সাফুরা জার্গারকে নিয়ে একটা পোস্ট। "এখন জেলে বসে কান্না ? দিল্লির দাঙ্গায় ইন্ধন দেওয়ার সময় মনে ছিল না?" আপনি স্বাভাবিকভাবেই কমেন্ট থ্রেডে বোঝাতে শুরু করেছেন, গর্ভবতী অবস্থায় একজন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে জেলবন্দী করে রাখাটা কতটা অমানবিক, হঠাৎ আপনাকে মেনশন করে কমেন্ট "তোর মা কটা মোল্লার সাথে রাত কাটিয়ে তোকে পয়দা করেছিল রে? " আপাদমস্তক বিরক্ত হয়ে আপনি তখনও তর্ক চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন যুক্তি দিয়ে। আবার আপনি কমেন্ট থ্রেডে মেনশনড। আপনার প্রোফাইল থেকে, আপনার প্রেমিকার ছবি ডাউনলোড করে, কমেন্টে দেওয়া হয়েছে, সাথে লেখা "দেখে তো মনে হচ্ছে না আমার সামনে ঠিকমতো পা ফাঁক করতে পারবে !" আপনি স্তম্ভিত। শকড। কী লিখবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কাঁপা হাতে ফেসবুকের ট্যাবটা অফ করে দিতে চাইছেন আপনি। কিন্তু ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছেন না।
বিজেপির কুখ্যাত আইটি সেলের ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে এইধরণের কদর্য আক্রমণ কমবেশি সবারই দেখা। ওদের পোস্টের কন্টেন্ট, শব্দচয়ন, আন্ডারটোন সুস্থ রুচির মানুষকে রীতিমতো ট্রমাটাইজড করার ক্ষমতা রাখে। অমর্ত্য সেনের দ্বিতীয় বিয়ে থেকে শুরু করে ঐশী ঘোষের শরীর – কুৎসিত রুচিহীনতার নজিরবিহীন মাইলস্টোন।
ফ্যাসিস্ত রাজত্বে বিষাক্ত মানসিকতার চাষ। সোশ্যাল সায়েন্স, নিউরোসায়েন্স সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চর্চিত বিষয়। নারীবিরোধী, যৌন হিংসাকে খুল্লমখুল্লা উদযাপন করার খোলাবাজার। বহুদিনের, পুরোনো অভ্যেস।
১৯১৯ নাগাদ নারীমুক্তি বিরোধী ফিউচারিস্ট আন্দোলনের সাথে নিজেকে একাত্ম করে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছিল ফ্যাসিবাদ। ক্ষমতায় আসার পর বেনিতো মুসোলিনির প্রকাশ্য ঘোষণা ছিল "l'eroismo dei vostri figlioli, dei vostri mariti, dei vostri fratelli, si deve anche a voi, o donne di Roma e 'Italia" – "the heroism of your sons, of your husbands, of your brothers, is also your merit, oh women of Rome and of Italy"। বটেই তো ! নারীর গৌরব তো ঠিক হবে তার সন্তান/স্বামী/ভাইয়ের বীরত্বের মাপকাঠিতে!
ভার্জিনিয়া উলফ, ১৯৪০-এর দশকে স্পষ্টই বলেছিলেন নাৎসি জমানার রিগ্রেসিভ চরিত্র এবং নারী-নির্যাতন দুয়েরই শেকড়ে রয়েছে শোষণ। সামাজিক শোষণকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মহিলাদের কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে চরিত্রায়িত করে ফ্যাসিবাদ। আর ঢাকের বাঁয়া হয়ে প্রশ্রয় দেয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, যেগুলোর ভিত্তিতে জ্বলজ্বল করছে মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষ। উইচহান্ট কিংবা দেবদাসী প্রথার স্রোত ফ্যাসিবাদ বয়ে নিয়ে চলে তার ধমনীতে। রোজা লুক্সেমবার্গকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে তবেই রাইখস্ট্যাগ দখল করতে পেরেছিল নাৎসি বাহিনী। 'দ্য বার্লিন রেপ' কিংবা গুলাগে টর্চারের রোমহর্ষক গল্প বাজারে ছেড়েও ফ্যাসিবাদের দালালরা ভোলাতে পারেনি নাৎসি ঘেটো আর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে ইহুদি কিংবা কমিউনিস্ট মহিলাদের ওপর এসএস অফিসারদের গণধর্ষণের কথা; এবং অত্যাচারের পর রক্তাক্ত নিগৃহীতার গায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার একের পর এক ঘটনা। প্রায় দুই মিলিয়ন মহিলাকে খুন করা হয় এই নাৎসি জমানায়, যাদের খুনের আগে অমানবিক সব এক্সপেরিমেন্ট কিংবা ধর্ষণ করা ছিল দস্তুর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভয়াবহতম গণহত্যার মঞ্চ ছিল ১৯৭১-এর অব্যবহিত আগের পূর্ব পাকিস্তান। ধর্মান্ধ, স্বৈরাচারী আয়ুব খান কিংবা ইয়াহিয়ার সরকার হিংস্র টার্গেটে ছিঁড়ে খেয়েছিল ওপার বাংলার শরীর – একরাতে একশোরও বেশি পাক মিলিটারি কর্তৃক একজন নাবালিকাকে ধর্ষণ রিপোর্টেড ছিল একাধিক সময়ে। ২০০২-এর গুজরাট দেখেছে যোনিতে ত্রিশূল ঢুকিয়ে ভ্রূণ বের করে আনার নৃশংসতা।
এগুলো তো তথ্য; ঘটনা। এই প্রতিটা ক্ষেত্রে বিকৃত পাশবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রোপাগেট করেছিল রাষ্ট্র। কেননা, ফ্যাসিবাদ প্রতিবারই মুখ থুবড়ে পড়েছে নারী ক্ষমতায়নের, সমানাধিকারের সুস্থ মানসিকতার সামনে। স্তালিনগ্রাদের অসম যুদ্ধে পুরুষ-নির্ভর নাৎসি বাহিনীর মনোবলকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে উড়িয়ে দিয়েছিল লাল ফৌজের নারী-ক্ষমতায়ন। বর্বর নাৎসিদের কাছে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মোসিন-নাগান্ত রাইফেল কাঁধে সোভিয়েত লাল ফৌজের মহিলা জেনারেলরা, স্নাইপাররা। তাঁদেরই একজন, ল্যুডমিলা প্যাভলিশেংকোকে যুদ্ধের পর যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, "কতজনকে খুন করেছেন আপনি ?" – ওনার দৃপ্ত জবাব ছিল "একজনও মানুষকে মারিনি। ৩০৯ জন ফ্যাসিস্তকে মেরেছি!"
প্রগতির বিরুদ্ধে নীতিগত অবস্থান ফ্যাসিবাদের – ঠিক তার বিপ্রতীপেই মানবতাবাদ, প্রগতিশীল আদর্শের দৃঢ় ব্যারিকেড। যেখানে অন্য বসন্তে মহাকাশে পৌঁছে যান ভ্যালেন্তনা তেরেস্কোভা। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা কাঁধে গেরিলা যুদ্ধে ধর্মোন্মাদদের ধ্বংসস্তূপের ওপর পা রাখেন মুক্তিযোদ্ধা নারীপুরুষ। মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা সুদানে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ায় খিলখিল করে হেসে ওঠেন আইসিসের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা তরুণী - একুশ শতকের কমরেড। কমরেড। যে শব্দের নারী-পুরুষ লিঙ্গভেদ নেই।
ডিয়ার চাড্ডি বাহিনী, আইটি সেলের ফ্রাস্ট্রেটেড জানোয়ার! আপনাদের জেনে রাখা জরুরী, আপনাদের ধর্ষকাম আগ্রাসী ভঙ্গিতে আমাদের কপালে একফোঁটা ঘামও যাতে না ঝরে, তার জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছি আমরা। আপনাদের বিকৃতরুচিকে কফিনে পুরে দিতে শুভবুদ্ধির লংমার্চে পা মেলান রবীন্দ্রনাথ; পা মেলান রোমা র্যঁলা, লোরকা, সিগার, জোন বায়েজ, ভিক্টর জারা। ভুলে যাবেন না, এই লংমার্চকে থামাতে চেয়ে স্যুইসাইডাল স্টেপে খতম হয়ে গেছে আপনাদের অনেক গডফাদার। আমাদের চেতনাকে সংহত করেন মিশেল ব্যাসেলেট – ২১ বছর বয়সে সান্তিয়াগোর অদূরে ভিল্লা গ্রিমালদির কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তীব্র শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে ২০০৬-এ মেজর কামব্যাক – চিলির ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য একজন মহিলা রাষ্ট্রপতি। যে ইতিহাস আর বর্তমানকে না জেনে আদালতে, জেলখানায়, ফেসবুকে আর হোয়াটস্যাপে উল্টোদিকে ঘোরাতে চাইছেন সভ্যতার চাকা, সেই সিরিজের লেটেস্ট এপিসোডে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ হবে রাস্তাতেই।
"হে আমার স্বদেশ! আহত তুমি হতে পারো, কিন্তু বিজিত কখনও না।" বলেছিলেন পাবলো নেরুদা। ভারতবর্ষও কারুর কেনা জমিদারি নয়। এই দেশ কোনও যুদ্ধবাজ ধর্মোন্মাদ ফ্রেঞ্চকাটের সামনে নতজানু হয়ে থাকবে না।
"La historia nos absolverá"! ইতিহাস আমাদের মুক্ত করবে !
চ্যালেঞ্জ !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন