বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২০

"ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন" ~ সুশোভন পাত্র

কি বললেন? 
'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন'? তাই বলুন, আমি শুনলাম গৌরি লঙ্কেশ! 
দামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অপদার্থ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, লেজে-গোবরে অর্থমন্ত্রী, মেলোড্রামাটিক টেক্সটাইল মন্ত্রী -সবাই নাকি আজকে কেজি দরে টুইটারে অর্ণব গোস্বামীর 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন'র ঘুঁটে দিয়েছেন। তা বেশ করেছেন! তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশে 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন' থাকবে না? এ কেমন অলুক্ষণে কথা!  
কি বললেন? 'মিডিয়ার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ'? উরিব্বাস, আমি শুনলাম এম এস কালবুর্গি!
অর্ণব গোস্বামী গ্রেপ্তার হয়েছে বলে ভারতের 'স্বাধীন নিরপেক্ষ মিডিয়ার' পবিত্র দুধে চোনা পড়ে গেছে? ইস! কি লজ্জার ব্যাপার! এমনিতেই দেশের 'প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স' গত ১০ বছরে ১০৫ থেকে ১৮০ দেশের মধ্যে ১৪২-এ এসে ঠেকেছে। সো হোয়াট? পাকিস্তানের থেকে ৩ ধাপ উপরে! 
'অর্ণব গোস্বামী', 'বিজেপি' আর 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন', 'প্রেস ফ্রিডম' - শব্দগুলো নিয়ে ক্রশওয়ার্ড খেলতে খেলতে বিকেলের চায়ের আড্ডায় নরেন্দ্র দাভোলকার খুব হেসেছেন। ওহ ওয়েট! 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন'-র সাক্ষাৎ অবতার আপনি কিনা নরেন্দ্র দাভোলকার কে চিনতে পারছেন না? আচ্ছা, মনে করিয়ে দিচ্ছি! 
মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে পুনের ওমকারেশ্বর মন্দিরের কাছে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল হিন্দু ধর্মের জাত-পাত, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার সৈনিক দাভোলকার কে। আর কালবুর্গি বলেছিলেন, "হিন্দু দেবদেবীরা মোটেও মহাশক্তিধর নন"। বলেছিলেন, "হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় আচার আসলে সমাজ শোষণের যন্ত্র"। আর তাই কর্ণাটকের ধারওয়াড়ে, নিজের বাড়িতেই প্রকাশ্য দিবালোকে, খুন হতে হয়েছিল কালবুর্গি কে। 
জানেন, গৌরি লঙ্কেশও সাংবাদিক ছিলেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার কর্পোরেট পাপেট গিরি ছেড়ে কান্নাড় ভাষায় চালাতেন সাপ্তাহিক, 'লঙ্কেশ পত্রিকা'। অপরাধ? বুজরুগির   মুখোশ খুলে দিতেন হিন্দুত্ব ও সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শের। আর তাই বৃষ্টি ভেজা ব্যাঙ্গালুরুর স্নিগ্ধ সন্ধ্যায়, রাজরাজেশ্বরী নগরের ফ্ল্যাটে, তাঁর মাথায়, গলায় আর বুকে; তিনটে গুলি গেঁথে দিয়েছিল আততায়ীরা। 
ফরেনসিক জানিয়েছিল কালবুর্গি আর লঙ্কেশ কে খুন করা হয়েছে একই পিস্তলে। পুলিশি রিপোর্ট বলেছিল 'একই গ্রুপের দুষ্কৃতীরা রয়েছে দাভোলকার-কালবুর্গি-লঙ্কেশ খুনের নেপথ্যে'। নব্য ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডাররা একটু ঘেঁটে দেখবেন নাকি, সেদিন আমাদের দামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অপদার্থ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, লেজ-গোবরে অর্থমন্ত্রী, মেলোড্রামাটিক টেক্সটাইল মন্ত্রীরা টুইটারে কতটা শোক প্রকাশ করেছিলেন? 
শুনেছি হিন্টস দিলে ট্রেজার হান্টে সুবিধা হয়। দিচ্ছি। সেদিন বজরং দলের নেতা, ভুবিথ শেট্টী, কালবুর্গির মৃত্যুতে জান্তব উল্লাসে টুইট করেছিলেন—"হিন্দুত্ব কে নিয়ে তামাশা এবং একটি কুকুরের মৃত্যু।" হিন্দুবাদী টুইটার হ্যান্ডল, যাকে 'ফলো' করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, সেই নিখিল ধাদিচ গৌরি লঙ্কেশের মৃত্যু তে লিখেছিল "এক কুতিয়া কুত্তে কি মউত ক্যায়া মারি, সারে পিল্লে এক সুর মে বিলবিলা রহে হ্য।' আর অর্ণব? নাইট-শো তে বাণী দিয়েছিলেন, 'গৌরি লঙ্কেশের মৃত্যু পারিবারিক মনমালিন্যর কারণে।' কিউট না? হতেই হবে, 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন' বলে কথা! 
'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের' আবার ভ্যারাটিস ডিজাইন আছে। এই তো ৫ই অক্টোবর, সিদ্দিকি কাপ্পান, মালায়ালাম নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক কে হাথরাস ধর্ষণ কাণ্ডের রিপোর্টিং–র অপরাধে UAPA ধারায় গ্রেপ্তার করল উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। এই তো ১২ই সেপ্টেম্বর ত্রিপুরার সাংবাদিক পরাশর বিশ্বাস কে আক্রান্ত হতে হল বিপ্লব দেবের সমালোচনা করার জন্য। মনিপুরের সাংবাদিক কিশোরেচন্দ্র ওয়াংখেম কে মনে পড়ে? 'দেশদ্রোহিতার' অভিযোগে যাকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে দুবার। এছাড়াও উত্তর প্রদেশের সাংবাদিক প্রশান্ত কানোজিয়া, আসামের রাজীব শর্মা, গুজরাটের ধ্রুভল প্যাটেল, হরিয়ানার নরেশ খোয়াল, দিল্লির রাজীব শর্মা এদের সবাই কে গ্রেপ্তার করেছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিজেপি পুলিশ। হয় UAPA আর না হয় দেশদ্রোহিতার' অভিযোগে। 
তা তখন বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের' টুইট গুলো কোন চিলে-কোঠায় তোলা ছিল বলতে পারেন? নর্থব্লকের ছাদে না আম্বানির ২৬তলা ফ্ল্যাটের রুফ টপে? না বিজেপির ব্যবসায় 'all journalist are equal but Arnab Goswami is more equal than others'? 
স্বাধীনতা আন্দোলনের গর্ভে মিডিয়ার জন্ম এদেশে ১৮৬০-এ। মাত্র ১৮ বছরে ভারতের জাতীয়তাবাদী মিডিয়া জনমানসে ব্রিটিশ'দের বিরুদ্ধে ক্ষোভ কে এমন সঙ্ঘবদ্ধ ও সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল যে ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ লর্ড লিট্টন Vernacular Press Act' প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছিল ভারতীয় মিডিয়ার 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের' খর্ব করতে। লন্ডনের রয়টার্স এজেন্সি SHM Merryweather কে স্রেফ ভারতের মিডিয়ার মোকাবিলা করতে 'স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট' হিসেবে এদেশে পাঠিয়েছিল। সেইসময় ভারতের মিডিয়ার প্রতিনিধিত্ব করতেন গান্ধী, বাল গঙ্গাধর তিলক, আম্বেদকার, লালা লাজপত রায়'রা। 
আচ্ছা বুকে হাত রেখে বলুন তো, এই নাম গুলোর সাথে সাংবাদিক হিসেবে অর্ণব গোস্বামী, সুধীর চৌধুরীর মত দালালদের নাম উচ্চারণ করতে আপনার জিভ জড়িয়ে যায় না? লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসে না?   
মিডিয়ার গণতন্ত্রে মিডিয়ার ভূমিকার দিশা নির্ধারণে ১৯৫৪ এবং ১৯৮৮ সালে আমাদের দেশে দুটো প্রেস কমিশন গঠিত হয়েছিল। দুটো কমিশনই রিপোর্টে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিল, কর্পোরেট পুঁজির মালিকানা আটকাতে না পারলে মিডিয়ার স্বাধীন নিরপেক্ষ ভূমিকা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না। অমিত শাহদের 'প্রেস ফ্রিডম' কিম্বা 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন' নিয়ে দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম না হলে ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করছেন না কেন? অর্ণব গোস্বামী, সুধীর চৌধুরীরা মিডিয়া তে কর্পোরেট পুঁজির মালিকানার বিরুদ্ধে দুটো প্রাইম টাইম ডিবেট নামাচ্ছেন না কেন?
তাই সিলেক্টিভ প্রতিবাদের হিপোক্রিসি করবেন না প্লিজ! যদি আপনি 'ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের' পক্ষে হন, তাহলে দাভোলকার-কালবুর্গি-লঙ্কেশের খুনের সঠিক তদন্তের দাবী তে সোচ্চার হবেন না কেন? উমর খালিদ, সাফুরা জারগরদের জেলে যেতে হবে কেন? ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নাভলাখারা সরকারের বিরুদ্ধে লিখলেই 'আরবান মাওইস্ট' দাগিয়ে দেওয়া হবে কেন? নেহা দীক্ষিত জীবন বাজি রেখে আউটলুক পত্রিকায় উত্তর পূর্ব ভারতে RSS চাইল্ড র‍্যাকেটিং-র সাহসী খবর করলে কিম্বা রায়া আয়ুব গুজরাট ফাইলসের পাতায় সাহেব-গোলামের মুখোশ খুলে দিলে বিজেপি পুলিশ লেলিয়ে দেবে কেন?
আর শুনুন, চিটিংবাজ সাংবাদিক আমরাও অনেক দেখেছি। 'এক ফোনে একলাখ'-র সাংবাদিক দেখেছি, বুদ্ধবাবুর খুঁত ধরা ভুবনেশ্বরের জেলে ঘানি টানা সাংবাদিক দেখেছি, মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সফরে গিয়ে 'চামচ চোর' সাংবাদিকও দেখেছি। তাই অযথা অর্ণব গোস্বামী কে শহীদ বানানোর চেষ্টা করবেন না। উনি গ্রেপ্তার হয়েছেন সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে খবর করে না। তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে নিশ্চয় ছাড়া পাবেন। রিয়া চক্রবর্তীর 'উইচ হান্ট' হ্যান্ডলের অভিজ্ঞতা থেকে উনি নিজেও সেটা জানেন। 
তাই আপনারা অযথা আবেগতাড়িত হবেন না। উনি যতক্ষণ জেলে থাকেন ততক্ষণই লাভ। ওনার গলাটাও রেস্ট পাবে। কালীপূজাতে শব্দ দূষণও কম হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন