মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ছবি ~ অর্ক ভাদুরী

Sahid Khudiram

প্রতি বছর ১১ অগস্ট শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ছবিতে টাইমলাইন ভরে ওঠে। শুধু সোস্যাল মিডিয়ায় তো নয়, পাড়ায়-মহল্লায়-রাস্তার মোড়ে অসংখ্য মানুষ গভীর আবেগ ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন তাঁকে। কিন্তু কিশোর বিপ্লবীর যে ছবিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, অধিকাংশ পোস্টারে, ব্যানারে যে ছবিটি দেখতে পাই, সেটি কিন্তু ক্ষুদিরামের কোনও ফটোগ্রাফ নয়, কলকাতা হাইকোর্টের সামনে যে চমৎকার মূর্তিটি রয়েছে, তার ছবি। ভাস্কর্য সম্পর্কে আমার তেমন কোনও জ্ঞান নেই, কিন্তু ক্ষুদিরামের এই মূর্তিটি বড্ড প্রিয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, ভাস্কর্যটির মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে একটা আস্ত সময়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণজয়ী সংগ্রামের আঁচে অগ্নিশুদ্ধ হওয়া ওঠা সময়ের স্মারক যেন ওই ন'ফুট লম্বা মূর্তিটি।

কিন্তু কে তৈরি করেছিলেন ক্ষুদিরামের এই আশ্চর্য মূর্তি? তাঁর অন্য কোনও কাজের খোঁজ মেলে না কেন? উত্তর নেই। প্রতি বছর ১১ অগস্ট আসে, চলে যায়। শিল্পীর নাম সামনে আসে না। আমরা কেউ জানতেও পারি না এক আশ্চর্য কমিউনিস্টের গল্প।

চারের দশকের প্রায় শেষ। সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। বিহারের বাসিন্দা তাপস দত্ত শিল্পী হতে চেয়ে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন আর্ট কলেজে। কিন্তু উত্তাল সময়ের ঢেউ বদলে দিল জীবনের গতি। একের পর এক আন্দোলনে রাজপথ তখন উত্তাল। সেই স্রোতে ডিঙি ভাসালেন তাপসবাবুও। বন্ধু শীতেশ দাশগুপ্তের হাত ধরে জড়িয়ে পড়লেন বামপন্থী রাজনীতিতে। সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার (এস ইউ সি) দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে ভিড়ে গেলেন লাল পতাকার মিছিলে। শিল্পী হওয়া আর হ'ল না বটে, কিন্তু পেয়ে গেলেন একটা অন্য রকমের জীবন। কমিউনিস্ট জীবন।

রাজনৈতিক কাজকর্মের ফাঁকে শিল্পচর্চা চলতে লাগল ঠিকই, কিন্তু ধ্যানজ্ঞান সবই তখন রাজনীতি। কখনও ডক শ্রমিকদের নিয়ে ইউনিয়ন করছেন, কখনও ছুটে যাচ্ছেন জুটমিলের শ্রমিক মহল্লায়, কখনও পার্টির নির্দেশে চষে ফেলছেন ওড়িশার গ্রাম, শহর, মফস্বল। আর এই এতকিছুর মাঝে, কখনও একটু অবসর জুটে গেলে বসে পড়ছেন রংতুলি নিয়ে।

এমন করেই চলছিল। অনেক বছর পর এল ১৯৬৭ সাল। কংগ্রেসকে হারিয়ে বাংলার বুকে তৈরি হল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। জ্যোতি বসু হলেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী, তাপসবাবুদের দলের নেতা সুবোধ ব্যানার্জি শ্রমমন্ত্রী। কিন্তু সেই সরকার টিঁকল না। তারপর ১৯৬৯। আবার ক্ষমতায় এল যুক্তফ্রন্ট। এই দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের পূর্ত দফতর সিদ্ধান্ত নিল শহর জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূর্তি বসানো হবে। রাস্তাঘাট আর গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরগুলির নাম রাখা হবে বিপ্লবীদের স্মরণে। অ্যান্ডারসন হাউজ হল বিপ্লবী ভবানী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ভবানী ভবন, বিনয়-বাদল-দীনেশের স্মরণে হল বিবাদী বাগ, এমন আরও অনেক কিছু। ঠিক হল হাইকোর্টের সামনে বসবে ক্ষুদিরামের মূর্তি। শিল্পীদের কাছ থেকে নকশা আহ্বান করল সরকার।

অনেকদিন, অনেক অনেক দিন পর আবার সিরিয়াসলি খাতাকলম নিয়ে বসলেন তাপস দত্ত। ততদিনে তিনি বিশিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। আরও অনেকের মতো তাপসবাবুও সরকারের কাছে মূর্তির একটি মডেল জমা দিলেন। এবং সেটিই নির্বাচিত হল! তারপর একটানা কয়েক মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাপসবাবু তৈরি করে ফেললেন এই মূর্তিটি। বিপুল প্রশংসিত হলেন। প্রশংসা করলেন স্বয়ং রামকিঙ্কর বেইজ। কিন্তু ওই শেষ। তারপর দীর্ঘদিন তাপসবাবু আর কোনও মূর্তি তৈরি করেননি। বহু বছর পর ঘাটশিলা তাঁদের দলের প্রতিষ্ঠাতার একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি বাদে তাপসবাবুর সম্ভবত কোনও মেজর কাজ নেই। ইন্দিরা গান্ধির আমলে কেন্দ্রীয় সরকার জওহরলাল নেহরুর মূর্তি তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল বলে শুনেছি। কিন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে তাপসবাবু রাজি হননি।

শহীদ ক্ষুদিরামের অধিকাংশ মূর্তিই কলকাতা হাইকোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মূর্তিটির আদলে নির্মিত। ক্ষুদিরামের অধিকাংশ ছবিও তাই। পোস্টারে, ব্যানারে সর্বত্র এই মূর্তিটির ছবি দেখি। কিন্তু কেন জানি না তাপস দত্তের কথা কেউ বলেন না। পরবর্তীকালে তাপসবাবু সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টারের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন, শ্রমিক সংগঠন ইউ টি ইউ সি-র (লেনিন সরণী) সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু ভাস্কর তাপস দত্তের কথা কেন সামনে আসে না? তাঁর দলের কমরেডরাও কি আরেকটু বিশদে বলতে পারেন না এই কমিউনিস্ট শিল্পীর গল্প?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন