রামগ্রামের নাম কখনও শুনিনি, তাই সেখানে যে একটা বৌদ্ধ স্তূপ আছে, এবং বিশ্বের সব স্তূপের মধ্যে তা বিশিষ্ট, তা জানার কোনও স্কোপ ছিল না। বেড়াতে গিয়ে যা শুনলাম, তাতে রীতিমতো একটা ওটিটি সিরিয়াল হয়ে যায়। যাকে বলে, পিরিয়ড পিস। মহাপরিনির্বাণ সূত্রে গল্পের মূলটা রয়েছে।
ব্যাপার হল, গৌতম বুদ্ধ তো কুশীনগরে দেহ রাখলেন। বছরটা খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩, সেখানে তখন মল্ল বংশের এক রাজার রাজত্ব। তিনি বুদ্ধের ভস্মাধার এবং অন্যান্য যা কিছু স্মরণিকা, সেই সব কিছু একটি বৃহৎ জন-প্রকোষ্ঠে ('কাউন্সিল হল') কঠোর পাহারার মধ্যে রাখলেন। সেখানে ফুল, ধূপ, গান ইত্যাদি সহকারে শ্রদ্ধা নিবেদন চলতে থাকল। কিন্তু আশেপাশের রাজারা এক যোগে বুদ্ধের সেই সব স্মারকের ভাগ দাবি করলেন। তাদের মধ্যে কপিলাবস্তুর শাক্য রাজা, পভার মল্ল রাজা, বেথদীপের ব্রাহ্মণ রাজা, বৈশালীর লিচ্ছবি, মগধের মৌর্য, পিপলিবনের মৌর্য এবং রামগ্রামের কোলিয়া (বা কল্য) রাজারা। গোড়ায় কুশীনগরের মল্ল রাজা বেঁকে বসেছিলেন, কিন্তু অন্য রাজারা বুঝিয়ে দিলেন, দরকার হলে তাঁরা যুদ্ধ করবেন। শেষে কুশীনগরের এক ব্রাহ্মণ, তার নাম দ্রোণ বা দোন রাজাকে বোঝালেন, যে বুদ্ধ সারা জীবন করুণা আর অহিংসার বাণী প্রচার করলেন, তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে রক্তারক্তি কি ভাল দেখায়? শেষমেষ সেই সব স্মারক আট ভাগ হল (অথবা দশ ভাগ, নানা মত পাচ্ছি)।
কোলিয়া রাজা বুদ্ধের স্মারক পেয়ে মহাসমারোহে শোভাযাত্রা করে তাঁর রাজধানী রামগ্রামে এনে রাখলেন, এবং তার উপর মহাস্তূপ রচনা করলেন। এই কোলিয়া রাজারা ছিলেন গৌতম বুদ্ধের মাতুলকুল — এঁদেরই কন্যা মায়াদেবী এবং প্রজাপতি গোতমী (দুই বোনকেই বিয়ে করেছিলেন শুদ্ধোধন, বুদ্ধের জন্মের পরে মায়াদেবী মারা যান, গোতমী তাঁকে মায়ের মতোই বড় করেন, তাঁর নিজের দুই ছেলেমেয়েও ছিল)। বুদ্ধের স্ত্রী যশোধরাও কোলিয়া বংশের মেয়ে।
সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর স্থির করলেন, তাঁর গোটা রাজ্যে চুরাশি হাজার স্তূপ তৈরি হবে। তাই তিনি আদি স্তূপগুলি খুলে, তার ভিতরে রক্ষিত স্মারকগুলির অধিকাংশই বার করে নেন। কেবল রামগ্রামের স্তূপটি তিনি খুলতে পারেননি। কেন, তা নিয়ে যথারীতি কাহিনি তৈরি হয়েছে। যেমন, অশোক সেখানে এসে দেখেন, এক মহানাগ সেই স্তূপ রক্ষা করছে। অথবা, হাতির দল সেখানে শুঁড়ে করে জল দিচ্ছে, ফুল দিচ্ছে। এমন কোনও অলৌকিক দৃশ্য দেখে অশোক নিরস্ত হয়েছিলেন। কিংবা হয়তো বুদ্ধের মামাবাড়ির লোকেরা অশোকের 'মামাবাড়ির আবদার' পাত্তা দিতে চাননি, রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কী হয়েছিল, কে বলতে পারে। শরদিন্দু থাকলে এ নিয়ে একটা আস্ত উপন্যাস লিখতে পারতেন। সেখানে হয়তো রামগ্রামের কোনও দৃপ্ত ভিক্ষুণী দিগ্বিজয়ী সম্রাটকে নতমস্তকে প্রণিপাত করে বিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য করতেন।
সে যা-ই হোক, হিস্টরিক্যাল ফ্যাক্ট (কিংবা কনসেনসাস অন ফ্যাক্ট) হল এই যে, রামগ্রামই বিশ্বের একমাত্র আদি স্তূপ, যা আড়াই হাজার বছর ধরে অক্ষত রয়েছে।
তা বলে কি কালের ছায়া পড়েনি তার উপরেও? কয়েকশো বছর লোকে ভুলে গিয়েছিল, কী এই জায়গা, কী এর মাহাত্ম্য। স্থানীয় চাষিরা এই ভূখণ্ডকে বলতেন দুর্ভাগা জমি, কারণ এখানে ফসল লাগালে তা বড় হয় না। হবে কী করে, স্তূপকে ঘিরে মাটির তলায় ঘন ইটের গাঁথনিতে তৈরি সঙ্ঘারাম রয়েছে, তা কি আর তখন জানা গিয়েছিল? ১৮৯৯ সালে এক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্তিক ডব্লিই হোয়ি (W Hoey) এটিকে আবিষ্কার করেন।
লুম্বিনী থেকে চুয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে রামগ্রামের এই স্তূপ রয়েছে মাটির তলায়, সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে ঢাকা তার উপরিভাগ। তবে সত্যি বলতে কী, কারুকার্যময়, সোনালী চূড়ায় শোভিত , বিচিত্র স্থাপত্যে সাজানো স্তূপ তো নেপালে বা ভারতে কম নেই। তার চাইতে এই সবুজ ঘাসে ঢাকা, এক বৃহৎ অশ্বত্থের ছায়ায় শীতল, অতি শান্ত পরিবেশে শুয়ে থাকা স্তূপটি যেন অনেক বেশি স্পর্শ করে মনকে। এমন কোমল কিন্তু অবিচল স্থানে এসেই তো রাজশক্তি লজ্জা পায়, হেরে গিয়ে ফিরে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন