শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০২০

ভাইরাস ও মানবজাতি ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

সেদিন ছিল ঘোর অমাবস্যা। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শে সেদিন ১৩৪ কোটি মানুষের সম্পূর্ণ সঙ্গরোধে থাকবার নির্দেশ এসেছে। সম্ভবত আমরা তৈরী করতে চলেছি পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ সঙ্গরোধের ইতিহাস।

কালকে জানালা দিয়ে দ্বিতীয়ার একফালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ধীরে ধীরে একদিন আসবে পূর্ণিমা। সেদিন কি চাঁদের সাথে পৃথিবীও একটু হাসবে? নাকি আরেক অমাবস্যার প্রতীক্ষায় তাকে ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হবে?

যে দিন মানুষ আবার হাসবে সেদিন কি সে মনে রাখবে এই দিনগুলোর কথা? সেদিন কি খবরের কাগজে প্রথম পাতায় জায়গা হবে আজকের বিজ্ঞানী, ডাক্তারদের? জায়গা হবে অসংখ্য সাধারণ মানুষের যারা এই অবস্থায় ঢাল তলোয়ারহীন হয়ে লড়ে যাচ্ছেন তাদের? নাকি আমরা হয়ে যাব 'পুনর্মূষিক ভব'!

যে বিজ্ঞানীরা লেবোরেটরিতে থেকে জনগণেশের তোয়াক্কা না করে ৭৮০ কোটি মানুষকে বাঁচাতে নিরন্তর সাধনা করে চলেছেন সেদিনের চাঁদের আলোয় কি বিজ্ঞানে উৎসর্গীকৃত এই মৌন সাধকদের কথা আমরা জানতে পারব? 
একবার তাদের জন্য সারা পৃথিবী উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করব?

নাকি ফিরে যাব স্টারডম, ভোটের কারসাজি, ধর্মীয় জিগির দেওয়া বিভেদসৃষ্টিকারী গুরুদের ফাঁপা কথায় !

যে সাধকরা আমাদের আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুন করে তাদের কথা কাগজে পাবেন না। বিজ্ঞান থাকে না খবরের কাগজে। ওগুলো ঠিক সমসাময়িক নয়, ওই খবরগুলো ভীষণ ক্লান্তিকর, আমাদের জিভে লালা ঝরান উত্তেজনা আনে না। 

আমরা ৯৯.৯৯% সময়ে ব্যস্ত থাকি নায়ক ও নায়িকাদের জীবনের গুপ্ত কথা জানতে, নেতা ও নেত্রীদের দলবাজিতে গা ভাসাতে, অবৈজ্ঞানিক ধর্মীয় গুরুদের জিগির শুনতে।

তাই শেষ পর্যন্ত কিছু 'জনপ্রিয়' মানুষ পাঁচ পুরুষের জন্য সংস্থান করে যায়, আর বিজ্ঞানের কথা মনে আসে এই ক্রান্তিকালে।

আমরা হয়ত শিক্ষা নেব। 

ভাবতে ভাল লাগে একমাস বাদে পরের অমাবস্যায় পৃথিবী থেকে হয়ত কালো অন্ধকার কিছুটা ঘুচে যাবে। প্রতিপদের চাঁদের আলোয় নতুন পৃথিবী উদ্ভাসিত হবে। হয়ত সেই সময়ে অতি ক্ষুদ্র মানুষ বুঝবে আমাদের প্রয়োজন বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, শিক্ষায় অধিক অর্থ বরাদ্দ করা।

হয়ত সেই সময়ে রচিত হবে The Plague-এর মত আরেকটা মহাকাব্যিক রচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭০ বছর আগে উত্তর আফ্রিকার একটি শহরে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পরে আলবেয়ার ক্যামু লিখেছিলেন এক রূপকধর্মী উপন্যাস।

মৃত্যুর প্রতীক্ষায় মানুষের প্রতিক্রিয়া। 

কারণ এই শেষ নয়, আমরা যদি নিজেদের না পাল্টাতে পারি আবার আসবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস; তারা বুঝবে না রাজপুত্র ও ভিখারির তফাৎ, জানবে না ষ্টার গায়িকা ও রেলের সাধারণ যাত্রীর পার্থক্য - ভাইরাস ছড়িয়ে যাবে। 

এইবার অনেক দুঃখ, অনেক মৃত্যুর বিনিময়ে আমরা মুক্তি পাব। 

তবে পূর্ণ মুক্তি আসবে তখনই, যখন মানবজাতির রক্ষাকার্যে সকলে মিলে নিয়োজিত হব। সম্মান দেব আমাদের প্রকৃত রক্ষাকর্তাদের। অগ্রাধিকার দেব মানুষের একত্রিত যাত্রায়, বেঁচে থাকার  জন্য প্রকৃত প্রয়োজনে।

ভাইরাসকে আটকাতে সমাজের ভাইরাসদের সমূলে উৎপাটিত করতে হবে।

Madhusree Bandyopadhyay
27/03/2020

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন