মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৮

দাংগা ও দিদি ~ আরকাদি গাইদার

- তাড়াতাড়ি শেষ করো, অনেকক্ষন ধরে বসে আছি, এবার ক্লান্ত লাগছে।

- হ্যা, আর কয়েকটা বিষয় বাকি, সেগুলো আলোচনা করে নিলেই মিটিং শেষ।

- বলো, বলো।

- বিজেপি - আরএসএসের রথযাত্রা নিয়ে সেরকমভাবে কোন বিশেষ প্রশাসনিক পদক্ষেপের নির্দেশ পাইনি। ওটা কি করবো?

- কিছুই করবে না।

- কিছুই করবো না!

- না। পারমিশন আছে তো। নিয়ম মেনে সাথে এসকর্ট দেবে। ব্যাস, আরকি।

- কিন্তু..আসলে, মানে ব্যাপারটা তো এত সহজ না। এটা তো সাদামাটা রাজনৈতিক প্রচারযাত্রা নয়। এটার উদ্দেশ্য তো অন্য। সেই '৯২তে রথযাত্রা করেছিলো। যেখান দিয়ে রথ গেছিলো সেখানেই দাঙা লাগিয়েছিলো। এবারেও তাই করবে। গোটা বাংলা জুড়ে রথ চলবে, পেছনে গুন্ডা, দাঙাবাজদের দলবল থাকবে, সব জায়গায় দাঙার আগুন লাগবে।

- হুম।

- তাই বলছিলাম, একটু কড়া ভাবে যদি কন্ট্রোল করা যেতো। সেরকম নির্দেশ..

- আচ্ছা, এত বয়স হলো তোমার। রাজনীতি কবে বুঝবে? ধরো তোমার কথাই সত্যি। ওরা রথযাত্রা করলো। দাঙা লাগালো। সেটা ভালো না খারাপ?

- ভালো না খারাপ? ইয়ে, মানে?

- আরে ছাগল, দাঙা লাগলে কি হবে? বাড়ি ঘর জ্বলবে, অনেক লোক ঘরছাড়া হবে, ক্যাম্পে যাবে। কয়েকজন খুনও হতে পারে। তারপর সেই সমস্ত ছবি টিভিতে দেখানো হবে, পেপারে বেরোবে। তাতে কি হবে? লোক ভয় পাবে। ভয়, ভীতি, প্যানিক - এইগুলো হলেই মানুষ পরিত্রাতা খুজবে। সামনের বছরে নির্বাচন। ভয় পেলে মানুষ এই দাঙাবাজদের আটকাতে আমাদের দিকেই আসবে। 

- কিন্তু আগে থেকেই দাঙা আটকানো ভালো না?

- আগে থেকে আটকালে তো কোন ক্রাইসিসই হলো না। ভয় নেই। প্যানিক নেই। তখন দাঙা নিয়ে মানুষ চিন্তাভাবনা করবে? নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে না হলে মানুষ তখন অন্যান্য জিনিস নিয়ে ভাববে তো। তখন কি হবে ভেবে দেখেছো? 

- না, সেটা ভাবিনি।

- তাহলে ভাবো। কল্পনা করে নাও বাংলায় আমরা এর আগের কয়েকবছরে একটাও দাঙা ঘটতে দিইনি। কড়া হাতে দমন করেছি। কেউ মারা যায়েনি। কোন রক্ত ঝরেনি।  আজকের মতন মানুষ সাম্প্রদায়িক হিংসে নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে নেই। এরকম পরিস্থিতিতে এই যে আমাদের দলের প্রমোটারের অত্যাচারে বেকার যুবক নবান্নের সামনে এসে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলো বা তারপর ধরো ৭টা শবর অনাহারে মারা গেলো। তখন টিভি, পেপার, পাব্লিক স্পেসের আলোচনা-আড্ডা কি নিয়ে হতো? সেখানে আমাদের কি হাল হতো?

- এটা ভাবিনি।

- জানি। তাই ভাবতে বলছি। ধরো রথযাত্রা পরবর্তী হিংসেয় একজন মারা গেলো।  এই যে ৭জন শবর না খেতে পেয়ে মারা গেলো, তার থেকে দশগুন বেশি দৃশ্যমান হবে সেই ঘটনা। সবাই অনেক বেশি নাচানাচি করবে। কারন আপাতত বাজারে সাম্প্রদায়িকতার টিআরপি বেশি। তাহলে সেটা আমাদের জন্যে ভালো, না খারাপ?

- আপনি কি ব্যাটম্যান দেখেছেন? ওখানে জোকার এরকমই বলেছিলো - No one bothers when things go according to 'plan'..

- তুমিও কি বোকা লিবারবাল হয়ে গেলে নাকি? এরকম জ্ঞানপাপীদের মতন ডায়ালগ ঝাড়ছো কেন? যাই হোক, তাহলে এই নিয়ে আর কনফিউশন নেই তো? একটু ঝামেলা হলে ভালো। বাদবাকি দায়িত্ব লিবারবালরা নিয়ে নেবে। নেচে কেদে সমস্ত স্পটলাইট ওই দাঙাতেই ফোকাস করাবে। আর কিছু আছে?

- হ্যা, আর দুটো বিষয়। ওই শ্রমিক-কৃষক সংগঠনগুলোর পর পর কিছু দেশব্যাপী কর্মসূচী আছে।

- তাতে আমাদের কি?

- ওই কর্মসূচীগুলোর মধ্যে একটা ৮-৯ই জানুয়ারীর সারা ভারত সাধারন ধর্মঘট আছে। সেটা তো আমাদের রাজ্যেও হবে।

- সর্বশক্তি দিয়ে আটকাতে হবে। আমাদের রাজ্যে কোন শ্রমিক কৃষকের ব্যাপার নেই। ওসব যেন এখানে দৃশ্যমান না হয়। আজকে বলছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে, কালকেই একই ইস্যুগুলো আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দেবে। চাষ নিয়ে যা বলছে তা তো আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও সত্যি। তখন সামলাবো কি দিয়ে? আমাদের রাজ্যে যা হবে স্রেফ এই হিন্দু-মুসলমান-সেকুলার-দাঙাবাজ লাইনে, বুঝলে? নাহলে আমাদের চাপ আছে। শেষ বিষয় কি?

- ওই যে আপনি সরকারি ফুড ফেস্টিভাল করছেন না - আহারে বাংলা, আজ ওটার বাইরে বিরোধী বিধায়ক বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন ওই ৭ শবরের অনাহারে মৃত্যু নিয়ে। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে তো আবার ওই কয়েকটা ছেলেকে মাওবাদী বলে গ্রেপ্তার করা হলো। এই ঘটনাটা সামনে চলে আসছে বারবার। 

- হুম। দেখি মিডিয়ার লোকজনের সাথে কথা বলে। শোভন আর বৈশাখীর ব্যাপারটা বেশি বেশি করে প্রচার করলেই লোকে আর অন্যকিছু নিয়ে মাথা ঘামাবে না। দলেও বলে দেবো, এই বিষয় কিছু বাইট ফাইট দিয়ে পাব্লিক কে একটু বিভ্রান্ত রাখতে। আর কিছু?

- না। আসি তাহলে।

- এসো।

(প্রায় দু দশক আগে, লালুপ্রসাদ যাদব এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন - 'সরকার না চাওয়া, তো দাঙা না হোওয়া')


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন