নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ফাইল প্রকাশ হওয়ার পর সেই নিয়ে অনেকের মতো আমারও কৌতুহল ছিলো। গত দু দিন ধরে মোটামুটি গোটা পঞ্চাশেক প্রকাশিত নথি ঘেঁটে দেখলাম। প্রচুর সময় গেলো কিন্তু সুভাষ বসু আমার মত কিঞ্চিত মানুষের কাছে এইটুকু সময় এবং মনোযোগ অবশ্যই দাবি করেন। জানি না যারা এই ফাইল প্রকাশ করে সুভাষ বসুকে নিজেদের লোক দেখানোয় সবচেয়ে উত্সাহী সেই দেশপ্রেমিকরা আদেও একটিও ফাইল পড়ে দেখেছে কিনা।
ফাইলগুলো দেখে যা বুঝলাম তা হলো প্রায় ৯৯%-ই অত্যন্ত সাধারণ ফাইল। এগুলো এতদিন সিক্রেট নথি হিসেবে লোকানো থাকার ব্যাখ্যা একটাই তা হলো বেশিরভাগ নথিতেই বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে কিছু যোগাযোগের রেকর্ড রয়েছে এবং কুটনৈতিক নিয়ম মেনে সেগুলো প্রকাশ করা হয়নি। কোনো ফাইলেই গোপন কোনো ষড়যন্ত্রের হদিস এখনো অবধি নেই। ফাইলগুলি পড়তে পড়তে বার বার যেটা মনে হচ্ছিলো যে নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য ভেদ করতে এতো মানুষ এতো সময় ব্যয় করেছে যে গোটা বিষয়টা অপচয় বলেই মনে হয়। একের পর এক প্রধানমন্ত্রী, বিশেষ করে নেহেরুর লেখা গুচ্ছ চিঠি আর তত্পরতা দেখে সত্যি যে কারুর মনে হবে যে সদ্য স্বাধীন হওয়া দরিদ্র্য এক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কি এইরকম একটা বিষয় নিয়ে এতোখানি সময় ও মনোযোগ ব্যয় করা সাজে? সুভাষ বসুর অন্তর্ধানের পেছনে নেহরুর কিছু ষড়যন্ত্র আছে এই অভিযোগ অসত্য প্রমান করতেই বোধয় উনি এতখানি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা আর যত্ন নিয়েছিলেন রহস্যের সমাধান করতে। আরো আশ্চর্য্যের বিষয় হলো যে যখনই বিষয়টার একটা নিষ্পত্তি করে নেতাজীর স্মৃতিকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছে সরকার তখনই একাধিক জন মামলা মোকদ্দমা করে ফের বিষয়টাকে ঘেঁটে দিয়েছে এবং পাছে নেতাজীর অপমান হয় এই ভয়ে সরকারও এইসমস্ত গুচ্ছের মামলা মোকদ্দমাকে গুরুত্ব দিয়ে অভিনিবেশ করেছে। সমস্তটা দেখে এটাই বার বার মনে হচ্ছিলো যে দেশের এতো সমস্যা যেখানে সরকারের মনোযোগ পায় না সেইখানে এই বিষয় নিয়ে এতখানি সময় দেওয়া বোধয় বাহুল্য।
যাই হোক, আনন্দবাজার এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে দেখলাম নেহরুর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলিকে লেখা একটা চিঠি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্ঠি হয়েছে। চিঠিতে নেহেরু নেতাজীকে "যুদ্ধ অপরাধী" বলে সম্মোধন করেছেন। চিঠির বয়ানটি হলো :
"Dear Mr Attlee,
I understand from reliable sources that Subhas Chandra Bose, your war criminal, has been allowed to enter Russian territory by Stalin. This is a clear treachery and betrayal of faith by the Russians as Russia has been an ally of the British-Americans, which she should not have done. Please take note of it and do what you consider proper and fit."
Your's Sincerely,
Jawaharlal Nehru
কংগ্রেস বলেছে এইরম কোনো চিঠি নেহেরু লেখেননি। আমি ফাইল ঘেঁটে এই চিঠি তিন জায়গায় পেলাম। এই তিন জায়গা বাদ দিয়ে এই চিঠি আর কোথাও নেই। আপনারা খুঁজে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে পারেন অথবা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন।
১. এই চিঠির প্রথম উল্লেখ রয়েছে শ্রী রুদ্রজ্যোতি ভট্টাচার্য্যের ১৯৯২ সালে করা কলকাতা হাই কোর্টে একটি পিটিশনে (লিংক: http://netajipapers.gov.in/pdfjs/web/viewer.html…)। সেই সময় নেতাজীকে মরনোত্তর ভারত রত্ন দেওয়ার কথা উঠেছিলো সরকার থেকে আর তা ঠ্যাকাতে বেশ কিছু মামলা হয় যার মধ্যে এইটি একটি। এই পিটিশনে কিন্তু সরাসরি বলা হয়নি যে নেহেরু এরকম কোনো চিঠি দিয়েছিলেন। যা বলা হয়েছে তা হলো ১৯৭০-এ গঠিত খোসলা কমিশন, যার কাজ ছিলো নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্যভেদ, সেই কমিশনের সামনে নেহরুর ব্যক্তিগত স্টেনোগ্রাফার শ্যামলাল জৈন এইরম একটা চিঠি টাইপ করার কথা বলেছেন। যে বয়ানটা ওপরে দিলাম নেহেরু সেই বয়ানটি একটি প্যাডে হাথে লিখে শ্যামলালকে দেন এবং তিনি সেটা টাইপ করে নেহরুকে ফেরৎ দেন। নেহেরু তারপর সেই চিঠি নিয়ে কি করেছিলেন শ্যামলাল জানেন না। শ্যামলাল কিন্তু এই বয়ান স্মৃতি থেকে বলেছেন খোসলা কমিশনের কাছে, তাঁর কাছে সেই চিঠির কোনো প্রমাণ নেই। যদি ধরেও নি যে শ্যামলাল সত্যি বলেছেন তবুও ১৯৪৫-এ লেখা একটি চিঠি হুবহু ১৯৭০-এ এসে স্মৃতি থেকে আওড়ানো সোজা কথা না। কিছু শব্দের এদিক ওদিক যে হবেনা কেউই হলপ করে বলতে পারে না। যেটা আশ্চর্য্যের বিষয় তা হলো রুদ্রবাবু কোথা থেকে শ্যামলালের বয়ানের কথা জানলেন সেটা রহস্যময়। খোসলা কমিশনের রিপোর্টের মধ্যে শ্যামলালের বয়ানের কোনো উল্লেখ নেই। এই হলো খোসলা কমিশনের রিপোর্টের লিংক : http://subhaschandrabose.org/report-one-man-commission-inqu…
২. দ্বিতীয়বার এই চিঠির উল্লেখ রয়েছে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে লেখা নেতাজীর ভাই সুরেশ চন্দ্র বসুর ছেলে প্রদীপ বসুর ৯৮ সালের একটি চিঠিতে (লিংক: http://netajipapers.gov.in/pdfjs/web/viewer.html… , পৃষ্ঠা - ১১২)। প্রদীপ বসুও সেই খোসলা কমিশনকে দেওয়া শ্যামলাল জৈনের বয়ানকেই তুলে দিয়েছেন চিঠিতে কিন্তু তিনিও শ্যামলাল জৈনের বয়ানের কোনো রেফারেন্স দেননি, খোসলা কমিশনের রিপোর্টে ওই বয়ান কেনো নেই তাও লেখেননি।
৩. তৃতীয়বার এই চিঠির উল্লেখ রয়েছে আবার শ্রী রুদ্রজ্যোতি ভট্টাচার্য্যের করা ২০১৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টে একটি পিটিশনে। নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্যের কি কিনারা হলো তা জানতে চেয়ে সেই পিটিশন। এখানেও সেই শ্যামলাল জৈনের বয়ানকেই উধৃত করা হয়েছে যদিও শ্যামলাল জৈনের ওই বয়ান কোথায় পাওয়া গেছে তার কোনো উল্লেখ এখানেও নেই। (লিংক : http://netajipapers.gov.in/pdfjs/web/viewer.html… ) যেটা আশ্চর্য্যের বিষয় তা হলো শ্যামলাল জৈনের ওই বয়ান কিন্তু আদেও গোপন কিছু নয়। যেহেতু হাই কোর্টের পিটিশন তাই সেটা পাবলিক ডকুমেন্ট এবং সেই ডকুমেন্টে শ্যামলালের বয়ানের উল্লেখ থাকবে। একটু ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম যে যা সন্দেহ করেছিলাম তাই, এই পিটিশন নিচের দেওয়া India Kanoon ওয়েবসাইটে রয়েছে আর তাতে ওই শ্যামলালের তথাকথিত বয়ানও রয়েছে। অর্থাৎ নেহেরু সত্যি শ্যামলালকে এরকম বলেছেন কিনা জানা নেই আর শ্যামলালও এরকম কোনো কথা খোসলা কমিশনের কাছে বলেছেন কিনা তাও পরিষ্কার না কিন্তু এই তথাকহিত বয়ান পাবলিক ডকুমেন্টের মধ্যেই ছিলো, তার জন্যে ফাইল প্রকাশের প্রয়োজন ছিলো না। লিংক : http://indiankanoon.org/doc/176710997/
নেহেরু সুভাষ বসুকে যুদ্ধ অপরাধী বলেছেন এর কোনো সরাসরি প্রমাণই প্রকাশিত ফাইলে নেই, উল্টে যা আছে তা হলো সুরেশ চন্দ্র বসুর এক প্রশ্নের জবাবে নেহরুর চিঠি যাতে উনি লিখেছেন যে নেতাজীকে যুদ্ধ অপরাধী বলবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না এবং অন্য কোনো দেশ যদি তা মনেও করে তাদের হাতে নেতাজীকে খুঁজে পাওয়া গেলে তুলে দেওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। নেহেরু গঠিত শাহ নওয়াজ কমিশনে সুভাষ বসুর দাদা সুরেশ চন্দ্র বসু একজন সদস্য ছিলেন এবং সেই কমিশনের কাজ শুরুর আগে তিনি নেহেরুকে প্রশ্ন করেছিলেন যে নেতাজীকে যদি জীবিত খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে ভারত সরকার তাকে যুদ্ধ অপরাধী বলে ধরবে কিনা। তার উত্তরে নেহেরু ওই চিঠি লেখেন। লিংক : http://netajipapers.gov.in/pdfjs/web/viewer.html… পৃষ্ঠা ১৩০।
উপরন্তু, ভারত সরকার একাধিকবার জাতিসংঘ এবং মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি লিখেছে জানতে চেয়ে যে আদেও যুদ্ধ অপরাধীর তালিকায় সুভাষ বসুর নাম আছে কিনা এবং প্রত্যেকবারই তারা জানিয়েছে যে এরকম কোনো তালিকায় সুভাষ বসুর নাম নেই। এইসবও বেশ কয়েকটা ফাইলে আছে। এমন কি ফাইলের মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের মধ্যে একাধিক চিঠিপত্রও ফাইলগুলির মধ্যে রয়েছে যেগুলো সুভাষ বোস বেঁচে থাকতে লেখা। সেগুলোয় তাদের মধ্যে আলোচনা দেখা যাচ্ছে যেখানে তারা বলছেন যে কোনো আইনেই সুভাষ বসুকে যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে ধরা যাবে না, ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরোধিতা করবার কনস্পিরাসির কেস দেওয়া যেতে পারে কিন্তু সেরকম কোনো কেসের ট্রায়াল মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে সেই নিয়ে তারা চিন্তিত।
অমর্ত্য সেন যে মন্তব্য করেছেন তার সাথে একমত। নেতাজীকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ব্যবহার করা বন্ধ করা হোক, দিন কে দিন মানুষের বিরক্তিই এতে বাড়বে আর সেই বিরক্তির ভাগীদার অকারণে নেতাজীকে হতে হবে। তাঁর কাজকম্ম, আদর্শ নিয়ে আলোচনা হলে সেটা অনেক বেশি লাভজনক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন