সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৪

লাল ফিতার ফাঁস ও কয়টা নিঝুম স্কুলবাড়ি ~ বিহঙ্গ দত্ত

২০১৫-১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের আমলে এসএসসি-র সবচেয়ে বড় এক্সামটা সংগঠিত হয়। তিনটে পার্টে শিক্ষক নিয়োগ করার কথা হয়েছিল। 

১) পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পোস্ট ফর ইলেভেন টুয়েলভ 
২) অনার্স গ্র্যাজুয়েট পোস্ট ফর নাইন টেন 
৩) প্লেন গ্র্যাজুয়েট পোস্ট ফর আপার প্রাইমারি 


এর মধ্যে আপার প্রাইমারির রেজাল্ট এখনও বের করতে পারেনি রাজ্য সরকার। আশা রাখছি ২০৫০-র মধ্যে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাবে। 

কিন্তু বাকি দুইটো প্যানেলের রিক্রুটমেন্ট হয়। একজন পরীক্ষার্থী হিসাবে আমিও ছিলাম অগুন্তি চাকুরিপ্রার্থীর ভিড়ে। নম্বর নেহাত মন্দ পাই নাই। কিন্তু ইন্টারভিউতে ডাক আসেনি। যাদের এসেছিল তাদের মধ্যে মুড়ি মিছরি বাছতে বসা আমার কম্ম না। কিন্তু কানাঘুষায় শুনি বেশিরভাগই ১০০% উত্তর করে এসেছে। প্রশ্নটা ঠিক ১০০% করে আসার মত ইজি ছিল না। কিংবা হয়তো ছিল। মধ্যমেধার মানুষ আমরা। এ বিপুলা পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি? 

 যাই হোক, রিক্রুটমেন্ট হল। তখন তৃণমূলের দ্বিতীয় টার্ম। বিরোধীপক্ষ পর্যুদস্ত। বিজয়রথ চলতে থাকল। আবারও কানাঘুষায় শোনা গেল দরদাম করা উচিত না। কেননা এ হল লাইফ সেটলমেন্ট। বাঁধা দামে বাঁধা চাকরি হচ্ছে। স্ল্যাব নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। সঠিক মূল্যে সঠিক জিনিস কিনে সর্বমোট (গ্রূপ সি, গ্রূপ ডি চাকুরিজীবী ধরে) ২৫০০০ মতো নিয়োগ হল। কেউ বা ঘরের কাছে। কেউ বা একটু ব্যাজার মুখে খানিকটা দূরে। আমরা বসে রইলাম আরেকবারের আশায়। আমাদের থেকেও মরিয়া ছিল অনেকে। তারা কোর্টে গেল। এরপরের ইতিহাস আপনারা গত আটবছরের ব্রেকিং নিউজে দেখে আসছেন। আলাদা করে বলার কিছু নেই। 


আজ আটবছর পার হয়েছে। আবারও একটা ঐতিহাসিক রায় এসেছে। আগেও অনেকগুলা এসেছিল। এই রায়দান কিছুটা বিশেষ কেননা এখানে কোর্টও আমার জায়গায় নেমে এসেছে। মুড়ি মিছরি বাছেনি। এর আগে এই রায় একবার সুপ্রিম কোর্টে গেছিল। ফিরে এসেছে। আজ আবার বছর ঘুরে ফিরে এল একই গেরোয়। তাদের হাতে তিনটে অপশন ছিল। 

১) যেরকম চলছে সেরকম চলতে দেওয়া 
২) যোগ্য অযোগ্য প্রার্থী বাছা 
৩) পুরা প্যানেল ক্যানসেল করা 

১ আর ৩ নং অপশন গ্রহণ করা  এক মিনিটের কাজ। ২ নং কাজই কঠিন। কিন্তু সেই কাজটি করানোর জন্যই লোকে কোর্টে যায়। 
আজ বিজেপির কোনও নেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন যে কী করা উচিত? বলবে প্যানেল আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ। সবকটারে ধরে ক্যান্সেল করা। 
তৃণমূলের নেতার কাছে যান। সোজা বলবে আমরা সততার প্রতীক। যেমন চলছে সেটাকেই স্বীকৃতি দেওয়া। 
সাধারণ মানুষের কাছে যান। যেটা শুনতে পাবেন সেটা হল যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি হোক। তাই নিয়েই আট বছরের লড়াই। 

কিন্তু কমিশন সেটা করতে দেবে না। কমিশন নিজেদের দায় এড়াবে। ঘোরাবে। যোগ্য প্রার্থীদের টেনে নামাবে অযোগ্যদের পাঁকে। ওএমআর বের না করার জন্য জান লাগিয়ে দেবে। কেননা নিজেদের মুখ পোড়াবার চাইতে, জেলের ঘানি টানার চাইতে হাজার হাজার চাকুরিজীবীকে যূপকাষ্টে তোলা অনেক বেশি সহজ। 

এত শত ঢাকাচাপা দেওয়ার পরেও ৫৫৭৩ জনের ঘাপলা ঢাকা যায়নি। তারা কেউ ফাঁকা ওএমআর দিয়ে চাকরি পেয়েছে। কেউ মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যানেল লিস্ট থেকে সুপার নিউম্যারিক্যালি ডাক পেয়েছে। কেউ বা দারুণ বুদ্ধি খাটিয়ে পেছনের র‍্যাঙ্ক থেকে লং জাম্প মেরে ঢুকেছে মেইন লিস্টে। এদের টাকা ফেরত দিতে হবে চাকুরিজীবনের। একশোবার ভালো হয়েছে। 

কিন্তু বাকিদের অভিযোগ কি প্রমাণিত? যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে আরও ২০০০০ র মধ্যে ১৫০০০ ই অযোগ্য এবং ঘুরপথে ঢুকেছে তারপরেও বাকি পাঁচ হাজারকে কেন এই নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে? কেন তাদের বারবার দেখে যেতে হবে স্টে অর্ডার পড়ল কিনা? তাদের সততার দাম নেই? সমাজের চোখে তারা যে নিচু হয়ে গেল এই মুহুর্ত থেকে এর কোনও দাম নেই? 

এই প্রত্যেকটা চাকুরিপ্রার্থীর সততাকে বেচেছে কমিশন। তাদের দাঁওয়ে রেখে অযোগ্যদের আড়াল করার চেষ্টা করে গেছে এবং যাচ্ছে। 
এবং আপনি! মহামান্য হাইকোর্ট! আপনারা এতদিন সময় পেয়েও সবরকম তদন্তের স্বাধীনতা পেয়েও এই কতিপয় সৎ চাকুরিজীবীকে সিকিওর করতে পারেননি। অতটা চাপই দিতে পারেননি কমিশনকে। 

এই সব লেখার পর একটু থামতে হল। খানিক মনোবল জোগাতে লাগে। কেননা বাকি গল্পটা বড্ড করুণ। এই রায়ে আবার স্টে অর্ডার পড়বে। তারপর আবার একটা দুটো। শেষ অব্দি হয়তো চাকরি যাবে অনেকের। কিংবা কয়েকজনের। লাল ফিতার ফাঁস আরও কড়া হয়ে বেড়ি পড়াবে স্কুলশিক্ষাকে। গান্ধীমূর্তির পাদদেশের চাকুরিপ্রার্থীরা কাঁদছিলেন এক অদ্ভুত প্রতিহিংসায়। তারা জ্বলেছেন এতদিন। আজ জ্বলতে দেখছেন তাদের ভাত মারা সেইসব অযোগ্যদের। কিন্তু তারপর? বারকয়েক সাংবাদিকরা এই প্রশ্নটা করায় এক মুহূর্তে শূন্যতা নামল চোখে। প্যানেল ক্যানসেল হচ্ছে। প্যানেল ক্যানসেল? না, এতদিন যে ওএমআর পাওয়া যায়নি সেটাকে নাকি খুঁজা আনার ব্যবস্থা হচ্ছে। তাহলে এতদিন হয়নি কেন? এই রায় দিতে হল কেন? 
এরপর? এদের আর সেই বয়স নেই। সেই খাটার ক্ষমতা নেই। সেই যোগ্যরা যাবে কোথায় যারা বসে আছে? অপেক্ষা করবে আর একটা ন্যায় বিচারের? আরও কোনও ধর্ণামঞ্চে? 

আর বসে থাকবে কিছু আধফোটা মুখ। নিঝুম স্কুলবাড়িতে বিকালের ছায়া দীর্ঘ হয়ে আসবে। শিক্ষক নেই। শিক্ষক নেই বলে ছাত্র নেই। ছাত্র নেই বলে শিক্ষক নেই। এই ক্রমান্বয়ী লুপে কতগুলো পরিবারের রমেশ, আলতাফ, রাবেয়া, রোকসানারা মোট বাঁধবে পরিযায়ী হওয়ার জন্য। ফেলে রেখে যাবে পেন-পেন্সিল, পড়াশুনার বইপত্র, ঘরের আঙিনা আর প্রিয় বাংলাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন