শুক্রবার, ১ মে, ২০২০

"ভুল করে তুই চিনলি না রে..." ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

এর আগে রাষ্ট্র ও সরকারের নানান নীতির সমালোচনা করে অনেক কিছু লিখেছি। জ্ঞানত কোনো মিথ্যে কথা লিখিনি, কোনো বিকৃত তথ্যও পরিবেশন করিনি। তাতে প্রচুর সাধুবাদও পেয়েছি। কিন্তু বারবার একটি কথাই মনে হয়েছে। সমস্ত সমালোচনা কি কেবল ওদেরই প্রাপ্য? আমাদের অর্থাৎ আম-আদমিদের নিয়ে গঠিত জনসমাজ এর কোনই দায়িত্ব নেই, বা ছিল না?

আজকে সারা পৃথিবী জুড়ে, দেশ জুড়ে, রাজ্য জুড়ে যখন জনস্বাস্থ্যের করুন চেহারাটা একটু একটু করে বে-আব্রু হচ্ছে, তখন আমরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছি। কিন্তু একদিনে তো এটা হয় নি। বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্যের জন্য ১% ২% বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। আমরা চুপ করে ছিলাম। আমরা মেতে ছিলাম বিদেশে বেআইনি অভিবাসী নিয়ে অথবা দেশে মন্দির-মসজিদ, এনআরসি নিয়ে। 

আমাদের দেশে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কত বরাদ্দ হল, কোনো নির্বাচনে এটা ইস্যু হয়েছে কোনোদিন? স্বাস্থ্যের মধ্যে আবার চিকিৎসাখাতে আর জনস্বাস্থ্যের খাতে কত বরাদ্দ হল আমরা ভেবেছি কোনোদিন?

আজ স্টার আনন্দের সাংবাদিকের মা ভর্তি হতে হয়রানি হওয়ার পরে সংবাদের চর্চায় এসেছে কোন বেসরকারি হাসপাতালে কত আইসলেশন বেড। এর আগে তো আসেনি। ওই আনন্দতেই তো সার্জিক্যাল স্ক্রাব সুট পরা মুখপাত্ররা প্রচার করতে ব্যস্ত ছিলেন যে বাইপাসের ধারের পাঁচতারা হাসপাতালগুলি কোনো অংশে দক্ষিণ ভারতের চেয়ে কম নয়। আমরা দর্শক-শ্রোতারা তখন কেবল হাততালি দিতেই ব্যস্ত ছিলাম।

আজকে তৃণমূলস্তরের স্বাস্থ্যকর্মী এএনএম আর আশাকর্মীরা বাড়ি গিয়ে জ্বরের সার্ভেলেন্সে কি উজ্জ্বল ভূমিকা নিতে পারেন তার কথা বলা হচ্ছে। অথচ এরা যখন চাকরিগত কিছু সামান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন ধর্মঘট করেছিল তখন আমরা জনসাধারণ পাত্তাই দিই নি। আমাদের মনোভাব ছিল - এরা কারা, চিনিনা তো। এক পদ এক বেতনের দাবিতে সেকেন্ড এএনএমরা জমায়েত করলে পুলিশ দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে বিগ বসরা নিজের নীল বাতি জ্বালানো গাড়ি নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেছেন। এবিপি আনন্দ কভার করেনি কিন্তু সেই ফুটেজ। আজ সুমন কাঁপা কাঁপা গলায় কাঁদুনি গাইছে।

আজকে টেস্ট বাড়াও, টেস্ট বাড়াও বলে আমরা যারা চিল্লিয়ে বাজার মাত করে দিলাম তারা ক'জন খোঁজ নিয়েছিলাম যে নবগঠিত মেডিক্যাল কলেজগুলোর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের কটাতে বায়ো-সেফটি ক্যাবিনেট আছে। ক'জন আমরা মাথা ঘামিয়েছি যখন একের পর এক ল্যাব টেকনোলজিস্ট, বা অক্সিলিয়ারী নার্স কাম মিডওয়াইফ N95 এর অভাবে এমডিআর যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছেন। আজ টোটেম পোলের সর্বোচ্চ কোনো ডাক্তার পিপিই পাচ্ছেন না বলে আমরা আহা-উহু করছি। কেন, ওই ল্যাব টেক, ওই এএনএম কি মানুষ ছিল না? ডাক্তার সংগঠন থেকে দাবি জানানো হচ্ছে, মৃত ডাক্তার কে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। একশো বার দিতে হবে। কেবল তুচ্ছ প্রশ্ন, যে এএনএম টিবিতে মারা গেল তার শহীদের মর্যাদার জন্য কোন ডাক্তার সংগঠন কবে মুখর হল কেউ জানাবেন? পাবলিক হেলথের অন্যতম স্তম্ভ হেলথ এসিস্টেন্ট মেল নামে একটা গোটা ক্যাডার অবলুপ্ত করে দেওয়া হল, ডান-বাম কারুর কোনো হেলদোল দেখিনি। গ্রামের ছোট্ট পিএইচসির ডাক্তারকে "অর্ডিনারী এমবিবিএস" বলে উপহাস করেছি পাবলিক হেলথে তার লিডারশিপের ভূমিকা অক্লেশে ভুলে।

আমরা প্রাণভরে মন্দির-মসজিদ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড ৩৭০ এসব বড় বড় বিষয় নিয়েই মেতে ছিলাম। আজ করোনা আসাতে স্বাস্থ্য নিয়ে একটু আধটু মাথা ঘামাচ্ছি। লিখে রাখুন, আগামী নির্বাচনে স্বাস্থ্য কোনো এজেন্ডাই হবে না। আমরা আলোকিত ফ্লাইওভার, বিশাল প্যাটেল মূর্তি, নেতা নেত্রীর ছবি ঝোলানো ফিল্ম উৎসব, আম/ইলিশ উৎসব এসব নিয়েই আবার মেতে উঠবো।

কেবল, কেবল আমরা গুটিকয় মানুষ সীমিত সাধ্য নিয়ে, মানুষের হাজার সমালোচনা মেনে নিয়ে তখনও লড়ে যাবো। আমাদের গ্ল্যামারহীন জগতে কোনো তারকা খচিত লিভার বিশেষজ্ঞ নেই। আমরা মাঠে ঘাটে কাজ করা মানুষ, প্রতিদিন মানুষের প্রত্যাশার চাপ নেওয়া মানুষ, যাদের পয়সা দিয়ে স্বাস্থ্য কেনার ক্ষমতা নেই তাদের সেবা করা মানুষ, যাদের কেউ টিভি টক শোতে ডাকে না, তেমন গ্ল্যামারহীন মানুষ। 

আমরা সীমিত সাধ্য নিয়ে ময়দানে আছি। এই কারণেই আছি যে নিউইয়র্ক এর কুইন্স বোরোর ছোট্ট রাব্বি পরিবারে জন্মানো আমার, আমাদের না দেখা শিক্ষক, জন হপকিন্সের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক লিওন গর্ডইস শিখিয়ে ছিলেন যে এপিডেমিওলজিটা কেবল ক্লাস রুমে শেখা যায় না, মানুষের মাঝে গিয়ে শিখতে হয়।

কেবল একটাই অনুরোধ, পরের বার কেউ ভোট চাইতে এলে একটি বার জিজ্ঞেস করবেন, স্বাস্থ্য বাজেট এ ক'পয়সা খরচ করবে বাবারা? সিয়াচেনে সৈনিকদের আত্মত্যাগের পাশাপাশি নিজের পাড়ায় কাজ করা আশা কর্মী, HHW, এএনএমদের কথাও বোধহয় একটু ভাবা দরকার। সৈনিক কি কেবল জলপাই বা খাকি রঙের ইউনিফর্মই পরে?

"রাধে, ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমের শ্যাম রাই;
ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়..."

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন