মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

মোটা মাথার বোকা প্রশ্ন ~ নীলাঞ্জন মিশ্র

আমি অর্থনীতিবিদ নই। অর্থনীতির কিছু বুঝিও না। আর বুঝি না বলেই বোকা মাথায় কিছু সোজাসাপ্টা প্রশ্ন আসে। সেইসব প্রশ্নদের এক জায়গায় করার জন্যই এই লেখা।
আজকের লেখার বিষয় ব্যাংক কর্মী। ব্যাঙ্কে যখন প্রথম কম্পিউটার এল তখন বলা হয়েছিল যে এর ফলে দশজন লোকের কাজ একটা মেশিন করবে। ফলে, কর্মীদের ওপর কাজের চাপ কমবে। ভাল কথা। কিন্তু আদতে সেটা হল কি? ব্যংকিং সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের ওপর কাজের চাপ কমল কি?
আজকের দিনে যে কোনও ব্যাংক কর্মীকে জিজ্ঞেস করলেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন। বেসরকারি ব্যাংকের কথা তো ছেড়েই দিন, এমনকি সরকারি ব্যাংকেও আর দশটা পাঁচটার কাজ করলে এখন চলে না। সব জায়গাতেই দিনে আট ঘন্টার অনেক বেশি কাজ করতে হয়।
কিন্তু কেন? কম্পিউটার এসে না কাজের চাপ কমানোর কথা ছিল? তাহলে?
আসলে কম্পিউটার কাজের চাপ কমায় নি, কমিয়েছে কর্মীর সংখ্যা। আর সাথে সাথে বাড়িয়েছে একজন মানুষ কতটা কাজ করবেন সেই প্রত্যাশা। আগে যদি একজন কর্মী গড়ে দিনে দশজন গ্রাহককে সামলাতেন, এখন তাঁকে সামলাতে হয় একশজনকে।
আপনি বলবেন, সে তো হবেই। গ্রাহকসংখ্যা বাড়ছে, কাজের চাপ তো বাড়বেই। সেই জন্যই তো কম্পিউটার আনা।
আমার মোটা মাথা বলে, কর্মীর সংখ্যা না কমালে, কম্পিউটারের সাহায্যে সহজেই এই বাড়তি গ্রাহকদের চাপ সামলানো যেত। তাতে কর্মীদের ওপর কাজের চাপও এইভাবে বাড়ত না।
অর্থনীতিবিদরা বলবেন, কর্মীসংকোচন না করলে ব্যাংক চলবে কি করে? কি করে কম্পিটিশনে টিঁকে থাকবে? সেইজন্যই তো আর্থিক সমস্যায় পড়লেই যে কোনও সংস্থার প্রথম পদক্ষেপই হয় কর্মী ছাঁটাই। সহজেই যেন কেমন করে কালকের দক্ষ কর্মীরা আজ বাড়তি হয়ে যান। যাকে সংবাদপত্রের সুন্দর ভাষায় বলে, "বাড়তি মেদ ঝরিয়ে নতুন উড়ানের জন্য তৈরী এক্স ওয়াই জেড সংস্থা।"
আচ্ছা, তর্কের খাতিরে না হয় তাও মেনে নিলাম। আর্থিক মজবুতির জন্য এইসব "বাড়তি" কর্মীদের ছাঁটাই না করে কোনও উপায় নেই। তাহলে, এই কর্মীসংকোচের পর এখন তো ব্যাংকগুলোর লাভের মুখ দেখা উচিৎ? তা না হয়ে এখনও কেন ধুঁকে চলেছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক? কেন উত্তরোত্তর খারাপ হয়ে চলেছে তাদের আর্থিক অবস্থা?
ঠিক কতটা খারাপ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর স্বাস্হ্য? বেশ খারাপ। শুধু গত ত্রৈমাসিকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির মিলিত ক্ষতির পরিমাণ ১.৫ বিলিয়ন ডলার। কতগুলো শূন্য যেন? এর মধ্যে ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ারই ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
কোথায় যাচ্ছে এত এত টাকা? যাচ্ছে অনাদায়ী ঋণে, যাকে বলা হয় নন-পারফর্মিং অ্যাসেট। এই মুহুর্তে আমাদের রাস্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ চার লক্ষ কোটি টাকা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। চার লক্ষ কোটি। সংখ্যাটা কত বড়। একটু তুলনা করলে বুঝতে সুবিধে হবে। ইন্ডিয়ার স্বাস্থ্যখাতে বাজেট হল ষাট হাজার কোটি। অর্থাৎ, এই অনাদায়ী ঋণ দিয়ে ভারতের মত সাতটি দেশের স্বাস্হ্য বাজেট চালানো যায়। আরেকটা ছোট তথ্য। এই বছরের উনিশে ফেব্রুয়ারি ইটালিকে পেছনে ফেলে অনাদায়ী ঋণের অনুপাতে ভারত উঠে এসেছে বিশ্বের এক নম্বরে।
মজার কথা হল, এই অনাদায়ী ঋণের বোঝার পুরোটাই প্রায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাঁধে। প্রাইভেট ব্যাংকগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমান দশ ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ চল্লিশ হাজার কোটি।
তাহলে কি দেখলাম? একদিকে বাড়ল বেকারি, বাড়ল কর্মীদের ওপর কাজের চাপ, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো সম্মুখীন হল এক বিশাল পরিমান আর্থিক ক্ষতির।
কি হল আসলে? কোন ঝণখেলাপি পিঁপড়ে খেয়ে গেল
লাভের গুড়, আমার আপনার কষ্টার্জিত টাকা?
এ লেখার শুরুতেই বলেছি, আমি অর্থনীতি বুঝি না। তাই কত টাকা কোথায় গেল বুঝতে আমার ভরসা গুগুল। কোন ঋণখেলাপি আমার কত টাকা খেয়ে গেল সেটা গুগুল করতে গিয়ে আরেকটা মজার জিনিষ পেলাম। জানলাম, রাজ্যসভায় এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রকের ছোটমন্ত্রী শিবপ্রসাদ শুক্লা গত বছর জুলাই মাসে জানিয়েছেন, রিজার্ভ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী ভারতবর্ষের ব্যাংকিং সেক্টরে মোট ঋণখেলাপের পরিমান মার্চ ২০১৪তে আড়াই লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ৩১শে মার্চ ২০১৮-তে হয়ে দাঁড়িয়েছে নয় লক্ষ বাষট্টি হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ভারতের শিক্ষা বাজেটের দশগুন ও প্রতিরক্ষা বাজেটের প্রায় তিনগুন।
মন্ত্রীমশাই আরও জানিয়েছেন, এই ঋণখেলাপি টাকার নব্বই শতাংশই গেছে বড় কর্পোরেটদের ঘরে।
তা কাদের ঘরে গেল এই টাকা? গুগল করে জানতে পারলাম, আরবিআই এই তথ্য প্রকাশে অনিচ্ছুক। তবে গোপন কথাটি তো আর সবসময় গোপন থাকে না। ক্রেডিট সুইস বলে একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক পরামর্শদাতা সংস্হার দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫-র মার্চ অব্দি শুধু অনিল আম্বানিরই ঋণখেলাপের পরিমাণ সওয়া লক্ষ কোটি টাকা। আদানি, এসার ও বেদান্ত গ্রুপের প্রত্যেকের ঋণখেলাপের অংক কমবেশি এক লক্ষ কোটির ঘরে। আবার একটু হিসেবের সুবিধের জন্য জানিয়ে রাখি, ভারতবর্ষের শিক্ষাখাতে ২০১৯ সালের বাজেট হল কমবেশি নব্বই হাজার কোটি টাকা।
এ পর্যন্ত পড়ে কেউ বলতেই পারেন, আহা রে, বাছাদের ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। নচেৎ কি আর এরা ধারদেনা বাকি রাখত? সে হয়ত যাচ্ছে, কিন্তু অক্সফ্যামের দেওয়া হিসেব কিন্তু অন্য কথা বলছে. এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটির দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ২০১৬ সালের উৎপাদিত সম্পদের ৫৮ শতাংশ গেছিল ভারতবর্ষের ধনীতম এক শতাংশের হাতে। ২০১৭ সালে সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিয়াত্তর শতাংশে। অর্থাৎ, ভারতবর্ষে ২০১৭ সালে যদি ১০০ টাকার সম্পদ উৎপাদন হয়ে থাকে, তার মধ্যে তিয়াত্তর টাকাই ঢুকেছে একজনের পকেটে। আর দরিদ্রতম পঞ্চাশজন একসাথে পেয়েছে এক টাকা, গড়ে দু পয়সা।
এই যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্য, তা কিন্তু শুধু ভারতের সমস্যা নয়, তা ঘটে চলেছে বিশ্বের কমবেশি সর্বত্র। কিন্তু আবারও আমার মোটা মাথায় খচখচ করতে থাকে, এভাবে কি চলতে পারে? কতদিন দাঁড়িয়ে থাকবে এরকম মাথা ভারী পা রোগা কাঠামো?
লেখাটা শুরু করেছিলাম ব্যাংক কর্মীদের দিয়ে, কিন্তু আসলে এই সমস্যাটা আমার আপনার সবার। একটু ভেবে বলুন তো, আজকের দিনে কোন পেশাটা আছে, যেখানে আট ঘন্টা কাজ করলে চলে? আমাদের আগের প্রজন্ম তাঁদের অফিসে যা সময় দিতেন, আমাদের সবাইকে কেন দিতে হচ্ছে তার থেকে অনেক অনেক বেশি? যন্ত্র এসে তো আমাদের জীবনকে আরও সহজ করে দেওয়ার কথা ছিল, তাই না? তাহলে আমরা চারপাশে সবাই ছুটছি কেন? ছুটছি, কেন না, আমাদের বোঝানো হয়েছে সারভাইভ্যাল অফ দা ফিটেস্ট। থ্রি ইডিয়টস সিনেমার ভাইরাসের মত আমাদের সর্বক্ষণ বোঝানো হচ্ছে, জীবন হচ্ছে একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এখানে আরাম করতে হবে নিক্তি মেপে, যার পারিভাষিক নাম, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যলান্স। আসলে কিন্তু সেই ভারসাম্য থাকছে না। কর্মী কমছে, মাথাপিছু কাজ বাড়ছে। আট ঘন্টার কাজ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দশ বা বারো ঘন্টায়। কখনও আরো বেশি। কিছু বলার উপায় নেই। কেন না তোমার অফিসের বাইরেই অপেক্ষা করছে দশ হাজার চাকরিপ্রার্থী, তোমার ওই একটা চেয়ারের জন্য। গত বছরের একটা খবরে দেখলাম, বাষট্টিটি পিয়নের পোস্টের জন্য ইউপিতে জমা পড়েছে তিরানব্বই হাজার অ্যাপ্লিকেশন। তার মধ্যে প্রায় চারহাজার জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী।
এর ফল গিয়ে দাঁড়াচ্ছে নির্মমতায়, হিংসায়। আমাদের বোঝানো সহজ হচ্ছে যে আমার এই চাকরির সংকটের জন্য দায়ী আমার পড়শি। সে আছে, তাই চাপ বাড়ছে, তাই আমি চাকরি পাচ্ছি না। হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে রাগ। মাথার ওপর বসে থাকা লোকেরা এই রাগটার খবর রাখেন না, এমন নয়। তারা জানেন, ওই নীচের তলার দুপয়সা ওয়ালা পঞ্চাশজন যদি একজোট হয়, তাহলে ওই তিয়াত্তরটাকা ওয়ালা একজনের সমূহ বিপদ। তাই ক্রমাগত বিভিন্ন ইস্যুতে ঝগড়া লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে- ধর্মে ধর্মে, ভাষায়-ভাষায়, গায়ের রঙ-এ, আর নাগরিকে নাগরিকে। বোঝানো হচ্ছে, যত সমস্যার মূলে ওই মেক্সিকানরা, অতএব দেয়াল তোলো।
আমরা ভুলে যাচ্ছি, আসলে আমাদের কি প্রাপ্য ছিল। সাতমহলা বাড়ির ব্যালকনি থেকে মালিক ছুঁড়ে দিচ্ছে অর্ধভুক্ত মাংসের হাড়, আর নীচে দাঁড়িয়ে আমরা একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করছি কে কত উঁচুতে লাফ দিয়ে ওই ছুঁড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট লুফে নিতে পারব। যে আজকে মাংসের টুকরোটা পাচ্ছে, কাল সে লাফাতে পারছে আরেকটু বেশি। আর যে পারছে না, সে অক্ষম আক্রোশে কামড়ে ধরছে পাশের জনের ঘাড়।
যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নেই যে সার্ভাইভ্যাল অফ দ্যা ফিটেস্ট, জীবনে প্রতিযোগিতা করেই টিঁকে থাকতে হবে, কিন্তু নিরপেক্ষ প্রতিযোগিতার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাওয়া যাচ্ছে কি? প্রাইভেট এয়ারলাইন্স জেট এয়ারওয়েজ প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে দশহাজার কোটি টাকা দেনার দায়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে এসবিআই ও অন্যান্য সরকারি ব্যাংক শুধু সেই ঋণ মুকুবই করছে না, উপরন্তু আরও দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে। অন্যদিকে সরকারি বিএসএনএল ছাঁটাই করতে চলেছে তাদের পঞ্চান্ন হাজার কর্মীকে। একদিকে রাফায়েল ডিল পাচ্ছে দেনায় ডুবে থাকা অনিল আম্বানি, অন্যদিকে সরকারি সংস্থা হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল) চলে যাচ্ছে চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে। ইতিহাসে প্রথমবার কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য অন্যতম ধনী ও সফল সরকারি সংস্থা হ্যালকে বাজার থেকে ধার করতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু কেন হ্যালের এই অবস্থা? কি করে পৌঁছল ক্যাশ রিচ হ্যাল এমন অবস্থায়?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন