রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

কাঙাল হরিনাথ ~ নবশ্রী চক্রবর্তী বিশ্বাস

গ্রীষ্মের অপরাহ্ন। গ্রামের কচিকাচার দল বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে গৃহে ফিরছিল। পথ প্রায় জনশূন্য ছিল এতক্ষণ। এখন শিশুদের কলকাকলিতে পথ-ঘাট-পুকুরের যেনো তন্দ্রাভঙ্গ হল। শিশুদিগের মুখে এক অপূর্ব আহ্লাদ! গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহও সেই উত্তেজনায় বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাদের গ্রীষ্ম-অবকাশের সূচনা হয়েছে যে! সেই আনন্দই তাদের চোখেমুখে প্রতীয়মান। পথপার্শ্বে চণ্ডীমণ্ডপের দক্ষিণের একটি কক্ষ থেকে কোলাহলের শব্দ শুনে কিছু শিশু থমকে দাঁড়ালো, বাকি শিশুরা নিজ নিজ বাড়ীর পথ ধরলো। 

      দুটি শিশু কোলাহলের শব্দ অনুসরণ করে খুব ধীরে পদসঞ্চারণ করে কক্ষের গবাক্ষের সমীপে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। তন্মধ্যে একজন শিশু কৌতুহলবশতঃ উকিঝুঁকি দিতে উদ্যত হ'লে কক্ষের অন্দর থেকে এক যুবক কণ্ঠ ভেসে এলো। যুবকটি দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠলো, "একটা বাউলগানের দল করলে কেমন হয়! তোমরা কি বলো!" কথাটা শেষ হতেই ঘরে এক নিস্তব্ধতার পরিবেশ সৃষ্টি হল। আরেক যুবক উত্তর দিলো, "কথাটা মন্দ বলোনি অক্ষয়। এইতো প্রাতঃকালে কালিগঙ্গা থেকে এক বাউল এসেছিলেন। শুনেছি তাঁর অনেক শিষ্য। কি যেন নাম!" পাশ থেকে আরেক যুবক উত্তর করলেন, "লালন ফকির! কি ভারী সুন্দর একখানি গান শোনালে গো!" যুবকটি সম্মতি জানিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, "তিনি পারলে, আমরাও পারবো।" অক্ষয় বললো, "ঠিক! আজই, এখন থেকেই আমরা বাউল দল তৈরী করবো।" অপেক্ষাকৃত এক বয়স্ক ব্যক্তি বললে, "কাজটি সহজ নয় অক্ষয়। নতুন গান বাঁধতে হবে যে!" অক্ষয় বললো, "হলে হবে, আমরা ভয় করবো না। একটা কলম আর কাগজ নিয়ে আয় জলদা! আর যা যা বলছি, কাগজে লিখেনে।" জলদা নামের যুবকটি বাধ্য ছেলের মত একটা কাগজ ও কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলো। অক্ষয় বলতে শুরু করলো -
  
"ভাব মন দিবানিশি, অবিনাশি,
                  সত্য- পথের সেই ভাবনা।
যে পথে চোর ডাকাতে, কোন মতে,
                  ছোঁবে না রে সোনা দানা । ....... "

    গানটির অনেক কলি লেখা হ'লে, অক্ষয় থামলো। মধ্যবয়সী পুরুষটি বললেন, "এতে তো হবেনা। বাউল গানের নিয়ম হলো গানের শেষে ভণিতা দিতে হবে।" তার সামনে বসা যুবকটি বললো, "আপনি পণ্ডিত মানুষ, আমাদের এইটুকু ত্রুটি নয় মার্জনা করলেন!" অক্ষয় বললো, "না লিখছি যখন, নিয়ম মেনেই লিখবো।" উত্তেজিত হয়ে জলদা বললো, "এতো চিন্তার কি আছে ভাই! চল না কাঙালের কাছে যাই। তিনিই সুন্দর ভনিতা লিখে দেবেন।" অক্ষয় বলল, "না জলদা, আমিই ভণিতা লিখবো। তাঁকে আমি অবাক করে দিতে চাই।" জলদা আবার কলম ধরল, অক্ষয় বলতে লাগলো -
    
     "ফিকিরচাঁদ ফকির কয় তাই, কি কর ভাই,
                                          মিছামিছি পর ভাবনা ।
        চল যাই সত্য পথে, কোন মতে,
                                           এ যাতনা আর রবে না।"
     
    গানের ভণিতা সমাপ্ত হলো। সকলে সমস্বরে বললো, ঠিক, এই ফিকিরচাঁদ নামটাই সঠিক। জলদা বললো, "আমাদের তো ধম্ম ভাব নেই এক চিলতে। ফিকিরে সময় কাটাবো, এটাই মুখ্য উদ্দেশ্য।" 

      গানের সুর দিলেন আরেক যুবক। সুর শেষ হতেই জলদা বললো, "চল হে, একবার কাঙালকে শুনিয়ে আসি।" এই বলে যুবকগুলি দল বেঁধে সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে অনতিদূরে পার্শ্ববর্তী এক ছোট কুটিরের উদ্দেশ্যে চললো। শিশুগুলি নিঃশব্দে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। তারা এখন যুবকদলটিকে অনুসরণ করতে লাগলো। তারা ভাবলো, এবার বুঝি খুব আমোদ হবে। উত্তেজনায় যুবকদলের কেউ শিশুগুলিকে খেয়াল করলো না। যুবকদল সেই ছোট কুটিরে প্রবেশ করলো। কুটিরের একটি কক্ষে এক মধ্যবয়সী মানুষ, একটি কাষ্ঠনির্মিত ভগ্ন আরামকেদারায় বসে কি যেন লিখছেন। তার গাত্রে ছিন্ন- পরিচ্ছন্ন -শুভ্রবস্ত্র, কেশ রুক্ষ, চোখ দুখানি আয়ত - উজ্জ্বল, মুখখানি জীবনযুদ্ধে কিছুটা ম্লান হলেও, জীবনীশক্তিতে ভরপুর। যুবকের দল একে একে এসে নিঃশব্দে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। তাঁর ছোট কুটিরের কক্ষে আর স্থান সংকুলান হয়না! এদিকে মানুষটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি লিখেই চলেছেন আপনমনে। হঠাৎ যুবকদলের মধ্যে কারো কারো ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো। তাদের মধ্যে মৃদুস্বরে বাক্যালাপ শুরু হ'লে, সেই শব্দেই মানুষটি লেখা ছেড়ে যুবকদলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তাদের দেখে তিনি যারপরনাই তৃপ্তি পেলেন। সেই তৃপ্তি তাঁর ব্যবহারে ও কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পেল । তিনি যুবকদের সোৎসাহে বললেন, "আরে তোরা! কি ব্যাপার! কোনো সংবাদ আছে নাকি! একেবারে দল বেঁধে!" জলদা বললো, "আছেই তো ! তাই তো এলাম। আমরা বাউলগান লিখেছি। সুর করেছি। আপনাকে শোনাতে এলাম। আপনি যদি রাজী হন, তো কাল থেকেই আমরা এই গান গেয়ে গ্রামের পথে পথে ঘুরবো।" মানুষটি হাতের কাগজটা রেখে এসে বললো, "শোনা দেখি!" তাঁর উৎসাহ দেখে যুবকদল ততোধিক উৎসাহে গান ধরলো। গান গাইতে গাইতে তারা নাচতে লাগলো। মানুষটিও তাদের সাথে যোগ দিলো। মনে হলো, কিছু বাউল মনের আনন্দে গান গাইছে আর নাচছে। শিশুর দল বড়ই আমোদ অনুভব করলো। নাচ-গান সমাপ্ত হলে শিশুর দল স্ব স্ব বাড়ীর উদ্দেশ্যে ধাবিত হল। পথে যাদের সাথেই দেখা হলো, তাদেরই বললো, "কাল এখান দিয়ে বাউল গানের দল যাবে গো।" সকলেই উৎসাহিত!

     এদিকে কক্ষ মধ্যে শোরগোল পরে গেল। যুবকের দল উত্তেজনায় ফুটতে লাগল। কাঙাল বললেন, "দ্যাখ, একটা গানে তো আর বাউলের দল হয় না। তাই ভাবছি আমিও একটা লিখবো। অক্ষয় কলম ধর!" তিনি বলতে লাগলেন -
  
    "আমি কোরব এ রাখালী কতকাল ।
      পালের ছটা গরু ছুটে,
                         করছে আমার হাল বেহাল ।
     আমি, গাদা করে নাদা পুরে রে,
    কত যত্ন ক'রে খোল বিচালী খেতে দিই ঘরে ;.....,"

     এই দুটি গান সম্বল করে পরের দিন যুবকদল সন্ধ্যাকালে বাউলের পোশাকে ও সজ্জায় সুসজ্জিত হয়ে খোল করতাল নিয়ে গ্রামের পথে বেরোলো। তাদের নগ্নপদ, গেরুয়া বসন, কারো মুখে কৃত্রিম দাড়ি, কিন্তু মুখে সকলের অনাবিল হাসি। গ্রামের মেঠো পথ ধরে "ফিকিরচাঁদ ফকিরের" দল গান গাইতে গাইতে চললো। বাউলের দলের সম্মুখে চললেন কাঙাল। তাঁকে অনুসরণ করলেন তাঁর স্নেহধন্য যুবকরা। পথের দুই ধারে মানুষের ঢল নামলো। এইভাবে একদিন-দুইদিন-তিনদিন করে প্রায় প্রতিদিনই বাউলের দল বের হয়ে গ্রামের পথে পথে গান গেয়ে বেড়ায়। ধীরে ধীরে গানের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, সেই সাথে গানের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে ফিরতে শুরু করলো এইসব গান। এই ছোটো পরিসরে রইলো সেই ফিকিরচাঁদ ফকির দলের প্রধান কান্ডারী কাঙালের সংক্ষিপ্ত জীবনী। 
       
     ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালির অন্তর্গত কুন্ডুপাড়া গ্রামে এক তিলি পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রকৃত নাম হরিনাথ মজুমদার৷ যিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন 'কাঙাল হরিনাথ' নামে৷ তাঁর পিতার নাম হরচন্দ্র (মতান্তরে হলধর) মজুমদার ও মাতার নাম কমলিনী দেবী। 
 
       বাল্যকালেই তাঁর পিতৃমাতৃ বিয়োগ ঘটে। শৈশবে
কিছুকাল কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজী বিদ্যালয়ে বিদ্যালাভের সুযোগ ঘটেছিল তাঁর৷ কিন্তু নিদারুণ অর্থকষ্টে তিনি তাঁর বিদ্যাচর্চা সমাপ্ত করতে পারেননি। তিনি তাঁর জীবনীতে লিখেছিলেন, পিতাকে দাহ করে ফিরে পরনের বস্ত্রটুকু পরিবর্তনের মত বস্ত্র ও ভক্ষণের নিমিত্ত সামান্য হবিষান্নটুকুও তাঁর গৃহে ছিল না। শৈশবকালে পিতৃবিয়োগের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পড়াশোনা শেষ না করতে পারার যন্ত্রণা তিনি আজীবন বয়ে বেরিয়েছেন!
এই সময় ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্য্যদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কুমারখালি প্রদেশে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের জন্য পণ্ডিত দয়ালচাঁদ শিরোমণি মহাশয়কে প্রেরণ করেছিলেন। হরিনাথ, শিরোমণি মহাশয়ের নিকট কিছু ব্যাকরণ পাঠ করতে লাগলেন এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ও তৎকালে প্রকাশিত ব্রাহ্মধর্মে কিছু গ্রন্থ অধ্যয়ণ করেছিলেন।

       শৈশবের সেই দুর্বিষহ অভাবই তাঁর জীবনে পরমপাথেয় হয়ে দাড়িয়েছিল৷ ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি  গ্রামে একটি মাতৃভাষার বিদ্যালয় (ভার্নাকুলার স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাপারে তিনি পাশে পেয়েছিলেন গোপাল কুণ্ডু, যাদব কুণ্ডু, গোপাল সান্যাল প্রমুখ বন্ধুদের৷ সেই বিদ্যালয়ে তিনি কিছুদিন অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবলে ইংরেজী শিক্ষার পদ্ধতি অনুসরণ করে গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় সাহিত্য, ব্যাকরণ, ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক প্রভৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তাঁর মাসিক বেতন হয় কুড়ি টাকা। কিন্তু এর থেকে পনের টাকা গ্রহণ করে বাকী অর্থটুকু তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। 

       নারী শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তৎকালীন সময়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষে নারীদের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। যে ক'জন উদারমনস্ক ও সাহসী ব্যাক্তিত্ব এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন কাঙাল হরিনাথ। অর্থ ব্যতীত আর অন্য কোন বিষয়ে অপ্রতুলতা বিধাতা তাঁর মধ্যে দেননি। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কাঙাল হরিনাথের সহায়তায় কৃষ্ণনাথ মজুমদার একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন কুমারখালিতে।
 
     তাঁর যে সকল বিষয় অধীত ছিল না, তা গৃহে তাঁর বাল্যবন্ধু মথুরামোহন মৈত্র (সাহিত্য ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রের পিতা) মহাশয়ের নিকট শিক্ষা ও অভ্যাস ক'রে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করতে লাগলেন। যারা বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে অসামাজিক কাজকর্মে নিযুক্ত হয়ে পড়েছিল, সেই সমস্ত ছাত্রদের নিয়ে তিনি নৈশ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করেন। এই নৈশ বিদ্যালয়ে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজী বিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিল।

    তিনি আজীবন দুর্বিষহ দারিদ্রের সাথে লড়াই করেছেন। অর্থ উপার্জনের জন্য কুমারখালিতে তিনি কিছুদিন নীলকর সাহেবদের অধীনে চাকরী করেন। কিন্তু নীলকর সাহেবদের নীল কৃষকদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার সন্দর্শণে তিনি এই চাকরি পরিত্যাগ করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তাঁর বাল্যবন্ধু মথুরানাথ হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাতে লেখা শুরু করেন। তাই দেখে হরিনাথও হাতে কলম তুলে নেন। কাঙাল হরিনাথ তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, "সাধ্য ততদূর না থাকুক, প্রজার প্রতি নীলকরদের অত্যাচার যাতে নিবারিত হয়়, তার উপায় চিন্তাকরণ আমার ও মথুরের নিত্যব্রত ছিল।" তার তথ্য-ঋদ্ধ লেখনীতে মূর্ত হয়ে উঠত কৃষকদের অসহায় পরিস্থিতি ও নির্যাতিত-লাঞ্ছনা -বঞ্চনা-যন্ত্রণাময় জীবন। প্রথমদিকে তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাতে লেখালেখি শুরু করেন। তারপর ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কুমারখালিতে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর আত্মজীবন চরিতে লিখেছেন, "ঘরে নেই এক কড়া, তবু নাচে নায় পাড়া। আমার ইচ্ছা হলো এইসময় একখানি সংবাদপত্র প্রচার করে গ্রামবাসী প্রজারা যেরূপে অত্যাচারিত হচ্ছে, তা গভর্নমেন্টের কর্ণগোচর করলে অবশ্যই তার প্রতিকার এবং তাদের নানা প্রকার উপকার সাধিত হবে। সেই ইচ্ছাতেই গ্রাম ও পল্লীবাসী প্রজার অবস্থা প্রকাশ করব বলে পত্রিকার নাম গ্রামবার্তা প্রকাশিকা রেখেছি।"

এর পাশাপাশি কবি ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাতে তিনি  প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। তাঁর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন  এর যন্ত্রে মুদ্রিত হত, কিন্তু প্রকাশিত হতো কুমারখালী থেকে (বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার ইতিহাসের উপাদান -কাঙাল কুঠির ও এম এন প্রেস)।

  সংবাদপত্রের আদিযুগে একজন দরিদ্র অসহায় দীনহীন কাঙ্গাল, অতুলপ্রতিভা ও ঐশীশক্তিবলে দেশের জন্য এইরূপ বহুব্যয় সংবাদপত্রের প্রচারে ব্রতী হলেন। বিশেষত তখন নিজের বা মফস্বলের কোথাও মুদ্রাযন্ত্র ছিল না। কলকাতায় যাতায়াতের সুবিধা ছিল না, কারণ পূর্ববঙ্গের রেলপথ তখনো খোলা হয়নি। এই সময়ে কলকাতায় সংবাদপত্র মুদ্রিত করে প্রকাশ করা অসম্ভব সাহসের পরিচয়। তখন সাধারণ মানুষের সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস গঠিত হয় নি। সংবাদপত্রের মূল্য অত্যধিক থাকায় ধনী ভিন্ন সাধারণের তা গ্রহণ করার সামর্থ ছিলনা। সেই কারণে সংবাদপত্রের কথা সাধারণ মানুষ পরীজ্ঞাত ছিল না। কাঙাল হরিনাথ ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে এই দুরূহ কাজে হস্তক্ষেপ করিলেন। এই দুরূহ কার্য সম্পন্ন করার জন্য তিনি নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পরিত্যাগ করেন। বিদ্যালয়ের প্রাপ্য বেতন তার সংসারযাত্রা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন ছিল। পত্রিকায়  সেই উপায় হয় না, যার দ্বারা তিনি সংসারকার্য নির্বাহ করতে পারেন। সুতরাং অতিকষ্টে সংসারের ব্যয় নির্বাহ হতে লাগলো। তিনিই নিজেই ছিলেন একাধারে লেখক, সম্পাদক, পত্রিকা বিলিকারক এবং মূল্য আদায়কারী অর্থ সংগ্রাহক। তাঁর জীবনযন্ত্রণা তিনি লিখে গেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে, "এই দিন চৈত্রমাসের দুপ্রহরের রৌদ্রের সময় পদ্মার  তীরস্থ তাপিত বালুকাময়ী চড়া অতিক্রম করতে পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ ও রৌদ্রতাপে তাপিত হয়ে যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছিলাম, যদি গ্রামবার্তার প্রতি প্রেমানুরাগ সঞ্চিত না থাকতো, তবে তা তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগের কারণ হত।"

     ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কুমারখালিতে তিনি নিজস্ব পত্রিকা ছাপানোর জন্য ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮ বছর ধরে রাজশাহীর রানী স্বর্ণকুমারী দেবী এই ছাপাখানার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করেন। হরিনাথ তাঁর গ্রামের মানুষদের অসহায়তা, দারিদ্র্য প্রতিকারের চিন্তা থেকেই এই কার্যে ব্রতী হন ('কাঙাল হরিনাথ ও ' গ্রামবার্তা প্রকাশিকা', কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ - আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৮)।

কাঙাল হরিনাথের ছাপাখানা

      গ্রামবার্তা দ্বারা এ দেশের প্রভূত উপকার সাধিত হয়। এটা যে শুধুমাত্র জমিদারের মহাজনের এবং নীলকুঠির অত্যাচার নিবারণ সাধন করেছিল তাই নয়, প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য সম্পর্কে যে সকল প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো, তদনুসারে কার্য করতে ইংরাজ সরকারেরও যথেষ্ট প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সংবাদপত্রের অনুবাদক মিঃ রবিনসন সাহেব স্বয়ং "গ্রামবার্তা" গ্রহণ করেছিলেন এবং সরকারের গোচরার্থে গ্রামবার্তা থেকে যে অনুবাদ হত, তাতে গ্রামবাসীর বিশেষ উপকার হয়েছিল। এতে করে গ্রামের নদী খাল প্রভৃতি পয়ঃপ্রণালী সংস্কারপূর্বক জলকষ্ট নিবারণ, গো-ধন রক্ষা, পুলিশ বিভাগের সংস্কার ব্যবস্থা ইত্যাদি। তৎকালে "সোমপ্রকাশ"ও "গ্রামবার্তা" ই উচ্চশ্রেণীর সাময়িক পত্র ছিল।

   কাঙাল হরিনাথ যখন বাংলা সাহিত্যের সেবায় নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস গ্রন্থের অভাব ছিল। তখন বাহারদানেশ, চাহারদরবেশ, বিদ্যাসুন্দর, কামিনীকুমার ইত্যাদি গ্রন্থই উপন্যাসের স্থান গ্রহণ করেছিল। উপন্যাস সৃষ্টির আদিযুগে হরিনাথ "বিজয়বসন্ত" (রচনাকাল- ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দ) নামক এক উপন্যাস রচনা করে বাংলার সাহিত্যজগৎকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তিনি ইংরেজী ভাষা জানতেন না। এদিকে তৎকালীন ইংরেজীশিক্ষায় শিক্ষিত যুবকশ্রেণী বাংলার তৎকালীন  উপন্যাসসমগ্রকে উচ্চ আসনে স্থান দিতেন না। কিন্তু হরিনাথের "বিজয়বসন্ত" মৌলিকতা, মধুরতা, এবং প্রকৃত কাব্যগুনে মাতৃভাষার যথেষ্ট গৌরব বৃদ্ধি করে বহুজনের সমাদর লাভ করে।

তাঁর স্মৃতিতে নির্মিত সংগ্রহশালা
     
       তিনি আরো অনেক গ্রন্থ রচনায় বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন ৷ তার মধ্যে চারুচরিত্র (১৮৬৩), কবিতা কৌমুদী (১৮৬৬), কবিকল্প (১৮৭০), অক্রুর সংবাদ, চিত্তচপলা (১৮৭৬), ব্রহ্মান্ডবেদ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷

   তাঁর প্রতিভা সর্বতোমুখী ছিল৷ তিনি ছিলেন স্বভাব কবি৷ সেই সময় কুমারখালিতে কীর্তনের বড় ধুম ছিল। অনেকেই সুললিত পদ রচনা করে বিগ্রহের পর্ব উপলক্ষে গান করতেন। হরিনাথের পদগুলি মহাজন বিরচিত পদাবলী অপেক্ষা কোন অংশে নিকৃষ্ট ছিল না। তাঁর রচিত পদ তিনি নিজেই স্বকন্ঠে গেয়ে সমবেত শ্রোতৃমন্ডলীকে মুগ্ধ করে রাখতেন। এইরূপে তিনি পূর্ববঙ্গের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার নিকটে তার বাউল সংগীতের দ্বারাই অসামান্য লোক বলে পরিচিত হয়েছিলেন। এই বাউল সংগীতের সহজ সরল প্রাণস্পর্শী কথা ও সুরে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সর্বশ্রেণীর মানুষ উদ্বেলিত হতেন। অল্পদিনের মধ্যেই বাউলসংগীতের মধুর সুর হাটে- ঘাটে- মাঠে- নৌপথে সর্বত্রই শ্রুত হতে লাগলো -

 "হরি দিন গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে।
 তুমি পাড়ের কর্তা জেনে বার্তা ডাকি হে তোমারে।।"
 

      তিনি সাধক লালন ফকিরের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। তিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে একটি বাউল সংগীতের দল গঠন করেন। দলটি "কাঙাল ফকিরচাঁদের দল" বলে পরিচিত। তাঁর শিষ্যগণের মধ্যে ছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্রনাথ রায়, জলধর সেন প্রমুখ বাংলার বিশেষ ব্যক্তিত্বরা। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এই মহাপ্রাণের জীবনাবসান ঘটে। তিনি আমৃত্যু বঙ্গদেশের শিক্ষার প্রসার ও সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। বাঙালির অত্যন্ত কাছের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আজ তিনি প্রায় প্রচারের আড়ালে। বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, সংবাদিকতা ও মননে যে সুগভীর ছাপ তিনি রেখে গেছেন তা অনস্বীকার্য।

তথ্যসূত্র :
(১) কাঙাল হরিনাথ - শ্রী জলধর সেন।
(২) কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জীবন সাহিত্য ও সমকাল - ডঃ অশোক চট্টোপাধ্যায়।
(৩) কাঙাল হরিনাথ ( গ্রামীণ মনীষার প্রতিকৃতি) - আবুল আহসান চৌধুরী।
(৪)বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার ইতিহাসের উপাদান -কাঙাল কুঠির ও এম এন প্রেস।
(কলকাতা কথকথা পত্রিকায় প্রকাশিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন