রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০

আয়ুর্বেদ ও শল্যচিকিৎসা ~ ডঃ কৌশিক দত্ত

আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। আয়ুর্বেদের ভাবনা ও পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসার বেশ কিছু মিল আছে, আবার কিছু মৌলিক পার্থক্যও আছে, যার মধ্যে আছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পার্থক্য। আমি মনে করি, আয়ুর্বেদ বিষয়ে উপযুক্ত চর্চা হওয়া উচিত, পড়াশোনা আর গবেষণার সমন্বয়ে। বিশেষত যখন আধুনিক চিকিৎসা বহুজাতিক ব্যবসায়ীদের লোভের কবলে পড়ে ক্রমশ দুর্মূল্য হয়ে উঠছে, তখন আয়ুর্বেদকে নিয়ে গভীর বৈজ্ঞানিক চর্চার মাধ্যমে এর আধুনিকীকরণ ঘটিয়ে একে আরও বেশি কার্যকর এবং মানব-বান্ধব চিকিৎসার উপায়ে পরিণত করার চেষ্টা অন্তত করা উচিত। তা করতে হলে প্রথমেই ভেষজ আর গোমূত্র নিয়ে যারা ব্যবসা করে মানুষের কুসংস্কারকে মূলধন করে, বা যারা জ্যোতিষকে আয়ুর্বেদ বলে চালাতে চেষ্টা করে অথবা আয়ুর্বেদকে দৈব/ অলৌকিক বলে ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে আসলে আয়ুর্বেদকেই অপমান করে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতায়ন করা উচিত আয়ুর্বেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক গবেষকদের। আয়ুর্বেদ কোনো অলৌকিক বা বিশ্বাস-নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি নয়, প্রাচীন ভারতের নিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক চর্চার ফসল। দুর্ভাগ্যক্রমে মধ্যযুগে এর অগ্রগতি রুদ্ধ হয়েছিল এবং ইউরোপীয়রা যেভাবে মহান গ্যালেনের ঘোর কাটিয়ে পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে শিল্পবিপ্লবোত্তর সময়ে, আমরা চরক-সুশ্রূতর প্রতি সেই সুবিচার করতে পারিনি। এবার চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু তা কি হচ্ছে? 

আপাতদৃষ্টিতে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। স্বভাবতই আয়ুর্বেদের প্রতিও তাঁদের শ্রদ্ধা থাকার কথা। শ্রদ্ধাবান সন্তান পিতার সম্পদ ফুটানি মেরে উড়িয়ে দেবার বদলে জ্ঞানার্জন করে এবং পূর্বজদের সম্মান বাড়ানোর চেষ্টা করে। তেমন কি হচ্ছে? নাকি গোদুগ্ধের সোনা, গোমূত্রের অমৃত আর গোময়ের মাইক্রোচিপের পথেই আয়ুর্বেদের সমাধি নির্মাণে তাঁরা উদ্যোগী? দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, আয়ুর্বেদকে প্রকৃত জাতীয় সম্পদে পরিণত করার বদলে সস্তা রাজনৈতিক লাভের খেলাতেই তাকে ব্যবহার করার উদ্যোগ বেশি। শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাহীন দুএকজন রাজনীতির কারবারি যে-ধরনের কথা বললে বা আচরণ করলে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায়, তেমন কাজ ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন করলে ততটা লঘুভাবে নেওয়া যায় না। 

সম্প্রতি এনএমসি একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, যাতে কিছু আধুনিক শল্যচিকিৎসার সংস্কৃত নামকরণের দ্বারা তাদের আয়ুর্বেদিক অস্ত্রোপচার হিসেবে চিহ্নিত করে, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের দ্বারা সেই সব অস্ত্রোপচার করানোর সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। অচিরেই সরকারি হাসপাতালে এসব অস্ত্রোপচার সম্ভবত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা করবেন আর "পাশ করা সার্জেন"-এর হাতে অপারেশন করাতে চাইলে আপনাকে গাঁটের কড়ি খরচা করে ছুটতে হবে বেসরকারি হাসপাতালে। 

উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিলে কি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা এসব অস্ত্রোপচার করতে পারেন না? নিশ্চয় পারবেন। প্রশ্ন হল, কোন পদ্ধতিতে তাঁরা অস্ত্রোপচার করবেন? আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে, নাকি আধুনিক শল্যচিকিৎসার পদ্ধতিতে? এই জায়গায় এসে "আয়ুর্বেদিক শল্যচিকিৎসা" ব্যাপারটা নিয়েই অনেকে হাসবেন, বিশেষত যাঁরা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল নন। হাসবেন না। প্রাচীন পৃথিবীতে ইংল্যান্ড অঞ্চলের অধিবাসীদের যখন ল্যাজ খসেনি, তখন মিশরে এবং প্রাচ্যে শল্যচিকিৎসার সূচনা হয়েছিল। ভারত বেশ কিছু ধরনের শল্যচিকিৎসার চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল বলেই সুশ্রুতর মতো মহান শল্যচিকিৎসক এদেশে তৈরি হতে পেরেছিলেন। প্রশ্ন হল, তারপর থেকে তাঁদের পদ্ধতিকে আমরা কতটা এগিয়ে নিয়ে গেছি? কোন পদ্ধতিতে আজকের এই আয়ুর্বেদিক অস্ত্রোপচারগুলো হবে? যদি প্রাচীন পদ্ধতিতে হয়, তবে তা স্পষ্ট জানানো হোক এবং মানুষকে বেছে নিতে দেওয়া হোক শল্যচিকিৎসার এত উন্নতির ফসল ছেড়ে দিয়ে তাঁরা প্রাচীন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করাতে চাইতেন কিনা। (সুশ্রুত বেঁচে থাকলে আধুনিকতম পদ্ধতিটিই শিখতেন বা নিজে উদ্ভাবন করতেন, আমি নিশ্চিত।) যদি এঁরা আধুনিক শল্যচিকিৎসার পদ্ধতিতেই কাজ করেন, তবে তার জন্য কী ধরনের প্রশিক্ষণ তাঁদের দেওয়া হয়েছে? সমগ্র এমবিবিএস এবং এমএস শিক্ষাক্রমের যাবতীয় শিক্ষণীয় বিষয়, যা শল্যচিকিৎসায় নানাভাবে কাজে লাগে (অবশ্যই কাজে লাগে, কারণ শুধু কাটতে আর জুড়তে জানলেই সার্জন হওয়া যায় না), তা কি তাঁদের শেখানো হয়েছে? যদি শেখানো হয়ে থাকে, তবে কি আর তাঁরা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক রইলেন? যদি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের এই কৌশলে আধুনিক চিকিৎসার সহযোগী চিকিৎসকে পরিণত করা হয়, তবে কি তা আয়ুর্বেদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে না? এমন চলতে থাকলে আয়ুর্বেদ চর্চার প্রকৃত উন্নয়ন ঘটবে কীভাবে? 

ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশনের এই কার্যক্রম আদৌ সুবিধের লাগছে না। আধুনিক চিকিৎসা এবং আয়ুর্বেদ চিকিৎসার উন্নয়ন করা দরকার পাশাপাশি, দুটো স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে। একমাত্র তাহলেই একটা পদ্ধতি আরেকটির পরিপূরক হয়ে উঠতে পারবে এবং আয়ুর্বেদ আমাদের জাতীয় ঐশ্বর্যে পরিণত হবে। ঐতিহ্যকে ঐশ্বর্যে পরিণত করতে আরও সৎ উদ্যোগ প্রয়োজন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন