সাধারণভাবে বামপন্থা বিশ্বাস করে সমানাধিকারে, সামাজিক সমতায়। শক্তি ও সম্পত্তির অত্যধিক পার্থক্য যখন কমে আসে, তখনই আসতে পারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ক। আর তখন মানুষের পূর্ণ বিকাশ ঘটা সম্ভব। এই হলো মূল কথা।
বামপন্থীদের চওড়া বর্ণালীতে আছে বিভিন্ন লেবার পার্টি, কম্যুনিষ্ট পার্টি, সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি, সোশালিষ্ট পার্টি, গ্রীন পার্টি অথবা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তারা হয়ত কোন নির্দিষ্ট পার্টি পলিটিক্সের সাথে যুক্ত নন, তবে বামপন্থী চিন্তার বিকাশে কাজ করে চলেছেন।
বামপন্থীদের বিশেষ অবদান আছে সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে। পৃথিবীর বহু দেশে মানুষকে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা থেকে বার করে নিয়ে এসে প্রগতিশীল চিন্তা, অর্থনৈতিক সাচ্ছল্য ওরা দিয়েছেন। এমনকি কট্টর ডানপন্থীরা জানেওনা তারা আজ অনেক বাম চিন্তার উত্তরসূরী। সমাজ সমষ্টিগত ভাবে সেই কাজের সুফল গ্রহণ করেছে।
যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম আক্রমণ করে তখন সেই স্বচ্ছাচারী শক্তিকে বাঁধা দেয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ভিয়েতনামের আপামর জনগণ। সেই লড়াই হয়েছিল নাপাম বোমার বিরুদ্ধে শরকাঠি নিয়ে। কিভাবে জিতল দরিদ্র দেশের সামরিক শক্তিহীন মানুষ? সেই লড়াই সম্ভব হয়েছে কারণ আমেরিকার বব ডিলান, জন লেনন বা পিট সিগার গিটার নিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে পৃথিবী জুড়ে গান গেয়ে নিজের কণ্ঠ দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। সেই সুর ঢেউ তুলেছে কলকাতার বুকে কয়ারগুলিতে, ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। ভিয়েতনামের জনগণ একা এই লড়াই করে নি, ওদের পশে দাঁড়িয়েছে সমগ্র পৃথিবীর ছাত্র ও যুবকরা, আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছে বামপন্থীরা।
ভিয়েতনামিজদের সাথে বুক পেতে বুলেট নিতে হয়েছে জন লেননকেও।
১৯৪৩ সালে, বিশ্ব যুদ্ধের সময়কালে, বাংলায় এক অভূতপূর্ব মন্বন্তর হয়। বৃটিশ সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে একদা দেশের খাদ্যভাণ্ডার অবিভক্ত বাংলায় ৫% মানুষ প্রাণ হারায়। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ আগস্ট মাসে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করার ডাক দেয়। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পরিণত হয় হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায়। দাঙ্গা বিধস্ত কলকাতায় সেদিন বামপন্থী কৃষকসভা তেভাগা আন্দোলনের ডাক দেয়। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত শেষকথা নয়, মানুষকে তার রুটিরুজির জন্য আন্দোলনে ফিরে আসতে সাহায্য করে বামপন্থীরাই।
পৃথিবীতে যত নাগরিক অধিকার আন্দোলন, নারী রক্ষার আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, সমকামীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের আন্দোলন হয়েছে, জানবেন পিছনে আছে বামপন্থীরা।
অভিবাসীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যত আন্দোলন হয়েছে, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছে উন্নতদেশের সোশালিস্টরা, বামেরা। ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশে এই ভারত, বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীরা অপেক্ষা করে কখন লেবার সরকার আসবে, ওরা নাগরিক অধিকার পাবে।
এদেশে প্রথম পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠা করে বামেরা, দেশে প্রথম ক্ষমতা নিম্নতম স্তরে পৌঁছে যায়। নিম্নতম শ্রেণীর মধ্যে অধিকার সচেতনতা আনে বামেরা। নূন্যতম মজুরীর লড়াই করেছে ওরা। আজকে যারা স্কুল কলেজে চাকরি করে তারা ভাবতেও পারবেনা, ঠিক এক প্রজন্ম আগে আমাদের মা, মাসিরা কি টাকা পেতেন ওই শিক্ষকতার চাকরি করে।
এই দশ বছর আগেও কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার প্রগতিমূলক যে কাজগুলি করেছে, যেমন Right to Information Act, তার পেছনে আছে বামেরা।
এমনকি এই সেদিন কেরালার সাবরিমালাতে সেখানকার বাম সরকার নিজেদের ক্ষমতাকে বাজি রেখে মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশের পক্ষে দাঁড়াল।
আর কোন মতাদর্শগত গ্রুপের কথা চিন্তা করতে পারেন যারা নিজের ক্ষমতার এক চুল অধিকার ছাড়তে রাজি হয় নারীর অধিকার রক্ষার জন্য?
তাই বামপন্থীদের কাজটা সবসময়েই ছিল কঠিন। কারণ তারা ভেসে যায় না, মানুষকে ভাসিয়ে দেয় না, তারা গঠন করে। নিজেরা চিন্তা করে, মানুষকে চিন্তা করায়। তারা কঠিন কাজটার দায়িত্ব নেয়।
ভেবে দেখুন, কোন কাজটা কঠিন?
· ১৯৯০তে এক রথযাত্রা করে মানুষকে উত্তেজিত করা ও দাঙ্গা বাঁধাতে উস্কানি দেওয়া নাকি সেই দাঙ্গা মানুষের মধ্যে যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার প্রতি দায়বোধ? সারা পৃথিবীতে সমস্ত দেশে যদি একজনও বামপন্থী থাকে সে দাঁড়িয়েছে সেই দেশের সংখ্যালঘু মানুষের পক্ষে।
·তুরস্কে আইয়া সোফিয়া গির্জা তথা মিউজিয়াম মসজিদে পরিবর্তিত করা নাকি ওই তুরস্কের মেয়ে হেলিন বোলিকের ওই দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৮৮ দিন অনশনের শেষে মৃত্যুবরণ?
· মসজিদে বোমা মেরে অসহায় মানুষ খুন নাকি বিধ্বংসী ঘৃণা রুখতে ক্রাইস্টচার্চ পর্বের পরে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা আর্ডেনের মানবিক পদক্ষেপ?
মতাদর্শগতভাবে জ্যাসিন্ডা সোশ্যাল ডেমোক্রাট আর হেলিন ছিলেন কমিউনিস্ট।
সমাজে ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য বেড়েই চলেছে। এই কোভিদকালে সেই বৈষম্য রকেটের গতিতে বেড়েছে। সেই ব্যর্থতার দায় শাসকবর্গ নেয় না, তার ব্যর্থতার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে আমদানি করে ঘৃণার রাজনীতি, বিভেদের রাজনীতি। মানুষ একে অপরকে তীব্রতর ঘৃণা করে। এই ঘৃণা যত বাড়বে ততই দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে সামাজিক বৈষম্যের কথা, দারিদ্রের কথা।
মিশর থেকে ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স থেকে ভারতবর্ষ, ইরান থেকে বাংলাদেশ - দেশ, কাল, ধর্ম, জাত ব্যতিরেকে ঘৃণার বিরুদ্ধেএই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে বামেরা।
মিসরে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের রক্তপাত হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া লক্ষ বামপন্থী রক্ত দিয়েছে, তবু লড়াই করে গেছে। তারা ভোটার কথা ভাবেনি, মানুষের কথা ভেবেছে।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও তারা এগিয়ে এসেছে। আবার তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। লড়াইয়ের ময়দানে থাকতে হবে।
কারণ এই কাজ কোন আঞ্চলিক ক্ষুদ্রস্বার্থসম্পন্ন দল করবে না। ভোট শেষ কথা নয়, ২০১৯ এর ভোট নয়, ২০২১ এর ভোটও নয়।
মূল কথা মানুষকে সঠিক আন্দোলনে নিয়ে এসে তার অবস্থার উন্নতি ঘটান, সমাজের বিভেদ ঘোঁচানো।
এখানে হতাশার কোন জায়গা নেই, কিসের হতাশা? মনে রাখতে হবে সোভিয়েত পরবর্তী সময়েও, এই ২০০৪ সালে, BBC Radio 4-এ ভোটে কার্ল মার্কস সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে শীর্ষ স্থান পায়।
বামপন্থা আছে। আছে মানুষের মনে, মননে। মানুষ ক্লান্ত, তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে বামপন্থীদেরই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন