• তৃণমূলীরা বারবার প্রচার করে, বামফ্রন্ট সরকার ১লক্ষ ৯২হাজার কোটি টাকা ঋণ করে গেছে। বাস্তবে সেই ঋণ স্বাধীনতা প্রপ্তির সময় থেকে ২০১১ সালের ১১ই মে পর্যন্ত সময়ে করা। বাজার থেকে করা ঋণের পরিমাণ তুলনায় কমই ছিল।
• বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে স্বল্পসঞ্চয়ে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল। চিটফান্ডগুলির রমরমা ঠেকাতে তা কাজে এসেছিল। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকারের বিচিত্র একতরফা আইন অনুসারে রাজ্যে যত অর্থ স্বল্পসঞ্চয়ে সংগৃহীত হতো, তার একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে রাজ্য সরকারকে নিতে হয়। সেই কারণে, কেন্দ্রীয় আইন অনুসারে ৭৯হাজার কোটি টাকা ঋণ হয় কেন্দ্রের কাছে। এই ঋণ বাজার থেকে করা ঋণ নয়।
• কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা খাতের বরাদ্দের ৭০শতাংশ রাজ্য সরকারকে নিতে হতো ঋণ হিসাবে। সেই ঋণের পরিমাণ বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ছিল ১২হাজার ৩০০কোটি টাকা।
• নাবার্ডসহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সাহায্য থেকে রাজ্যের ৩৪বছরে ঋণ দাঁড়ায় ৮হাজার ৫০০কোটি টাকা।
• পি এফ তহবিলে ঋণের পরিমাণ বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ছিল ৮হাজার কোটি টাকা।
• কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক বছরের শেষ লগ্নে টাকা পাঠানোয় কখনও কখনও টাকা খরচ করা যায় না। খরচ না হওয়া ওই টাকা পরের আর্থিক বছরের ধারের তালিকায় ঢুকে পড়তো। এমন ১২হাজার কোটি টাকাও চৌত্রিশ বছরে ঋণের তালিকায় রয়েছে।
• এইসব নিয়ে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১লক্ষ ৯২হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে বাজার থেকে ধারের পরিমাণ ৭২হাজার কোটি টাকা।
• তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রশ্ন ছিল ঋণভারে জর্জরিত অর্থনীতির সাহায্যে কি কোনো উন্নতি করা সম্ভব? রাজ্যের বহুল প্রচারিত একটি সংবাদপত্র সেদিন তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিল, ''সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বৈঠকে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন রাজ্যের এক টাকা আয়ের ৯৪ পয়সাই চলে যায় বেতন পেনশন, সুদ ইত্যাদি যোজনা বহির্ভূত খরচ মেটাতে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, ৬ পয়সায় কি উন্নয়ন সম্ভব? (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ অক্টোবর, ২০১১)
• সত্যিই কি এক টাকা আয়ের ৯৪ পয়সাই চলে যায় বেতন, পেনশন, সুদ ইত্যাদি যোজনা বহির্ভূত খরচ মেটাতে? ডাহা মিথ্যা কথা। তৃণমূল রাজ্য সরকারেরই তথ্য বলছে, ২০১৪-১৫ আর্থিক বর্ষে ঋণ, বেতন, পেনশন বাবদ রাজ্য সরকারের খরচ হয়েছে মোট ৭৪ হাজার ৮৮৮ কোটির সামান্য বেশি। সেখানে ২০১৪-১৫ আর্থিক বর্ষে রাজ্য সরকারের মোট আয় ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। (সূত্র : বাজেট অ্যাট এ গ্লান্স ২০১৫-১৬, পৃ: ১ ও পৃ: ১৩) অর্থাৎ, বেতন, পেনশন, সুদ এই তিনটি খাতে রাজ্য সরকারের খরচের পরিমাণ আয়ের ৫৮ শতাংশ, মমতা ব্যানার্জি কথিত ৯৪ শতাংশ নয়।
• বর্তমানে ধার করার হিসেবে তৃণমূল-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে 'এক নম্বর'। বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেবার সময় (২০১১ সালের ১১ মে) সব মিলিয়ে (স্বাধীনতার পর কংগ্রেসী আমলের ঋণসহ) রাজ্যের পুঞ্জিভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের বাজেটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। সরকারি তথ্যই জানিয়ে দিচ্ছে মমতা ব্যানার্জির সরকার পাঁচ বছরে রাজ্যবাসীর মাথায় অতিরিক্ত ১ লক্ষ ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ চাপানোর ব্যবস্থা করেছে। সবটাই বাজার থেকে নেওয়া ধার।
• ২০১১সালের ২০শে মে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ক্ষমতায় আসার প্রথম ১০মাসে নতুন সরকার বাজার থেকে ধার করেছিলো ১৭হাজার ৫০০কোটি টাকা। ২০১২-১৩আর্থিক বছরে রাজ্য ধার করে প্রায় ২১হাজার কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে বাজার থেকে মমতা ব্যানার্জির সরকারের ধারের পরিমাণ ছিলো ২১হাজার ৫৫৬কোটি ৪২লক্ষ টাকা। ২০১৪-১৫-তে বাজার থেকে রাজ্য সরকার ধার নিয়েছিল ২১হাজার ৯০০কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ আর্থিক বর্ষের প্রথম মাসে, অর্থাৎ ২০১৫-র এপ্রিলে, রাজ্য সরকার ১০০০কোটি টাকা ধার করে। তারপর প্রায় প্রতিমাসেই ধার।
• ১৯৪৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত রাজ্য সরকার গড়ে প্রতি বছর ঋণ নিয়েছিল ৫ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে বছরে গড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে।
ঋণের টাকা কোথায় গেল?
• লক্ষাধিক কোটি টাকা রাজ্য সরকার ধার করলেও কাজ কী করলো? প্রশ্ন সেটাই। নতুন কোনো স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি হয়নি বলেই চলে। শুধু শিলান্যাস হচ্ছে। বামফ্রন্টের আমলে তৈরি সরকারী বাড়ি, হাসপাতাল, সেতুতে নীল-সাদা রঙ চাপিয়ে পাথরে মন্ত্রী-নেতাদের নাম খোদাই চলছে। রেগার মজুরি দেওয়া হয়নি। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি বন্ধ হবার মুখে, উন্নয়নমূলক কাজে টাকা নেই। টাকা ঢালা হচ্ছে সরকারী মেলা, মোচ্ছব আর উৎসবের নামে এবং চক্ষু লজ্জাহীন সরকারী প্রচারে। মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফর ঘিরে কোটি কোটি টাকা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
• পরিকল্পনা বহির্ভূত খরচে রাশ না টানার ফলেই প্রতি মাসে নিয়ম করে বাজার থেকে টাকা ধার করছে রাজ্য সরকার। ২০১৪-১৫সালের রাজ্য বাজেটে পরিকল্পনা উন্নয়ন খাতে সরকার ৪২হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর উলটোদিকে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে রাজ্য সরকারের ব্যয় বরাদ্দ ১লক্ষ ১৪হাজার ৩১৯কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে খরচ করার মধ্য দিয়েই বেহিসাবি খরচে কোনো লাগাম নেই।
• সরকারি হিসাব অনুযায়ী এক শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বাবদ মাসিক ব্যয়ের পরিমাণ ২৫ কোটি টাকা বা বছরে ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এর জন্য বছরে ১৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরকারের হাতে রয়ে গেছে। বর্তমানে বকেয়া ৫৪ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিয়ে ২০১২ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সাশ্রয়ের পরিমাণ ৩০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এত টাকা কোথায় নয়ছয় করলো তৃণমূল সরকার?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন