মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০২০

ধর্ম ও মানুষ ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

তিন লক্ষ বছরের মানুষের ইতিহাসে অধিকাংশ সময় অধিকাংশ মানুষ থাকত ক্ষুধার্ত হয়ে। রাতে শিশুরা ঘুমাতে যেত খিদে নিয়ে।

১৮০০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল মোটমাট ১০০ কোটি। 
দু'শ বছর আগেও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ খাদ্যের জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও দুই বেলা পেট ভরাতে পারেনি। 
দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা ছিল অধিকাংশ মানুষের জীবনের অংশ। 

তাই, বিগত দুই শতক ধরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেছেন অধিকাংশ মানুষকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে বার করে আনতে। খাদ্য উৎপাদন ও বন্টনে জন্য বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। সেই সব তত্ত্বকে বাস্তবে প্রয়োগের প্রচেষ্টা নিয়েছে রাষ্ট্র।

একইসাথে বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নিয়েছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী। এমনকি সেই প্রচেষ্টা স্বীকৃতি পেয়েছে নোবেল পুরস্কার প্রদানে। খাদ্যের উৎপাদনের দ্রুত বৃদ্ধির সাথে বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছিল বন্টন ব্যবস্থায় বিপ্লব।
শেষ দুইশ বছরে ভ্যাক্সিনেসন, আ্যন্টিবায়োটিক ও স্বাস্থ্যবিধির জন্য পৃথিবীর জনসংখ্যা লাফ দিয়ে ১০০ কোটি থেকে হয়েছে প্রায় ৭৮০ কোটি।

১৯৭০ সালে পৃথিবীর ৩০% মানুষ থাকত ক্ষুধার্ত হয়ে। ভয়ানক জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ২০১৮ সালে প্রায় ১০% মানুষ খিদে নিয়ে ঘুমাতে যায়। এই সংখ্যা ফেলে দেবার মত নয়। বোঝা যায় খাদ্য উৎপাদন ও বন্টনের যে প্রক্রিয়া বিগত শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশে নেওয়া হয়েছিল, তার অনেকটা সাফল্য বিভিন্ন দেশে এসেছে। 
সত্যি কথা বলতে দূর্ভিক্ষের যে ছবি পৃথিবীতে ১০০ বছর আগেও দেখা যেত এখন তা কমে গেছে। 

নিশ্চিত আগামী একশ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা কমে যাবে। তবে বৈষম্য সম্ভবত কমবে না।

মানুষ অধিকাংশ সময়ে শুধু খাদ্য অন্বেষণ করেছে, খাদ্যের জন্য অন্যকে সংহার করেছে, খাদ্য প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করবার জন্য ধর্মের জন্ম দিয়েছে। 

পরবর্তীকালে সেই ধর্ম মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করল। শেষ আড়াই হাজর বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও তার বিভেদ রাষ্ট্রের হাতিয়ার হয়ে গেল। 

লক্ষ্য করে দেখবেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ৯০% মানুষ একটাই ধর্ম পালন করেন। এই একরূপতা এসেছে অনেক রক্তের বিনিময়ে। আর একরূপ সমাজে ধর্মের প্রভাবে জীবন যাপন, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক হয়ে গেছে বৈচিত্র্যহীন।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হয়েছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা।
আমেরিকা, ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ার অধিকাংশ দেশ এর বাইরে নয়। 

ধর্মই জীবন, ধর্মই মরণ। তাই ধর্ম এত শক্তিশালী।

তবে বিগত অন্তত ২০০ বছরে পৃথিবীতে ধর্মের বাইরে গিয়ে বহু মানুষ চিন্তা করছেন। তারা সামগ্রিকভাবে মানুষকে নিয়ে ভাবছেন। বিংশ শতকে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বাদ দেবার প্রচেষ্টা শুরু হয়। 
রাষ্ট্র ধর্মের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সুবিধা হল বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু ও নিরীশ্বরবাদীরা নিরাপদে থাকতে পারেন। ধর্মের অধিকারের বদলে মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হয়। তাই রোমান ক্যাথলিক পোপকেও বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান মানুষকে রক্ষা করতে সেকুলারিজমের কথা বলতে হয়। 

সেকুলারিজমের কথা সকলকে সৎভাবে ভাবতে হবে, বলতে হবে। 
আমি ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ চাইব, বাংলাদেশ মুসলমানের জন্য চাইব আর ইউরোপে দেশান্তরী হয়ে সেকুলার হব - এই ভাবে চলে না, চলতে পারে না।

নিশ্চিত একদিন এই খাঁচাগুলি ভাঙবে। 

মানুষ নিজের স্বার্থেই ধর্মের উপরে স্থান দেবে মানবধর্মকে। সে এই কাজ করতে বাধ্য হবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। কারণ যতদিন যাচ্ছে, দলবদ্ধভাবে নয়, এককভাবে মানুষ দেশান্তরে যাচ্ছে। শুধু ধনী নয়; কর্ম, শিক্ষা, বিবাহ উপলক্ষে বহু মানুষ অন্য দেশে যাচ্ছে। অন্যদের সাথে মিশছে। নিজের স্বার্থে সে বাধ্য হবে শান্তি ও সেকুলারিজমের কথা বলতে।

আমরা এক ক্রান্তি-কালে আছি। ট্রান্সিশন পিরিয়ড। পরিবর্তন আসবে।

Madhusree Bandyopadhyay
03/03/2020

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন