মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০১৩

টুক্‌নামচা... ৩ ~ সংগীতা দাশগুপ্তরায়

নদী বলতে বাড়ির পাশের গঙ্গাই ছিল চেনামুখ। বাকি একটু অল্প চেনা ছিল উশ্রী। তার সঙ্গে দেখা হত মনোরম হিম হিম শীতকালে। ভোরের উশ্রী, শীতের পলি ভরা। কোথাও কোথাও পায়ের গোছ ডোবা জল। সে জলে পা রাখলে মনে হত পা জমে গেল মুহূর্তে। একটু বেলা বাড়লে গিরিডি আর আশেপাশের লোকজনের পিকনিক স্পট উশ্রী। নদীর বুকে নৌকো নেই কিন্তু পিকনিক আছে, এমন নদীকে নদী বলে পাত্তাই দিতাম না । দাদা, অর্কদারা সবাই মিলে ক্রিকেট খেলত বেশি ফাঁকা জায়গা পেলে। শীতের লোকাল সবজী নিয়ে কানে নাকে ইয়াব্বড় রুপোর মাকড়ি আর গলায় হাঁসুলি পড়া দেহাতি চাচিরা পসরা সাজিয়ে বসত উশ্রীর মাঝ বরাবর, হিন্দীতে নিজেদের মধ্যে কিচির মিচির কথা বলত আর গুড়াকু দাঁতে ঘষে এখানে সেখানে থুতু ফেলত... সাইকেল টেনে নিয়ে যেত খাটো ধুতি পরা কিছু লোক।

আমাদের বাড়ির ছাদ থেকেই দেখা যেত উশ্রীর এই পাঁচমিশেলি রূপ। তবে এই সব  শুরু হওয়ার আগে খুব ভোর ভোর আকাশে সূয্যিদেব যখন আড়মোড়া ভাংবেন কিনা ভাবছেন তখন নদী থাকত শুনশান। যদিও কাছে গেলে দেখা যেত সেই সময়টা আসলে নদীর ধার জুড়ে এখানে ওখানে পাবলিক শৌচালয়। মাসিমণির বড় ননদের মেয়ে শেলিদি ছিল তুমুল মোটাসোটা । বিয়ের ঠিক হওয়ার আগে তাকে রোগা করার জন্য শুরু হল হাঁটাহাঁটি। কদিন ভোরবেলা ঠাসাঠাসি সোয়েটার মাফলার চাপিয়ে সে বেরিয়ে পরে হাঁটতে। ফিরে আসে একদম ঝকঝকে তরতরে। অতখানি হেঁটে আসার ক্লান্তিটুকুও বোঝা যায় না মোটে। পিসিমণি, শেলিদির মা ওই সময়েই বাগান উজাড় করে ঠাকুরের ফুল তোলে। শেলিদিও দিব্যি ফিরে জামা কাপড় চেঞ্জ করে চায়ের কাপ নিয়ে বাইরে বাগানে এসে ছায়ায় বসে একটা অর্ধেক বোনা কুরুশের ঢাকনা বা লেটেস্ট আনন্দলোক নিয়ে। বাবা না থাকায় মামারবাড়ি আদরটা একেই একটু বেশি তারওপর আবার মর্ণিং ওয়াকের ধকল সেরে এসে বসেছে। পিসিমা মেয়েকে খুব কিছু জিজ্ঞাসাও করে না । একদিন বলল হ্যাঁরে শেলি, তুই উশ্রী পেরিয়ে ওপারে যাস তো। ফেরার সময় বাজারটা বসে যায়? শেলিদি যাহোক একটা উত্তর দিয়ে বোনায় মন দেয়। বেশ কদিন এইভাবেই গেল। তারপর একদিন শেলিদিও বেরিয়েছে আর তার পিছনে বেরিয়েছেন আমার মেসোমশাই, শেলিদির বড়মামা। কিছুদূর গিয়ে শেলিদি ডাইনে বাঁক নিতে মেসোমশাই একটু থমকে যান । ডাইনে বেঁকে বড় রাস্তা, হাইস্কুল, ব্যাঙ্ক। ওদিক দিয়ে নদীতে পৌছনো যায় না । একটু এগিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলেন গলির তিন নম্বর বাড়ির কাঠের গেট খুলে শেলিদি গটমটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মেসোমশাই কৌতূহল মেটাতে নিজেও ও বাড়ির গেট খুলে ঢুকলেন। প্রবাসে বাঙ্গালীরা বেশ পরিবারের মতই হয়ে যেত তখন। গেটওয়ালা বাড়িটা শেলিদের বন্ধু তুসুদিদের।  মেসোমশাই বাইরে থেকে তুসুউউ বলে ডাক দিতেই ভেতর থেকে সারা এল "সব তো ঘুমুচ্ছে !! এত ভোরে আপনি!!" জানা গেল শেলিদি সাজপোশাক এঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে এ বাড়িতে এসে দিব্যি তুসুদির বিছানায় ঢুকে ঘুমিয়ে পরে । বেলা হলে আবার উঠে বাড়ি ফিরে যায় । শুনেই বাড়িতে হইচই পরে গেল। হুকুম হল   বাড়ির সব ছোটরা শেলিদির সঙ্গে মর্ণিং ওয়াকে যাবে রোজ। আমার তো প্রবল আপত্তি । আমি একেই প্যাংলা টিংটিং ছিলাম। আরও রোগা হওয়ার প্রশ্নই নেই। তাছাড়া ছুটিতে গিয়ে মাসতুতো বোনের পিসতুতো দিদিকে রোগা হতে হেল্প করার জন্য ভোর রাতে ওঠার থেকে কলকাতা ফিরে আসা ভাল। তবে সে আপত্তি জীবনের বাকি নাইন্টি পারসেন্ট আপত্তির মতই ধোপে টিকল না । সেবারের ছুটিটা ভোরে ওঠার ধকল নিয়েই কাটল।

পরের বর্ষার আগেই বিয়ে ঠিক হল শেলিদির। একটা আনপ্ল্যানড ভেকেশন আমাদের। দানাপুর এক্সপ্রেসে রাত্রে চড়ে বসলাম। দুটো কামরা একদম শেষের দিকে এক্সক্লুসিভলি গিরিডির জন্য থাকত। গিরিডির সব প্যাসেঞ্জারের বুকিং ওই দুটোতেই । ভোর চারটেয় ট্রেনটা মধুপুরে ঢুকে গিরিডি বগিগুলোকে কেটে রেখে এগিয়ে যেত দানাপুরের পথে। প্যাসেঞ্জাররা আলো ফোটার আগেই ট্রেন থেকে নেমে হাত পা ছড়িয়ে নিত একটু। প্ল্যাটফর্মের কলে মুখ হাত ধুয়ে খাওয়া হত কচু বা পদ্মপাতায় সার্ভ করা গরম গরম পুরি সবজী। গরম, ধোঁয়া ওঠা মসালা চায়েএএওয়ালা আমাদের দিকে তাকিয়ে লোভ দেখাত মোটা দুধের অমৃত চায়ের। খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতেই আলো ফুটত পূবে আর সেই আলোর ফ্রেম থেকে ঝিকঝিকিয়ে বেরিয়ে আসত একটা ইঞ্জিন। শুদ্ধু ইঞ্জিন। সে এসে, হাঁপিয়ে, থিতু হতে হতেই বগি দুটো জুড়ে নিত ল্যাজে আর তারপর হুশহুশিয়ে গিরিডি পৌঁছে যেতাম এক ঘন্টায়। সেবার কিন্তু ব্যাপারটা অন্য রকম হল। মাঝরাতে আসানসোল থেকে এক ফ্যামিলি উঠল কাকভেজা হয়ে। তাদের রিজার্ভেশন নেই। ঘুমন্ত আধাঘুমন্ত লোকজনকে ঠেলেঠুলে বসতে বসতে গোটা কামরা জাগিয়ে এবং ভিজিয়ে দিল তারা। তাদের কাছেই শুনলাম তিনদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি চলছে। ঝাঁঝা, জসিডির দিকে নাকি জল দাঁড়িয়ে গেছে প্ল্যাটফর্মের লেভেলে। আধা ঘুম আধা জাগায় বাঙ্কে শুয়ে থাকতে থাকতে সে বৃষ্টি তেমন ভয়ানক মনে হয় নি। মধুপুরে আসার আগেই বাপী  তুলে দিল। নেমে দেখি উপুরঝুপুর বৃষ্টি। গিরিডি বগি দুটো একদম শেষ মাথায়। সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে শেডের নিচে পৌঁছতে গিয়ে আমরাও কাকভেজা। বোনের তো দাঁতের ঠকঠকানি থামেই না । শেডের নিচে  মিটমিট করে টেমি জ্বলছে শুধু একটা স্টলে। পর পর তিন ভাঁড় করে চা খেলাম আমরা। চাওয়ালার শিশিতে  কয়েকটা বিস্কুট পড়ে আছে। পুরি সবজী দুদিন ধরে বন্ধ। ভোজপুরি মেশানো হিন্দিতে সে যা বলল সেটা হল কিছুই পাওয়া যাবে না।  সব্জী উব্জী আটা গেঁহু সব জমা করে রাখতে হচ্ছে। বার আসছে রেডিওতে টিভিতে বলেছে। সুতরাং এখন শুধু শুখা খাবার খেয়ে পেট ভরাতে হবে পিসেঞ্জারদের। মা বাপীকে বলল চিন্তা না করতে... একেবারে বাড়ি গিয়ে খেলেই হবে। আর তো একঘন্টার পথ। এখন একটু চা বিস্কুটেই চলবে। শুনে চা-ওয়ালার কী হাসি! কপালে হাত চাপড়ে বলল নেতাজীকি কসম , আজ ইঞ্জিন আসবে একবারই। বেলা ন'টার সময়। গিরিডির পিসেঞ্জারদের নিয়ে আসবে। একা আসবে না। আমরা দু বোনে ওর "নেতাজী কি কসম"  শুনে খুব মজা পেয়েছিলাম। আর কখনও কাউকে নেতাজীর দিব্যি দিতে শুনিনি জীবনে।
বাপী আমাদের নিয়ে রিটায়ারিং রুমের দিকে এগোলো। সেখানে এক কোনে মাদুর পেতে শুয়ে এক বৃদ্ধ ঘুমোচ্ছেন আর একজন কাকু টাইপের ভদ্রলোক ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে খাচ্ছেন একটা বই পড়তে পড়তে । অনেক কিছুই ভুলে গেছি ছেলেবেলার। কিন্তু ভেজা অন্ধকার প্ল্যাটফর্মের রিটায়ারিং রুমের আধখোলা দরজা দিয়ে ছিটকে আসা একফালি আলো, পিঠ ফেরা একটা ঘুমন্ত শরীর আর বইয়ে মুখ গোঁজা একজন ভদ্রলোক, এই ছবিটা খুব স্পষ্ট মনে আছে।

ইঞ্জিন এলো, বহু ঘন্টা পরে... আমাদের মনে হচ্ছিল এক যুগ পার করে এল... বেলা বারোটায় ইঞ্জিন এলো বগি টেনে নিয়ে যেতে । ততক্ষনে কামরায় লোকাল লোকের ভিড়, বিড়ি, তামাকের গন্ধ আর  চিৎকারের মধ্যে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এ সবের জন্য ওই বিচ্ছিরি মর্ণিং ওয়াকই দায়ী। না সকালে হাঁটত শেলিদি, না রোগা হত আর না বিয়ের ঠিক হত এই বৃষ্টিতে।

কটা দিন গুচ্ছের খিচুরি খেলাম আমরা। আইবুড়োভাতের আগের দিন আকাশ যেন একটা কুটকুটে কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে নিল। আমাদের ছাদে দাঁড়ালে মনে হচ্ছিল সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। মাসিমনিদের কাজের মাসিরা এসে বলল উশ্রীর খুব গুসসা হয়েছে। জলের তোড়ে ভাসিয়ে নিচ্ছে সব। আমরা দুড়দাড় করে ছাদে দৌড়লাম । চতুর্দিক ঘেরা প্যান্ডেলে। অনেক কসরত করেও সে ঘেরাটোপ থেকে না বেরোতে পেরে দাদা নিচ থেকে কাঁচি নিয়ে এল। কুচকুচিয়ে কোনার দিকের নারকেল দড়ি কেটে বেশ আলগা একটা ফাঁক তৈরি হল। মাথার ওপর কালো আকাশ আর একটু দূরে জলে ফুলে ফেঁপে ওটা উশ্রী। নদীর অমন রূপ আগে কখনও দেখিনি। পরেও না । ঠিক যেন শান্ত শিষ্ট সারাক্ষন রোদে পিঠ পেতে শুয়ে থাকা একটা মেয়ে প্রচন্ড রেগে উঠেছে। চুল দুলিয়ে হাত পা ছুঁড়ে যেন তান্ডব শুরু করেছে মেয়েটা।  আমাদের বাড়িতে  মাত্র একটা আগফা ক্যামেরা ছিল তখন। এখনকার মত যত্রতত্র ক্যামেরা বার করতে পারতাম না কেউই। তাই সে উশ্রীর ছবি নেই কোন । মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আমরা সব ভাইবোনেরা জড়সড় এক জায়গায়।

সন্ধে হল সন্ধে নামার অনেক আগেই। কে যেন এসে খবর দিল জল ছাপিয়ে গেছে ব্রীজের মাথা। জলের তোড়ে ভিড়ে ঠাসা একটা বাস একটু আগে  ব্রীজ টপকে নদীতে পরে ভেসে গিয়েছে। স্তব্ধ হয়ে গেছিল ছোট্ট ছিমছাম শহরটা। আমরা ছোটরা আর খেলছিলাম না । সবাই এই নিয়েই কথা বলছিল শুধু।  অথচ প্রাকৃতিক নিয়মেই পরের দিন থেকে সবার দৈনন্দিন জীবন নিজের খাতে বইতে শুরু করল।  আইবুড়োভাতে মাছের মাথা দিয়ে ডালটা নিরিমিষি ডালের গামলায় ঠেকে যাওয়ায় মনিঠাকুমা সারাদিন গজগজ করলেন এবং বোধহয় কিছু খেলেনও না । আত্মীয়দের মধ্যে যারা আসতে পারেনি তাদের রেপুটেশনের ভিত্তিকে কিছু প্রশংসা কিছু হালকা নিন্দে ইত্যাদি চলতে লাগল...  সারাদিন ধরে মাঝেমাঝেই কেউ কেউ এসে খবর দিল নদীতে একটা দুটো  'বডি' পাওয়া যাচ্ছে । একবার খুব ঝড়ো হাওয়ায় সেই কোনের ত্রিপল খুলে পড়ে গেল যেদিকের দড়ি কেটে আমরা নদী দেখতে বেরিয়েছিলাম। তবে সেটাকে  প্রাকৃতিক দুর্‍্যোগের কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবেই ধরা হল এবং আমরা কেউই বকুনি খেলাম না ।

প্রচুর বাধাটাধা পেরিয়ে নট-সো-রোগা ন্যাকামীতে ভরপুর শেলিদিদির বিয়ে হয়ে গেল সেই ভরা বৃষ্টির মধ্যে। আমাদের চোখে আটকে রইল বিয়ের এটাওটাসেটা সব ঘটনা আর প্রথমবার দেখা  রাগী উশ্রী।
ও হ্যাঁ, আমি একটা নতুন জিনিস শিখলাম... মানুষ মারা গেলে তাদের বডি বলে... 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন