জীবনীতে লিখেছেন, ওদের সেই কাকা যে এত বিখ্যাত এক মানুষ, আমাকে কেউ বলেই নি। স্যার হ্যারি স্টিফেন ওঁর এত পরিচিত, কিন্তু বেনারসে কথাপ্রসঙ্গে অবন-গগনের ছবির আলোচনা হলেও উনি তাকে রবীন্দ্রনাথের কথা বলেন নি। কলকাতা থেকে দার্জিলিং বেড়াতে যান রোদেনস্টাইন, সেখানে পর পর অবনীন্দ্রনাথ, কুমারস্বামী ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চিঠি পান তিনি শান্তিনিকেতন পরিদর্শনের আমন্ত্রণ হিসাবে। জীবনীতে স্মরণ করলেন, রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিজের ডেরায় দেখার মত চিত্তাকর্ষক সৌভাগ্য আর কী হতে পারে, কিন্তু আমার হাতে একেবারেই সময় ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে তিনি লিখলেন, খুব ভেবেছিলাম কাল দুপুরের ট্রেন ধরে বোলপুরে যেতে পারব, কিন্তু হল না। পরদিনই তাকে বোম্বে গিয়ে দেশে ফেরার জাহাজ ধরতে হয়।
এই বন্ধুত্ব রয়ে গেল আজীবন। ইংল্যাণ্ডে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ রোদেনস্টাইনের সাহচর্যে ছিলেন তো বটেই, সেখান থেকে আমেরিকা গিয়ে নিউ ইয়র্কে পদার্পণ করেই বন্ধুকে চিঠি লিখে জানালেন জাহাজে যাত্রাপথের বিবরণ। সেই যাত্রার প্রথমার্ধ ছিল বেশ দুঃসহ। চিঠিটা শেষ হল এইভাবে – Each time I come to a city like New York or London I discover afresh that in my veins courses the blood of my ancestors who were forest dwellers. The thick solitude of the crowd is oppressive to me. In London your friendship was the only refuge I had, and I clang to you with all my heart. If I had not known you I should have gone back to India not knowing Europe. It fills me with wonder when I think how by merest chance I came to know you and in what a short time your friendship has become a part of my life.
গীতাঞ্জলির ইংরাজী অনুবাদ বেশ কিছু হয়েছিল ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে, জাহাজে। ১৯১২ সালের ২৭শে মে বোম্বে থেকে তিনি জাহাজে ওঠেন। ইংল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেক আগেই, কিন্তু অসুস্থতার জন্যে সেই যাত্রা স্থগিত ছিল এতদিন। শিলাইদহে মাসাধিককাল কাটিয়ে শরীর সুস্থ হলে যাত্রা শুরু হল। এবার যাত্রার সঙ্গী ছিল পুত্র রথীন্দ্রনাথ আর তার স্ত্রী প্রতিমা। প্রতিমা ঠাকুরবাড়িরই মেয়ে, অবন-গগনের বোন বিনয়িনীর কন্যা, রথীর চেয়ে বছর চারেকের ছোট সে। নীলনাথ মুখোপাধ্যায় নামে একজনের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু অচিরেই নীলনাথের মৃত্যু হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আদর্শ মেনে ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বিধবা-বিবাহের দৃষ্টান্ত রাখলেন নিজের ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়ে। এর আগে রথী আমেরিকার ইলিনয় শহরে কৃষিবিদ্যা অধ্যয়ন করতে গেছিলেন, সে সময় ইওরোপেও ছিলেন কিছুদিন। কিন্তু তিনি ইওরোপ সম্বন্ধে খুব বেশী ওয়াকিবহাল ছিলেন না, আর প্রতিমার তো এটাই প্রথম বিদেশ সফর। রথীর নিজের কথামতোই – বাবার সঙ্গী হিসাবে আমরা ছিলাম একেবারে অকম্মার ঢেঁকি। জাহাজযাত্রা শেষ হলে ট্রাভেল এজেন্ট টমাস কুক আমাদের নিয়ে গিয়ে তুলল লন্ডনের ব্লুম্স্বেরী হোটেলে। চেরিং ক্রস স্টেশন থেকে টিউব ট্রেনে যেতে হল সেখানে। সেই প্রথম আমি আর প্রতিমা পাতাল রেল দেখলাম, আর দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। আমার সাথে ছিল বাবার অ্যাটাচি কেসটা, তার মধ্যে গীতাঞ্জলী আর দ্য গার্ডেনার-এর পাণ্ডুলিপি। পরদিন বাবা রোদেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করে সেই পাণ্ডুলিপি তাকে পড়তে দেবেন বলেছিলেন। সেইমত অ্যাটাচি কেসটা হোটেলে আমার কাছে চাইতেই আমি দেখি, যাহ্, কোথায় সেটা? কোথায় হারালাম? টিউব ট্রেনের মধ্যে তো সঙ্গে ছিল, পরিস্কার মনে আছে। দৌড়ে গেলাম স্টেশনে আবার, যদি হারানো লাগেজের মধ্যে সেটা পাওয়া যায়। কী স্বস্তি যে পেলাম, যখন দেখলাম সেখানে কেউ জমা রেখে গেছে আমাদের হারানিধি সেই অ্যাটাচি কেসটা। সেটা যদি হারিয়ে যেত, গীতাঞ্জলী কি বাবা আর প্রকাশ করত কোনদিন? পরবর্তী ঘটনা যে কী হত, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে!
১৯১৩-র এপ্রিলে আমেরিকা থেকে ইংল্যাণ্ডে ফেরার সময়ও রোদেনস্টাইনকে একই ধরণের চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ। পয়লা এপ্রিলে শিকাগো থেকে লেখা সেই চিঠিতে কবি জানাচ্ছেন, অলিম্পিক নামে তাঁর জাহাজ নিউ ইয়র্ক থেকে ছাড়বে ১২ই এপ্রিল। I can not tell you how glad I feel to be once again near you, for which I always had a longing since I came to this country. এই সেই চিঠি যেখানে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন – Somehow I have an impression that America has a great mission in the history of western civilization; for it is rich enough not to concern itself in the greedy exploitation of weaker nations. Its hands are free and perhaps it will hold up the torch of freedom before the world. কিন্তু এসব এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
১৯১২ সালের সেপ্টেম্বরে ইয়েট্স্ গীতাঞ্জলির মুখবন্ধ লিখে দেন। পাশ্চাত্য পাঠক-পাঠিকাদের কাছে রবীন্দ্রনাথকে চিনিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল, কেননা ততদিন পর্যন্ত তিনি যা লিখেছেন সবই প্রায় বাংলায়। একজন অনামী লেখকের ইংরাজী পড়বেই বা কে? কিন্তু এই চিনিয়ে দেওয়াটা ইয়েট্স্ যেভাবে করেছিলেন, তার নজির মেলা ভার। তাঁর সেই লেখায় ফুটে উঠেছিল স্বতস্ফূর্ততা, শ্রদ্ধা, ভক্তিমিশ্রিত বিস্ময়। তিন পরিচ্ছেদে সেই বড়সড় লেখাটির কিছু কিছু অংশ এখানে না দিলেই নয় – ... these prose translations from Rabindra Nath Tagore have stirred my blood as nothing has for years… I have carried the manuscript of these translations about with me for days, reading it in railway trains, or on the top of omnibuses and in restaurants, and I have often had to close it lest some stranger would see how much it moved me. These lyrics - which are in the original, my Indians tell me, full of subtlety of rhythm, of untranslatable delicacies of colour, of metrical invention, display in their thought a world I have dreamed of all my life long. The work of a supreme culture, they yet appear as much the growth of the common soil as the grass and the rushes… An innocence, a simplicity that one does not find elsewhere in literature makes the birds and the leaves seem as near to him as they are near to children, and the changes of the seasons great events as before our thoughts had arisen between them and us. At times I wonder if he has it from the literature of Bengal or from religion, and at other times, remembering the birds alighting on his brother's hands, I find pleasure in thinking it hereditary, a mystery that was growing through the centuries like the courtesy of a Tristan or a Pelanore.
আশ্চর্য নয়, যে দিকে দিকে এই বার্তা রটে যাবে যে ইয়েট্স্-ই রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদ করে দিয়েছেন, এবং মূলতঃ ইয়েট্সের জন্যেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বেশ ক্ষুব্ধ, অপমানিত ও বিরক্ত হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রোদেনস্টাইনকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন – It will amuse you to learn that at a semi-public conference of the Mohammedan leader of Bengal Valentine Chirol gave his audience to understand that the English Gitanjali was practically written by Yeats. Naturally such rumours get easy credence among our people who can believe in all kinds of miracles except genuine worth in their own men. It is annoyingly insulting for me to be constantly suspected of ebing capable of enjoying a reputation by fraud and it makes me wish that the chance had never been given to me to come out of the quiet corner of my obscurity. সেটা ছিল এক দীর্ঘ চিঠি। তার এক অন্য অংশে ঠাট্টা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – ... your language is not easy for me to use. I know I am apt to make a mess of your prepositions and in my blissful ignorance I go on dropping your articles… I do not know set phrases which greatly economise trouble in sentence-making and very often I do not know how to write simple matter-of-fact things in English. No wonder people can hardly believe that I had any hand in translating the poems of Gitanjali.
বস্তুতপক্ষে, ইয়েট্সের কাজ ছিল মূলত এটাই, preposition, article ইত্যাদির বা কিছু syntax গড়বড় সংশোধন করা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত লেখার ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন। এক একটা কবিতার বহু লাইন কতবার যে কেটে আবার লিখতেন, তার ইয়ত্তা নেই। এডওয়ার্ড জন টমসন নামে একজন রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর লেখা ছোট গল্পগুলো একত্রে অনুবাদ করার অনুমতি চান। এই গল্পগুলো পড়ে টমসনের মত ছিল, বিশ্বসাহিত্যে এত মহৎ ছোটগল্প আর লেখা হয়নি। ১৯১৪ সাল থেকে প্রায় আট বছর তাকে পর্যায়ক্রমে উৎসাহিত ও নিরুৎসাহিত করে রবীন্দ্রনাথ এই পরিকল্পনা বাতিল করেন। তাঁর মত ছিল বাংলা ও ইংরাজী দুটো ভাষাতেই সমান পারঙ্গম না হলে তাঁর গল্পের ইংরাজী অনুবাদ সম্ভব নয়। তিনি তাঁর নিজের করা অনুবাদও পছন্দ করেন নি।
নোবেল পাওয়ার প্রায় এক যুগ পরে, ১৯২৫ সালের ২৯শে মার্চ আলাপ আলোচনা নামে এক প্রবন্ধে কবি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর প্রথম ইয়েট্সের সাথে সাক্ষাতের কথা। লিখেছেন – বাংলা গীতাঞ্জলির কবিতা ইংরেজিতে আপন মনেই তর্জমা করেছিলুম। শরীর অসুস্থ ছিল, আরকিছু করবার ছিল না। কোনোদিন এগুলি ছাপা হবে এমন স্পর্ধার কথা স্বপ্নেও ভাবি নি। তার কারণ, প্রকাশযোগ্য ইংরেজি লেখবার শক্তি আমার নেই – এই ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল ছিল। খাতাখানা যখন কবি য়েট্সের হাতে পড়ল তিনি একদিন রোদেন্স্টাইনের বাড়িতে অনেকগুলি ইংরেজ সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসজ্ঞকে তার থেকে কিছু আবৃত্তি করে শোনাবেন ব'লে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি মনের মধ্যে ভারি সংকুচিত হলেম। তার দুটি কারণ ছিল। নিতান্ত সাদাসিধে দশ-বারো লাইনের কবিতা শুনিয়ে, কোনোদিন আমি কোনো বাঙালি শ্রোতাকে যথেষ্ট তৃপ্তি পেতে দেখি নি। এমন-কি, অনেকেই আয়তনের খর্বতাকে কবিত্বের রিক্ততা ব'লেই স্থির করেন। একদিন আমার পাঠকেরা দুঃখ করে বলেছিলেন ইদানীং আমি কেবল গানই লিখছি। বলেছিলেন – আমার কাব্যকলায় কৃষ্ণপক্ষের আবির্ভাব, রচনা তাই ক্ষয়ে ক্ষয়ে বচনের দিকে ছোটো হয়েই আসছে। তার পরে আমার ইংরেজি তর্জমাও আমি সসংকোচে কোনো-কোনো ইংরেজি-জানা বাঙালি সাহিত্যিককে শুনিয়েছিলেম। তাঁরা ধীর গম্ভীর শান্ত ভাবে বলেছিলেন – মন্দ হয় নি, আর ইংরেজি যে অবিশুদ্ধ তাও নয়। সে সময়ে এন্ড্রুজের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। য়েট্স্ সেদিনকার সভায় পাঁচ-সাতটি মাত্র কবিতা একটির পর আর-একটি শুনিয়ে পড়া শেষ করলেন। ইংরেজ শ্রোতারা নীরবে শুনলেন, নীরবে চলে গেলেন – দস্তুর-পালনের উপযুক্ত ধন্যবাদ পর্যন্ত আমাকে দিলেন না। সে রাত্রে নিতান্ত লজ্জিত হয়েই বাসায় ফিরে গেলেম। পরের দিন চিঠি আসতে লাগল। দেশান্তরে যে খ্যাতি লাভ করেছি তার অভাবনীয়তার বিস্ময় সেই দিনই সম্পূর্ণভাবে আমাকে অভিভূত করেছে।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই তিনি কবি ইয়েট্সের ওপরে এক প্রবন্ধও লিখেছেন। ইয়েট্সের সমকালীন অন্যান্য ইংরেজ কবিদের অধিকাংশের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিল এই রকম – ইংলণ্ডের বর্তমানকালের কবিদের কাব্য যখন পড়িয়া দেখি তখন ইঁহাদের অনেককেই আমার মনে হয়, ইঁহারা বিশ্বজগতের কবি নহেন। ইঁহারা সাহিত্যজগতের কবি। এ দেশে অনেক দিন হইতে কাব্য সাহিত্যে সৃষ্টি চলিতেছে, হইতে হইতে কাব্যের ভাষা উপমা অলংকার ভঙ্গী বিস্তর জমিয়া উঠিয়াছে। শেষকালে এমন হইয়া উঠিয়াছে যে কবিত্বের জন্য কাব্যের মূল প্রস্রবণে মানুষের না গেলেও চলে। কবিরা যেন ওস্তাদ হইয়া উঠিয়াছে; অর্থাৎ, প্রাণ হইতে গান করিবার প্রয়োজনবোধই তাহাদের চলিয়া গিয়াছে, এখন কেবল গান হইতেই গানের উৎপত্তি চলিতেছে।
অথচ ইয়েট্সের ব্যাপারে তাঁর মূল্যায়ন একেবারে অন্যরকম – ভিড়ের মাঝখানেও কবি য়েট্স চাপা পড়েন না, তাঁহাকে একজন বিশেষ কেহ বলিয়া চেনা যায়। যেমন তিনি তাঁহার দীর্ঘ শরীর লইয়া মাথায় প্রায় সকলকে ছাড়াইয়া গিয়াছেন, তেমনি তাঁহাকে দেখিলে মনে হয়, ইঁহার যেন সকল বিষয়ে একটা প্রাচুর্য আছে, এক জায়গায় সৃষ্টিকর্তার সৃজনশক্তির বেগ প্রবল হইয়া ইঁহাকে যেন ফোয়ারার মতো চারি দিকের সমতলতা হইতে বিপুলভাবে উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলিয়াছে। সেইজন্য দেহে মনে প্রাণে ইঁহাকে এমন অজস্র বলিয়া বোধ হয়।
সেই লেখার শেষ প্যারাগ্রাফে লিখলেন - এই imaginative conviction কথাটা য়েট্স্ সম্বন্ধে অত্যন্ত সত্য। কল্পনা তাঁহার পক্ষে কেবল লীলার সামগ্রী নহে, কল্পনার আলোকে তিনি যাহা দেখিয়াছেন তাহার সত্যতাকে তিনি জীবনে গ্রহণ করিতে পারিয়াছেন। অর্থাৎ, তাঁহার হাতে কল্পনা-জিনিসটি কেবলমাত্র কবিত্বব্যবসায়ের একটা হাতিয়ার নহে, তাহা তাঁহার জীবনের সামগ্রী; ইহার দ্বারাই বিশ্বজগৎ হইতে তিনি তাঁহার আত্মার খাদ্যপানীয় আহরণ করিতেছেন। তাঁহার সঙ্গে নিভৃতে যতবার আবার আলাপ হইয়াছে ততবার এই কথাই আমি অনুভব করিয়াছি। তিনি যে কবি, তাহা তাঁহার কবিতা পড়িয়া জানিবার সুযোগ এখনো আমার সম্পূর্ণরূপে ঘটে নাই, কিন্তু তিনি যে কল্পনালোকিত হৃদয়ের দ্বারা তাঁহার চতুর্দিককে প্রাণবানরূপে স্পর্শ করিতেছেন তাহা তাঁহার কাছে আসিয়াই আমি অনুভব করিতে পারিতেছি।
এমন ব্যক্তি, যিনি তাঁর বন্ধুত্বকে অকুণ্ঠ সম্মান দিতেন, নিজের ক্ষমতা ও বিশেষ করে অক্ষমতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ ছিলেন, নিজের বক্তব্য ত্রুটিহীন ও পরিপাটিভাবে উপস্থাপনায় যার জুড়ি মেলা ছিল ভার, তিনি অন্যের অনুবাদ নিজের বলে চালাতেই পারেন না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পরে অনেকেই অনুবাদ করেছেন – বেশ নামী দামী পণ্ডিত তারাও – তবু মনে হয়না সেগুলো ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের নিজের করা অনুবাদের মত সুচারু হয়নি?
একথা ঠিক যে, ইংরাজীতে লেখা তাঁর কিছু চিঠিপত্রে প্রিপোজিশন বা আর্টিক্ল্-এর কিছু গোলমাল ছিল। কিন্তু সেগুলো তো চিঠি, সাহিত্য করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সেগুলো লেখা তো নয়। রবীন্দ্রনাথের ইংরাজী জ্ঞান নিয়ে সংশয়ের বিশেষ অবকাশ নেই। ইংরাজীতে লেখা তাঁর প্রবন্ধ বা বক্তৃতাগুলি এক একটি সাহিত্যসম্পদ। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর যে চিঠি ভাইসরয়কে পাঠিয়ে তিনি নাইট উপাধি পরিত্যাগ করেছিলেন, ইংরাজী ভাষায় লেখা সেই রকম প্রতিবাদপত্র খুব কমই লেখা হয়েছে। সেই সব লেখা কেউ এডিট করে দিয়েছিলেন, এ রকম খবর কেউ পায়নি।
কিন্তু না, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার পিছনে ইয়েটসের অন্য প্রত্যক্ষ অবদান নেই। যদি কেউ ভেবে থাকেন, ইয়েট্স্ই রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেছিলেন এই পুরস্কারের জন্য, সেটা একেবারে ভুল। কেননা সেরকম অধিকারই তার ছিল না। বস্তুত ইয়েট্স্ নিজেই ছিলেন ওই পুরস্কারের একজন দাবিদার। নোবেল প্রদানের দ্বিতীয় বছরেই, অর্থাৎ ১৯০২ সালেই তার নাম এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলে, কিন্তু তিনি সেবার এটা পাননি। এর পরে তার নামের মনোনয়ন ঘটে অনেক বছর পরে - ১৯১৪, ১৯১৫, ১৯১৮, ১৯২১ এবং ১৯২২ সালে। এর মধ্যে শেষবার নোবেল কমিটি নিজেই সেই মনোনয়ন করেছিল, কিন্তু প্রতিবারই হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৯২৩-এ অবশেষে সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে।
তবুও এটা বলা অমূলক নয় যে রোদেনস্টাইন ও ইয়েট্সের পীড়াপীড়িতেই গীতাঞ্জলির অনেকগুলো কবিতার ইংরাজী অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পরিচিত হয়েছিলেন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী মানুষের সঙ্গে। কিন্তু নোবেল পুরস্কারের জন্যে শুধু সাহিত্য সৃষ্টি করলেই তো হয় না। লাগে মনোনয়ন, নোবেল কমিটির লিস্টিতে নাম ওঠানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে সেই নামকে টিঁকিয়ে রাখা, আর শেষ পর্যায়ে অন্যদের চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে বাজিমাত করা। এ ব্যাপারে টিভিতে দেখা বিউটি কন্টেস্টের সঙ্গে এর বিশেষ পার্থক্য নেই।
শুধু এই দুজন নয়, রবীন্দ্রনাথের রচনার ইংরাজী অনুবাদের পিছনে আরও অনেকের পরোক্ষ অবদান ছিল। আনন্দ কুমারস্বামীর কথা বলেছি, আর একজন ছিলেন চার্ল্স্ ফ্রিয়ার অ্যানড্রুজ, যিনি পরে দীনবন্ধু নাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ভারতসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ছিলেন সুকুমার রায়, যার কথা বলেছি আগে। ছিলেন কবিবন্ধু বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে সমর্পিত প্রাণ ভগিনী নিবেদিতা। কিন্তু এদের নাম তো আপনারা জানেন, কবির রচনার প্রথম ইংরাজী অনুবাদ সম্ভবত এক অনামা দেশপ্রেমীর, যিনি অনুবাদ করেছিলেন তাঁর 'সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে' কবিতাটি।
আলিপুর বোমার মামলায় তখন ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে ব্রিটিশ সরকার। অরবিন্দ ঘোষ সেই মামলার আসামী। এ নিয়ে যে কোন লেখালিখি প্রকাশ হলেই ধরে জেলে চালান দেওয়া হচ্ছে। বালগঙ্গাধর তিলকের মত নামী মানুষ এ নিয়ে মাত্র দুটো প্রবন্ধ তার কেশরী পত্রিকায় ছাপানোর অপরাধে বর্মার মান্দালয় জেলে চালান হয়ে গেলেন ছ'বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে। সেই সময় বিপ্লবীদের দেশপ্রেমের শিখা জাজ্বল্যমান রাখার অভিপ্রায়ে এই কবিতাটির অনুবাদ হয়েছিল এই রকম –
'Blessed is my birth – for I was born in this land,
Blessed is my birth – for I have loved thee.
I don't know in what garden
Flowers enrapture so much with perfume;
In what sky rises the moon, smiling such a smile.
Oh mother, opening my eyes, seeing thy light
My eyes are regaled;
Keeping my eyes on that light
I shall close my eyes in the end.'
কোনো পত্রিকার এক সাংবাদিক এই অনুবাদটি করেছিলেন, কিন্তু তার নাম কেউ জানে না।
(ক্রমশ)
১৯১৪ সালে লণ্ডনের সেন্ট মার্টিন'স্ স্ট্রীটের ম্যাকমিলান অ্যাণ্ড কোম্পানী প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির (হ্যাঁ, এটাই মূল নাম, নীচে ব্র্যাকেটে সং অফারিংস) এক কপি থেকে এই তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে –
১। বইটির কিছু সীমিত সংস্করণ ১৯১২ সালে 'ইস্যু' করেছিল ইণ্ডিয়া সোসাইটি।
২। বইটির প্রথম মুদ্রণ হয় ম্যাকমলান অ্যাণ্ড কোম্পানী দ্বারাই, ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে।
৩। ১৯১৩ সালেই বইটির পুনর্মুদ্রণের প্রয়োজন হয় – চমকে যাবেন না – একবার দুবার নয়, আরো তেরো বার। এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই (দুবার), সেপ্টেম্বর, অক্টোবর (তিনবার), নভেম্বর (দুবার) ও ডিসেম্বরে (দুবার)।
৪। পুনর্মুদ্রণের এই ধারা চলতে থাকে পরের বছরেও। জানুয়ারি (দুবার), ফেব্রুয়ারি, এপ্রিল (দুবার) ও জুন মাসে। এর পরে কী ফ্রিকোয়েন্সিতে বইটা ছাপার দরকার হয়েছিল, সে তথ্য আমার কাছে আর নেই। তার দরকারও নেই।
৫। বইটাকে বলা হয়েছে মূল বাংলা থেকে লেখকদ্বারা কৃত গদ্য-অনুবাদের সংকলন। তার নীচে লেখা – ডব্লিউ বি ইয়েট্সের ভূমিকা সহ।
৬। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে উইলিয়াম রোদেনস্টাইনকে।
গীতাঞ্জলি ও নোবেল প্রাইজের ব্যাপারে রোদেনস্টাইন ও ইয়েট্সের বেশ অবদান ছিল, সে নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। আমি দু একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে ব্যাপারটা প্রাঞ্জল করার একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা করি।
রোদেনস্টাইনের সঙ্গেই কবির আলাপ হয়েছিল আগে। গীতাঞ্জলি ইংরাজীতে ছাপা হওয়ার আগে রোদেনস্টাইন ইংল্যাণ্ডে ইয়েট্সের কাছে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিয়েছিলেন এই বলে – What the poems are he is. For years I have believed this to be a necessary relation between the artist and the work of art, and have suffered greatly both in my own struggles and because it has been difficult for me to accept much that is admired by many good men. When I first met Rabindranath it was like a personal reward, and the renewal of intimacy has been one of the prizes of my life. Above all, the poems have nothing in them which any man must feel to reject, as is the case with so much of the great mystical poetry of the world, where here and there are stated things which offend that perfect balance of visions which great art must show.
বলা বাহুল্য ইয়েট্স্ এই পরিচয় পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কবিতার বিষয়ে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথের ইংরাজী কবিতার পাণ্ডুলিপি তার হাতে আসা মাত্র তিনি সেটা নিয়েই মজে ছিলেন অনেক দিন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ইয়েট্স্ রবীন্দ্রনাথকে অনুপ্রেরণা দেন আরও কবিতা অনুবাদ করার জন্যে। ইয়েট্স নিজে খুবই জনপ্রিয় কবি, রোদেনস্টাইনের সুবাদে তার সাথে আলাপ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যাণ্ডে তাঁর পরিচিতির গণ্ডি অনেক বাড়িয়ে নিতে পারলেন।
কিন্তু কে এই রোদেনস্টাইন? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হল কী করে?
আইনস্টাইনের সঙ্গে নামের মিল, চিত্রশিল্পী রোদেনস্টাইন জাতিতে ছিলেন জার্মান ইহুদী। তার সবচেয়ে বড় খ্যাতি বিখ্যাত ব্যক্তিদের পোর্ট্রেট আঁকিয়ে হিসেবে, আর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিনি ছিলেন অফিশিয়াল ওয়ার আর্টিস্ট। 'প্রভাতে বিচ্ছেদ', 'মা ও শিশু', 'সিনাগগে ইহুদী বিলাপ' প্রভৃতি তার অমর সৃষ্টি। পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের ব্র্যাডফোর্ডে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। লণ্ডন ও প্যারিসে চিত্রশিল্প নিয়ে পড়াশুনা করে অচিরেই তার শিল্পী হিসাবে খ্যাতিলাভ হয়। চিত্র ও সাহিত্যজগতের নামীদামি ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন তিনি। এই তালিকায় ছিলেন এইচ জি ওয়েল্স্, ম্যাক্স বীয়রবম, অগস্তাস জন, জোসেফ কনরাডের মত সেলিব্রিটিরা। লণ্ডনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কারফ্যাক্স গ্যালারি, সেখানে সমসাময়িক চিত্রকরদের ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়। পরিস্থিতি এমন হতে থাকে যে তার সান্নিধ্যে আসার ফলেই বেশ কিছু শিল্পীর প্রতিষ্ঠালাভ শুরু হয়, যেমন ওয়াইন্ডহ্যাম লুইস, মার্ক গ্রেটলার, পল ন্যাশ, অগস্ত রডিন। ক্রমে তার উৎসাহ পাশ্চাত্য চিত্রের গণ্ডি অতিক্রম করে প্রাচ্য বিশেষ করে ভারতবর্ষের শিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়।
ফরাসী বংশোদ্ভূত আর্নেস্ট হ্যাভেল ছিলেন একজন চিত্রবোদ্ধা, যিনি ১৮৮৪ সালে ভারতে এসে মাদ্রাজ স্কুল অফ আর্টে সুপারিন্টেডেন্ট ছিলেন দশ বছর। ১৮৯৬ সালে তিনি কলকাতায় গিয়ে গভর্ণমেন্ট আর্ট স্কুলে যোগ দেন একই পদে। সেখানে ইওরোপীয় ও ভারতীয় চিত্রের চর্চা হত। হ্যাভেল বললেন, ভারতে চিত্রকলার শিক্ষা ভারতীয়দের মত করেই হওয়া উচিত। তার মত ছিল প্রাচ্য বিশেষ করে ভারতীয় শিল্পকলার এক নিজস্ব রীতি আছে, তা অত্যন্ত মৌলিক ও সৃজনশীল, বিশ্বের অন্যতম সেরাদের তালিকায় আসার উপযুক্ত। তার পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় চিত্রকলা শিক্ষায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন হল। ঠাকুরবাড়ির দুই যুবক, অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট। ভারতীয় নিজস্ব ঘরানা, বিশেষ করে মোগল ও রাজপুতদের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করল এই শিক্ষাকেন্দ্র। কলকাতায় দশ বছর কাটিয়ে হ্যাভেল ইংল্যাণ্ডে ফিরে গেলেন।
১৯১০ সালের ১৩ই জানুয়ারি লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অফ আর্টের ভারতীয় শাখায় হ্যাভেল ভারতের চিত্র-প্রশাসনের ওপর এক বক্তৃতা দেন। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন রোদেনস্টাইন। ইতিমধ্যে রোদেনস্টাইন ভারতীয় চিত্রকলা সম্বন্ধে অনেক জ্ঞানলাভ করেছেন। সভার চেয়ারম্যান জর্জ বার্ডউড ভারতীয় চিত্রকলায় 'ফাইন আর্টস' বলে কিছু নেই মন্তব্য করায় রোদেনস্টাইন তার শুধু তীব্র প্রতিবাদই করেননি, স্বনামধন্য টাইম্স্ পত্রিকায় ২৮শে ফেব্রুয়ারি একটা চিঠিও ছাপিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, ভারতীয় চিত্রকলা ও তার বিভিন্ন দিক নিয়ে চর্চার প্রয়োজন নিয়ে তিনি একটা সোসাইটি তৈরীর প্রস্তাব জানিয়ে একটা গোটা প্রবন্ধ তিনি ছাপিয়ে দিলেন ঐ ম্যাগাজিনেরই ১১ই জুন সংখ্যায়।
এর ফল হল সুদূরপ্রসারী। মাত্র চারদিনের মধ্যেই তার তত্ত্বাবধানে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে তৈরী হয় ইণ্ডিয়া সোসাইটি। আনন্দ কুমারস্বামী, যিনি জন্মসূত্রে তামিল শ্রীলঙ্কান, কিন্তু প্রাচ্য বিশেষ করে ভারতীয় চিত্র ও শিল্পকলাকে পশ্চিমে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টায় যার অবদান অনস্বীকার্য হলেন এই সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বছর ঘোরার আগেই ভারত, আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে এর সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ১৯৩-এ। এই ইণ্ডিয়া সোসাইটিই প্রথম প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী, ১৯১২ সালে।
ভারতীয় কলা ও স্থাপত্যশৈলী নিজের চোখে দেখার বাসনায় রোদেনস্টাইন ১৯১০ সালের নভেম্বরে ভারতে আসেন। উদ্দেশ্য ধর্মীয় ও চারুকলাসম্পন্ন স্থানগুলো পরিদর্শন করবেন। প্রথমেই গেলেন অজন্তার গুহাচিত্র দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখলেন লেডি ক্রিশ্চিনা হেরিঙ্ঘাম আর নন্দলাল বসু জলরঙে সেই ছবিগুলোর কপি করছে। অজন্তার পরে গেলেন বেনারস। সেখানে গঙ্গার ঘাটের বিভিন্ন দৃশ্য তার এত ভাল লেগে গেল যে আগে থেকে স্থির করে রাখা কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান তিনি বাতিল করে দিলেন। হ্যাভেল তাকে বলেছিলেন ঠাকুর পরিবার আর তাদের বিপুল আর্ট কালেকশনের কথা, তাই ফেরার পথে কলকাতা (আর পারলে দার্জিলিং ও পুরী) হয়ে ফিরবেন, এমনই পরিকল্পনা ছিল। দশাশ্বমেধ ঘাটের বাঙ্ময় চিত্রে মোহিত হয়ে তিনি অবনীন্দ্রনাথকে তার করে বলে দিলেন তিনি কলকাতা যাবেন না, অবন যেন তার ছাত্রদের নিয়ে বেনারসে তার সঙ্গে দেখা করেন। ১৬ই ডিসেম্বর অবন ঠাকুর রোদেনস্টাইনকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন, তার পক্ষে বেনারস যাওয়া তখন কঠিন, তবে রোদেনস্টাইন কলকাতা গেলে তিনি তাকে পুরনো ভারতীয় ছবি আর ভারতের স্বকীয় ব্রোঞ্জের স্থাপত্যের নিদর্শন দেখাবেন। ঠাকুর পরিবারের সংগ্রহশালা অতিশয় বিখ্যাত, বহু বিশিষ্ট ইওরোপীয় অতিথিদের নিত্য আনাগোনা সেই বাড়িতে। কলাপিপাসু লেফটেন্যান্ট গভর্ণর কারমাইকেল ঠাকুরবাড়ির বন্ধুবিশেষ। একবার লেফটেন্যান্ট গভর্ণর লর্ড রীডিং ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট এডুইন মন্টেগুকে নিয়ে সে বাড়ি গেলেন, তিনি অবনীন্দ্রনাথের বিখ্যাত 'শাহজাহানের মৃত্যু' ছবিটা এত পছন্দ করলেন, যে ওটা তাকে দিয়ে দেওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। পারিবারিক সম্পত্তি, ওটা কাউকে দিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। মন্টেগুর জন্যে অবনীন্দ্রনাথ সেই ছবিটার কপি করা শুরু করলেন। বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই কোন বিখ্যাত চিত্রকরের ছবি নিজে কপি করার একমাত্র উদাহরণ। অবন ঠাকুরের চিঠি পেয়ে রোদেনস্টাইন কলকাতা চলে এলেন কালক্ষয় না করে। পরে তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, আমি যদি বেনারসের গঙ্গার ঘাটে বসে থাকতাম আরো কিছু দিন, যদি সেখানে আমার আরো কিছু ছবি আঁকার নেশা কাটিয়ে না উঠতে পারতাম আর কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান সত্যিই বাতিল করে দিতাম, রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার এ জন্মে হয়ত দেখা হত না।
না না, রবীন্দ্রনাথকে দেখতে তিনি কলকাতা আসেন নি মোটেও। তখনও রবীন্দ্রনাথের নামও জানতেন না তিনি। কলকাতা এসে উঠলেন হাইকোর্টের জাজ স্যার হ্যারি স্টিফেনের ক্যামাক স্ট্রিটের বাড়িতে, স্যার হ্যারি তখন বেনারসে বেড়াতে গেছেন। সেখান থেকে বেশ কয়েকদিন তিনি ঢুঁ মারলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, আর ওদের কালেকশন দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলেন। কিন্তু আর্ট কালেকশনের চেয়েও তাকে বেশি মোহিত করল অবন-গগনের কাকাকে। রোদেনস্টাইন লিখছেন, আমরা গল্প করতাম, দেখতাম দূরে এক চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতেন এক অত্যন্ত সুপুরুষ মানুষ, পরণে তার শ্বেতশুভ্র ধুতি আর চাদর। আমার ইচ্ছে করত, ঐ দেবকান্তি পুরুষটার একটা পেন্সিল স্কেচ আঁকি। যখন শুনলেন অবন-গগনের কাকা ঐ ভদ্রলোকটি একজন নামকরা কবি, রোদেনস্টাইন ওদের অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার অনুবাদ ওকে জোগাড় করে দিতে। রবীন্দ্রনাথ বাংলায় কবিতা লেখেন, তার অনুবাদ তিনি করেন না। কোথায় মিলবে তবে অনুবাদ? মডার্ণ রিভিউ পত্রিকায় তখন রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে, অনুবাদক স্বয়ং কবি নন। সেগুলো পড়েই রোদেনস্টাইন অভিভূত হয়ে যান। ইংল্যান্ডে তিনি এত নামকরা কবিদের সাথে ওঠাবসা করেন, উইলিয়াম ইয়েট্স্ আর এজরা পাউন্ডও সেই দলে, কই তাদের কবিতা তো এমন প্রাণস্পর্শী নয়! এঁর এক একটা কবিতায় যে গভীর আত্মনিবেদন, তা পাঠ করলে চেতনার যে গভীর তন্ত্রী আন্দোলিত হয়, তা তো হয়না বিখ্যাত সাম্প্রতিক ইংরেজ কবিদের লেখা পড়লে। ইনি তবে শুধু কবি নন, দার্শনিক, এর সাথে আলাপ না করে ফিরে যাওয়ার কোন মানেই হয় না।
পরের কিছু দিন অবন-গগনকে ছেড়ে রোদেনস্টাইন কথা বললেন শুধু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। জানলেন, কবির মন ব্যস্ত রয়েছে এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুতিতে। রোদেনস্টাইন অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রনাথ যেন ইংরাজীতে কিছু কবিতা লেখেন। তিনি তো পড়তে চান বটেই, পড়াতে চান তার দেশের অন্যান্য কবিদের। রবীন্দ্রনাথ এই শুনে অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে গেলেন। ইংরাজীতে কবিতা লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব না!
রোদেনস্টাইন তার জীবনীতে লিখেছেন, ওদের সেই কাকা যে এত বিখ্যাত এক মানুষ, আমাকে কেউ বলেই নি। স্যার হ্যারি স্টিফেন ওঁর এত পরিচিত, কিন্তু বেনারসে কথাপ্রসঙ্গে অবন-গগনের ছবির আলোচনা হলেও উনি তাকে রবীন্দ্রনাথের কথা বলেন নি। কলকাতা থেকে দার্জিলিং বেড়াতে যান রোদেনস্টাইন, সেখানে পর পর অবনীন্দ্রনাথ, কুমারস্বামী ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চিঠি পান তিনি শান্তিনিকেতন পরিদর্শনের আমন্ত্রণ হিসাবে। জীবনীতে স্মরণ করলেন, রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিজের ডেরায় দেখার মত চিত্তাকর্ষক সৌভাগ্য আর কী হতে পারে, কিন্তু আমার হাতে একেবারেই সময় ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে তিনি লিখলেন, খুব ভেবেছিলাম কাল দুপুরের ট্রেন ধরে বোলপুরে যেতে পারব, কিন্তু হল না। পরদিনই তাকে বোম্বে গিয়ে দেশে ফেরার জাহাজ ধরতে হয়।
এই বন্ধুত্ব রয়ে গেল আজীবন। ইংল্যাণ্ডে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ রোদেনস্টাইনের সাহচর্যে ছিলেন তো বটেই, সেখান থেকে আমেরিকা গিয়ে নিউ ইয়র্কে পদার্পণ করেই বন্ধুকে চিঠি লিখে জানালেন জাহাজে যাত্রাপথের বিবরণ। সেই যাত্রার প্রথমার্ধ ছিল বেশ দুঃসহ। চিঠিটা শেষ হল এইভাবে – Each time I come to a city like New York or London I discover afresh that in my veins courses the blood of my ancestors who were forest dwellers. The thick solitude of the crowd is oppressive to me. In London your friendship was the only refuge I had, and I clang to you with all my heart. If I had not known you I should have gone back to India not knowing Europe. It fills me with wonder when I think how by merest chance I came to know you and in what a short time your friendship has become a part of my life.
গীতাঞ্জলির ইংরাজী অনুবাদ বেশ কিছু হয়েছিল ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে, জাহাজে। ১৯১২ সালের ২৭শে মে বোম্বে থেকে তিনি জাহাজে ওঠেন। ইংল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেক আগেই, কিন্তু অসুস্থতার জন্যে সেই যাত্রা স্থগিত ছিল এতদিন। শিলাইদহে মাসাধিককাল কাটিয়ে শরীর সুস্থ হলে যাত্রা শুরু হল। এবার যাত্রার সঙ্গী ছিল পুত্র রথীন্দ্রনাথ আর তার স্ত্রী প্রতিমা। প্রতিমা ঠাকুরবাড়িরই মেয়ে, অবন-গগনের বোন বিনয়িনীর কন্যা, রথীর চেয়ে বছর চারেকের ছোট সে। নীলনাথ মুখোপাধ্যায় নামে একজনের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু অচিরেই নীলনাথের মৃত্যু হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আদর্শ মেনে ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বিধবা-বিবাহের দৃষ্টান্ত রাখলেন নিজের ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়ে। এর আগে রথী আমেরিকার ইলিনয় শহরে কৃষিবিদ্যা অধ্যয়ন করতে গেছিলেন, সে সময় ইওরোপেও ছিলেন কিছুদিন। কিন্তু তিনি ইওরোপ সম্বন্ধে খুব বেশী ওয়াকিবহাল ছিলেন না, আর প্রতিমার তো এটাই প্রথম বিদেশ সফর। রথীর নিজের কথামতোই – বাবার সঙ্গী হিসাবে আমরা ছিলাম একেবারে অকম্মার ঢেঁকি। জাহাজযাত্রা শেষ হলে ট্রাভেল এজেন্ট টমাস কুক আমাদের নিয়ে গিয়ে তুলল লন্ডনের ব্লুম্স্বেরী হোটেলে। চেরিং ক্রস স্টেশন থেকে টিউব ট্রেনে যেতে হল সেখানে। সেই প্রথম আমি আর প্রতিমা পাতাল রেল দেখলাম, আর দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। আমার সাথে ছিল বাবার অ্যাটাচি কেসটা, তার মধ্যে গীতাঞ্জলী আর দ্য গার্ডেনার-এর পাণ্ডুলিপি। পরদিন বাবা রোদেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করে সেই পাণ্ডুলিপি তাকে পড়তে দেবেন বলেছিলেন। সেইমত অ্যাটাচি কেসটা হোটেলে আমার কাছে চাইতেই আমি দেখি, যাহ্, কোথায় সেটা? কোথায় হারালাম? টিউব ট্রেনের মধ্যে তো সঙ্গে ছিল, পরিস্কার মনে আছে। দৌড়ে গেলাম স্টেশনে আবার, যদি হারানো লাগেজের মধ্যে সেটা পাওয়া যায়। কী স্বস্তি যে পেলাম, যখন দেখলাম সেখানে কেউ জমা রেখে গেছে আমাদের হারানিধি সেই অ্যাটাচি কেসটা। সেটা যদি হারিয়ে যেত, গীতাঞ্জলী কি বাবা আর প্রকাশ করত কোনদিন? পরবর্তী ঘটনা যে কী হত, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে!
১৯১৩-র এপ্রিলে আমেরিকা থেকে ইংল্যাণ্ডে ফেরার সময়ও রোদেনস্টাইনকে একই ধরণের চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ। পয়লা এপ্রিলে শিকাগো থেকে লেখা সেই চিঠিতে কবি জানাচ্ছেন, অলিম্পিক নামে তাঁর জাহাজ নিউ ইয়র্ক থেকে ছাড়বে ১২ই এপ্রিল। I can not tell you how glad I feel to be once again near you, for which I always had a longing since I came to this country. এই সেই চিঠি যেখানে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন – Somehow I have an impression that America has a great mission in the history of western civilization; for it is rich enough not to concern itself in the greedy exploitation of weaker nations. Its hands are free and perhaps it will hold up the torch of freedom before the world. কিন্তু এসব এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
১৯১২ সালের সেপ্টেম্বরে ইয়েট্স্ গীতাঞ্জলির মুখবন্ধ লিখে দেন। পাশ্চাত্য পাঠক-পাঠিকাদের কাছে রবীন্দ্রনাথকে চিনিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল, কেননা ততদিন পর্যন্ত তিনি যা লিখেছেন সবই প্রায় বাংলায়। একজন অনামী লেখকের ইংরাজী পড়বেই বা কে? কিন্তু এই চিনিয়ে দেওয়াটা ইয়েট্স্ যেভাবে করেছিলেন, তার নজির মেলা ভার। তাঁর সেই লেখায় ফুটে উঠেছিল স্বতস্ফূর্ততা, শ্রদ্ধা, ভক্তিমিশ্রিত বিস্ময়। তিন পরিচ্ছেদে সেই বড়সড় লেখাটির কিছু কিছু অংশ এখানে না দিলেই নয় – ... these prose translations from Rabindra Nath Tagore have stirred my blood as nothing has for years… I have carried the manuscript of these translations about with me for days, reading it in railway trains, or on the top of omnibuses and in restaurants, and I have often had to close it lest some stranger would see how much it moved me. These lyrics - which are in the original, my Indians tell me, full of subtlety of rhythm, of untranslatable delicacies of colour, of metrical invention, display in their thought a world I have dreamed of all my life long. The work of a supreme culture, they yet appear as much the growth of the common soil as the grass and the rushes… An innocence, a simplicity that one does not find elsewhere in literature makes the birds and the leaves seem as near to him as they are near to children, and the changes of the seasons great events as before our thoughts had arisen between them and us. At times I wonder if he has it from the literature of Bengal or from religion, and at other times, remembering the birds alighting on his brother's hands, I find pleasure in thinking it hereditary, a mystery that was growing through the centuries like the courtesy of a Tristan or a Pelanore.
আশ্চর্য নয়, যে দিকে দিকে এই বার্তা রটে যাবে যে ইয়েট্স্-ই রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদ করে দিয়েছেন, এবং মূলতঃ ইয়েট্সের জন্যেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বেশ ক্ষুব্ধ, অপমানিত ও বিরক্ত হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রোদেনস্টাইনকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন – It will amuse you to learn that at a semi-public conference of the Mohammedan leader of Bengal Valentine Chirol gave his audience to understand that the English Gitanjali was practically written by Yeats. Naturally such rumours get easy credence among our people who can believe in all kinds of miracles except genuine worth in their own men. It is annoyingly insulting for me to be constantly suspected of ebing capable of enjoying a reputation by fraud and it makes me wish that the chance had never been given to me to come out of the quiet corner of my obscurity. সেটা ছিল এক দীর্ঘ চিঠি। তার এক অন্য অংশে ঠাট্টা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – ... your language is not easy for me to use. I know I am apt to make a mess of your prepositions and in my blissful ignorance I go on dropping your articles… I do not know set phrases which greatly economise trouble in sentence-making and very often I do not know how to write simple matter-of-fact things in English. No wonder people can hardly believe that I had any hand in translating the poems of Gitanjali.
বস্তুতপক্ষে, ইয়েট্সের কাজ ছিল মূলত এটাই, preposition, article ইত্যাদির বা কিছু syntax গড়বড় সংশোধন করা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত লেখার ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন। এক একটা কবিতার বহু লাইন কতবার যে কেটে আবার লিখতেন, তার ইয়ত্তা নেই। এডওয়ার্ড জন টমসন নামে একজন রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর লেখা ছোট গল্পগুলো একত্রে অনুবাদ করার অনুমতি চান। এই গল্পগুলো পড়ে টমসনের মত ছিল, বিশ্বসাহিত্যে এত মহৎ ছোটগল্প আর লেখা হয়নি। ১৯১৪ সাল থেকে প্রায় আট বছর তাকে পর্যায়ক্রমে উৎসাহিত ও নিরুৎসাহিত করে রবীন্দ্রনাথ এই পরিকল্পনা বাতিল করেন। তাঁর মত ছিল বাংলা ও ইংরাজী দুটো ভাষাতেই সমান পারঙ্গম না হলে তাঁর গল্পের ইংরাজী অনুবাদ সম্ভব নয়। তিনি তাঁর নিজের করা অনুবাদও পছন্দ করেন নি।
নোবেল পাওয়ার প্রায় এক যুগ পরে, ১৯২৫ সালের ২৯শে মার্চ আলাপ আলোচনা নামে এক প্রবন্ধে কবি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর প্রথম ইয়েট্সের সাথে সাক্ষাতের কথা। লিখেছেন – বাংলা গীতাঞ্জলির কবিতা ইংরেজিতে আপন মনেই তর্জমা করেছিলুম। শরীর অসুস্থ ছিল, আরকিছু করবার ছিল না। কোনোদিন এগুলি ছাপা হবে এমন স্পর্ধার কথা স্বপ্নেও ভাবি নি। তার কারণ, প্রকাশযোগ্য ইংরেজি লেখবার শক্তি আমার নেই – এই ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল ছিল। খাতাখানা যখন কবি য়েট্সের হাতে পড়ল তিনি একদিন রোদেন্স্টাইনের বাড়িতে অনেকগুলি ইংরেজ সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসজ্ঞকে তার থেকে কিছু আবৃত্তি করে শোনাবেন ব'লে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি মনের মধ্যে ভারি সংকুচিত হলেম। তার দুটি কারণ ছিল। নিতান্ত সাদাসিধে দশ-বারো লাইনের কবিতা শুনিয়ে, কোনোদিন আমি কোনো বাঙালি শ্রোতাকে যথেষ্ট তৃপ্তি পেতে দেখি নি। এমন-কি, অনেকেই আয়তনের খর্বতাকে কবিত্বের রিক্ততা ব'লেই স্থির করেন। একদিন আমার পাঠকেরা দুঃখ করে বলেছিলেন ইদানীং আমি কেবল গানই লিখছি। বলেছিলেন – আমার কাব্যকলায় কৃষ্ণপক্ষের আবির্ভাব, রচনা তাই ক্ষয়ে ক্ষয়ে বচনের দিকে ছোটো হয়েই আসছে। তার পরে আমার ইংরেজি তর্জমাও আমি সসংকোচে কোনো-কোনো ইংরেজি-জানা বাঙালি সাহিত্যিককে শুনিয়েছিলেম। তাঁরা ধীর গম্ভীর শান্ত ভাবে বলেছিলেন – মন্দ হয় নি, আর ইংরেজি যে অবিশুদ্ধ তাও নয়। সে সময়ে এন্ড্রুজের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। য়েট্স্ সেদিনকার সভায় পাঁচ-সাতটি মাত্র কবিতা একটির পর আর-একটি শুনিয়ে পড়া শেষ করলেন। ইংরেজ শ্রোতারা নীরবে শুনলেন, নীরবে চলে গেলেন – দস্তুর-পালনের উপযুক্ত ধন্যবাদ পর্যন্ত আমাকে দিলেন না। সে রাত্রে নিতান্ত লজ্জিত হয়েই বাসায় ফিরে গেলেম। পরের দিন চিঠি আসতে লাগল। দেশান্তরে যে খ্যাতি লাভ করেছি তার অভাবনীয়তার বিস্ময় সেই দিনই সম্পূর্ণভাবে আমাকে অভিভূত করেছে।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই তিনি কবি ইয়েট্সের ওপরে এক প্রবন্ধও লিখেছেন। ইয়েট্সের সমকালীন অন্যান্য ইংরেজ কবিদের অধিকাংশের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিল এই রকম – ইংলণ্ডের বর্তমানকালের কবিদের কাব্য যখন পড়িয়া দেখি তখন ইঁহাদের অনেককেই আমার মনে হয়, ইঁহারা বিশ্বজগতের কবি নহেন। ইঁহারা সাহিত্যজগতের কবি। এ দেশে অনেক দিন হইতে কাব্য সাহিত্যে সৃষ্টি চলিতেছে, হইতে হইতে কাব্যের ভাষা উপমা অলংকার ভঙ্গী বিস্তর জমিয়া উঠিয়াছে। শেষকালে এমন হইয়া উঠিয়াছে যে কবিত্বের জন্য কাব্যের মূল প্রস্রবণে মানুষের না গেলেও চলে। কবিরা যেন ওস্তাদ হইয়া উঠিয়াছে; অর্থাৎ, প্রাণ হইতে গান করিবার প্রয়োজনবোধই তাহাদের চলিয়া গিয়াছে, এখন কেবল গান হইতেই গানের উৎপত্তি চলিতেছে।
অথচ ইয়েট্সের ব্যাপারে তাঁর মূল্যায়ন একেবারে অন্যরকম – ভিড়ের মাঝখানেও কবি য়েট্স চাপা পড়েন না, তাঁহাকে একজন বিশেষ কেহ বলিয়া চেনা যায়। যেমন তিনি তাঁহার দীর্ঘ শরীর লইয়া মাথায় প্রায় সকলকে ছাড়াইয়া গিয়াছেন, তেমনি তাঁহাকে দেখিলে মনে হয়, ইঁহার যেন সকল বিষয়ে একটা প্রাচুর্য আছে, এক জায়গায় সৃষ্টিকর্তার সৃজনশক্তির বেগ প্রবল হইয়া ইঁহাকে যেন ফোয়ারার মতো চারি দিকের সমতলতা হইতে বিপুলভাবে উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলিয়াছে। সেইজন্য দেহে মনে প্রাণে ইঁহাকে এমন অজস্র বলিয়া বোধ হয়।
সেই লেখার শেষ প্যারাগ্রাফে লিখলেন - এই imaginative conviction কথাটা য়েট্স্ সম্বন্ধে অত্যন্ত সত্য। কল্পনা তাঁহার পক্ষে কেবল লীলার সামগ্রী নহে, কল্পনার আলোকে তিনি যাহা দেখিয়াছেন তাহার সত্যতাকে তিনি জীবনে গ্রহণ করিতে পারিয়াছেন। অর্থাৎ, তাঁহার হাতে কল্পনা-জিনিসটি কেবলমাত্র কবিত্বব্যবসায়ের একটা হাতিয়ার নহে, তাহা তাঁহার জীবনের সামগ্রী; ইহার দ্বারাই বিশ্বজগৎ হইতে তিনি তাঁহার আত্মার খাদ্যপানীয় আহরণ করিতেছেন। তাঁহার সঙ্গে নিভৃতে যতবার আবার আলাপ হইয়াছে ততবার এই কথাই আমি অনুভব করিয়াছি। তিনি যে কবি, তাহা তাঁহার কবিতা পড়িয়া জানিবার সুযোগ এখনো আমার সম্পূর্ণরূপে ঘটে নাই, কিন্তু তিনি যে কল্পনালোকিত হৃদয়ের দ্বারা তাঁহার চতুর্দিককে প্রাণবানরূপে স্পর্শ করিতেছেন তাহা তাঁহার কাছে আসিয়াই আমি অনুভব করিতে পারিতেছি।
এমন ব্যক্তি, যিনি তাঁর বন্ধুত্বকে অকুণ্ঠ সম্মান দিতেন, নিজের ক্ষমতা ও বিশেষ করে অক্ষমতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ ছিলেন, নিজের বক্তব্য ত্রুটিহীন ও পরিপাটিভাবে উপস্থাপনায় যার জুড়ি মেলা ছিল ভার, তিনি অন্যের অনুবাদ নিজের বলে চালাতেই পারেন না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পরে অনেকেই অনুবাদ করেছেন – বেশ নামী দামী পণ্ডিত তারাও – তবু মনে হয়না সেগুলো ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের নিজের করা অনুবাদের মত সুচারু হয়নি?
একথা ঠিক যে, ইংরাজীতে লেখা তাঁর কিছু চিঠিপত্রে প্রিপোজিশন বা আর্টিক্ল্-এর কিছু গোলমাল ছিল। কিন্তু সেগুলো তো চিঠি, সাহিত্য করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সেগুলো লেখা তো নয়। রবীন্দ্রনাথের ইংরাজী জ্ঞান নিয়ে সংশয়ের বিশেষ অবকাশ নেই। ইংরাজীতে লেখা তাঁর প্রবন্ধ বা বক্তৃতাগুলি এক একটি সাহিত্যসম্পদ। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর যে চিঠি ভাইসরয়কে পাঠিয়ে তিনি নাইট উপাধি পরিত্যাগ করেছিলেন, ইংরাজী ভাষায় লেখা সেই রকম প্রতিবাদপত্র খুব কমই লেখা হয়েছে। সেই সব লেখা কেউ এডিট করে দিয়েছিলেন, এ রকম খবর কেউ পায়নি।
কিন্তু না, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার পিছনে ইয়েটসের অন্য প্রত্যক্ষ অবদান নেই। যদি কেউ ভেবে থাকেন, ইয়েট্স্ই রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেছিলেন এই পুরস্কারের জন্য, সেটা একেবারে ভুল। কেননা সেরকম অধিকারই তার ছিল না। বস্তুত ইয়েট্স্ নিজেই ছিলেন ওই পুরস্কারের একজন দাবিদার। নোবেল প্রদানের দ্বিতীয় বছরেই, অর্থাৎ ১৯০২ সালেই তার নাম এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলে, কিন্তু তিনি সেবার এটা পাননি। এর পরে তার নামের মনোনয়ন ঘটে অনেক বছর পরে - ১৯১৪, ১৯১৫, ১৯১৮, ১৯২১ এবং ১৯২২ সালে। এর মধ্যে শেষবার নোবেল কমিটি নিজেই সেই মনোনয়ন করেছিল, কিন্তু প্রতিবারই হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৯২৩-এ অবশেষে সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে।
তবুও এটা বলা অমূলক নয় যে রোদেনস্টাইন ও ইয়েট্সের পীড়াপীড়িতেই গীতাঞ্জলির অনেকগুলো কবিতার ইংরাজী অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পরিচিত হয়েছিলেন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী মানুষের সঙ্গে। কিন্তু নোবেল পুরস্কারের জন্যে শুধু সাহিত্য সৃষ্টি করলেই তো হয় না। লাগে মনোনয়ন, নোবেল কমিটির লিস্টিতে নাম ওঠানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে সেই নামকে টিঁকিয়ে রাখা, আর শেষ পর্যায়ে অন্যদের চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে বাজিমাত করা। এ ব্যাপারে টিভিতে দেখা বিউটি কন্টেস্টের সঙ্গে এর বিশেষ পার্থক্য নেই।
শুধু এই দুজন নয়, রবীন্দ্রনাথের রচনার ইংরাজী অনুবাদের পিছনে আরও অনেকের পরোক্ষ অবদান ছিল। আনন্দ কুমারস্বামীর কথা বলেছি, আর একজন ছিলেন চার্ল্স্ ফ্রিয়ার অ্যানড্রুজ, যিনি পরে দীনবন্ধু নাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ভারতসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ছিলেন সুকুমার রায়, যার কথা বলেছি আগে। ছিলেন কবিবন্ধু বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে সমর্পিত প্রাণ ভগিনী নিবেদিতা। কিন্তু এদের নাম তো আপনারা জানেন, কবির রচনার প্রথম ইংরাজী অনুবাদ সম্ভবত এক অনামা দেশপ্রেমীর, যিনি অনুবাদ করেছিলেন তাঁর 'সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে' কবিতাটি।
আলিপুর বোমার মামলায় তখন ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে ব্রিটিশ সরকার। অরবিন্দ ঘোষ সেই মামলার আসামী। এ নিয়ে যে কোন লেখালিখি প্রকাশ হলেই ধরে জেলে চালান দেওয়া হচ্ছে। বালগঙ্গাধর তিলকের মত নামী মানুষ এ নিয়ে মাত্র দুটো প্রবন্ধ তার কেশরী পত্রিকায় ছাপানোর অপরাধে বর্মার মান্দালয় জেলে চালান হয়ে গেলেন ছ'বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে। সেই সময় বিপ্লবীদের দেশপ্রেমের শিখা জাজ্বল্যমান রাখার অভিপ্রায়ে এই কবিতাটির অনুবাদ হয়েছিল এই রকম –
'Blessed is my birth – for I was born in this land,
Blessed is my birth – for I have loved thee.
I don't know in what garden
Flowers enrapture so much with perfume;
In what sky rises the moon, smiling such a smile.
Oh mother, opening my eyes, seeing thy light
My eyes are regaled;
Keeping my eyes on that light
I shall close my eyes in the end.'
কোনো পত্রিকার এক সাংবাদিক এই অনুবাদটি করেছিলেন, কিন্তু তার নাম কেউ জানে না।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন