বৃহস্পতিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

প্রাউড টু বি অ্যান এমবিবিএস ~ ডঃ বিষাণ বসু

প্রাউড টু বি অ্যান এমবিবিএস। এ নিয়ে প্রচুর পোস্ট হচ্ছে। ডাক্তারি পাস করার বেসিক ডিগ্রী এমবিবিএস, কথাটা সবাই জানেন। এবং সেই ডিগ্রী অর্জন করার শেষে - এবং তদপরবর্তী প্রশিক্ষণের পর্ব পার হলে - সকলেই ডাক্তারি করার পক্ষে ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করে থাকেন। পাস করতে পাঁচ বছর - হাতেকলমে শিক্ষার বাড়তি বছরগুলো, অর্থাৎ ইন্টার্নশিপ-হাউসস্টাফশিপ ধরলে সাত বছর। জেনারেল লাইনে পড়লে ওর চেয়ে কম সময়ে মাস্টার ডিগ্রী হয়ে যায়। কাজেই, এমবিবিএস ডিগ্রীখানা সাধারণ ব্যাচেলর ডিগ্রীর থেকে কিঞ্চিৎ ভিন্ন গোত্রের - উন্নততর দাবী করছি না, বলছি ভিন্ন।

কথাগুলো কারোরই অজানা নয়। কিন্তু, নতুন বিতর্কের পেছনে সংবাদপত্রের একটি খবর। যেখানে হেডলাইন, "স্রেফ এমবিবিএস" করলেন প্রসূতির জটিল অস্ত্রোপচার - কথাটা ওই স্রেফ বিশেষণটি নিয়ে। 

সকলের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা যাক, এমবিবিএস ডিগ্রীটিই কিন্তু শল্যচিকিৎসা এবং প্রসূতির চিকিৎসার পক্ষে যথেষ্ট ডিগ্রী। অন্তত, মেডিকেল কাউন্সিল তেমনই বলে থাকেন। অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে জটিলতা অনেকক্ষেত্রেই তৈরী হয় - চিকিৎসক এমবিবিএস বলেই হয়েছে, এমন নয়। কাজেই, অন্তত আমার চোখে, স্রেফ এমবিবিএস শব্দবন্ধ এক্ষেত্রে অনুচিত।

সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক অবশ্য জানিয়েছেন, এমবিবিএস-এর আগে স্রেফ বিশেষণটি তাঁর নয় - রাজ্যের ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন-এর প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীম কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনিই রায়দানের মুহূর্তে বলেছেন, ওনলি এমবিবিএস - স্রেফ শব্দটি ওনলি-র বঙ্গানুবাদ মাত্র।

সহমত। এক্ষেত্রে সাংবাদিকের দোষ দেখছি না।

যেকোনো বিষয়ে মতামত দেওয়ার আগে সে বিষয়ে অল্পবিস্তর জ্ঞান অর্জন জরুরী - আমাদের শাস্ত্রে বলত, বলার আগে অধিকারী হও, অর্থাৎ বলার অধিকার তথা বিষয়ের উপর দখল অর্জন করো। মেডিকেল সায়েন্স ব্যাপারটা ইদানীং যেন সুলভ শৌচালয়ে পরিণত হয়েছে - পকেটে দুটি টাকা থাকলেই সকলেরই মলমূত্র ত্যাগের অধিকার জন্মে যাচ্ছে - থুতু ফেলা তো বিলকুল ফ্রী। সেখানে বিচারপতি এমন মন্তব্য করলে আপত্তির কী-ই বা আছে!!  

শুধু দুইখান কথা কইতে চাই।

আইন মোতাবেক ওনলি এমবিবিএস হলে ডাক্তারবাবু অমন অপারেশন করতে পারবেন না, এমনটি কোথায় লিখিত রয়েছে? (এই বিশেষ ঘটনাটিতে অবশ্য চিকিৎসক নিজেকে বিশেষজ্ঞ বলে দাবী করেছিলেন - এবং তেমন হলে, ঘটনাটি অবশ্যই প্রতারণার। কিন্তু, রায় এবং সংবাদপত্রের হেডলাইন, সর্বত্রই মিথ্যে দাবী এবং প্রতারণার দিকটাকে ছাপিয়ে গিয়েছে "স্রেফ এমবিবিএস")

দ্বিতীয়ত, ডাক্তারি লাইনটিই, অন্তত এদেশে, বোধহয় দুনিয়ার একমাত্র পেশায় পরিণত হয়েছে, যেখানে অভিজ্ঞতা ও চর্চার কোনো স্বীকৃতি নেই। তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জেনারেল প্র‍্যাকটিশনারের চাইতে পরশু এমডি পাস করা ডাক্তারের কদর বেশী - কেননা, প্রথমজন "স্রেফ এমবিবিএস"। এতে ক্ষতি চিকিৎসকদের যতখানি, তার চাইতে অনেকগুণে বেশী ক্ষতি আপনাদের সকলের। বিশেষজ্ঞ ট্রেনিং-এর অনিবার্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া - নোয়িং মোর অ্যান্ড মোর অ্যাবাউট লেস অ্যান্ড লেস - আরো পরিমিত বিষয়ে আরো অনেকখানি বিস্তারে ও গভীরে জ্ঞান অর্জন করা। আমরা যারা তথাকথিত বিশেষজ্ঞ, তারা গাছখানা খুবই খুঁটিয়ে দেখতে শিখি - জঙ্গলের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে। জঙ্গলের আর পাঁচটা গাছের চাইতে এই বিশেষ গাছটিকেই খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন কিনা, সেই বিচার সবচেয়ে ভালো করতে পারেন একজন জেনারেল প্র‍্যাকটিশনার - স্রেফ এমবিবিএস-ই। এর উল্টোপথে হাঁটলে প্রতিটি গাছকেই বিশেষ গাছ হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ে - পরীক্ষানিরীক্ষার সংখ্যা এবং চিকিৎসার খরচ, দুইই বাড়ে। বিপণনমুখী চিকিৎসা অবশ্য তেমনটিই চায় - আর সেজন্যেই এমবিবিএস পরিণত হয়েছে পাতি বা স্রেফ এমবিবিএস-এ। লাগামছাড়া চিকিৎসার খরচে তিতিবিরক্ত আপনিও অন্য কিছু ভাববেন না? এখনও ভাবা শুরু করবেন না?

এরই উল্টোপিঠে, এমবিবিএস-এর গুরুত্ব হ্রাসের কারণে, তরুণ চিকিৎসকরাও আর স্রেফ এমবিবিএস থাকতে চাইছেন না। এমবিবিএস ব্যাপারটাকেই উচ্চমাধ্যমিকের আগে মাধ্যমিকের মতো এমডি-র প্রাথমিক ধাপ হিসেবে দায়সারা গোছের ভাবতে শিখছেন - যত্ন নিয়ে সার্বিক দৃষ্টি অর্জনের চেষ্টাটাই লুপ্ত হতে চলেছে। অতএব, তেমন দিন আর দূরে নেই, যখন পেটখারাপের চিকিৎসার জন্যেও গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের শরণাপন্ন না হয়ে গতি থাকবে না - কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবস্থার রমরমা অবশ্য সেক্ষেত্রে আরো বাড়বে - আপনিও কি তেমনটাই চান? এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে অভিজ্ঞ জেনারেল প্র‍্যাক্টিশনার ব্যাপারটাই অবলুপ্ত হয়ে যাবে। সেটাই চাইছেন তাহলে??

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলছেন, চিকিৎসাকে মানবিক করে তুলতে আমাদের ফিরতে হবে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের ধারণায় - স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জেনারেল প্র‍্যাক্টিশনারের গুরুত্ব হবে সর্বাধিক। আমরা উল্টোপথে হাঁটব??

বাই দ্য ওয়ে, ওনলি এমবিবিএস কথাটা যিনি বললেন, জাস্টিস অসীম কুমার ব্যানার্জি, খুঁজে দেখলাম, তাঁর ডিগ্রি বলতে বিএ এলএলবি। ওনলি ব্যাচেলর ডিগ্রি - উইদাউট এনি মাস্টার ডিগ্রি। ইদানীং তো আইনবিদ্যায় মাস্টার ডিগ্রি - এলএলএম বা পিএইচডি - সবই হয়। বিচারপতি হতে গেলে - এমনকি হাইকোর্টের বিচারপতি - দুরূহ মামলার জটিল যুক্তি বিচার করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট, ডিগ্রী নয়। কিন্তু, চিকিৎসার ক্ষেত্রে, অভিজ্ঞতার বিচার নয়, শুধুই ডিগ্রীর হিসেবই শেষ কথা?? 

বিচারপতিরা কি বাড়িতে আয়না রাখেন না? দাড়ি কামান কীভাবে??

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন