শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১৮

যাদবপুর এবং প্রবেশিকা ~ সৌরিত ভট্টাচার্য্য

আবার বড়ো লেখা। তবে কথাগুলো বলা দরকার ছিল 

পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ও কাউন্সিলের স্কুলগুলোতে ইংরেজি পড়ানো নিয়ে এই লেখা। যারা পর্ষদে/কাউন্সিলে পড়েছেন তারা বিষয়টা ভালো বুঝবেন। আর আপনি যদি আমার মতো কলকাতা থেকে অনেক দূরে কোনো একটি ছোট শহরে বা গ্রামের পর্ষদভুক্ত স্কুলে পরে থাকেন তাহলে আরো ভালো বুঝবেন। আমি সকলের কথা লিখছিনা। আমার কথা লিখছি। আমি পড়েছি এমন একটা সময়ে যখন পঞ্চম শ্রেণীতে না উঠলে ইংরেজি পড়া যেতনা। সিপিএমের দূরদর্শিতা আর র্পারদর্শিতা দুয়ের কারণেই আমরা প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি পড়িনি। আলিপুরদুয়ারের ভালো বাংলা মিডিয়াম স্কুল, ম্যাকউইলিয়াম হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর প্রবেশিকা পরীক্ষার কিছু দিন আগে তরিহোরি করে ইংরেজি আলফাবেট গুলো সঠিক ক্রমে শেখানো হয়েছিল আর একটা গরুর রচনা মুখস্থ করানো হয়েছিল। যদ্দুর মনে পরে ওই গরুর রচনাটাই পরীক্ষায় এসেছিলো। তারপর পঞ্চম শ্রেণীতে অ্যানুয়াল পরীক্ষায় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ছোট হাতের ও বড়ো হাতের ইংরেজি আলফাবেট সঠিক ক্রমে লিখতে এবং এরোমি আরো কিছু লিখতে যাতে সব মিলিয়ে আমি ১০০ তে ৯০ পেয়ে বাড়ির সকলকে চমকে দিয়েছিলাম। বলে রাখি এটা আমি ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সালের কথা বলছি। এখনো পরিষ্কার মনে আছে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে আমাদের জিজ্ঞেস করা হতো সেন্টেন্স কাকে বলে, ভার্ব কাকে বলে, নাউন কাকে বলে ইত্যাদি। মানে, পরিষ্কার সংজ্ঞা দাও। ইংরেজিতে। বইতে এমন বাজে ভাবে সংজ্ঞা লেখা থাকতো, আর যেহেতু বাড়িতে দেখানোরও কেউ ছিলোনা, শিখতেও ইচ্ছে করতো না. এই সংজ্ঞাগুলো স্কুলে বলতে পারলে ভালো, না পারলে হাতে একটা করে বেতের বাড়ি। চিন্তা করে গা কাঁপতো। তাও সংজ্ঞা মুখস্ত হতো না. অনেক সময় বাংলায় বলে দিতাম, তাতেও পার পেতাম না. এরপর ইংরেজিতে নম্বর কমতে কমতে অষ্টম শ্রেণীতে প্রায় ফেইল করে যাই. খুব কঠিন প্রশ্ন তৈরী করা হয়েছিল. বলেই দেয়া হয়েছিল প্রশ্ন কঠিন হবে. তাই ওরাল ও অন্যান্যতে প্রচুর মার্ক্স্ দেয়া হয়েছিল। অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ৬০ এ ১২ পেয়েছিলাম। এরপর বাবা একজনের কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়তে পাঠালেন. তিনি পরবর্তী চার বছর গ্রামারের দিকটা অনেক শিখিয়েছিলেন। তবে তাও অনেক ভুলভ্রান্তি রয়ে গ্যাছে. এখনো লিখতে ভুল হয়। হয়তো সারাজীবনই হবে. 

আমার সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে যা ইংরেজি পড়ানো হতো তা হলো মূলত এই গ্রামার আর প্র্যাক্টিক্যাল ইংলিশ। এই যেমন ছুটির দরখাস্ত। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার দরখাস্ত। প্রেসি, রচনা ইত্যাদি। এগুলো কোনোটাই খারাপ নয় তবে কোনোটার প্রতিই স্বাভাবিক ভাবে ভালোবাসা আসেনা। কারণ ওই নম্র বয়সে ভালোবাসা থাকে অনেক বেশি সাহিত্যের সূক্ষ অনুভবের প্রতি বা বিজ্ঞানের চমৎকার উদ্ধাবনের প্রতি। টেকনিক্যালিটিস এর প্রতি ভালোবাসা তৈরী হতে সময় লাগে। আর এই ব্যাপারটাই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ গা করেনি। আমাদের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সাহিত্য ছিল কিছু কবিতা আর কিছু গদ্য আর একটা নাটকের অংশবিশেষ। উচ্চমাধ্যমিকেরটা  মনে আছে তাই বলছি। গদ্যে ছিল কতগুলো রসকষহীন প্রবন্ধর অংশবিশেষ যা এমন কিছু লোকজন লিখেছেন যাদের পরবর্তী পনেরো বছরের সাহিত্যচর্চার জীবনে আর কোনোদিনই বিশেষ ভাবে পাইনি। এ জি গার্ডিনারের 'অন লেটার রাইটিং, লুই ফিশারের 'মাই উইক উইথ গান্ধী',  জ্যাকব ব্রনোওস্কির 'টেকনোলজি  ফর মানকাইন্ড' ইত্যাদি। যাদের পেয়েছি ও যারা একটি বিশেষ সময়ের মেজর ইংরেজি গদ্যকার যেমন ডিকেন্স, হার্ডি, এলিয়ট, ব্রন্টে সিস্টার্স, অরওয়েল, ইত্যাদি সিলেবাসে তাদের কেও নেই. আমি বলছিনা এদের সবাইকে পড়াতে হবে. অন্তত, আমাদের এই নামগুলোর সাথে পরিচিত করে দিন যাতে স্নাতকস্তরের পড়াশোনায় হোঁচট খেয়ে না যাই. যে পাঠ্যবই থেকে এসব পড়তে হতো তাতে কিছু উপরুল্লিখিত লেখকের লেখা ছিল..সেগুলো কোনোদিন পড়তে অনুপ্রাণিত করা হতোনা। যতটুকু দরকার ততটুকুই। প্রশ্ন উত্তর দাও. নম্বর পাও. এগোও। 

এই জ্ঞান নিয়ে আমরা মধ্যে কেউ কেউ আসতাম কলকাতায় যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, সেন্ট জেভিয়ার্স এর প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে যেখানে জিজ্ঞেস করা হয় সাহিত্য কি, বিজ্ঞাপন কি সাহিত্যের অংশ, জন ডান কে, মিল্টন এর এরপজিটিকা নিয়ে লেখো, দুর্গেশনন্দিনী নিয়ে লেখো, মকবুল সিনেমা নিয়ে লেখো, ইত্যাদি। খুবই চমৎকার লাগে ভাবতে যে কত কিছু সাহিত্যের অংশ. তবে স্কুলের এইটুকু স্টক নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা কোথা থেকে এগুলো নিয়ে লিখবে? কেউ যদি নিজে থেকে পড়াশোনা করে থাকে সে কিছুটা জানবে। তবে ছোট শহরে বা গ্রামে নিজে থেকে পড়াশোনায় বা করবে কি করে? তার জন্য বই পত্র কিনতে হবে, অন্যরকমের গান শুনতে হবে, সিনেমা দেখতে হবে, পারলে বছরে একবার কলকাতা যেতে হবে. কে নিয়ে আসবে। বাবাদের জেনারেশন যারা দেশভাগের পর ওপর বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসেছে তারা নিজের জীবন দাঁড় করাতেই সময় গোটা সময়টা বেরিয়ে গ্যাছে। উনাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে এটা বুঝতে যে তাদের নিজের বাড়ি এখন আর নিজের নেই. নতুন জায়গা। নতুন ঘর. পরিবার ছেড়াবেড়া। এখন শুধু নিজেদের বাঁচানো আর টিকে থাকার লড়াই। তাই তাদেরকে দোষারোপ করে লাভ নেই. তাদের থেকেই কেউ কেউ আশেপাশের স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকা হয়েছেন ফলে তারাও নিজের কাজটুকু করিয়ে দিয়েই সমাপ্তি টেনেছেন. আর স্কুলে যদি বাংলা মিডিয়াম হয় তাহলে ছাত্র ছাত্রীকে গোটা স্কুল জীবনে ইংরেজি গ্রামার শেখাতে গিয়েই হিমশিম খেতে হয়েছে. আর ইংরেজি মিডিয়াম এ পড়ার মতো অধিকাংশেরই পয়সা ছিলোনা। ইন ফ্যাক্ট, কিছু জায়গায় তো ইংরেজি মিডিয়ামই ছিল না. আলিপুরদুয়ার শহরে আমার সময় মোটের ওপর একটি নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল ছিল. তবে তাদের ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা হতে যে তাদের প্রাইভেট টিউশন পড়াবে কারা? তাই অনেকেই ইংরেজি মিডিয়াম থেকে বাংলা মিডিয়াম এ চলে আসতো। আবার অনেক সময় পয়সা ঠেকলেও অনেকে সিপিএম আইডিওলজির জন্য নিজের ছেলে মেয়েদের বাংলা মিডিয়াম এ ভর্তি করাতেন না। আমার জেনারেশনটা এইরকম কিছু 'ঐতিহাসিক' ভুলের শিকার। আমার পরের জেনারেশন এ পর্ষদে/কাউন্সিলে শুনেছি অনেক নম্বর ওঠে. তবে বিভিন্ন সময়ে অনেকের সাথে কথা বলে বুঝেছি সমস্যাগুলো একই রয়ে গ্যাছে। এখনো সেই কয়েকটা গদ্য কবিতা সংক্ষিপ্ত উত্তর ইত্যাদি। অনেক জায়গাতেই সার্বিকভাবে কোনো অনুপ্রেরণা নেই. কোনো গাইডেন্স নেই. এই রকম ইংরেজি (সাহিত্য) শেখানোর পর যখন সেই ছাত্র বা ছাত্রীটি স্নাতকস্তরে পড়তে আসবে আর প্রবেশিকা পরীক্ষায় ধাক্কা খাবে অথবা পরে কোনো এক কলেজে  ভর্তি হয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, কবিতা, গদ্য, নাটক পুরোপুরিভাবে পরে উত্তর লিখবে ও হোঁচট খাবে, সে ও তো সকলের মতো ভয় পাবে। ভাববে আমি এতগুলো মার্ক্স্ পেয়েও কিছুই জানিনা। আমায় সকলে বললো আমি কত ভালো, আমি ১০০ তে ৯০, ৯৫ এমনকি ৯৯ পেয়েছি। অথচ এখন ৫৫-৬০ তুলতে পারছিনা। মা বাবা পাড়া প্রতিবেশী বলছে আমি কলেজে উঠে বাজে সঙ্গে তলিয়ে গ্যাছি. এই রকম একটি চরম দৈনন্দিন মানসিক ক্রাইসিস এর সাথে যুক্ত করুন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর পরীক্ষায় বড়ো প্রশ্নের আধিপত্য, নোট পড়া, টিউশন পড়া, মার্ক্স্ না ওঠা, আর শেষমেশ স্বীকার করা ইংরেজি বড্ডো কঠিন। আমরা দ্বারা হবে না. 

তাই আজ যখন যাদবপুরে এডমিশন টেস্ট পাল্টাও, মার্ক্স্ দিয়ে বিচার করো, সকলকে সুযোগ করে দাও মার্কা পপুলিস্ট রাজনীতি হচ্ছে, তখন এটাই বলতে হয় যে যাদবপুর প্রেসিডেন্সির মান না নামিয়ে মধ্যশিখা পর্ষদে/কাউন্সিলে কলাবিভাগ পড়ানোর অবস্থার উন্নতি করুন। বাংলার মেজরিটিই পর্ষদের স্কুলে পড়াশোনা করে. তাদের গুরুত্ব দিন. খালি কলকাতা কলকাতা করা বন্ধ করুন. কলকাতার বাইরে ভাবুন। ভাবুন কলাবিভাগের সাব্জেক্ট গুলোকে কিভাবে ইন্টারেষ্টিং উপায়ে পড়ানো যায়. সিলেবাসকে কি করে আপটুডেট করা যায়। কি করে স্কুল ও স্নাতকস্তরের শিক্ষায় একটা মিল তৈরী করে যায় যাতে আমরা স্নাতকস্তরে এসে বিশাল এক ধাক্কা খেয়ে না যাই. নজর দিন কি করে ছাত্রছাত্রীকে অনুপ্রেরণা দেয়া যায়.পরিমান মতো শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ করুন। তাদেরকে শিক্ষিত করুন। তাদের বোঝান যে সকল শিক্ষক শিক্ষিকার নিজের ক্লাসে সকল ছাত্র ছাত্রীকে নাম ধরে চেনা উচিত। এই ছাত্র ছাত্রীগুলোর ভালোবাসা প্রয়োজনীয়তা জানা উচিত। স্টুডেন্ট-স্টাফ রেসিওর দিকে নজর দিন. এক্সট্রা কাররিকুলার একটিভিটি বাড়ান। এগুলোর মধ্যে যদি কিছুও করে থাকেন, তাহলে নজর দিন এগুলো সুষ্ঠভাবে সব জায়গায় পালন করা হচ্ছে কিনা? অবশ্যই স্টুডেন্ট দের থেকে ফিডব্যাক নিন. তারপর নজর দিন স্নাতকস্তরে কিভাবে বেটার করা যায়. আপামর বাংলায় স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো হলে স্নাতকস্তরে কলেজও ভালো মানের ছাত্রছাত্রী থাকবে। হেলথি কম্পেটিশন হবে. মার্ক্স্ নিয়ে আর ব্যাকডোর দিয়ে কাড়াকাড়ির রাজনীতি কমবে। আর আমাদের মতো অনেক ছাত্রছাত্রীকে কথায় কথায় কলকাতা ছুটতে হবে না, অথবা সারাজীবন হ্যানস্থ হতে হবে না. এগুলো না করে যাদবপুর এডমিশন টেস্ট নেয়া দরকার আছে কি নেই এসব ফালতু বিতর্ক বন্ধু করুন। যাদবপুরের কলাবিভাগ নিয়ে ভাবা বন্ধ করুন। এই বিভাগ রাজ্য স্তরেই নয়, জাতীয় ও আন্তর্জান্তিক স্তরেও সুপরিচিত। তাই সেখানকার শিক্ষক শিক্ষিকারা জানেন তাদের কি করলে ছাত্রছাত্রীদের ও নিজেদের ভালো হবে. মাত্র তো গুটি কয়েক ভালো ইউনিভার্সিটি/কলেজ রাজ্যে পড়ে রয়েছে। তাদের কে তো ভালো থাকতে দিন. তাদের মান মাটিতে নামিয়ে কি লাভ হবে আমাদের?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন