শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০

রবীন্দ্রনাথ কি বুর্জোয়া কবি? ~ সৌরভ গোস্বামী

রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যু দিন এলেই শুনতে হয় কমিউনিস্ট পার্টি তাকে 'বুর্জোয়া কবি' বলেছিল ।  কমিউনিস্টদের আক্রমণের এই মোক্ষম সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে!! কিন্তু,  কমিউনিস্ট পার্টির কোন বৈঠকে এই রকম সমবেত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল? কোন দলিলে, মুখপত্রে তা প্রকাশিত হয়েছিল, সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে কোন নেতা কী মত দিয়েছিলেন  তার উত্তর মেলেনা। 
যে আলোচনা হয়েইনি তার প্রমাণই বা দেবে কী করে!
কমিউনি্সট পার্টিতে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মানে, একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ভিত্তিতে। 
রবীন্দ্রনাথকে 'রবীন্দ্র গুপ্ত' ছদ্মনামে বুর্জোয়া কবি বলেছিলেন কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন। যা ছিল ভবানী সেনের একান্তই নিজস্ব মতামত। যা নিয়ে পার্টির মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিলে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন।
১৯৬১ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একটি মেলার আয়োজন করে কমিউনিস্টরা। উদ্বোধন করেন রবীন্দ্র কন্যা মীরা দেবী। আমন্ত্রিতদেস মধ্যে ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস, জে বি এস হল্ডেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ,সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সুরকার বালাসানিয়ান, কিউবার নর্তকী এ.এলিশিয়া। ছিলেন কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক থেকে শতাধিক কবি। এছাড়াও বাংলার আদিবাসী লোকশিল্পীরা এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের মজুর শিল্পীরাও মর্যাদার সাথে তাদের শিল্প নৈপুণ্য প্রকাশ করেন। ছিলেন দুই বাংলার কবিরা। সাথে ছিল উর্দু কবিদের মুশায়েরা। উত্তরপ্রদেশের নিরক্ষর কবি রামখেরের কবিতা এবং ভারতের বিভিন্ন ভাষার কবির কবিতা পাঠ ও আবৃত্তির আয়োজন করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা সংস্থা ' ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ' থেকে গোপাল হালদারের সম্পাদনায় প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয় যার লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে,   নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। হীরেন্দ্রনাথ মুখপাধ্যায় লেখেন 'Himself a true poem'.  এই মেলা বয়কট কারা করেছিল? যাদের 'পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়'

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির উষালগ্নে 'লাঙল' পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হলে রবীন্দ্রনাথের আশির্বাদ চান কমরেড মুজফফর আহমেদ, কবি নজরুল ইসলাম (কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীও বটে) এবং তাঁদের অন্যান্য সহযোগীরা। 

সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন—" রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে 'লাঙলের' জন্য আশীর্বচন যোগাড় এর ভার পড়ল আমার উপর।একদিন সকালবেলা রবীন্দ্রনাথের কাছে পেশ করলুম আমাদের আর্জি। তিনি তৎক্ষণাৎ লিখে দিলেন----  জাগো, জাগো বলরাম, ধরো তব মরুভাঙ্গা হল /প্রাণ দাও , শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।
'লাঙলে'র  প্রচ্ছদপটে তাঁর ঐ আশীর্বচন থাকত।" 
ঐ লাঙল পত্রিকা প্রকাশের সূত্রে কমিউনিস্টরা জোড়াসাঁকোর বাড়ি ও কিছুটা রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসেন। পশ্চিমবঙ্গ সিপিআই(এম) সম্পাদক সরোজ মুখোপাধ্যায় ১৯৮৩, ২১ জানুয়ারী 'দেশহিতৈষী' পত্রিকায় লেখেন, ' জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিচের তলায় নেপু ঠাকুরের ঘর ছিল তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কেন্দ্র। সে ঘরে কমরেড হালিমের সাথে আমি বহুবার গেছি। সোমনাথ লাহিড়ীও যেতেন, রণেন সেনও যেতেন। আব্দুল হালিমের সঙ্গে আমি ছ'সাতবার ওখানে রবীন্দ্রনাথের সাথে আলাপ আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম। আব্দুল হালিম বীরভূমের মানুষ—তাঁকে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ স্নেহ করতেন। তাই আমাদের আলাপ ভালোই জমত। একবার আমরা তাঁর তীব্র সমালোচনা করে বললাম – আপনার 'রাশিয়ার চিঠি'র কয়েক জায়গা আমাদের ভালো লাগে নি। আমরা "সর্বহারার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের 'রাশিয়ার চিঠি'" শীর্ষক একটা পুস্তিকা প্রকাশ করছি। তিনি বললেন, তা তোমরা কর , কিন্তু মোটামুটি ভালো চিঠি লিখি নি? আমি তো আর তোমাদের মত কমিউনিস্ট নই। আমরা বলি ঠিকই তো, আপনি যা লিখেছেন তাতে তো দারুণ কাজ হয়েছে, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যা অপপ্রচার চলছে তাঁর মোক্ষম জবাব আপনি দিয়েছেন।"
আবার ওই একই বইতে তিনি লিখেছেন, ''গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। ...ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না ... একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।'' রবীন্দ্রনাথের মুশকিল হল তাঁকে কেটে-ছেঁটে সাইজ় করা যায় না। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মানেন তিনি, কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব ভুলে যান না- যা গান্ধীজীর সাথেও তাঁর বিতর্কের একটা অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

২টি মন্তব্য:

  1. ভবানী সেন কি বললেন বা পলিটব্যুরোতে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হল কি না তাতে কিছু আসে যায় না, প্রশ্ন হল কম্যুনিস্ট পার্টির ভিত্তি মার্কসবাদ তা কি বলছে? প্রশ্ন হল মার্কশীয় দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে কেন বুর্জোয়া বলা হবে না ? রবীন্দ্রনাথের শ্রেণী অবস্থান কি ?

    উত্তরমুছুন
  2. গেয়র্গে লুকাচের Tagore’s Gandhi Novel যেটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ আজ থেকে একশ বছর আগে বার্লিনের Die rote Fahne নামক সাময়িকীতে। সেটা পড়লে আবার রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী কী কারনে সামন্তবাদের প্রতীক সেটি বোঝা যাবে, যদিও তার পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে রবীন্দ্র মননে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধতা খুবই স্পষ্ট। (মাঝে সৌমেন ঠাকুরের চিঠির এপিসোড ও আছে)ভবানী সেন তো বিরাট কিছু অশিক্ষিত লোক ছিলেন না, শ্রেনী বুঝতেন না এমনটাও নয়। যাই হোক লেখাটা আরেকটু বড় হতে পারত।

    উত্তরমুছুন