সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

কলকাতার ভাতের হোটেল ~ অর্ক ভাদুরী





বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, করোনা আর লকডাউনের মাঝে কলকাতার ভাতের হোটেলগুলো কেমন আছে একটু খোঁজখবর নেব। আসলে, কয়েক মাস আগেও আমার কাছে চারবেলার খাওয়াদাওয়াটা ছিল অ্যাডভেঞ্চারের মতো। বাড়িতে রান্নাবান্নার পাট ছিল না। শহরের একপ্রান্তে লাঞ্চ করতাম, অন্যপ্রান্তে ডিনার। ব্রেকফাস্টে কখনও শ্যামবাজারের হরিদাস মোদক, কখনও রাসবিহারীর রাধুবাবু, কখনও বাগবাজারের পটলা। কখনও গড়িয়াহাটের দাস কেবিন, কখনও দেশপ্রিয় পার্কের আশেপাশের সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান বা এই রকম কোথাও। সন্ধেবেলায় কখনও সদানন্দ রোডের আপনজন, কখনও রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে শংকরের ফ্রাই, কখনও কালিকা। উত্তরের দিকে গেলে শ্যামবাজারে বড়ুয়ার প্যান্থারাস, ফিয়ার্স লেনের অ্যাডামের কাবাব, গিরীশ পার্কের নিরঞ্জন আগারের কাটলেট। হাজরা মোড়ের কাফেতে প্রায় নিয়মিত চা-কফি-পুডিং। মাঝেমধ্যে শোভাবাজারের অ্যালেন কিচেনে বা অন্য কোথাও। কিন্তু লাঞ্চ আর ডিনারে তো এত অপশন নেই। শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫-৬টা দোকানে ভাত খেতাম। কখনও কখনও যে অন্য কোথাও খাইনি তা নয়, কিন্তু চেষ্টা করতাম ওই কয়েকটা দোকানেই যেতে।

লকডাউনের শুরু থেকে গল্পটা বদলে গেল। বাড়িতে রান্নাবান্না শুরু হল। সেও এক নতুন মজা। কিন্তু আমার পছন্দের ভাতের হোটেলগুলো কেমন আছে, লকডাউন শিথিল হওয়ার পর ব্যবসাবাণিজ্য আদৌ হচ্ছে কিনা, সেসব না জানলে চলে! কিন্তু কিছুতেই আর সময় বের করে যাওয়া হচ্ছিল না। আচমকাই একটা সুযোগ চলে এল। একটি সংস্থা বলল, কলকাতার খাবারের দোকানগুলো নিয়ে একটু খোঁজখবর করতে হবে। অবশ্যই কেবলমাত্র আমার পছন্দের দোকানগুলো নিয়েই। তাই মনে হল, খুব সংক্ষেপে আমার প্রিয় ভাতের হোটেলগুলো কেমন আছে, বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করি।


স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল
৮/২ ভবানী দত্ত লেন

এই হোটেলটা সম্ভবত কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত পাইস হোটেল। ১৯১০ সালে ভূবনেশ্বর থেকে দুই ভাই মনগোবিন্দ আর প্রহ্লাদচন্দ্র কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজের কাছে হিন্দু হোটেল খুলে বসলেন। এক আনায় মাছ-ভাত। পেটচুক্তি খাওয়া। বাড়িটা ছিল এক মুসলিম পরিবারের। কিন্তু কোনওদিন সাম্প্রদায়িক ঝামেলা পোহাতে হয়নি। বরং বিপদে আপদে আশেপাশের মুসলিম বাসিন্দারা বুক দিয়ে রক্ষা করেছেন হিন্দু হোটেলকে। হিন্দু হোটেলে সুভাষচন্দ্র বসুর নিয়মিত আসা এবং পাত পেড়ে পুঁই-চচ্চড়ি খাওয়ার গল্প এখনও এই চত্বরে কান পাতলে শোনা যায়। মেয়র থাকাকালীনও সহকর্মীদের নিয়ে এসে দুপুরবেলায় ভাত খেয়ে যেতেন সুভাষচন্দ্র। আসতেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সত্য বক্সী, হেমচন্দ্র গুহরা। লালবাজারের নথিতে ফেভারিট কেবিনের মতো হিন্দু হোটেলে কারা আসছেন, তার উপর নজর রাখার কথা রয়েছে।

১৯৪৩ সালে যখন মন্বন্তর এল, মনগোবিন্দ আর প্রহ্লাদচন্দ্র হোটেলের দরজা খুলে দিলেন সক্কলের জন্য। বিরাট বিরাট ডেকচিতে খিচুড়ি রান্না করে নিরন্ন মানুষের মুখে তুলে দিলেন তাঁরা। তার চার বছর পর দেশভাগ, ইংরেজ রাজত্বের অবসান। হিন্দু হোটেলের সামনে জাতীয় পতাকা তোলা হল ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট। পরের বছর হোটেলের নাম বদলে হল- স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল।

মনগোবিন্দ মারা গিয়েছেন আগেই। অতিবৃদ্ধ প্রল্হাদচন্দ্র  গত বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি হিন্দু হোটেলে যাঁরা খেতে আসেন, তাঁদের পাতে বিনামূল্যে কয়েকটি পদ পরিবেশন করা হয়। ২০১৮ পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫ অগস্ট দোকানের সামনে জাতীয় পতাকা তোলা হত। সাইনবোর্ডে নতুন রং করা হত। প্রল্হাদবাবুর মৃত্যুর পর থেকে সেসব বন্ধ আছে।

লকডাউনে একটানা কয়েক মাস ঝাঁপ বন্ধ ছিল স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের। তৃতীয় প্রজন্মের মালিক অরুণাংশু পণ্ডা এখনও ওড়িশায় আটকে আছেন। কিছুদিন হল হোটেল খুলছে বটে, কিন্তু খরিদ্দার নেই। আগে দিনে ২০০-২৫০ পাত পড়ত, এখন ২০-৩০ জনও আসেন না।


প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজ / মহল
৬/৩ রমানাথ মজুমদার লেন

আমার খুব প্রিয় হোটেল। চমৎকার রান্না। ১৯১৭ সালে, রুশ বিপ্লবের বছরে নন্দলাল দত্ত প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজ খুললেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, তপন সিংহ-সহ আরও অনেকে ছিলেন প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজের বোর্ডার। একটা সময় ৫০-৬০ জন থাকতেন। এখন কমতে কমতে ১০-১২ জন। প্রথমে কেবল বোর্ডারদের জন্যই রান্নাবান্না হত। এখন যেখানে মহল হোটেলটা হয়েছে, সেটাই ছিল বোর্ডিং হাউজের রান্নাঘর। আর ভিতরে ঢুকে যে প্যাসেজটা রয়েছে, সেখানে সারিবদ্ধ ভাবে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ১৯৯১ সালে নন্দলালের নাতি সন্দীপ দত্ত রান্নাঘরটাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন, বাইরের ঘরে খুললেন সর্বসাধারণের জন্য ভাতের হোটেল। সন্দীপবাবু বলছিলেন, "আটের দশক থেকেই মেস/বোর্ডিং ব্যবসা ক্রমশ অলাভজনক হয়ে পড়ছিল। তখন থেকেই অধিকাংশ মেস এবং বোর্ডিং বোর্ডারদের জন্য রান্না বন্ধ করে দিতে শুরু করে। আমরাও হোটেল খুলি তখনই।"

সন্দীপবাবুর বাবা নৃপেন্দ্রনাথ ছিলেন মেস-বোর্ডিং মালিকদের সংগঠনের প্রধান। ওই এলাকায় তো মেস আর বোর্ডিং-এর ছড়াছড়ি। একটু দূরে শিবরাম চক্রবর্তীর মেস। আরেকটু এগোলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন বসুদের বিখ্যাত মেসবাড়ি, যেখানে বাঘাাযতীন আসতেন। কয়েকদিন আগে প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মদিনে ওই মেসবাড়িটায় গিয়েছিলাম। সে অন্য গল্প।

লকডাউনের শুরু থেকেই মহল বন্ধ। এখনও খোলেনি৷ মাঝখানে রটে গিয়েছিল প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজ নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও সেটা সর্বৈব বাজে কথা।


জগন্মাতা ভোজনালয়
৪০, কৈলাশ বোস স্ট্রিট

এই দোকানটাও বেশ বিখ্যাত। তবে আমার যাতায়াত একটু কম। জগন্মাতার বৈশিষ্ট্য হল, এখানে টেবিল-চেয়ারের পাশাপাশি এখনও মাটিতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। রান্না বেশ ভাল। মুরগি ঢোকে না। কেবল পাঁঠার মাংস। বৃহস্পতিবারে মাংস হয় না। জগন্মাতায় রান্না হয় কয়লার উনুনে। শিলে বাটা মশলা ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করা হয় না।

ওড়িশা থেকে এসে বিকলচন্দ্র দাস জগন্মাতা ভোজনালয়ে খাবারের ব্যবসা শুরু করেন। এখন তৃতীয় প্রজন্মের গঙ্গাধর দাস দায়িত্বে। লকডাউনের শুরু থেকেই দোকান বন্ধ। এখনও খোলেনি।


হোটেল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম
১৯, রানী রাসমণি রোড

দোকানের গায়ে প্রতিষ্ঠার বছর হিসাবে ১৯৩৮ থাকলেও পুরসভার নথি অনুযায়ী ১৯২৮ সালে ক্ষুদিরাম সরকার হোটেল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। রানী রাসমণির জানবাজারের বাড়ির খুব কাছে রানীর জমিতেই ভাড়া বাড়িতে হোটেল শুরু হয়। আগে একতলায় মেস ছিল, মূলত চাকরিজীবীরা থাকতেন। এখন মেস উঠে গিয়েছে। হোটেলের কর্মচারীরাই মেস করে থাকেন।

সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের বৈশিষ্ট্য হল নানা রকমের মাছের চমৎকার রান্না। প্রতিদিন প্রায় ১২-১৫ রকমের মাছ থাকে। মাছের ডিশগুলোর দাম নির্দিষ্ট নয়, বাজারের দামের সঙ্গে ওঠানামা করে। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে বিনামূল্যে দই-রসগোল্লা খাওয়ানো হয়।

সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমও এখন বন্ধ। একটু দূরেই রয়েছে ঢাকেশ্বরী হোটেল। সেটাও বন্ধ। কবে খুলবে কে জানে!


তরুণ নিকেতন
১/৪ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ

এই হোটেলের খাবার আমার যত না পছন্দ, তার চেয়েও পছন্দ হোটেলের পরিবেশ। ছোট ছোট খাটের চেয়ার, শ্বেতপাথরের টেবিল, লম্বা আয়না। ঢুকতেই চোখে পড়বে - 'এই হোটেল সম্পূর্ণভাবে পাইস হোটেলের নিয়ম অনুসারে পরিচালিত।' তরুণ নিকেতন পাঁঠার মাংসের একটা হাল্কা ঝোল করে, বেশ লাগে। অরুণ দে এখন মালিক। আড্ডাবাজ মানুষ। নিজেই লেক মার্কেট থেকে বাজার করেন। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে বিনামূল্যে সকলকে পায়েস খাওয়ান। 

এই দোকানেও আগে মুরগির মাংস ঢুকত না, খাইয়েদের চাপে এখন ঢোকে। তবে মুরগির ডিমের এখনও প্রবেশ নিষেধ। লকডাউন শিথিল হওয়ার পর তরুণ নিকেতন খুলছে। তবে খদ্দের প্রায় নেই। আগে দুপুরবেলা বসার জায়গা পাওয়া যেত না, অপেক্ষা করতে হত, এখন শুনশান।

....................................................

এই ৫ টা হোটেল আমার সবচেয়ে প্রিয়। এর বাইরেও আরও অনেক হোটেল চমৎকার রান্না করে। খিদিরপুরের ইয়ং বেঙ্গল হোটেল, কলেজ স্ট্রিটে জগন্নাথ হোটেল, গড়িয়াহাট বাজারের দো'তলায় কালীপদ মাইতির হোটেল, ফার্ন রোডের ফার্ন হোটেল, হাতিবাগানের বেশ কয়েকটা হোটেল, যাদবপুরে হালে তৈরি হওয়া শেফ, ভবানীপুরে জগুবাবুর বাজারের কাছে পার্বতী হোটেল- তালিকা শেষ হবে না। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ আর গণেশ অ্যাভিনিউ ক্রসিংটার কাছে, হেয়ার স্ট্রিট আর বউবাজার থানার গলিতে দু'টো চমৎকার হোটেল আছে। একদম ছোট, ঘিঞ্জি, টুলে বসে খেতে হয়। তার একটা এত ভাল মাটন করে যে বলে বোঝানো যাবে না। চাঁদনি চকের ভিতরের হোটেলটাও মন্দ নয়।
জেলার হোটেলগুলোও চমৎকার। কয়েকদিন আগে মুর্শিদাবাদে গিয়ে পদ্মপাতায় ভাত খেলাম, মন ভরে গেল। বীরভূম, নদীয়াতেও বেশ খেলাম। তবে করোনা আর লকডাউনের জাঁতাকলে কেউ ভাল নেই। ব্যবসা লাটে উঠেছে প্রায় সকলেরই। কলকাতার চপ-কাটলেটের দোকানগুলোরও প্রায় একই অবস্থা।

কবে সব ঠিক হবে কে জানে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন