রবিবার, ৩ মার্চ, ২০১৩

আজি হতে শতবর্ষ আগে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

এক – বাজিলো কাহার বীণা

তেরো সংখ্যাটা নাকি অশুভ। শ্বেতকায় বোদ্ধারা বলেন, আনলাকি থার্টীন। দু'হাজারের পর তেরো বসালে সেটা লাকি না আনলাকি, সেটা বছর না গেলে তো বোঝা যাবে না। তবে মিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে দিয়ে সিনেমার মত ফ্ল্যাশব্যাকে যদি দেখি একশো বছর আগে! কেমন ছিল সেই সময়টা?

সিনেমার জগতের খবর দিয়েই শুরু হয়েছিল ঊনিশশো তেরোর প্রথম দিনটা। পয়লা জানুয়ারি ব্রিটিশ বোর্ড অফ ফিল্ম সেন্সরস্‌ পেলো সিনেমাকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত ও সেন্সর করার অধিকার। মজার ব্যাপার, এখন যেমন সেন্সর কথার মানেই হচ্ছে অতিরিক্ত শরীর প্রদর্শনের বা জঘন্য রকমের মারপিটের বিরুদ্ধে কাঁচি চালানো, এর শুরুর উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল বেশ আলাদা। তখন আধুনিক ফিল্মের উপযোগী প্লাস্টিক রোল আবিস্কার হয়নি। তুলোর সেলুলোজের সঙ্গে নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় প্রাপ্ত নাইট্রোসেলুলোজ ছিল হোমিওপ্যাথি ডোজের বিস্ফোরক। জাপানের কোডাক কোম্পানি এই নাইট্রোসেলুলোজের সাথে কর্পূরের মিশ্রণে তৈরী করল ফটোর উপযুক্ত ফিল্ম, তার নাম হল নাইট্রেট ফিল্ম। এই নাইট্রেট ফিল্ম দিয়েই তৈরী হতে লাগল সিনেমাও। আর তখন সিনেমাহল বলেও নির্দিষ্ট কোন জায়গা ছিল না। একটা ঘুপচি দোকানঘর বা গুদামঘর বা কারও বাড়ির বেসমেন্টেও সিনেমা দেখানো যেতে পারত। কিন্তু এই নাইট্রেট ফিল্ম জাতে তো বিস্ফোরক, ঘষাঘষি হলেই এই ফিল্মে আগুন লেগে যেত, ফলে একের পর এক এই সব মেকশিফ্‌ট্‌ সিনেমাহলে দুর্ঘটনা ঘটতে লাগল। এর হাত থেকে বাঁচার উপায় হিসাবেই তৈরী হল সেন্সরশিপ, কোথায় কেমন পরিবেশে সিনেমা দেখানো যেতে পারবে, তার নিয়ম বানিয়ে। শীঘ্রই অবশ্য সিনেমার বিষয় ও তাতে যৌনতা ও ভয়াবহতাও সেন্সরশিপের আওতায় এসে যায়।

সিনেমার ব্যাপারেই আরো দুটো 'পয়লা' ঘটে গেল ব্রিটিশ ভারতেও। পয়লা মে রাওয়ালপিণ্ডি শহরে এক পাঞ্জাবী ক্ষত্রি পরিবারে জন্ম হল যুধিষ্ঠির সাহনির, আমরা যাকে পরে চিনলাম বলরাজ নামে। আর পয়লা অগাষ্ট মুম্বইয়ের শহরতলিতে কাপড়ের কলে চাকরি করা আভাজী পালব-এর ঘরে জন্মালেন ভগবান, ক্রমে সে হয়ে গেল ভগবান দাদা। 

না, শুধু ভবিষ্যৎ নায়কের জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি ভারতীয় সিনেমা। মে মাসের তিন তারিখে ভারতের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি রিলীজ হল সিনেমাহলে, তার নাম রাজা হরিশচন্দ্র, পরিচালক দাদাসাহেব ফালকে। এ ছবিটি ছিল অ-বাক, ভারতীয় ছবিতে সংলাপ শুরু হওয়া আরো পরের ঘটনা, কিন্তু সেই যুগে পরাধীন ভারতে এটাও এক অবাক কাণ্ডই বটে। 

আরও আছে। মহীশূরের উপকণ্ঠে ধারোয়ার ও হুবলি দুই পাশাপাশি শহর, যমজ ভাইয়ের মত। দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণমৃত্তিকা তুলোচাষের পক্ষে উৎকৃষ্ট, এ ছাড়াও লৌহসমৃদ্ধ এই মাটিতে অনেক কিছুর চাষবাস হয়। চিক্কুরাও নাদিগার নামে এক ভদ্রলোক, তার বাড়ি ধারোয়ারে, চাষবাস নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। স্ত্রী অম্বাবাঈ ভালোবাসেন গান, কর্ণাটকী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত। দুর্ভাগ্য তার, যে পরিবারে অম্বা-র জন্ম হয়েছিল, সমাজের চোখে সেটা নীচু জাত, তাদের গান গাওয়ারই অধিকার নেই, স্টেজে পরিবেশন তো দূরের কথা। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন তাই অম্বাবাঈ, আর সাধনা করে যান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। হয়ত এমন দিন আসবে, যখন এই নিষ্ঠুর জাতপাতপ্রথা দূর হয়ে যাবে। তার নিজের জীবিতকালে না হলেও, হয়ত পরবর্তী প্রজন্মে।

মার্চের পাঁচ তারিখে তার কোল আলো করে এল এক কন্যাসন্তান। চিক্কুরাও তার নাম রাখলেন গাঙ্গুবাঈ। 

বিজ্ঞানের দুনিয়াতেও নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটে যাচ্ছিল। ঊনিশশো তেরোতে নিল্‌স্‌ বোর প্রকাশ করলেন তার কোয়ান্টাম মডেল। মিলিক্যান মেপে দেখালেন ইলেকট্রনের চার্জ। পিতাপুত্র দুই ব্রাগ মিলে বের করলেন এক্স-রের জোরালো প্রতিফলন পাওয়ার শর্তাবলী। জে জে টমসন মাস স্পেক্ট্রোমেট্রি বলে এক প্রকৌশলের সন্ধান দিলেন, যা দিয়ে আয়নিত পদার্থকে পৃথক করে তাদের সম্বন্ধে বিশদ জানা সম্ভব হয়। আর বিজ্ঞানের জগতের রাজপুত্র অ্যালবার্ট আইনষ্টাইন শুরু করলেন আপেকিক্ষতাবাদের ওপর তার নতুন কাজকর্ম, প্রচলিত তত্ত্ব থেকে এটা আলাদা বোঝাতে এর নাম দিলেন স্পেশ্যাল থিওরী অফ রিলেটিভিটি। 

যদি মনে হয় এসব বেশ বোরিং তাত্ত্বিক ব্যাপার, তবে প্রযুক্তির দিকে চোখ মেলা যাক। সেই বছরের শেষের দিকে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সী নিউ ইয়র্কের এক তরুণী মেরী ফেল্প্‌স্‌ জেকব মহিলাদের প্রথম আধুনিক বক্ষবন্ধনী ডিজাইন করে তার পেটেন্ট নেন। এর আগে ফ্যাশনদুরস্ত মহিলাদের ঊর্ধাঙ্গে অন্তর্বাস হিসাবে ব্যবহৃত পোষাক ছিল কর্সেট, তা শুরু করেছিলেন ফরাসী রাজা দ্বিতীয় হেনরির পত্নী রাণী ক্যাথেরিন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের সরু কোমর বীভৎসভাবে আঁটসাঁট করে রাখা। তাতে ব্যবহৃত হত তিমিমাছের কাঁটা অথবা ধাতব সরু রড, মাঝে মাঝেই সেগুলো হয় শরীরে ফুটে যেত, বা পোশাক ভেদ করে দৃষ্টিকটু হয়ে শজারুর মত খাড়া হয়ে থাকত। দীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছর ধরে ফ্যাশনের নামে মেয়েরা সহ্য করে এসেছে যে যন্ত্রণা, মেরীর এই আবিস্কার তা থেকে তাদের মুক্ত করে। দিনে দিনে এর চাহিদা বাড়তে থাকলেও মেরী এই ব্যবসা চালাতে পারেনি। মাত্র পনেরশো ডলারে সে তার পেটেন্ট বিক্রী করে দেয় ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নামে এক কোম্পানীকে (এরা সিনেমা বানানোর ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নয়)। পরবর্তী তিরিশ বছরে তারা দেড় কোটি ডলারের বাণিজ্য করে শুধু এই বক্ষবন্ধনীরই। ১৯১৭ সালে পুরনো কর্সেট ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বছরে প্রায় আঠাশ হাজার টন ষ্টীল অন্য কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পায়। 

রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত ঘোরালো এই সময় সমগ্র বিশ্বে। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতিকে আলাদা করতে ঊনিশশো পাঁচে বাংলাকে কেটে দুভাগ করার জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে তীব্র বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূচনা হয়, ঊনিশশো এগারোতে তার ফলে দ্বিখণ্ডিত বাংলা আবার জোড়া লেগে যায়। সমস্যা হল, আলাদা হওয়ার জন্য যারা কিছু অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গে, তারা এই জোড়া দেওয়াটা মেনে নিতে পারছিলেন না। এ নিয়ে সমস্যা লেগেই ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরাজের এ নিয়ে তখন নাক গলানোর তেমন সময় নেই। কেননা তাদের নিজের ঘরের সামনে ততদিনে বিশাল আগুন লেগে গেছে। 

ইওরোপের বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েক দশক ধরে অশান্তি লেগেই আছে। বুলগেরিয়া-গ্রীস-মন্টেনিগ্রো আর সার্বিয়া, যারা তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনতামুক্ত হয়ে তৈরী করেছে বলকান জোট, তারা অটোমানদের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা লাগিয়েই চলছিল। গত বছরেই পুরোপুরি যুদ্ধ লেগে গেছে, ছাব্বিশে মার্চ বুলগেরিয়া ছিনিয়ে নিল আড্রিয়ানোপল। অটোমানদের অবস্থা যায় যায়, তিরিশে মে লণ্ডন চুক্তি স্বাক্ষর করে তাদের অনেক জমিজিরেত বলকানদের উপঢৌকন দিয়ে সেই যুদ্ধ শেষ হল। অবশ্যই এতে মদত জোগাল পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী রাজ্যগুলি যাদের মধ্যে ব্রিটেন এক নম্বরে। সঙ্গে জার্মানী, রাশিয়া, অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইটালি। কিন্তু শেষ হলে কী হয়, বলকানরাও চারটে দেশ। অটোমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জমির বিলিবন্দোবস্ত পছন্দ হল না বুলগেরিয়ার। সার্বিয়া আর গ্রীস নিজেদের মধ্যে ম্যাসেডোনিয়ার ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছিল। ক্ষেপে গিয়ে দু সপ্তাহের মধ্যেই বুলগেরিয়া আক্রমণ করে বসল মাত্র কিছুদিন আগেই যারা তার মিত্র জোটের সদস্য ছিল, সেই সার্বিয়া আর গ্রীসকে। তারাও পালটা হানা দিল বুলগেরিয়ায়, সঙ্গে জুটে গেল রোমানিয়া। ফলে বুলগেরিয়া অটোমানদের কাছ থেকে অল্প যা কিছু পেয়েছিল, তার প্রায় সবটাই হারালো। অগাষ্টের দশ তারিখে বুখারেষ্ট চুক্তিতে সেই যুদ্ধ শেষ হল। ম্যাসেডোনিয়া পেয়ে গেল সার্বিয়া আর গ্রীস, উত্তর ইপিরাস চলে গেল আলবেনিয়ার ভাগে, দক্ষিণ ডব্রুজা কেড়ে নিল রোমানিয়াও।

এই সব অশান্তি আর তার প্রত্যক্ষ মদত সূচনা করল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রঙ্গমঞ্চ।

ভারতের রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক মোহনদাস গান্ধী সে বছর দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে আনপড় শ্রমিকশ্রেণীর ভারতীয়দের ওপর দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের বঞ্চনার ইতিহাস অনেক পুরনো। তাদের ওপর ধার্য হয় অহেতুক কর, ভারতীয় মতে অনুষ্ঠিত বিবাহ তাদের দেশে গ্রহণযোগ্য নয়, ইংরাজীতে নাম সই না করতে পারলে সে দেশে ঢোকাও অসম্ভব। এর বিরুদ্ধে গান্ধী শুরু করলেন পদযাত্রা, চার্লসটাউন শহর থেকে। সঙ্গে ২০৩৭টি পুরুষ, ১২৭ জন মহিলা এবং ৫৭টি শিশু। সকাল ছটায় শুরু হওয়া পদযাত্রা পুলিশের কর্ডন অতিক্রম করে ফোক্সরাষ্ট বর্ডার পেরিয়ে গেল। সন্ধ্যে সাড়ে আটটায় গান্ধী গ্রেফতার হলেন পামফোর্ড রেলষ্টেশনের কাছে। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ পুলিশের এই নীতির নিন্দা করায় গান্ধী ও দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এক টেবলে আলোচনায় বসতে পারে। গান্ধীর সত্যাগ্রহে অনেক দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয় সরকার।

প্রচণ্ড পরিশ্রমী গান্ধী, তাঁর পায়ের নীচে সর্ষে। তাঁকে যিনি মহাত্মা বলে অভিহিত করেছেন, তাঁর পরিশ্রমও নেহাৎ কম নয়। সারাটা বছর এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরেই কেটে গেল রবীন্দ্রনাথের। এদিক ওদিক মানে আমেরিকা আর ইংল্যাণ্ডে। এর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল বছর দুই আগে। ইংল্যাণ্ড থেকে চিত্রশিল্পী রথেনষ্টাইন আর জার্মানী থেকে দার্শনিক কাউন্ট হারম্যান কিসেরলিং এসেছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে, তাদের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয় কবির। ব্রাহ্মসমাজের বার্ষিক অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ কর্মযোগ শীর্ষক ভাষণ দিলেন। শান্তিনিকেতনে কবি ও আর একজন শিক্ষকের সহযোগিতায় আনন্দ কুমারস্বামী রবীন্দ্রনাথের শিশু কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতার ইংরাজী তর্জমা করলেন, সেগুলো ছাপা হল মডার্ন রিভিউ পত্রিকায়। পঞ্চাশ বছর বয়স হল তাঁর, মহা ধুমধাম করে সেই রৌপ্যজয়ন্তী পালন করা হল, কলকাতা থেকে তাতে যোগ দিতে এসেছিল অনেকেই, তার মধ্যে তাঁর অন্যতম ভক্ত রায়বাড়ির ছেলে সুকুমার। তাঁর লেখা রাজা নাটক মঞ্চস্থ করা হল, তিনি নিজে সাজলেন ঠাকুর্দা। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর ঘাড়ে, লিখলেন অচলায়তন নাটক। এই সময় তাঁর বেশ অর্থকষ্টে গেছে। প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর আত্মজীবনী, জীবনস্মৃতি। শান্তিনিকেতনে শারদোৎসবে তিনি সাজলেন সন্ন্যাসী, লিখলেন ডাকঘর নাটক আর ভারতী আর প্রবাসী পত্রিকার জন্যে অনেকগুলো ছোটগল্প। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তাঁর লেখা ও সুর দেওয়া গান জনগণমন-অধিনায়ক প্রথম গাওয়া হল এই সময়।

পরের বছরের অর্থাৎ ১৯১২র শুরুতেই বাংলার প্রায় দুশোজন বুদ্ধিজীবী কলকাতায় তাঁকে সম্বর্ধনা দিলেন, মডার্ণ রিভিউতে তা একজন ভারতীয় সাহিত্যিকের প্রতি অভূতপূর্ব সম্মানপ্রদর্শন বলে বর্ণিত হল। সাধারণ ব্রহ্মসমাজের সভায় তিনি আত্মপরিচয় বলে একটা প্রবন্ধ পাঠ করলেন। বাংলা ও অসমের সরকারী আমলারা শান্তিনিকেতনকে তাদের পরিবারের সন্তানদের পড়াশুনার অযোগ্য ঘোষণা করলেও মাইরন ফেল্প্‌স্‌ নামে এক আমেরিকান আইনজীবী শান্তিনিকেতন সফর করে এর ন্যায়নীতিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করে প্রবন্ধ লেখেন। ভারতীয় ইতিহাসের মূল্যায়নের ওপর রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার ইংরাজী তর্জমা করে যদুনাথ সরকার মডার্ণ রিভিউতে প্রকাশ করেন। তা উচ্চপ্রশংসিত হওয়ায় তাঁর বন্ধুবান্ধব তাঁকে ইংল্যাণ্ড ভ্রমণের পরামর্শ দেন। জোরজার করে টিকিট কাটা হয়ে গেলেও কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর বিদেশযাত্রা পিছিয়ে যায়। 

ইংল্যাণ্ড যাত্রা ঠিক হয়ে আছে, ওদেশে শোনাতে হবে তাঁর নিজের লেখা, ওদের ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানগুলির ইংরাজী অনুবাদ শুরু করলেন। এ কাজটা তাঁর খুব পছন্দের নয়, কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কী? ইংল্যাণ্ডে যাওয়ার পূর্বে লেখেন যাত্রার পূর্বপত্র, তাতে বর্ণনা করেন তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্য শান্তিনিকেতনে তাঁর শিক্ষাসংক্রান্ত কাজের সঙ্গে পশ্চিমী মহলকে অবহিত করা। যাত্রাপথেও তাঁর কবিতার অনুবাদ করতে থাকেন ইংরাজীতে। লণ্ডনে পৌঁছে সেগুলির পাণ্ডুলিপি তিনি দেন রথেনষ্টাইনকে। রথেনষ্টাইন সেগুলি টাইপ করে পড়তে দিলেন উইলিয়াম ইয়েট্‌স্‌, স্টপফোর্ড ব্রুক আর অ্যান্ড্রু ব্র্যাডলিকে। সকলেই মুগ্ধ হয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ কেমব্রিজে গিয়ে দেখা করলেন বারট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে। রথেনষ্টাইন কবির কিছু কবিতাপাঠের আসরের আয়োজন করলেন, সেগুলো সব দারুণভাবে প্রশংসিত হল। জর্জ ক্যালডেরন তাঁর ছোটগল্প ডালিয়ার নাট্যরূপ দিলেন মহারাণী অফ আরাকান নাম দিয়ে, সেটা রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে অভিনীত হল। কবি দেখা করলেন বার্ণার্ড শ', এইচ জি ওয়েলস ও আরো অন্যান্য পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথে। রাজা আর ডাকঘর নাটকেরও ইংরাজী অনুবাদ হল। ১৯১২র ২৮শে অক্টোবর তিনি ইংল্যাণ্ড থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ইলিনয়ের আর্বানা শহরে আধ্যাত্মিকতার ওপরে একগুচ্ছ প্রবন্ধপাঠ করেন, যা পরে সাধনা নামে প্রকাশিত হয়। 

ইংরেজ কবি ইয়েট্‌সের উদ্যোগে গীতাঞ্জলির বেশ কিছু কবিতার ইংরাজি অনুবাদ সং অফারিংস নামে প্রকাশিত হল ইংল্যাণ্ডে, ইয়েট্‌স্‌ নিজেই তার ভূমিকা লিখে দিলেন, সেই বই ইংরেজ শিক্ষিত সমাজে অসম্ভব প্রশংসা লাভ করল। শিকাগোর পোয়েট্রি পত্রিকায় গীতাঞ্জলির ছখানা কবিতার ইংরাজী তর্জমা ছাপা হল। কবির বন্ধু অ্যান্ড্রুজ দেশে ফিরে কবির কথা ফলাও করে লিখলেন লাহোরের সিভিল অ্যাণ্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায়। 

১৯১৩ সালের প্রথম দিকে আমেরিকাতে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কবি প্রাচীন ভারতীয় নীতির ওপর বক্তৃতা করলেন। শিকাগোতেই ইউনিটারিয়ান হলে বক্তৃতা করলেন ইভিল বা মন্দের সমস্যা নিয়ে। উদার ধর্মীয় গোষ্ঠী কংগ্রেসের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে জাতিবৈষম্যের ওপর বক্তৃতা করলেন রচেষ্টারে। তারপর গেলেন বষ্টনে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমার্সন হলে একগুচ্ছ প্রবন্ধপাঠ করলেন। গেলেন নিউ ইয়র্কে। সেখান থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি আমেরিকা থেকে ফিরে আবার গেলেন লণ্ডন। লণ্ডনের ম্যাকমিলান অ্যাণ্ড কোম্পানী প্রকাশ করল গীতাঞ্জলীর এক পপুলার সংস্করণ। দ্য গার্ডেনার, দ্য ক্রেসেন্ট মুন আর চিত্রাও প্রকাশ করল ম্যাকমিলান। আইরিশ থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল তাঁর নাটক দ্য পোষ্ট অফিস। ক্যাক্সটন হলেও তিনি দিলেন একগুচ্ছ বক্তৃতা। 

কম কাজ? বয়স তো কমছে না, কত আর দৌড়াদৌড়ি করবেন?

রবীন্দ্রনাথের তরুণ ভক্তদের অন্যতম, যাকে আমরা হাস্যরসের সম্রাট হিসাবে পরে জানতে পেরেছি, সেই সুকুমার রায় তখন ইংল্যাণ্ডে। রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি নাটকের অনুসরণে পিতা উপেন্দ্রকিশোর তার ডাকনাম রেখেছেন তাতা, দিদি সুখলতার ডাকনাম হাসি। রবীন্দ্রসাহিত্যে অনুপ্রাণিত এই যুবক ইংল্যাণ্ডের ইষ্ট অ্যাণ্ড ওয়েষ্ট সোসাইটির এক অধিবেশনে এক বক্তৃতা দিলেন, তার শীর্ষক হল 'দ্য স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ'। বক্তৃতার শুরুতে তিনি শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিলেন এইভাবে – In the midst of all our work and all our pleasures, we are often unconscious that we are ever carrying with us the burden of an eternal question. Very few of us indeed have anything more than a vague consciousness of its existence and most of us are satisfied with an occasional mild intellectual interest in the problem. But in some lives – and these lives are only truly great – the question has assumed an imperative form; and wherever the demand for an answer has been thus insistent, we have had one of those contributions to human thought that leave a definite impression on the ever-changing ideals of humanity.

রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্বন্ধে তিনি বললেন - Where poetry is coextensive with life itself, where art ceases to be the mere expression of an imaginative impulse, it is futile to attempt a comprehensive analysis. Rabindranath's poetry is an echo of the infinite variety of life, of the triumph of love, of the supreme unity of existence, of the joy that abides at the heart of all things. The whole development of his poetry is a sustained glorification of love. His philosophy of love is an interpretation of the mystery of existence itself. 

সেপ্টেম্বরে জাহাজে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরলেন, সহযাত্রী ছিলেন সুকুমার। কিছুদিন আগেই উপেন্দ্রকিশোর সন্দেশ নামে একটা শিশুদের পত্রিকা শুরু করেছেন, তিনি চান সুকুমার দেশে ফিরে তার ভার নিক। ভারতবর্ষে মুদ্রণশিল্পে চাঞ্চল্যকর অভিনবত্ব এনেছেন উপেন্দ্র, হাফটোন মুদ্রণে তিনি সৃষ্টি করেছেন নতুন প্রযুক্তি, তাঁর প্রবন্ধ ছাপা হয় লণ্ডনের নামী পত্রিকায়। এই শাস্ত্র শিক্ষা করতেই সুকুমারের ইংল্যাণ্ডে আসা, তিনি ইতিমধ্যেই পদার্থ ও রসায়নে যুগ্ম স্নাতক। সাহিত্য রচনার ব্যাপারে অবশ্য তার এখনো কিছু উৎসাহ দেখা যায়নি। 

পুরনো লেখার অনুবাদ আর বক্তৃতা করেই চলে যাচ্ছে বছর, নতুন লেখার সময়ই হচ্ছে না, রবীন্দ্রনাথ স্বস্তি পান না। ইংল্যাণ্ড ছাড়ার আগে ২৪শে অগাষ্ট – সেদিন রবিবার – সারাদিন বসে লিখে ফেললেন কয়েকটি নতুন গান। মনে বাজছে রাগাশ্রয়ী সুর। লিখলেন ইমনকল্যাণের সুরে এ মণিহার আমায় নাহি সাজে, খাম্বাজে অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে, খাম্বাজেই বাউল-অঙ্গে তোমারি নাম বলব নানা ছলে। পরদিন জন্মাষ্টমী। সেদিন লিখলেন আশাবরী-ভৈরবীতে ভোরের বেলা কখন এসে পরশ করে গেছে হেসে, ভৈরবী-রামকেলীতে প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে। তার দুদিন পরে দেশ রাগে জীবন যখন ছিল ফুলের মত। ফেরার পথে জাহাজে বসেও কয়েকটি কবিতা ও গান রচনা করলেন। বাজাও আমারে বাজাও, ভেলার মত বুকে টানি কলমখানি মন যে ভেসে চলে, রামকেলীতে কীর্তন-অঙ্গে জানি গো দিন যাবে এ দিন যাবে, ইমন রাগে বাউল-অঙ্গে নয় এ মধুর খেলা তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল সন্ধ্যাবেলা। 

দেশে ফিরেই সোজা চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। বহুদিন দেশছাড়া, হাতে এখন অনেক কাজ। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো কি মুখের কথা? তিনি না থাকলেই অনেক কাজ পড়ে থাকে, সব কিছুর ব্যাপারেই তাঁর মতামত চাওয়া হয়। মত দিতে অসুবিধে নেই, কিন্তু তাইজন্যে কাজ পড়ে থাকবে? গীতার কর্মযোগ এদের শেখাতেই হবে। শান্তিনিকেতনে বসে তার কলম চলতে লাগল। দুর্গাপুজো পেরিয়ে গিয়ে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর শারদ পূর্ণিমায় ইমন রাগে বাউলাঙ্গের সুরে লিখলেন নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে, কয়েকদিন পর পরজ রাগে আমার যে কাছে আসে, যে যায় চলে দূরে, বাউল অঙ্গের আরেকটি গান তুই কেবল থাকিস সরে সরে। লেখালিখির পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের পড়ে থাকা কাজ জোরকদমে শুরু করে দিলেন। 

তেরোই নভেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ অধিবেশনে কবিকে সাম্মানিক ডি লিট উপাধি দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হল। তার দুদিন পর, সেদিন বৃশ্চিক সংক্রান্তি, আগের দিন পূর্ণিমা ছিল, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পরের পূর্ণিমা, কবি বসে আছেন শান্তিনিকেতনে তাঁর নিজস্ব কক্ষে। কে এসে খবর দিল পিওন এসেছে তাঁর নামে এক টেলিগ্রাম নিয়ে। প্রতিদিন গোছা গোছা চিঠি আসে কবির নামে, কিন্তু টেলিগ্রাম শুনলেই এখনও মন অস্থির হয়ে যায়। আবার কি কোন অশুভ খবর? স্ত্রী, কন্যা রাণী, কনিষ্ঠ পুত্র শমীর অকালে মৃত্যু হয়েছে। আর কত সহ্য করবেন তিনি?

বাইরে এসে সই করে টেলিগ্রাম নিলেন তিনি। মুহূর্তেই তাঁর মুখের অভিব্যক্তি পালটে গেল। এ যে অভাবনীয়। টেলিগ্রামে আগের দিন অর্থাৎ চোদ্দই নভেম্বরের তারিখ। দুই লাইনের টেলিগ্রামে লেখা – সুইডিশ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডেড ইউ নোবেল প্রাইজ লিটারেচার প্লীজ অয়্যার অ্যাক্সেপ্টেশন সুইডিশ মিনিষ্টার। 

এশিয়া মহাদেশে প্রথম কেউ এই সম্মানে সম্মানিত হতে চলেছে, তাও পরাধীন জাতির একজন হিসাবে। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথের মন তোলপাড় হতে লাগল। এ কি সত্যি! ধীর পায়ে উঠে গেলেন তিনি নিজের ঘরে। এক অদ্ভুত আনন্দে তাঁর প্রাণমন উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে, কার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন এই আনন্দ? আশেপাশে লোকের অভাব নেই, কিন্তু হঠাৎ যেন নিজেকে একা বোধ করতে লাগলেন। দেয়ালে একের পর এক সারি সারি তৈলচিত্র। দাদামশাই, বাবামশাই, যুবতী মায়ের ছবি, মৃণালিনী। এঁদের সবাইকে ফেলে তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর বাল্যের খেলার সাথীর ছবির সামনে। দু চোখ বোঁজা, মনে মনে বললেন, দেখো, নতুন বৌঠান, এরা আজ আমাকে কত বড় সম্মানটা দিচ্ছে। তোমার জন্যেই তো এত কিছু। তবে কিসের অভিমানে তুমি সব ছেড়ে চলে গেলে? কেন আজ আমার এই আনন্দের দিনে তুমি নেই?

বাহান্ন বছর ধরে পৃথিবীর অনেক রূপ-রস দেখেছে তাঁর চোখ, সয়েছে অনেক অপ্রত্যাশিত দুঃসহ বেদনা। আজ এই আনন্দের দিনে সেই চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল অঝোরে। 

(ক্রমশঃ)

[কৈফিয়ৎ - যা শুরু করি, অনেক সময় তাতে সাময়িক বিরতি দিতে হয়। গীতার অনুবাদ শুরু করেছিলাম ছড়ায়, একশো শ্লোকের অনুবাদের পর সেটা থেমে আছে। 'আপনাকে এই জানা আমার' বলে আত্মজীবনীমূলক সুলুক-সন্ধান, সেটাও গোটা আটেক এপিসোডের পর আটকে গেল। আর এই 'অনন্ত জীবন' শুরু করেই মুখ থুবড়ে পড়ল। 

পড়ুক। যে কাজটা যখন করা উচিৎ, তার আগে বা পরে করলে অনেক সময় তা অর্থহীন হয়ে যায়। যে সব মনীষীদের চরণস্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়নি বলে স্রষ্টাকে ধমকাই, তাঁদের কিছু কথা যথাযথ সময়ে শোনানোর সুযোগ পাওয়াও তো কম ভাগ্যের নয়। যে মানুষটা জন্মেছিলেন বলে আজ আমি ও আমার মত আর পাঁচজন রসায়নের ছাত্র 'করে খাচ্ছি', সেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সার্ধশতবার্ষিকী চলে গেল সামনে দিয়ে, অঞ্জলি দেওয়া হয় নি। এই রকম ভুল বার বার না হয়, সে জন্যেই এ লেখাটার শুরু...]
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন