"কৈলাস হতে বাপের বাড়ি এসেছে পার্বতী,
সঙ্গে গনেশ, কার্তিক আর লক্ষ্মী সরস্বতী। "
মহালয়ার আর হপ্তা খানেক বাকি। পূজোর আগের লাস্ট উইক এন্ড। কৈলাসে মর্ত্যে যাবার প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। এমন সময় কার্তিক ফেসবুকে স্ক্রোল করা থামিয়ে উত্তেজিত গলায় বলল "খবর শুনেছ? ইন্দ্র আমাদের মামারবাড়ি যাওয়া নিয়ে ইনজাংশান জারি করছে।"
সরস্বতী খবরের কাগজ পড়ছিল বিরক্ত মুখে বলল "কেতো ফেসবুক পড়ে ফালতু গুজব ছড়াস না, মর্ত্যের কিছু ভক্ত বাঙালিদের দূর্গাপুজোর ধরনধারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, ভক্ত অসন্তোষের ব্যাপারটা নিয়ে ইন্দ্রের সভায় আলোচনা হয়েছে, ব্যাস এইটুকুই,সব কিছুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ফেসবুকে গুজব ছড়ায়।
মা ব্ল্যাকবেরীটা চেক করতে করতে একটু চিন্তিত গলায় বললে "শুধু আলোচনা নয়, ইন্দ্র ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, কাল দেবতাদের পাঁচ সদস্যের এক কমিটি দূর্গাপুজোর ধর্মীয় ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে কৈলাসে আসবেন। আমরা যেন কোওপারেট করি।"
লক্ষ্মী রেগে টং, "মা নিজের বাপের বাড়ি যাবে আমরা মামার বাড়ি যাব, তাতে কমিটি কি করবে? আসলে হিংসে। তেত্রিশ কোটির আর কারো তো এরকম মামারবাড়ির আদর নেই।"
গনেশ সবসময় অন দ্য টপ অফ এভরিথিং থাকে। বলল "মা আমি মর্ত্যের ট্রেন্ড টা দেখলাম, সকলে সনাতন হিন্দু ধর্মের দিকে ঝুঁকছে, আমাদের কাল কমিটির কাছে প্রেসেন্ট করতে হবে আমরাও খুব সনাতন।" মা বললেন "কত পুরোনো? বৈদিক যুগ? মহামায়া রূপে ফিরে যাব?" গনেশ আরে না অতটা না ওই মধ্যযুগের শেষের দিকটা যখন অরাজকতার দরুন কুসংস্কার খুব বেড়েছিল।"
যাই হোক মা আর ছেলেমেয়েরা ঠিক করলেন কমিটির সামনে দূর্গাপূজার সনাতন রূপ তুলে ধরবেন। মা ভেবেছিলেন কমিটিতে অগ্নি, বরুন, পবন ইত্যাদি দেবতারা থাকবেন কিন্তু দেখলেন এসেছেন তিরুপতি, বৈষ্ণোদেবী, স্বামী নারায়ন, সিদ্ধি সাঁইবাবা, পদ্মনাভন।
গনেশ ফিসফিস করে বললেন এঁরাই এখন স্বর্গের টপ ফাইভ রেভেনিউ জেনারেটর।
প্রশ্নোত্তর পর্ব আরম্ভ হল।
ভক্তির প্রথম স্টেপ হল মূর্তি, সেটার মেটেরিয়ালটা কি? মা জানালেন খড়, মাটি, রঙ। ওঁরা বললেন "ওসব নয় সোনা, রূপা, অষ্টধাতু, রত্নের বিগ্রহ হয়?" মা জানালেন ওসব হয় না তবে কাঠ, কাগজ, শোলা, সিমেন্ট,পাট, দড়ি, পেরেক, ঘুড়ি,ছাতা, ননী, ছানা, বাবলগাম, তাস, ভাঁড় ইত্যাদি মেটেরিয়াল মূর্তি বা প্যান্ডেলে ব্যবহার হয়। কমিটি একটু হেঁচকি তুললেন।
দ্বিতীয় হল খাওয়া দাওয়া। ভক্তরা কতটা খাওয়ার কৃচ্ছ্রসাধন করে? উপবাস? লবন বিহীন অন্নগ্রহণ, ননভেজ না খাওয়া, ভক্তরা এর মধ্যে কোনটা করে? মা বললেন এগুলো ঠিক করে না তবে বাছারা পূজোর সময় ঢেড় খাওয়ার কষ্ট সহ্য করে। আরসালানের সামনে আড়াই ঘন্টা লাইন দিয়েও মাটন বিরিয়ানি না পেয়ে চিকেন বিরিয়ানি খায়, পুজোর কদিন রোজ সন্ধ্যেবেলা আধকাঁচা এগবিহীন এগরোল খায়, অম্বলে গলা জ্বলে গেলেও ষষ্টি থেকে দশমী ফুচকা খাওয়া ছাড়ে না।"
এহেন কৃচ্ছ্রসাধনের বিবরণে কিন্তু কমিটির মন গলল না। তারা গম্ভীর মুখে পরের প্রশ্নে গেলেন।
"নামগান কিরকম করে ভক্তরা?" এবার সরস্বতী হাল ধরলেন। পাছে মা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজা "তোদের ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা" বা "এ তুমি কেমন তুমির" কথা বলে বসে, তাই সরস্বতী ঘরোয়া পূজোয় বাজা রবীন্দ্রসংগীত গুলো এগিয়ে দিল। কিন্তু গান গুলো রিভিউ করতে গিয়ে কমিটির মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। একে তো নিরাকার উপাসক কবি,তায় মুসলমানের মত জোব্বা পড়া, বড় বড় দাড়ি। তার উপর ঔদ্ধত্য দেখ? লিখেছে "আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।"
নাম গানের ঘরে ঢ্যাঁড়া পড়ল।
পরের টপিক ভক্তের পরীক্ষা, কে কত কষ্ট সহ্য করতে পারে দেবতার জন্য। মাথার চুল দান করে? দন্ডি কাটে? ঠান্ডা কনকনে জলে ডুব দেয়, কাঠফাটা রোদে খালি পায়ে হাঁটে?
মা সোতসাহে জানালেন শরীরপাত করে বইকি? ঠাকুর দেখতে হোল নাইট জাগে, হাই হিল জুতো পরে মাইলের পর মাইল হাঁটে, বাঁশবাঁধা লাইনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অন্যের কনুইএর গুঁতো খায়। কিন্তু মনের খুশিটা কিছুতেই যায় না। একে অন্যের পা মাড়িয়ে, প্যান্ডেলের লাইনে অন্যের ঘামে ভেজা টিশার্টে মুখ ঘষেও হাসিমুখে মায়ের প্রতিমার সাথে সেল্ফি তোলে।
মা এবং ছেলেমেয়েরা সভয়ে দেখলেন ভক্তের কৃচ্ছ্রসাধনের ঘরেও গোল্লা বসল। এদিকে সরস্বতীর টেবিলে এবছরের পূজোসংখ্যা গুলো রাখা ছিল কমিটির সে দিকে নজর পড়ল। সরস্বতী জানালেন ওগুলো দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে স্পেশালি ছাপা হয়। কমিটি ভাবলেন স্তবস্তুতি প্রার্থনামন্ত্র হবে। খুলে লেখার নমুনা দেখে চক্ষুচরকগাছ। এখানে বড়ই কনফ্লিক্ট হল। কমিটিও কিছুতেই বুঝতে পারছে না ধর্মের সাথে সম্পর্ক বিযুক্ত এইসব সাহিত্যের পুজোর সময় কিসের দরকার? এদিকে মা আর ছেলেমেয়েরাও বুঝতে পারছে না পূজোসংখ্যা ছাড়া দুর্গাপূজো হয় নাকি?
অবশেষে কমিটি শেষপ্রশ্নে পৌঁছল। দুর্গাপূজায় রেভেনিউ জেনারেশন কেমন হয়? গনেশ খাতাপত্র খুলে বসল। এইতো দেখা যাচ্ছে প্রচুর চাঁদা ওঠে, প্লাস পুজোর মাসে বাঙালি গৃহস্থের খরচাপত্র খুব বেড়ে যায়, কর্তাদের নাভিশ্বাস ওঠে। কমিটি জানতে চাইলেন প্রণামীর বাক্স সেকথা বলছে না কেন? মায়ের মন্দির কই? সে মন্দিরের ট্রাস্টফান্ডে সম্পদ কই? রেভেনিউ যাচ্ছে কোথায়? গনেশ জানালো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, খানিক থীম শিল্পির ঘরে, খানিক কুমোরটুলিতে, আর্টকলেজে, প্যান্ডেলের মজুরের ঘরে, ঢাকীর ছেলের ধোঁয়াওঠা গরম ভাতে, তাঁতশিল্পির ঘরে, শাড়ীর দোকানদারের মেয়ের বিয়ের খরচে, কাজের লোকের বকশিশে, রক্তদান শিবিরে, কম্বল বিতরনে, অষ্টমীর খিচুড়ি ভোগে, ফুচকাওয়ালার ময়লা পকেটে ছড়িয়ে পড়ে এই রেভিনিউ।
কমিটি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এরম ভাবে দেবতারা বর দেন নাকি? ওঁদের সব সোজা হিসাব। মন্দিরে সোনার বিগ্রহ দিলে ব্যাংক্রাপ্টসির হাত থেকে বাঁচিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দেব, পাঁচসিকের পুজো দিলে ছেলের সর্দি সারিয়ে দেব, মাথার চুল মানত করলে আমেরিকার ভিসা, সোমবার উপোষ করলে এন আর আই বর। এতেই ভক্তের মনে ভয়, ভক্তি জাগে। থীম পুজোর প্যান্ডেলে জন খেটে রোজগারের টাকায় ছেলের চিকিৎসা হলে মানুষ ভগবানকে শ্রদ্ধাভক্তি করবে কেন?
মা মৃদু হেসে বললেন ভক্তি তো চাইনি ভালোবাসা চেয়েছি, স্তব পাইনি, "নবমী নিশি পোহাইও না রে" আকুল আবেদন পেয়েছি, ভক্তের মস্তকমুন্ডন চাইনি, থীমের পূজোয় নিউ হেয়ার স্টাইল পেয়েছি, প্রণামী চাইনি, শিউলি চেয়েছি, বর দিতে চাইনি, আনন্দ দিতে চেয়েছি, ভক্তের শুদ্ধশুচি উপবাস চাইনি বচ্ছরকার দিনে ছেলেপুলের হাতে নারকেল নাড়ু দিয়ে চেয়েছি, মহিষাসুরমর্দিনী হতে চাইনি উমা হতে চেয়েছি।"
তাই বলে কি মায়ের এমন মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় কমিটির রায়দানে কোনো হেরফের হল? ওরকম হলে আল্লা, গডের সাথে পাল্লা দিয়ে সনাতন ধর্ম টিকিয়ে রাখা যেত না। কমিটি জানালেন ওঁরা দুর্গার মর্ত্যের ট্যুরের উপর স্থগিতাদেশ জারি করবেন। বাঙালিরা পূজোর নামে এই যে অধর্মীয় কাজ করছে সেটা বন্ধ করা দরকার।
কৈলাসে অন্ধকার নেমে এল। মা জানেন "আর অসুর দমন করব না" বলে ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। অসুরদের সাথে দেবতাদের তলায় তলায় সমঝোতা হয়ে গেছে।
ভোলানাথ ক্যাসুয়ালি ইন্দ্রের সভায় গিয়ে জানালেন "গলাটা বড়ই ট্রাবল দিচ্ছে হে, এতদিন ধরে হলাহল গলায় ধরে রাখা তো চাট্টিখানি কথা নয়। অন্যবার মহামায়া বাপের বাড়ি গেলে কয়েক হাজার ছিলিম গাঁজা চড়িয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজে রাখি। তা এবার তো ওদের যাওয়া বন্ধ, হলাহল টা নাহয় ইন্দ্রলোকেই নামিয়ে রাখি?"
ইন্দ্র আমতা আমতা করে বললেন "ইয়ে মানে যাওয়া বন্ধ নয় তো, কতগুলো ব্যাপারে কমিটি আপত্তি করেছে, ব্যাপারটা আলাপ আলোচনার মধ্যে মিটিয়ে নেওয়া যায়।"
মহাদেব বললেন "বাঙালিদের একে আঠারো মাসে বছর, তায় এমনি ল্যাদখোর কিন্তু বাঙালের গোঁ খুব, ওদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভদ্র হিন্দু করতে সময় লাগবে। ততদিন হলাহলটা তুমিই ধারণ কর না হয়।"
এই কথোপকথনের আধঘন্টার মধ্যেই মায়ের মোবাইলে ইন্দ্রের ম্যাসেজ এল যে কমিটির সবাই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন, মায়ের বাপেরবাড়ি যাওয়া নিয়ে তেত্রিশকোটির কারোর আপত্তি নেই।
প্রতিবারের মত গৌরী এবারেও বাপেরবাড়ি আসছেন। মা মেনকা পান্তাভাত আর কচুরশাক রেঁধে রেখেছেন।
(সংগৃহীত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন