রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

কল্পনা দত্ত ~ চন্দন দাস

''ধরা পড়ার পর মাস্টারদা, ফুটুদা আর আমাকে নিয়ে নতুন করে মামলা শুরু হয়েছিল। আমরা কাঠগড়ায় একসঙ্গে দাঁড়াতাম। সেইসময় একদিন ফুটুদা বলেছিলেন, তোকে ভালো লাগে। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি? আমার মৌনতায় হয়তো সম্মতি ছিল। কারন এর প্রায় দশ বছর পরে যখন জোশী(পিসি জোশী) আমাকে প্রোপোজ করে তখন আমি বলেছিলাম আমি যে তারকেশ্বর দস্তিদারকে কথা দিয়েছি।''
                                          -----'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমনকারীদের স্মৃতিকথা', লেখিকা-কল্পনা দত্ত, পৃষ্ঠা ১২১।

'ফুটুদা' ফিরে আসেননি। ১৯৩৩-এ একইসঙ্গে মাস্টারদা সূর্য সেন এবং ফুটুদা, অর্থাৎ তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৪ই আগস্ট। 
কে জানতো, তার ঠিক চোদ্দ বছর পর চট্টগ্রামে পা রাখতে পাসপোর্টের প্রয়োজন শুরু হবে? কে জানতো একটা জঘন্য বেইমানীর কাঁটাতার লক্ষ কোটি বছরের জন্য পেতে দেওয়া হবে সংগ্রামী, আত্মত্যাগী একটি জাতির বুকে? কে জানতো স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে একা 'দখল' করার উদ্যোগ শুরু হবে একটি দলের পক্ষ থেকে? কে জানতো শাসক আর রাষ্ট্রের সব দখলের ধারাবাহিকতা বজায় থাকতেও, স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও রুখে দাঁড়াবে কল্পনা দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদাররা?
আজও লড়াই আছে। কারন শোষণ আছে। কাঠগড়া আছে, শোষিতের জন্য। তবু স্বাধীন, সার্বভৌম, হেমন্তের আকাশের মত স্বপ্ন আছে আজও। আর আছে আজও, তাকে ধারন করার দুর্জয়, অনবদ্য হৃদয়। সেই হৃদয়ের দুটি প্রকোষ্ট — একটির নাম ফুটুদা। আর একটি সূর্য সেনের বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি তারকেশ্বর দস্তিদার। কিন্তু দুই প্রকোষ্ঠের মাঝে কোনও দেওয়াল নেই। কোনদিন ছিল না। 
কাঠগড়ার সেই কয়েকমুহুর্তের বিবরণই তার প্রমাণ।
কল্পনা দত্তের 'শাস্তি' হয়েছিল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের। রায়ে স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি বলেছিলেন,''মেয়ে বলে এবং কম বয়স বলেই প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা গেলো না।'' তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজের চিঠি এবং লক্ষ মানুষের আবেগ, প্রতিবাদের মুখে কল্পনা দত্তের আন্দামানের কারাগারে পাঠানো রদ করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ শাসকরা। তবে ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ — দেশের বিভিন্ন জেলে তাঁকে দিন কাটাতে হয়েছিল। রাজশাহীর জেলে বসে মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির খবর পেয়েছিলেন। কল্পনা দত্তের কথায়,''মাস্টারদার ফাঁসি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, তবু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম রাজশাহী জেলে বসে: 'তোমার আদর্শ বহন করে নিয়ে আমরা চলব।'
সেই আদর্শের স্রোত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সেনানী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষদের সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত খুঁজে পেয়েছিলেন কমিউনিস্টদের মধ্যে।
আর 'ফুটুদা'? সেই কথা দেওয়া? কল্পনা দত্ত জানিয়েছেন,''দুর্ভিক্ষের পরে বোম্বেতে একটা কনফারেন্স হয়েছিল। সালটা সম্ভবত ১৯৪৩। আমি চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে সেই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানেই জোশী আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি বললাম আই হ্যাভ প্রমিসিড্‌ তারকেশ্বর দস্তিদার। জোশী বলল, তুমি জানো না ওর ফাঁসি হয়ে গেছে। ও তো আর কোনদিন আসবে না।.....তাও আমি দোনামোনা করছিলাম। বিটি(বিটি রণদিভে), ডক(ড: গঙ্গাধর অধিকারী) এরা ইনসিস্ট করাতে বিয়ে করলাম।'' তারপরও ১৯৯৫-র ৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কমরেড কল্পনা দত্ত বেঁচে ছিলেন। সব লড়াইয়ে 'ফুটুদা'-র ঐতিহ্য, আত্মত্যাগের শিক্ষা তাঁর পাথেয় ছিল।
এবারে পাঠকের একটি প্রশ্ন সম্ভবত অবধারিত। আপনি মশাই, কল্পনা জোশী(দত্ত)-র ওই বইটির বিষয়ে এত কথা লিখছেন কেন? বইটির বিজ্ঞাপনে কাজ কী? পাঠকদের জানাই, বইটি বর্তমান বাজারে প্রায় দুর্লভ। একটি কপি জোগাড় করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। স্বাধীনোত্তর ভারতের বড় দোষ — স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগ্রামী ধারার বই, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন কখনও প্রয়োজনিয় মাত্রায় পৌঁছোয় না। শাসকের ভয় — যদি গুটিকয় মানুষের দারুন অবদানের যে ভাবমূর্তি তিলেতিলে, প্রবল বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে গড়ে তোলা হয়েছে, তা যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ে যায়। কল্পনা দত্ত, গণেশ ঘোষ, সতীশ পাকড়াশি, সুবেধ সেনরা কেন তেভাগা-তেলেঙ্গানায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, কেন স্বাধীনতার পরে তাঁরা কমিউনিস্ট-জীবন বেছে নিয়েছিলেন — এ' সব প্রশ্ন বড় বিপজ্জনক। 
তার চেয়ে সোজা কী? এমন বাজার গড়ে তোলো যেখানে অনেক, অনেক, অনেক সহজে পাওয়া যায় মমতা ব্যানার্জির বই — তা সে 'উপলব্ধি'-ই হোক কিংবা 'কথাঞ্জলী'। কিংবা সাভারকার। চেনেন তো এই মানুষটিকে? পুরো নাম বিনায়ক দামোদর সাভারকার। কল্পনা দত্ত কিংবা সূর্য সেনের কথা বেমালুম ভুলে গেলেও রাষ্ট্র একটি আস্ত বিমানবন্দর 'বীর সাভারকার'-র নামঙ্কিত করেছে। সেটি আন্দামানে। সেখানেই সেলুলার জেল। সেখানে কল্পনা দত্তের নির্বাসন আটকাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ। আর সেই জেল থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চিঠি লিখেছিলেন ভারতে 'হিন্দুত্বের' প্রণেতা সাভারকার। কী ছিল তাতে? ঐতিহাসিক এ জি নুরানী তাঁর 'সাভারকার ও হিন্দুত্ব' বইয়ে লিখছেন,''আন্দামানের রাজধানী পোর্টব্লেয়ারে ১৯১১-র ৪ঠা জুলাই সাভারকারকে আনা হয়। কিন্তু বছর কাটতে না কাটতেই তিনি 'ক্ষমার জন্য আবেদনপত্র' জমা দিলেন।...১৯১৩-র ১৪ই নভেম্বরের আরেকটি আবেদনপত্রে এটির উল্লেখ রবেছে। গভর্নর জেনারেলের কার্যনির্বাহী পরিষদের হোমমেম্বার রেগিনাল্ড দ্রাভকের উদ্দেশ্যে লিখিত ১৯১৩ সালের এই আবেদনপত্রটি 'মহামান্য' সম্বোধনে তাঁকে '১৯১১ সালে ক্ষমার জন্য আমি যে আবেদনপত্রটি পাঠিয়েছিলাম' সেটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।'' 
ব্রিটিশ শাসকের কাছে সাভারকার আরও কী শপথ করেছিলেন? তিনি লিখেছিলেন,''সরকার যেমনভাবে চাইবেন ঠিক সেই শক্তিতে তাদের হয়ে কাজ করবো। যেহেতু এ আমার বিবেকের উচ্চারণ সেকারণে আমার ভবিষ্যৎ আচরণও তেমনই হবে আশা রাখি। আমাকে জেলে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না। সে তুলায় অন্য ক্ষেত্রে হয়ত কিছু হতে পারে। পরমশক্তিধরের পক্ষেই সদয়তার মহত্ব দেখানো সম্ভব। কাজেই অনুতপ্ত পুত্র তার পিতৃমাতৃসদৃশ সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথায় ফিরে আসতে পারে?''
আহা! স্বাধীনতার যোদ্ধার কী করুণ আবেদন 'পিতৃমাতৃসদৃশ', 'পরমশক্তিধর' ব্রিটিশ সরকারের কাছে।
তবু স্বাধীনতার সত্তর বছরে সাভারকারের দর্শনকেই ছড়িবে দেওয়া হয়েছে দেশজুড়ে। ছড়িয়েছেন তাঁরাই, যাঁরা সূর্য সেনদের দৃষ্টিভঙ্গী, লড়াইয়ের ইতিহাসের প্রকাশ সুকৌশলে আটকেছেন।
তারা নির্দিষ্ট কোনও দল নয়। দলে ভাগ হয়ে আছেন। কিন্তু আদপে শাসক এবং শোষক। মমতা ব্যানার্জি তাদেরই উপাদান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন