অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা একটুখানি ফাঁক হল। সেই সামান্য ফাঁকটুকু আড়াল ক'রে কবি এসে দাঁড়ালেন। মুখে চোখে কেমন যেন ভয়-ভয় ভাব। টুকরো টুকরো এমন কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন যা প্রায় অর্থহীন স্বগতোক্তির সামিল। কথোপকথন হোঁচট খেতে খেতে আর এগোতে পারল না। দরজা থেকেই ফিরে আসতে হল। জীবনানন্দের সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে গিয়েছেন তাঁদের অনেকেরই প্রাথমিক অবস্থা এই রকম।
আজ থেকে ষোল বছর আগে ১৯৫২ সালের একটি সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে। আমরা তিন বন্ধু––নরেশ গুহ, অশোক মিত্র, আর আমি একরকম জোরজার করে ঢুকে পড়েছি জীবনানন্দ দাশের ল্যান্সডাউন রোডের ভাড়াটে বাড়িতে। কবি থাকেন একতলার কোণের একটি ঘরে। একাই থাকেন। সম্পূর্ণ নিরাভরণ ঘর। একটি তক্তাপোষ, যৎসামান্য শয্যা, এককোণে কুঁজোভর্তি জল আর এককোণে একরাশ খবরের কাগজ। ঘরের সামনে চওড়া বারান্দা, একটুকরো জমি, নিমগাছ। অনুরোধের অপেক্ষা না রেখেই আমরা বারান্দায় বসে পড়লাম। চেয়ার, মোড়া বা মাদুরে নয়, স্রেফ সিমেন্টের উপরে। কবিও বাধ্য হয়ে আমাদের পাশে হাঁটু মুড়ে বসলেন। গায়ে গেঞ্জি।
এই তবে জীবনানন্দ দাশ? এমন সাদামাঠা, মফঃস্বলের যে কোনও প্রৌঢ়ের মতো এত সাধারণ? আমি রিপন কলেজের ছাত্র। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়––এই তিনজন আধুনিক কবিকে তাঁদের যৌবনকালে শিক্ষক হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি পোষাকে-পরিচ্ছদে তাঁরা কত ছিমছাম, আচারে ব্যবহারে কী শৌখিন, কত সাবধান, কিছুটাবা উন্নাসিক। নিখুঁত সাহেবী পোষাক পরা অনিন্দ্যকান্তি কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকেও দেখেছি। সুতরাং আধুনিক কবিদের অন্যতম জীবনানন্দের চেহারা সম্বন্ধে মনের মধ্যে মোটামুটি একটা ছবি আঁকা হয়েই ছিল। বলাবাহুল্য, জীবনানন্দকে দেখে সে ছবিটা মুহূর্তেই চুরমার হয়ে গেল।
কিন্তু কি আশ্চর্য তার জন্যে মোটেই দুঃখ পেলুম না। বরং আশ্বস্ত হলুম এমন একজন কবিকে দেখতে পেয়ে যাঁর কোন মুখোশ নেই, যাঁর কাছে হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায়, যাঁর সঙ্গে কথা বলার আগে ভেবে নিতে হয় না কি বলব। যাই হোক, কোনরকম ভণিতা না করে আমরা সরাসরি দাবী জানালুম, 'আপনার মুখ থেকে কবিতা শুনতে চাই।'
জীবনানন্দ কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠলেন। এড়িয়ে গেলেন আমাদের অনুরোধ। আমরাও নাছোড়বান্দা, কবিও অনড়। শেষ পর্যন্ত এক কাণ্ড করে বসলুম। শুরু করলুম জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করতে। কখনো একক, কখনোবা যৌথভাবে একনাগাড়ে দেড় ঘন্টা দু-ঘন্টা ধরে জীবনানন্দের একটির পর একটি কবিতা আমরা আবৃত্তি করে চললাম। বই দেখে নয়, মন থেকে। অশোক মিত্র থামেন তো আমি ধরি, আমি থামি তো নরেশ গুহ। কোথাও আঁটকে গেলে একে অন্যকে সাহায্য করি।
স্পষ্টই বোঝা গেল জীবনানন্দ অভিভূত হয়ে পড়েছেন; বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তরুণ কবিরা তাঁর কবিতা এত যত্ন নিয়ে, এত আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠ করে। চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের প্রত্যেকটি কবির উপর যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, অনেককেই অনেক দিন ধরে আড়ষ্ট, আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, নিজের কবিতা সম্বন্ধে তাঁর মনে এত দ্বিধা ছিল কেন? ছিল একাধিক কারণে, নিজের অগণিত পাঠকদের সঙ্গে জীবনানন্দের কোন যোগাযোগ ছিল না। তাঁর না ছিল দল, না ছিল শিষ্য, না ছিল নিজস্ব কোন পত্রিকা। বলতে গেলে কলকাতার বাইরে বাইরেই জীবন কাটিয়েছেন। সভা সমিতিতে পদার্পণ করেছেন ক্বচিৎ কদাচিৎ অনেক টানাহেঁচড়ার পর, তাও জীবনের শেষ দুটো বছরে। তাই জীবনানন্দ জানতেন না, জানবার তাঁর কোন উপায় ছিল না যে রজনীগন্ধার মতো নিজের অগোচরে তিনি হাজার পাঠকহৃদয় স্বপ্নে ভরে রেখেছিলেন। নিজের কবিতা সম্পর্কে তাঁর সংকোচের আরো কারণ ছিল। প্রভাবশালী রক্ষণশীল দল যে তাঁর কবিতা পছন্দ করে না। তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে থাকে একথা তিনি জানতেন। আর এটাও তিনি পরম দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন যে এক বুদ্ধদেব বসু ছাড়া তিরিশের যুগের কোন কবিই তাঁকে বিশেষ আমল দেননি।
যাই হোক, ১৯৫২ সালের সেই স্মরণীয় সন্ধ্যায় শেষ পর্যন্ত আমাদের জিৎ হয়েছিল। জীবনানন্দ দাশ কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন আমাদের বনলতা সেন এবং আরো কয়েকটি কবিতা। আবৃত্তি কেমন করেছিলেন মনে নেই। শুধু মনে আছে, আবৃত্তিকালে তাঁকে আর সাধারণ মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না। বারান্দার সেই অস্পষ্ট অন্ধকারে আমরা জীবনানন্দের চোখে এক অপার্থিব আলোক দেখতে পেয়েছিলাম। অবিস্মরণীয় সেই চোখ, সেই দৃষ্টি, গভীর, উজ্জ্বল, বাঙময়।
বাস্তবিক, জীবনানন্দের মতো এমন সহজ সরল নিরহঙ্কারী অথচ অতিরিক্ত আত্মসচেতন স্বভাব লাজুক মানুষ অল্পই চোখে পড়ে। একবার মনে আছে, কোন একটি পত্রিকার জন্য তাঁর কাছে একটি কবিতা আনতে গিয়েছিলাম। আমি আর আমার বন্ধু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আগে থাকতেই খবর দেওয়া ছিল তাই দরজা থেকে বিদায় নিতে হয়নি। মনে পড়ে, কোন বাক্য বিনিময়ের আগেই কবি একটি খাম আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। খামের মুখ খুব শক্ত করে আঁটা। জীবনানন্দের কবিতা সম্বন্ধে আমাদের তখন অসীম আগ্রহ, নতুন কবিতাতে তো আরো বেশি। তাই তাঁর সামনেই খামটা খুলতে চেষ্টা করলুম! কবি হা-হা করে উঠলেন। হাত চেপে ধরলেন। কিছুতেই তাঁর সামনে খামটি খুলতে দিলেন না। কিছুতেই না। আমরা পরে রেঁস্তরায় বসে কবিতাটি পড়েছিলাম।
জীবনানন্দ একা একা তাঁর মনোজগতে বাস করতেই ভালোবাসতেন। মনুষ্য সঙ্গ, বিশেষ করে কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গ, যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। তাদের সঙ্গে কিছুতেই সহজ––স্বাভাবিক হতে পারতেন না। তাই বলে ঘরে খিল এঁটে বসে থাকার লোক ছিলেন না তিনি। তাঁর নেশাই ছিল মানুষের ভিড়ে ঘুরে বেড়ানো। নিজেই দ্রষ্টব্য হয়ে পড়লে আর দর্শক থাকা যায় না। তাই কবি পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মবেশীর মতো ঘুরে বেড়ানোই হয়তো জীবনানন্দের পছন্দসই ছিল। হেঁটে হেঁটে দেখেছেন বলেই হয়তো মানুষ এবং প্রকৃতিকে অমন নিবিড়ভাবে তিনি চিনতে পেরেছিলেন; অনেক অনেক বাস্তববাদী কবির চাইতেও বিভিন্ন স্তরের মানুষকে খুব কাছ থেকে আরো খুঁটিয়ে দেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। গ্রামের মাঠে, নদীকূলে যেমন, তেমন এই শহরের অলিগলি––ফিয়ার্স লেন, টেরিটি বাজার কি চেতলার হাটও তাঁর অনধিগম্য ছিল না। এমন কি রাস্তার ভিখিরিদের জীবনযাত্রার খুঁটিনাটিও তাঁর চোখ এড়ায়নি। এই পথ চলার অভিজ্ঞতা তাঁর বিভিন্ন কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে।
........... >...
জীবনানন্দের হাঁটার কায়দাটাও অদ্ভুত ছিল। কোঁছাটাকে প্রায় হাঁটুর উপর পর্যন্ত তুলে, রাস্তায় যেন খুব জল জমেছে এমন ভঙ্গিতে, পথ চলতেন তিনি। কেমন যেন ধ্যানস্থ। পরিচিত জনকে এড়িয়ে চলতেন, দেখতে পেলেই চলার গতি অকস্মাৎ বাড়িয়ে দিতেন। কিংবা ঢুকে পড়তেন আশপাশের অলিগলিতে অথবা চলে যেতেন নাগালের বাইরে সটান অন্য ফুটপাথে। একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেলে, ধরা পড়ে গেছেন এমন একটা ভাব ফুটে উঠত তাঁর চোখে। সাহিত্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন না। বলতেন, ''একটা বাসা খুঁজে দিতে পারেন?" ইতর প্রতিবেশী তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
একটু বেশি রাতে, অনেক সময় প্রায় একটা দুটো অব্দি, দক্ষিণ কলকাতার লোকাঞ্চলে প্রায়ই তাঁকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। কোন কোন দিন মৌন সঙ্গী থাকত কেউ, অধিকাংশ দিনই একা একা। বেশ কয়েক বার সন্দেহবশত পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে টালিগঞ্জ থানায়। থানা অফিসার কবিকে চিনতেন। জীপে করে আবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছেন। জীবনানন্দের নৈশভ্রমণের একজন সঙ্গী্র কাছে শুনেছি মাঝে মাঝে কবি ছেলেমানুষের মতো ব্যবহার করতেন। এখন যেখানে রবীন্দ্র স্টেডিয়াম সেইখানে অন্ধকার মাঠের মধ্যে রেলিং টপকে ঢুকে পড়তেন। ভাঙা ডালপালা কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিতেন পার্শ্ববর্তী কোন গাছের শাখা লক্ষ্য করে। কয়েকটা কাক বা চড়ুই চিৎকার করে উড়ে যেত। কবি বলতেন––'চুপ, চুপ।'
'দেখতে পাচ্ছ?'
'কি আবার দেখব?'
'দেখছ না অন্ধকারে সমুদ্রে কেমন ঢেউ উঠেছে? কেমন স্পষ্ট ঢেউ! দেখছ না হাওয়ার রঙ?' বলেই একেবারে স্তব্ধ হয়ে যেতেন। ভীষণ গম্ভীর।
পরদিন দেখা হলে বলতেন, 'কাল গাছটাকে লক্ষ্য করে ঢিল না ছুঁড়ে মরা ডাল ছুঁড়লুম কেন বলতে পারো?'
'না তো।'
'ঘুমের মধ্যে শরীরে প্রিয়জনের হাত এসে লাগলে ঘুম ভাঙে না কিন্তু অপরিচিতের স্পর্শে আঁতকে উঠি আমরা। ইঁট ছুঁড়লে ঘুমন্ত গাছটা ভয়ে চিৎকার করে উঠত।' বলেই হা-হা করে হেসে উঠতেন। জীবনানন্দের সেই না-থামা বিখ্যাত হাসি।
বাংলাদেশের গাছপালার প্রতি কবির পক্ষপাত এতই প্রবল ছিল যে এ ব্যাপারে তাঁর বাছবিচার ছিল না। এমন কি পুঁই গাছের ফুলও তাঁর ভালো লাগত। ছোটবেলায় তাঁর শখের পুঁইগাছটা কেটে কেউ চচ্চড়ি রেঁধেছিল বলে ভাত খাওয়া বন্ধ করেছিলেন তিনি। এ গল্প অনেকের কাছেই শোনা যায়। জীবনানন্দের একটা নেশা ছিল রাতের পর রাত জেগে তন্ময় হয়ে ফুল ফোটার রহস্য উপভোগ করা। কেমন করে পাপড়িগুলো আস্তে আস্তে কাঁপতে কাঁপতে এই একটুখানি খুলে যাচ্ছে, বন্ধ হচ্ছে, আবার খুলে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে, অবশেষে ভোরের আলোয় ফুল হয়ে ফুটে উঠছে–-এসব খুঁটিনাটি দেখতে কবি বিশেষ ভালোবাসতেন।
নিজেকে দ্রষ্টব্য করে তোলার অশ্লীলতা জীবনানন্দকে স্পর্শ করেনি, তাঁর প্রতি নয়, তাঁর কবিতার প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হোক––এটাই তিনি চেয়েছিলেন। দাড়ি কামিয়ে এবং ঈষৎ গোঁফ রেখে, আর কোনরকম নেশাভাঙের মধ্যে না গিয়েও আধুনিক কবিদের তিনি বশীভূত করেছেন! আশ্চর্য নয় কি? আমার মনে হয় চল্লিশের কবিরা অনায়াসে দাবি করতে পারেন যে তাঁরাই জীবনানন্দকে তাঁর যথাযোগ্য স্থানে স্থাপন করেছেন। তিরিশের কবিরা বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে বাদ দিয়ে বলছি, জীবনানন্দকে সহ্য করেছেন কিন্তু স্বীকার করেননি। তাই, যদিও 'ধুসর পাণ্ডুলিপি' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালে, প্রাপ্য প্রতিষ্ঠা এবং স্বীকৃতির জন্য জীবনানন্দকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আধুনিক কবিতার ইতিহাসে ১৯৪২ সালটি উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এই বছরেই কবিতাভবন থেকে এক পয়সার একটি সিরিজে জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' প্রকাশিত হয়। চার আনা দামের মাত্র ষোল পাতার এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে , বিশেষ করে তদানীন্তন তরুণ কবিদের মধ্যে এক নিদারূণ উত্তেজনা ও আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। কলেজে, কফি হাউসে, কথোপকথনে, চিঠিপত্রে তরুণ কাব্যানুরাগীদের মধ্যে জীবনানন্দ ছাড়া আর কোন আলোচ্য ছিল না। জীবনানন্দ প্রেমিক আমার এক বন্ধু একাই বনলতা সেনের কুড়ি, পঁচিশ কপি কিনে বন্ধুমহলে বিতরণ করেছিলেন বলে মনে পড়ে। অনেক অনেক গভীর রাত্রে মোমবাতির অস্পষ্ট আলোয় যূথবদ্ধভাবে আমরা জীবনানন্দের কবিতা পড়েছি। হয়তো একই কবিতা কিন্তু বারবার বারবার। হরিণেরা জানে তাহা!
[ লেখাটা ১৯৬৮তে কলকাতা বেতার কেন্দ্রে পঠিত... ]
বানান অপরিবর্তিত রয়েছে। সংগ্রাহকের জন্য শুভেচ্ছা, নাম মনে নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন