'কমিউনিষ্টসুলভ জীবনযাপন' ইত্যাদি নিয়ে বহু চর্চা চলছে। ইতিমধ্যেই গতকালকে কমিউনিষ্ট পার্টির একজন সদস্য এবিপি আনন্দের স্টুডিওতে এসে ইন্টারভিউতে বলেছেন যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে তাকে কোথাও যেতে হলে পার্টি থেকে তাকে 'গ্যারেজে' থাকতে দেওয়া হয়েছে। এর থেকে তিনি বাঙালীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ উপলব্ধি করেছেন।
তো যেটা বলছিলাম, জীবনচর্চা বনাম জীবনচর্যা, এগুলো বেশ ধুসর পরিসর অনেকক্ষেত্রেই। তাই এগুলো নিয়ে চর্চা না করে দুটো গল্প বলি।
২০০৭ সাল। তখন সদ্য ব্যাংগালোরে ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের সাথে অল্প অল্প যুক্ত হচ্ছি। তা এরকম সময় হায়দ্রাবাদে ফ্রী সফটওয়ার কনফারেন্সে আমাদের ভলান্টিয়ার করে পাঠানো হলো। বিভিন্ন রাজ্য থেকে যারা ডেলিগেট এসেছেন, তাদের থাকবার ঘর দেওয়া হয়েছে ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউসে। আমাদের কয়েকজনকে সকালে পাঠানো হলো ত্রিপুরার ডেলিগেটকে নিয়ে সেমিনার হলে আসতে। আমরা সেই ডেলিগেটের ঘরের বাইরে পৌছালাম। ঘর মানে হোস্টেলের যেরকম ঘর হয়, সেরকম। উনি ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন - আপনারা একটু বসুন, আমার একটু সময় লাগবে। আমরা বললাম - তাহলে আমরা নিচে আছি, চা সিগারেট খাচ্ছি। নিচে বেশ কিছুক্ষন সময় অপেক্ষা করলাম, তখনও উনি নামছেন না। আবার ওপরে গেলাম। দেখলাম সেই ডেলিগেট একটা বালতিতে নিজের গেঞ্জি জাঙিয়া কেচে জানলায় সেগুলো শুকোতে দিচ্ছেন। আমাদের দেখে হেসে বললেন - সরি, এগুলো জার্নিতে নোংরা হয়ে গেছিলো, তাই কাচতেই হলো।
ও হ্যা বলে রাখা ভালো, ত্রিপুরার ডেলিগেট ছিলেন সেইসময়ের এবং বর্তমানের ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী। 'ফ্রী সফটওয়ার ইন ই-গভর্নেন্স' নিয়ে টক দিতে এসেছিলেন।
২০০৮ সাল। ইতিমধ্যে আমি সরাসরি ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য। এবার ঠিক হলো ফ্রী সফটওয়ার ন্যাশনাল কনফারেন্স ব্যাংগালোরে হবে। দায়িত্ব পড়লো আমাদের ঘাড়ে। ব্যাংগালোরের সংগঠনে ফ্রী সফটওয়ার কনফারেন্স সংগঠিত করবার বিষয় অভিজ্ঞ লোক কেউ নেই। তাই আমাদের জানানো হলো যে কেরালার স্টেট প্ল্যানিং বোর্ডের সদস্য জোসেফ থমাস ব্যাংগালোরে আসবেন ১০ -১২ দিন আগে থেকে আমাদের সাহায্য করতে। ঠিক সময় ট্রেন থেকে নামলেন উনি। কলেজের ছাত্রের মতন পিঠে ব্যাগ। নেমেই মিটিং হলো ট্রেড ইউনিয়নের অফিসে। তারপর ওনাকে জানানো হলো যে এই কয়েকদিন ওনার থাকবার এবং খাওয়ার ব্যাবস্থা করে হয়েছে দুই কমরেডের বাড়ি, পালা করে। উনি শুনেই বললেন, থাকবেন না। জিজ্ঞ্যেস করলেন - তোমাদের এই অফিসে রাতে থাকায় নিষেধ নেই তো? তাহলে এখানেই থাকবো। কোথাও যদি লাল ঝান্ডার অফিস থাকে তাহলে সেটা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকবো কেন? আমরা তো বুঝতেই পারছি না উনি কিভাবে অফিসে ঘুমোবেন। খাট নেই, গদি তোষক কিছু নেই। কিন্তু উনি থেকেছিলেন। ১২ দিন বেঞ্চের এক কোনে ব্যাগ রেখে তাতে মাথা দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন রোজ রাতে।
ওপরের দুই ঘটনার দুই ব্যাক্তি, একই পার্টির সদস্য। আমরা জানি, মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে যুক্তি সবার ওপরে, আবেগের খুব একটা জায়গা নেই। কিন্তু এই লোকগুলোকে সামনাসামনি দেখে, হয়তো আবেগে আক্রান্ত হয়েই, মনে হয়েছিলো এই দলটাই করা যায়। এই লোকগুলোকেই কমরেড বলে ডেকে চিরকাল গর্বিত হওয়া যায়।
তো যেই কথা থেকে এত কথার উত্থাপন - ইন্টারভিউ এবং জীবনচর্চা। ১০ বছরের আগের এই দুটো ঘটনা আমার মগজে গরম লোহা দিয়ে খোদাই করা রয়েছে। কালকে মার্কেটে যখন নতুন খোরাক আসবে, তোমাকে কালকেই লোকে ভুলে যাবে। যাও, আপাতত গ্যারেজ হও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন