বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০

হারিয়ে যাওয়া পার্বত্য রেলপথ ~ অরুণাভ দাস

হারিয়ে যাওয়া পার্বত্য রেলপথ 

(১)
রেল সংক্রান্ত কিছু লেখালিখির জন্য কয়েকটা কাগজ জেরক্স করাতে গিয়েছিলাম। দোকানে পাড়ার পরিতোষদার সঙ্গে দেখা। আমার চেনা প্রথম ও একমাত্র প্রতিবেশী রেলফ্যান। এমন কী, সারা দেশের রেলওয়ে টাইম টেবিল মুখস্থ করে রেখেছেন। আমাকে দেখেই বললেন, 'দার্জিলিঙয়ের টয়ট্রেন নিয়ে তোমার বইটা বেশ কাজের হয়েছে। এবার নতুন কী লিখছ?' 
      বললাম, 'একটা নতুন লেখায় হাত দিয়েছি। সময় হলে আপনাকে বলব।'
      'বেশ বেশ। তাহলে তোমার বুদ্ধির গোড়ায় একটু শান দেয়ার ব্যবস্থা করি। বল তো দেখি, আমাদের দেশে পাহাড়ি রেলপথ কটি?' 
      'এ তো খুব সহজ প্রশ্ন, পাঁচটি।'
      পরিতোষ দা হেসে ফেললেন। 'একটা ছ-নম্বর ছিল, এখন আর নেই। মানে বিলুপ্ত।'
      'মানে, বলেন কী? কোনটা সেটা?' 
      'বললে তো হয়েই গেল। সেটা খুঁজে বার করাই তো তোমার কাজ। দুদিন নাও। না পারলে ফোন কোরো, বলে দেব। আর পারলে বাড়িতেই চলে এসো। তোমার বউদির হাতের চায়ের নেমন্তন্ন।' 
      ভালোই বুঝলাম, এবার আমার ঘুম ছুটল। ছয় নম্বর হিল রেলওয়ে সম্পর্কে কোনো ধারনাই নেই। কিন্তু খুঁজে বার করতেই হবে। মনে মনে নিজেকে এক দিন সময় দিলাম। পরিতোষ দার পরিতোষ হয়, এমন তথ্য পেয়ে গেলাম সহজেই। ভদ্রলোক অনুসন্ধিৎসার আলোটা জ্বালিয়ে দিতে ভালোই পারেন। 

(২) 
আমাদের দেশে চালু আছে পাঁচটি পার্বত্য রেলপথ। এর মধ্যে কয়েকটা আবার ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায়। পাঁচটি হল; দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে, কালকা-সিমলা রেলওয়ে, নীলগিরি রেলওয়ে, কাঙড়া ভ্যালি রেলওয়ে এবং নেরাল-মাথেরন রেলওয়ে। ছিল একটি ছয় নম্বরও, এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। সেটি ছিল চাবাগানের জন্য বিখ্যাত কেরালার হিলস্টেশন মুন্নারে। নাম কুন্ডালা ভ্যালি রেলওয়ে। মানুষ পরিবহনের থেকে মুন্নারের চা বদিয়াকান্নুর হয়ে বাইরের দুনিয়ায় পৌঁছে দিতে বেসরকারি উদ্যোগে এই অভিনব রেলপথের প্রবর্তন। 
      ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভারতের এই প্রথম মোনোরেল প্রকল্প চালু হয় ১৯০২ সালে। মুন্নার বা কুন্ডালা ভ্যালি থেকে রেলপথ গিয়েছিল প্রায় ৩৫ কিমি দূরবর্তী কান্নান দেবান পাহাড়ের মাথায়। উচ্চতম প্রান্ত বলে এই অন্তিম বিন্দু টপ স্টেশন নামে পরিচিত হয়, যার উচ্চতা ১৭০০ মিটার। অভিনব ব্যাপার হল, প্রথম পর্বে একটি রাস্তা বরাবর একটাই রেললাইন পাতা হয়। লাইনের ওপর থাকত ছোটো চাকা ও রাস্তায় থাকত বড়ো চাকা। এইভাবে কামরার ভারসাম্য বজায় রাখা হত। ট্রেন টানত বলদে। অতীতে উত্তর ভারতে পাঞ্জাবের পাতিয়ালা রাজ্যে একই ধরনের রেলপথ ছিল। ৬ বছর বলদে ট্রেন টানলেও পরে ১৯০৮ সালে ন্যারোগেজ রেলপথ তৈরি করা হয় ও ইঞ্জিনের ব্যবহার আরম্ভ হয়। এই পর্বেই কুন্ডলা উপত্যকায় বিখ্যাত এলুমিনিয়াম রেলব্রিজ নির্মিত হয়। ৬১০ মিলিমিটারের ন্যারোগেজ রেলপথ ১৯২৪ সাল পর্যন্ত চা ও বাগিচার অন্যান্য দ্রব্য পরিবহন করত। কুন্ডালা ভ্যালি ও মাদুপেট্টি অঞ্চল থেকে চা টপ স্টেশনে পৌঁছানোর পর পাত্রগুলিকে রোপওয়েতে চাপিয়ে ৫ কিমি দূরে কোট্টাগুড়ির দক্ষিণে নিম্নবর্তী স্থানে নিয়ে যাওয়া হত। এই জায়গাটি পরিচিত ছিল বটম স্টেশন নামে। জায়গাটি বর্তমান তামিলনাড়ু রাজ্যে। বটম স্টেশন থেকে গরুর গাড়িতে চা যেত ১৫ কিমি দূরে বদিয়াকান্নুর। সেখান থেকে ট্রেনযোগে সারা দেশে। এমন কী বন্দর থেকে জাহাজে ইউরোপের বাজারেও পৌঁছাত।
      ১৯২৪ সালে কুন্ডালা ভ্যালি রেলপথের অন্তিম দিন ঘনিয়ে আসে। পাহাড়ে হঠাত ভয়াবহ বন্যা হলে ছোটো রেলপথ ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। কেরালার নিজস্ব ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী এই বন্যা ৯৯ এর বন্যা নামে কুখ্যাত।
      এখন মুন্নার বা টপ স্টেশনে রেলপথ, স্টেশন বা সেতু ইত্যাদির কোনো চিহ্ন নেই। মুন্নারে যেখানে স্টেশন বিল্ডিং ছিল, সেটি সংস্কার করে টাটা-টির আঞ্চলিক অফিস করা হয়েছে। প্লাটফর্ম এখন রাস্তা। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য টপ স্টেশন একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। মুন্নার থেকে গাড়িতে অনেকে ঘুরতে যান।

(৩)
পরিতোষ দা ভারতের ষষ্ঠ পার্বত্য রেলপথের গল্প শুনে এমনই খুশি, চায়ের সঙ্গে মুখরোচক টা সহ একশয় একশ দিলেন৷ তার সঙ্গে রেল বিষয়ক নতুন একটা হোমটাস্ক। সে গল্প পরে আর একদিন।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন