শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৮

ডাক্তারি শিক্ষার খরচ ও গ্রামের পোস্টিং ~ ডা: বিষান বসু

কিছু কিছু যুক্তি এমন আজব হয়, যাতে স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া ছাড়া পথ থাকে না। পালটা যুক্তি ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করা যেতে পারে, সেই নিয়েই কনফিউশন। 

সদ্য পাশকরা ডাক্তারবাবুদের বন্ডে বেঁধে গ্রামীণ স্বাস্থ্যপরিষেবায় পাঠানো ও তজ্জনিত জটিলতা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত অমিতাভবাবুর লেখাটিও সেই জাতের।

আপাত যুক্তিসমূহ সহজপাচ্য। ডাক্তারদের পড়াতে সরকারের খরচ, গ্রামে ডাক্তার না গেলে ক্ষতিপূরণ, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ডাক্তারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ, অস্বচ্ছল চিকিৎসকদের গ্রামে যেতে বাধ্য হওয়া, তজ্জনিত আর্থিক ক্ষতি, সেই ক্ষতির ক্ষতিপূরণের রাস্তা, স্বচ্ছল-অস্বচ্ছলের বেছে নেওয়ার সুযোগের অসাম্য, গ্রাম-শহরের অসাম্য - সলমাজরির কাজের নিপুণতায় সাজিয়েছেন তিনি।

পড়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম।

আমার তরফে সামান্য কিছু প্রশ্ন। 

আপনারাও ভাবুন। 

অমিতাভবাবুর কাছে পৌঁছোনোর সুযোগ আমার নেই, কেউ, পারলে, প্রশ্নগুলো ওনার কাছে পৌঁছে দেবেন, প্লীজ।

খবরের কাগজে উত্তর পাঠানো যেতো। পাঠালাম না, কেননা আগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তাঁরা বক্তব্য ছাপাতে যতোখানি আগ্রহী, উত্তর প্রকাশে তার ভগ্নাংশও নন।

প্রথমত, একটু সরকারবাহাদুরকে প্রশ্ন করবেন, একজন ডাক্তার তৈরী করতে সরকারের খরচ ঠিক কতোটা? সরকার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন, প্লীজ? প্রায়ই শুনছি, এই খরচ প্রায় তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ। কিন্তু, কিভাবে হিসেবটা হলো, সেইটা তো পরিষ্কার হওয়া দরকার। মেডিকেল কলেজের, যেহেতু, পুরো, হ্যাঁ পুরো পরিকাঠামোই রোগিদের চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়, সেহেতু, হিসেবটা অতোটা সহজ নয়। আর, সরকারি চাকুরিরত যে ডাক্তারবাবুরা শুধুমাত্র রোগির চিকিৎসা করেন, তাঁদের সাথে মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক-শিক্ষকদের (যাঁরা চিকিৎসার সাথে সাথে ছাত্রদেরও পড়ান, পরীক্ষা নেন) বেতনক্রম কিছু ভিন্ন নয়। কাজেই, চিকিৎসক-শিক্ষক নিয়োগের পেছনে সরকারের বাড়তি খরচের কথাটা ঠিক নয়।

তাই হিসেবটা ভেবেচিন্তে করুন। যেমন ধরুন, সাধারণ একটা ইক্যুয়েশন ।

(একটা মেডিকেল কলেজ চালাতে সরকারের বার্ষিক খরচ - সমান সুযোগসুবিধের সমান বেড সংখ্যার সমসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা হওয়া একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল চালানোর বার্ষিক খরচ) ÷ সেই মেডিকেল কলেজে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা = ডাক্তারি ছাত্রের পেছনে সরকারের বার্ষিক লগ্নি

হ্যাঁ, লগ্নিই। কেননা, সরকার সেই খরচের কথা ফলাও করে বলেন, উশুল করার চেষ্টাও করেন, সাধ্যমত।

পাশাপাশি, একজন ইঞ্জিনিয়ার তৈরিতে, বা একজন সায়েন্স বা যেকোনো শাখার গ্রাজুয়েট তৈরিতে সরকারের খরচ কতো জানাবেন। না, তাঁদের কাছ থেকে উশুল করার জন্যে নয়, শুধু একটা তুলনামূলক আলোচনার জন্যে।

আবার, ধরুন, ডাক্তারি ছাত্ররা যেমন করে ইন্টার্নশিপ করেন (তিনবছরের বন্ডের কথা না হয় তুললামই না), সামান্য টাকায়, হাতেকলমে কাজ শেখার জন্যে, তেমন করে এই বিপুল সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারও সরকারি ক্ষেত্রে কাজ শেখার জন্যে একবছর যদি কাজ করেন, হয়তো গ্রাম-মফস্বলের চেহারাটাই বদলে যেতে পারে। আর, তাহলে, কে জানে, হয়তো ডাক্তাররাও গ্রামে যেতে তেমন করে আপত্তি করবেন না।

দ্বিতীয়ত, ডাক্তারদের গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহাকে অমিতাভবাবু দেখতে চেয়েছেন মূলত আর্থিক ক্ষতির দৃষ্টিকোণ থেকে। আর ভাবতে চেয়েছেন, সেই আর্থিক ক্ষতির ক্ষতিপূরণের উপায় কী হতে পারে।

কিন্তু, আমার মনে হয়, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। 

গ্রামে না যাওয়ার পেছনে আর্থিক ক্ষতি কিন্তু ফ্যাক্টর নয়। কেননা, কর্পোরেটে চাকরির তুলনায় মফস্বলে প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিসের আয়, কোনোভাবেই, কম নয়। সত্যি বলতে কি, ছোটো শহরে অনেক সার্জেনের আয় কর্পোরেট হাসপাতালের অবেক সিনিয়র কনসাল্ট্যান্টকেই লজ্জা দিতে পারে।

প্রশ্নটা, কাজেই, আর্থিক ক্ষতির নয়।

প্রশ্নটা পরিকাঠামোর, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের।

এবার ধরুন, একটি সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা জায়গার হাসপাতালটি হঠাৎ করে একেবারে আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠবে, এমন তো নয়। হাসপাতালটিকে উন্নত করার পাশাপাশি জায়গাটারও উন্নতি দরকার। যেমন, ভালো স্কুলকলেজ, থাকার স্বাচ্ছন্দ্য, যাতায়াতের সুযোগসুবিধে ইত্যাদি ইত্যাদি।

তা অমিতাভবাবু যখন আর্থিক ইন্সেন্টিভের সর্বময় ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই চুঁইয়ে আসা বিকাশের তত্ত্বেও আস্থাবান।

শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী থাকলে চলবে?

আসুন না, বেসরকারী কোম্পানীরাও তাঁদের অফিস একটু কলকাতার বাইরে শুরু করুন। যেমন ধরুন, আইটি সেক্টর। তাঁদের কাজ তো বিশ্বব্যাপী। অফিস পুরুলিয়ায় হলে অসুবিধে তো কিছু নেই। বা, আনন্দবাজারসহ অন্যান্য সংবাদপত্রের অফিস। চাঁদনি চকের মতো ঘিঞ্জি জায়গায় পার্কিং-এর চাপ ইত্যকার অসুবিধের কথা ভাবতে হবে না, ধরুন, রামপুরহাটের একটু বাইরে অফিসটা শিফট করলে।

ভেবে দেখুন না একবার।

বড়ো বড়ো অফিস থাকলে, জায়গাটারও উন্নতি হবে। ডাক্তারবাবুরাও যেতে গাঁইগুঁই করবেন না। সরকারকেও বন্ডে বেঁধে ডাক্তার পাঠাতে হবে না।

আপনারা সবাই ভাবুন। অমিতাভবাবু আপনিও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন