বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮

মূর্তি ও সভ্যতা ~ পুরন্দর ভাট

অনেকেই ইস্টার আইল্যান্ডের নাম শুনেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে সেই জনমানবহীন দ্বীপ যেখানে শ'য়ে শ'য়েঅতিকায় পাথরের মূর্তি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্বিকরা গবেষণা করে জানতে পারেন যে আনুমানিক এক হাজার বছর আগে এই দ্বীপে 'রাপানুই' নামের এক বৃহৎ সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, যারা এই অতিকায় মূর্তিগুলো বানিয়েছিল। রাপানুইয়ের মানুষজন এই হাজার হাজার টনের পাথরের মূর্তি খোদাই করে, মাইলের পর মাইল তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মত প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে যতগুলো দ্বীপপুঞ্জ আছে তার কোথাওই এত উন্নত আদিম সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। বাকি সব দ্বীপেই আদিবাসীরা সামান্য কৃষিকাজ আর মাছ-শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো বা এখনো করে, কোথাওই কোনো নগর সভ্যতা বা বৃহৎ নির্মাণকাজের ইতিহাস নেই। সেই কারণেই ইস্টার আইল্যান্ড ব্যতিক্রম এবং রহস্য। তার চেয়েও রহস্যজনক হলো যে এই আদিম সভ্যতার সম্পূর্ণ বিলুপ্তিকরণ। ১৮ শতকে যখন প্রথম ইউরোপীয় নাবিকেরা দ্বীপটির খোঁজ পান তখন সেই দ্বীপে বসবাস করছিল মাত্র কয়েকশো আদিবাসী, যাঁদের মধ্যে রাপানুইয়ের উন্নত সভ্যতার কোনো চিহ্নই ছিল না। প্রশান্ত মহাসাগরের বাকি দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের মতোই তারা ছিল প্রযুক্তিগত ভাবে অনুন্নত। সেই সুবিশাল পাথরের মূর্তি খোদাই করা এবং তাদের টেনে নিয়ে আসার পদ্ধতি সম্পর্কেও সেই আদিবাসীদের কোনো ধারণা নেই। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইস্টার আইল্যান্ডের কবর ও ধ্বংসাবশেষ খোঁড়াখুঁড়ি করে অনুমান করেছেন যে রাপানুই সভ্যতার স্বর্ণযুগে এই দ্বীপের জনসংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি ছিল। তাহলে সেই রাপানুই সভ্যতার মানুষরা কোথায় গেল? সভ্যতার এক শিখরে পৌঁছে কী ভাবে তারা সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল? শত্রুর আক্রমণ? কোনো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ? মহামারী? না, এর কোনটারই প্রমাণ কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে পাননি। যা প্রমাণ মিলেছে তা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে হঠাৎ করে কোনো একটা ঘটনার জন্য সভ্যতাটা ধ্বংস হয়ে যায়নি। বরং দু তিনটে প্রজন্ম ধরে ক্ষয় হতে হতে ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু কেন হলো এমন ক্ষয়? তার আগে ইস্টার আইল্যান্ড নিয়ে আরেকটা রহস্য সম্পর্কে বলা প্রয়োজন। প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে এই হাজার হাজার টনের পাথরের মূর্তিগুলো দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কী ভাবে। ইস্টার আইল্যান্ড প্রায় সম্পূর্ণভাবে গাছপালশূণ্য, শুধু ঘাসে ঢাকা। তাই কাঠের চাকা অথবা গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এই রহস্যের কিনারা করেন শেষ অবধি উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা। তাদের গবেষণায় উঠে আসে যে এই দ্বীপ একসময় বড় বড় গাছপালায় ঢাকা ছিল, চাষাবাদও হত খুব ভালো কারণ দ্বীপের মাটি ছিল উর্বর। কী হলো সেই গাছপালা, চাষাবাদের? এর উত্তর আছে সেই অতিকায় মুর্তিগুলোতেই। বিশ্ববিখ্যাত নৃতত্ববিদ জ্যারেড ডায়মন্ড দীর্ঘ গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে এই অতিকায় সব মূর্তিই কাল হয়েছিল রাপানুইয়ের। মূর্তিগুলো সবই রাজা বা প্রভাবশালী পূর্বপুরুষদের। রাপানুইয়ের মানুষজন কোনো অজানা কারণে এই অতিকায় মূর্তি নির্মাণে এতটাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের সমস্ত শ্রম, উৎপাদনের সমস্ত উদ্বৃত্ত ব্যয় হতো শুধুই মূর্তি বানাতে। এর ফলে এক সময় ব্যাহত হতে থাকে চাষাবাদ, মাছ-শিকার। অর্থাৎ একটা সভ্যতা নিজের সমস্ত ধন দৌলত দিয়ে, সমস্ত পুঁজি দিয়ে শুধুই অতিকায় মূর্তি বানিয়ে চলেছে, উৎপাদনবৃদ্ধি বা প্রযুক্তিগত উন্নতির কথা না ভেবে। এই মূর্তি বানানোর পাগলামির ফলে আরেকটি ক্ষতিও হয়। পাথর টেনে আনার জন্য দ্বীপের অধিকাংশ বনস্পতিই কেটে ফেলে রাপানুইয়ের মানুষজন। সেই কাঠ দিয়ে তৈরি হতে থাকে চাকা, সিঁড়ি। পরিবেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিন্দুমাত্র না ভেবে তারা এই ধ্বংসকাজে লিপ্ত হয়। এর ফলে একটা সময় গিয়ে জমির উর্বরতা নষ্ট হতে থাকে, চাষাবাদ ভেঙে পড়ে, যে টুকু গাছ অবশিষ্ট ছিল তাও নষ্ট হয়ে যেতে থাকে জমি অনুর্বর হয়ে যাওয়ার ফলে। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ক্রমশ উন্নত নগরসভ্যতার পতন হয়, জনসংখ্যা কমতে থাকে। একটা সভ্যতা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যায় কারণ নিজের উদ্বৃত্তকে উন্নতির কাজে না লাগিয়ে, উৎপাদনের কাজে না লাগিয়ে, তাই দিয়ে শুধু মূর্তি বানানোর ফলে।
 
গুজরাটে বল্লবভাই প্যাটেলের মূর্তি বসেছে, উচ্চতা ১৮২ মিটার, খরচ ৩ হাজার কোটি টাকা। মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার শিবাজির একটি মূর্তি নির্মাণ করছে যার উচ্ছতা হবে ২১২ মিটার, খরচ ৪ হাজার কোটি টাকা। যোগী আদিত্যনাথ বলেছে উত্তর প্রদেশে একটি রামের মূর্তি নির্মাণ করা হবে ১০০ মিটার উচ্চতার, যার জন্য আনুমানিক খরচ হবে ২ হাজার কোটি টাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন