"ওরে আয়রে ছুটে আয়রে ত্বরা, হেথা নাইকো মৃত্যু নাইকো জ্বরা"
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতা ক্রমশ নতুন নতুন শিখর স্পর্শ করে চলেছে। সাধারণ মানুষের কাছে নিত্য তথ্য লুকোনোর, তথ্য পরিবর্তন করার এমন এক ইতিবৃত্ত রচনা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রীতিমত এক রোমহর্ষক গোয়েন্দা গল্প হয়ে যায়।

অথচ এই রেগুলার হেলথ বুলেটিন, অথবা সাংবাদিক সম্মেলনে করোনা পরিস্থতি মানুষকে জানানোর প্রথা শুরু করায় পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু প্রথম সারিতে থাকবে। ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দফতর দু তিন দিনে একবার করে রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বুলেটিন প্রকাশ করা শুরু করে। মার্চের শুরু থেকে এটা প্রায় প্রতি দিন নিয়মিত হয়ে যায়। সেই সময় খুব কম রাজ্যই এতটা স্বচ্ছভাবে তথ্য দিচ্ছিল মানুষকে, বহু রাজ্যের তো কোনো নিয়মিত বুলেটিনই ছিল না। কিন্তু টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন শুরু হতে পশ্চিমবঙ্গ পথ বদলায় এবং বাকি দেশের সব রাজ্য যে পথে চলছে তার উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে। কী রকম? এপ্রিলের শুরু থেকে সমস্ত রাজ্যগুলো প্রতিদিন নিয়মিত বুলেটিনে কত জন নতুন আক্রান্ত হলো, শুরু থেকে সেই দিন অবধি কত জন মোট আক্রান্ত, কত জন মারা গেছেন, কত জনের পরীক্ষা হয়েছে এসমস্ত কিছুর জেলাওয়ারী হিসেব দেওয়া শুরু করে। তখন পশ্চিমবঙ্গ জেলাওয়ারী হিসেব বা পরীক্ষার হিসেব দেওয়া তো ছেড়েই দিন, এমন কি কত জন মোট করোনা আক্রান্ত এবং কতজন মোট মৃত সেটা নিয়েও পরিষ্কার ভাবে জানানো বন্ধ করে দেয় বুলেটিনে। মার্চ অবধি পশ্চিমবঙ্গও বাকিদের মত মোট আক্রান্তের হিসেব দিত তাদের বুলেটিনে কিন্তু এপ্রিলের ১ থেকে ৫ হঠাৎ বুলেটিন প্রকাশ স্থগিত হয়ে যায়। ফের তা চালু হলে দেখা যায় দুটি বিষয় - এক, বুলেটিনের ফরম্যাট বদলে গেছে, মোট আক্রান্তের সংখ্যা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আর তার বদলে সেই দিন কতগুলো একটিভ কেস, কতজনের মৃত্যু হয়েছে, এবং সেই দিন কত জন রুগী সুস্থ্য হয়েছে - এই তথ্য দেওয়া শুরু করে। এই তথ্য থেকে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বের করা সম্ভব নয় যতক্ষন না শুরু থেকে কত জনের মৃত্যু হয়েছে এবং শুরুর থেকে কতজন সুস্থ হয়েছে তা জানা যাচ্ছে। এবং দুই, এই সময়তেই এক্সপার্ট কমিটি গঠন হয় যারা করোনা আক্রান্ত কারুর মৃত্যুকে করোনায় মৃত্যু নাকি অন্য কারণে - তা ঠিক করে দিতে থাকে। দেখা যায় যে মৃতের সংখ্যা হঠাৎ করে কমে যায়। যে সব করোনা আক্রান্তের মৃত্যুকে করোনা মৃত্যু বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না তাদের সরকারের তালিকাতেও জায়গা হয় না। এই রিপোর্টিংয়ের বদল দেখেই বুঝে যাই যে সরকার তথ্য লুকোনো শুরু করেছে। বামপন্থীরা এই নিয়ে প্রতিবাদে সরব হন। গণশক্তি পত্রিকা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩০ জন মৃতের তালিকা প্রকাশ করে যখন সরকারি হিসেবে মৃত ছিল বোধয় ১১ জন। গণশক্তির বিরুদ্ধে পুলিশে ডাইরি হয়। বামপন্থী নেতারা আটক হন। চারপাশে খবর রটতে থাকে যে পুলিশ রাতের অন্ধকারে দেহ দাহ করছে। সরকার গুজব বলে সেগুলোকে উড়িয়ে দেয়, যাঁরা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন তাদের পোস্ট উড়ে যেতে থাকে, পুলিশ ধমকি দিতে থাকে। অথচ ব্যক্তিগত আলাপে পুলিশকর্মীদের কাছেই জানতে পারি যে স্পেশ্যাল শ্মশানে দাহ করা মৃতের সংখ্যা সরকারিভাবে স্বীকৃত মৃতের অন্তত ১০ গুন। বেশিদিন লাশের গন্ধ চাপা থাকে না। শেষে ২৪ এপ্রিল সরকার স্বীকার করে যে করোনা আক্রান্তে মৃতের সংখ্যা আসলে ৫৭ কিন্তু তার মধ্যে ৩৯ জন "অন্য কারণে" মারা গেছে। সরকারি ভাবে স্বীকৃত মৃতের সংখ্যা সেদিন অবধি ১৮। অর্থাৎ গণশক্তির দেওয়া হিসেবই মেনে নেয় সরকার। চারপাশে সরকারি তথ্য চাপবার প্রয়াসকে নিয়ে হই চই পড়ে যায়, সবাই নিন্দে করতে থাকে, সরকারের দেওয়া সমস্ত তথ্যই সন্দেহ করতে থাকে মানুষ। এর মধ্যে কিছু তৃণমূলী সাফাই গাইতে থাকে যে অন্য অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হলে তার শরীরে করোনা পাওয়া গেলেও তাকে করোনায় মৃত বলা উচিত না, অন্য কেউই তাদেরকে কাউন্ট করছে না, ইত্যাদি। একদম সর্বৈব মিথ্যে কথা। সব রাজ্যই করোনা পজিটিভ কারুর মৃত্যুকে করোনা মৃত্যু বলেই ধরছে। মহারাষ্ট্রে মৃতর তালিকায় ৭০%-এরই শরীরে অন্য রোগও ছিল, তাদের রাজ্যের রোজের হেলথ রিপোর্টেই সেটা থাকছে। উন্নত দেশগুলোতে তো করোনা পরীক্ষা না হলেও যদি কারুর মধ্যে কিছু সিম্পটম দেখা যায় আর সে মারা যায় তাহলে তাকেও করোনায় মৃত বলে ধরে নিচ্ছে। হু-এর গাইডলাইন রয়েছে এক্সপার্ট কমিটি গঠন করার বিষয়ে কিন্তু সেটা করোনায় মৃতের সংখ্যা কমানোর জন্য নয়, উল্টে টেস্ট করা সম্ভব না হলে সিম্পটম দেখে করোনায় মৃত কি না তা যাচাই করার জন্যে অর্থাৎ মৃতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে সেই কমিটি করার কথা বলেছে। মৃতের সংখ্যা আন্ডারএস্টিমেট করাটা সমস্যার, ওভারএস্টিমেটটা সমস্যার নয় কারণ মৃতের সংখ্যা বেশি হলে বেশি টেস্ট করার তাগিদ হবে, উল্টে সংখ্যা কম দেখালে মানুষও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা মুখ ঢাকার গা করবে না। এই ৫৭ সংখ্যাটিকেও লোকে অবিশ্বাস করতে থাকে। সেটাই স্বাভাবিক, একবার মিথ্যে বলতে ধরা পড়ে গেলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। আরো বাড়তে থাকে জল্পনা, আরো লুকিয়ে দাহ করার ঘটনা সামনে আসতে থাকে। এর পর বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে দাহ করা নিয়ে প্রতিরোধ শুরু হয়। করোনা আক্রান্তকে রাতের অন্ধকারে, ফাঁকা শ্মশানে দাহ করাটা খুবই যুক্তিযুক্ত কিন্তু আক্রান্তের বাড়ির লোককে কেন অন্তত শ্মশান অবধি আসতে দেওয়া হবে না? তারা লাশের সংস্পর্শে না এলেই তো কোনো অসুবিধে নেই। বাড়ির লোকেরা যদি দেহর সাথে আসে তাহলে পাড়ার লোকও ঝামেলা করবে না। নাকি বাড়ির লোকজনকে না জানিয়েই দাহ করা হচ্ছে যাতে লুকিয়ে ফেলা যায়? ডেথ সার্টিফিকেটে করোনা পজিটিভ লিখতেও যেখানে কমিটির পারমিশন চাই সেখানে করোনা লুকোনোটাই উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে। এত হই চইয়ের পরেও কিন্তু কমিটি বাতিল হয়নি। এরপরও তারা করোনা আক্রান্তের মৃত্যুকে করোনা মৃত্যুর তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এই করতে করতে এপ্রিলের ২৯ তারিখ মোট করোনা আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৫-এ যেখানে সরকারি তালিকায় করোনায় মৃত বলে স্বীকার করা হয়েছে মাত্র ৩৩ জন।
এই মৃত্যু লুকোনোর কারণ কী? কেন মৃতের সংখ্যা কমানোর চেষ্টা? কারণ হলো যে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা স্বীকার করে নিলে পশ্চিমবঙ্গে করোনায় মৃতের হার সারা ভারতে সর্বোচ্চ হয়ে যাবে। সারা দেশে যেখানে মৃতের হার মাত্র ৩-৪% সেখানে এই রাজ্যে তা দাঁড়াবে ১২%। কেন বেশি মৃত্যু? কারণ যথেষ্ট সংখ্যক করোনা রুগী ধরা পড়েনি। মৃত্যুর হার গণিত হয় মোট আক্রান্তের সংখ্যার ওপর, আর মোট আক্রান্তের সংখ্যা নির্ধারিত হয় মোট পরীক্ষার ওপর। এবার যদি মোট পরীক্ষাই কম হয় তাহলে মোট আক্রান্তও কম হবে এবং মৃতের হার বেশি মনে হবে। টেস্টিংয়ের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে তাই মৃতের সংখ্যায় জল মেশানোর রাস্তা নেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ছোটর থেকে আমরা জানি যে একবার মিথ্যে বললে ক্রমশ সেই মিথ্যেকে ঢাকতে আরো মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন ঠিক সেই ফাঁদেই ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে। এই যে অতিরিক্ত ৭২ জন মৃত এরা কিন্তু সরকার প্রকাশিত করোনা তালিকায় কোথাও কাউন্টেড নন। কারণ আগেই বলেছি যে সরকার মোট আক্রান্তের সংখ্যা দিচ্ছে না, তার বদলে গত দু সপ্তাহ ধরে তারা জানাচ্ছে শুধু মোট বর্তমানে আক্রান্ত, কত জন সুস্থ হয়েছে, এবং কত জন মৃত। মৃতের মধ্যে এদের নাম নেই, এরা বর্তমানে আক্রান্ত, অথবা সুস্থও হয়ে ওঠেননি। তাই মোট করোনা আক্রান্তের মধ্যে এরা নেই। রাজ্যে মোট করোনা আক্রান্ত কত জন? এই সংখ্যাটাই আর পরিষ্কার নয়। রাজ্য ৩০-এ এপ্রিল সকালের পর আর বুলেটিন বের করেনি। শেষ বুলেটিনের হিসেবে ধরলে মোট আক্রান্ত ৭৫০ জন। অথচ কালকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককে দেওয়া চিঠিতে রাজ্য সরকার জানিয়েছে যে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯৩১ জন। এই ১৮০ জন কি এক দিনে আক্রান্ত হলো নাকি আগের হিসেবে গরমিল ছিল? কেউ জানে না। সেই চিঠিতে জেলাওয়ারী হিসেবও দিয়েছে রাজ্য অথচ বুলেটিনে জেলা বাবদ আক্রান্তের সংখ্যা জানানো হচ্ছে না।
যদি বুঝতাম যে মানুষকে তথ্য না দিলেও সরকার যা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নিচ্ছে তাহলেও হতো। কিন্তু সেটাও নেয়নি। আসলে আমাদের দেশ তো আর চীন নয়, এখানে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে আগে মানুষকে বলতে হয় কেন সেই পদক্ষেপ প্রয়োজন। তাই তথ্য লুকিয়ে মানুষের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলে মানুষ মানে না। মানুষ বাজার হাট, দোকান পাটে ভিড় করছে গুরুত্ব না বুঝে, এতে বিপদ বাড়ছে। আমি অনন্তকাল লকডাউন রাখার পক্ষে নই, কিন্তু লকডাউন তুলে নিতে গেলে একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে তা করতে হবে যাতে টেস্টিংয়ের এবং সংক্রমণকে চিহ্নিত করে রুগীদের তাড়াতাড়ি আলাদা করার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটাই যদি না হয় তাহলে লকডাউন তুললে দুদিন পর পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।
করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের সব উন্নত দেশও পর্যদুস্ত। পশ্চিমবঙ্গে করোনা আক্রান্ত এবং মৃতের প্রকৃত সংখ্যা মানুষকে জানালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেউ খারাপ প্রশাসক বলতো না, আমেরিকাই পারছে না তো মমতা পারবেন এই আশা কেউ করে না। কেরালার প্রসঙ্গ আলাদা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে দক্ষ প্রশাসক প্রমাণ করতে সংখ্যা নিয়ে এই লুকোচুরি করলো। এতে উল্টে রাজ্যের মানুষের বিশ্বাস খোয়ালো সরকার। এখন গোটাটার দায়ে মমতা চাপিয়ে দিয়েছে চিফ সেক্রেটারি আর হেলথ সেক্রেটারির ওপর এবং ওই মৃত্যু বিচারের এক্সপার্ট কমিটিকে প্রায় বিদায় দিয়েছে। তবুও এর দায় নিজে নেয়নি। নিজের ইমেজের কথা না ভেবে যদি একটু রাজ্যের মানুষের কথা ভাবতেন মমতা তাহলে আজকে রাজ্য এই বিপদের সামনে পড়ত না। এখন পরিস্থিতি এমনই যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করলেও অধিকাংশ মানুষ সেটাকেও মেনে নেবে। যদি শেষ অবধি সেটাই হয় তাহলে তার জন্য দায়ী হবেন একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
(নিচে সমস্ত তথ্যর লিংক দেওয়া রইলো)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন