আমি বাঘকে ভয় পাই না। কখনোই পেতাম না।
শীতের ছুটিতে বাবা চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেছিল, দেখিয়েছিল কেমন করে অসহায়ভাবে খাঁচায় বন্দী হয়েও পশুটা রাজকীয় ভঙ্গীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে লোকেরা চেঁচামেচি করছে, কেউ কেউ ঢিল ছোঁড়ার চেষ্টা করছে, হাততালি দিয়ে, শিস দিয়ে বিরক্ত করছে। বাঘটা পাত্তাও দিচ্ছে না। একবার একটু গা-ঝাড়া দিতেই সবাই হূরমুড়িয়ে পালালো।
বাবা বলেছিল, "দেখেছিস! সত্যিকারের সাহসী যারা, পরিস্থিতিও তাদের চরিত্র বদলাতে পারে না! অন্যায় কৌশলে ওকে বন্ধ করে রেখেছে, কিন্তু ওর সাহস, ওর তেজ কমাতে পেরেছে কী? বরং খাঁচার বাইরে, নিরাপদে থাকা লোকেরা ওকে এতদূর থেকে দেখেও ভয় পাচ্ছে!"
আমার বাবার খুব সাহস। বাবার বন্ধুরা বাবাকে বলে 'বাঘের বাচ্চা!'
আর আমি তো তারই ছেলে, আমি কেন বাঘকে ভয় পাব!
বাবার একটা বুলেট মোটরবাইক আছে। আমাকে সামনে বসিয়ে যখন সেটা চালিয়ে ভটভট করে বড় রাস্তা দিয়ে যায়, লোকেরা রাস্তা ছেড়ে দেয়। কেউ ভয়ে, কেউ সম্ভ্রমে।
বাবার নাম বিপ্লব, অনেকে ডাকে বুলেট বিপ্লব বলে।
আমাদের স্কুলে মিস সকলের নামের মানে জেনে আসতে বলেছিলেন। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "বাবা, বিপ্লব মানে কি?"
একটু হেসেছিল বাবা, তারপর বলেছিল, "তোকে এবার থেকে ক্লাবে নিয়ে যাব।"
শুনে মা খুশী হয়নি, "আবার ওকে টানছ কেন..."
বাবা শুনেও শোনেনি।
আমি ভেবেছিলাম, বিপ্লব মানে ক্লাব।
রাত্তিরে বাবার পাশে শুয়ে বাবার বুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলাম। একটা কাটা দাগ আছে বাবার বুকে, আগেও দেখেছি, কিন্তু প্রশ্ন করিনি। সেদিন জানতে চাইলাম, "বাবা, এই দাগটা কিসের?"
একটু হেসে বাবা বলেছিল "ওটা একটা বাঘের থাবার দাগ।"
-"তোমাকে বাঘে থাবা মেরেছিল?"
-"না, মারতে পারেনি। চেষ্টা করেছিল।"
-"তারপর! বাঘটার কি হলো?"
-"আর কী, এমন তাড়া করলাম, পালিয়ে গেল আমার ভয়ে!"
-"বাবা, পুরো গল্পটা বলো, আমি শুনবো!"
-"আজ নয়, আর একদিন বলব, কেমন?"
আমি ভেবে নিলাম, বিপ্লব মানে বাঘ।
বাবা খুব মোটা সোটা ছিল না, কিন্তু হাতদুটো ছিল লোহার মতো শক্ত, আর পরিশ্রম করতে পারতো খুব। যখন রাস্তার মাঝখান দিয়ে বুলেট বাইক চালিয়ে যেত, সামনে বসে আমি বাবার শক্ত হাতদুটো ধরে থাকতাম। গাড়ি যতোই জোরে যাক না কেন, আমার ভয় করতো না। সেদিনও ঐভাবেই ক্লাবে নিয়ে গেল বাবা। যেতে যেতে আমার মনে হল, বিপ্লব মানে নিশ্চয়ই ভরসা, সাহস!
আমি ভাবতাম ক্লাবে দোলনা থাকে, ছোটরা খেলাধুলো করে, বড়রা গান গায়, খাওয়াদাওয়া হয়। কিন্তু এই ক্লাবে দেখি সবাই অনেক বড়, খুব গম্ভীর আলোচনা করছে। এক একজন করে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে, আর সকলে হাততালি দিচ্ছে। আমার বাবাও কিছুক্ষণ কথা বললো, সবাই খুব হাততালি দিল। তারপর বললো, 'ইঙ্কলাব জিন্দাবাদ'। আমিও বললুম তাদের সঙ্গে। দু'জন কাকু সেটা দেখে আমার গাল টিপে আদর করে বললো, হবে না! বাঘের বাচ্চা তো!
ফেরার সময় বাবাকে বললাম, "বাবা, ক্লাবের মধ্যে বলে ইন ক্লাব বলতে হয়, তাই না?"
বাবা হা-হা করে হেসে বললো, "আরে না না, কথাটা ইনকিলাব জিন্দাবাদ, তার মানে বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!'
ভালো লাগলো যে এতজন কাকু চাইছেন আমার বাবা দীর্ঘজীবি হোন! বিপ্লব মানে তাহলে দীর্ঘজীবি!
তার কয়েকদিন পরেই শুনলাম "অবরোধ অবরোধ"। ভোরবেলা বাবা বেরিয়ে গেল। মা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর গজগজ করছিল। সারাদিন কেটে গেল, বাবা ফিরলো না। সন্ধ্যেবেলা দু'জন কাকু এসে মা-কে কীসব বলল, মা তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে, একটা ব্যাগ নিয়ে, আমাকে ঘরের পোশাকে নিয়েই কাকুদের সংগে একটা গাড়িতে উঠে চলল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে চললাম চুপচাপ। মা মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমরা কোথায় যাচ্ছি?"
-"তোমার বাবাকে দেখতে।"
-"বাবা কোথায়? কী হয়েছে বাবার?"
-"কিছু খারাপ লোক তোমার বাবাকে মেরেছে, বাবা হাসপাতালে ভর্তি।"
-"কেন! আমার বাবাকে অন্যরা মারবে কেন!"
-"তোমার বাবা তো ভাল লোক, তাই খারাপ লোকেরা বাবাকে ভয় পায়। সেই ভয় থেকেই মারে। তোমার বাবা মানুষের ওপর অত্যাচার মেনে নেয় না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। তাই খারাপ লোকেরা বাবাকে ভয় পায়। "
-"খারাপ লোকেদের পুলিশ ধরে না কেন? কেন তারা অন্যায় করবে?"
-"পুলিশও যে তাদের কথা শুনে চলে! তারাই যে দেশ চালায়, আতি তাদের অনেক ক্ষমতা! তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস লাগে, আর সেই সাহস সকলের থাকে না। তোমার বাবার আছে।"
-"হ্যাঁ, বাবার খুব সাহস। জানো কাকু, একবার বাবা একটা বাঘের সংগে লড়াই করেছিল, বুকে কাটা দাগ আছে!"
-"বাঘ নয়, ওই খারাপ লোকেরাই আগে একবার বাবাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, পারেনি। ওটা তারই দাগ। বাঘ তো সাহসী, আড়ালে লুকিয়ে মারে ভিতুরা। তোমার বাবার মতো যারা প্রতিবাদ করে, তাদের মারার চেষ্টা করে।"
-"কাকু, বিপ্লব মানে কি প্রতিবাদ?"
কাকু হাসলো। "ঠিক বলেছ। বিপ্লব মানে প্রতিবাদের লড়াই। একে চেপে রাখা যায় না।"
হাসপাতালে মাথায়, হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বাবাকে শুয়ে থাকতে দেখে কেমন অচেনা লাগছিল, সারা গা কাঁপছিল আমার রাগে, অসহায়তায়। বাবা ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল, মাথায় হাত রেখে ধীরে ধীরে, কেটে কেটে বলল, "ভয় পাসনা, আমি সেরে উঠব শিগগির! পড়াশোনা করবি, মায়ের খেয়াল রাখবি, কেমন?"
আমার বলতে ইচ্ছে করল, "ইনকিলাব জিন্দাবাদ!" কিন্তু গলায় কী যেন আটকালো, তাই বলতে পারলাম না।
মনে পড়লো খাঁচায় বন্দী সেই অসহায় বাঘটার কথা। কৌশলে বন্দী করে রেখে সক্কলে মজা দেখছে আর টিটকিরি দিচ্ছে। যদি একবার বাবা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে...
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হবে। হবেই!!
রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৬
বাঘ ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন