সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০

করোনা ভাইরাস ~ স্বপন ভট্টাচার্য

নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে একজন মাইক্রোবায়োলজির মাস্টার হয়ে ফেবুতে কিছু না বললে ইজ্জত থাকে না। সুতরাং দু চার কথা আমি যা জানি আর যেভাবে বলতে ভালবাসি সেভাবে বলি। উৎসাহ না থাকলে এখানেই পাঠক ছেড়ে যেতে পারেন এই লেখা, কেন না কোনোদিক থেকেই বিশেষজ্ঞ হবার দাবি আমি করছি না।

নভেল করোনাভাইরাস নভেল কেন? কেন না করোনাভাইরাসের চলতি প্রকরণগুলির থেকে এটা কিছুটা আলাদা বা ব্যতিক্রমী তাই নভেল।
সাধারন করোনাভাইরাস তো তেমন মারাত্মক নয়, এটা এমন হল কি করে? এটা একটা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার গল্প। এমনিতে আমাদের শরীর অন্ততপক্ষে ১০০০০০০০০০০০০ রকমের সংক্রমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম , কিন্তু তার একটা পুর্বশর্ত আছে। শরীরকে তার সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। টীকাদান এরকম একটা পরিচিতি ঘটানোর উদাহরণ। মারক সংক্রমণের হাত থেকে তাতে বাঁচা যায় কেন না মানবশরীরের নিজস্ব একটা 'স্মৃতি' আছে। একবার পরিচিতি ঘটে গেলে সে দাঙ্গাকারী যতদিন পরেই আবার আসুক না কেন,শরীর তাকে স্মৃতি থেকে চিনে নিয়ে আটকে দেয়। ফলে ব্যারিকেডের ওধারে থাকা হামলাকারী সংক্রমণকে ঢুকতে হয় ট্রয়ের ঘোড়ার মত আপাতনির্বিষ হয়ে। নভেল করোনা হল ওই বহুদিন বেকার বসে থাকা গ্রীক সেনার মত প্রায় বেকার ভাইরাস যারা নিজেদের গঠণ একটু আধটু আড়াল করে ঢুকে পড়ছে শরীরে। এই প্রথম তার বদলানো রূপের সঙ্গে 'পরিচিত' হচ্ছে শরীর। এর কিছু প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন বি সি জি নিলে বাচ্চার হয়,যেমন পোলিও প্রথমবার নিলে হয় ,তেমন এই চেনা পরিচিতির ফলস্বরূপ জ্বর, শ্বাসজনিত সমস্যা এসব হয়। মুশকিল আরো বাড়ে যখন এই অপরিচিত শত্রুর মোকাবিলায় ব্যস্ত শরীরকে আক্রমণ করে বসে অন্যান্য জীবাণু। সুতরাং নভেল করোনায় আক্রান্ত মানুষ ততদিন ভুগতে থাকবে যতদিন না শরীর এই চেনা পরিচিতিটা সম্পন্ন করে যথোচিত ব্যবস্থা নিয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলবে। এই সময়টা দিতে হবে আক্রান্ত শরীরকে।
নভেল করোনা বয়স্কদের ক্ষেত্রেই মারাত্মক হয়ে উঠছে অথচ বাচ্চাদের মধ্যে তো মৃত্যুহার অতটা নয়। এটা কেন? আমার মনে হয় গত দশ পনের বছরে যে সব ইম্যুনাইজেশন প্রোটোকল WHO দ্বারা আবশ্যিক করা হয়েছে তা কিছুটা হলেও প্রোটেকশন দিতে পারছে বাচ্চাদের হয়তো অপ্রত্যক্ষভাবে, কিন্তু দিচ্ছে,সেটা MMR বা যার জন্যই হোক না কেন । নয়তো, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ফলাফল মারাত্মক হবার কথা। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষেরা, যাদের এইসব আধুনিক ইম্যুনাইজেশন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় নি তাদের শরীরকে এই পরিচিতি ঘটানোর ধকলটা নিতে হচ্ছে অনেক বেশি করে। যারা সেটা পারছে না তারা সহজেই অন্যান্য জীবাণুরও শিকার হয়ে পড়ছে এবং মারা যাচ্ছে।

এর শেষ কোথায়? শরীর শত্রুকে ভালোভাবে চিনতে প্রথমবার যদি সময় নেয় ১৫ দিন তো দ্বিতীয়বার তা হয়ত হবে ১৫ ঘন্টায়।অর্থাৎ, নভেল ততদিনই নভেল যতদিন শরীরের চেনা না সম্পূর্ণ হচ্ছে। এই সময়টা সংক্রামিত শরীরকে দিতে হবে। যেহেতু চীন থেকে সংক্রমণ শুরু হয়েছে সেহেতু চীনের মানুষ সেরে উঠবে সবচেয়ে আগে,তারপর ইরান, ইটালী এই ক্রমে যদি না নতুন নতুন মানুষ আক্রান্ত হয়। সুতরাং দেশে দেশে প্রতিক্রিয়া বাড়াবাড়ি রকমের মনে হলেও যে কোন প্যানডেমিকের জন্য প্রতিক্রিয়ার বাড়াবাড়ি আদতে সবার জন্যই ভালো।
কারা বেশি সতর্ক থাকবেন? যারা ইমুনোসাপ্রেসিভ ওষুধ খান, কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে, অটো ইম্যুউন ডিজিজে ভোগেন তারা বাড়তি সতর্ক থাকবেন। ভাইরাস শরীরে ঢুকলে কিছু খেল দেখাবেই কেন না ওষুধ দিয়ে তাকে মারা যায় না। সে তখন আপনার শরীরের মালিক এবং যতদিন না শরীর সক্রিয়তা দেখাতে পারছে ততদিন জানবেন, আপনার সংক্রামিত কোষকলা তার দাসমাত্র, তার অর্ডারেই তারা চলবে,আপনি অসহায়। তবে আশার কথা, কোটিতে গুটিক ছাড়া বাকীরা সময় নিলেও ঠিক শত্রুকে সীমান্ত পার করে তাড়িয়ে ছাড়বে। অযথা আতঙ্কিত হলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন না, বরং শত্রু বুদ্ধিমান হলে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।বুঝুন, একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা যেটাকে পুরোপুরি জীবিত পদার্থই বলা যায় না তাকে মানুষ হয়ে 'বুদ্ধিমান' বলছি! এখন 'বুদ্ধি' জিনিষটাকে যদি মস্তিষ্ক নামক একদলা বাটার জাতীয় পদার্থ ছাড়া অন্যভাবে ভাবা যায় তাহলে খুব ভুল বললাম কী?

  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন