শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯

ইস্কনকে ৭০০ একর জমি ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

এটা করবেন না, প্লিজ। একটা ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে এটা করবেন না। এটা করা যায় না। এখনো আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা আছে, ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।

নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে এটা করবেন না। 
এখনো এই দেশের অধিকাংশ মানুষ বুঝে, না বুঝে মেনে চলেন সোয়া দুই হাজার বছর আগের অশোকের শিলালিপির মহান সত্যকে। সভ্যতার প্রথম দার্শনিক পদক্ষেপকে।
There should not be honour of one's own (religious) sect and condemnation of others without any grounds — Ashoka, Rock Edicts XII, about 250 BCE.

সেই দেশের এক নাগরিকের, সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীর অনুরোধ - এটা করবেন না।

কোন প্রয়োজন নেই শ্মশান-ব্রাহ্মণদের ভাতা দেবার। ওদের প্রতি কিন্তু কোন অসূয়া নেই। তবে প্রশ্ন, কেন এক সেক্যুলার দেশে ওরা সরকারি ভাতা পাবেন। কি ভিত্তিতে এই সরকারি বদান্যতা ঠিক হলো! ওদের থেকে গরিব মানুষ কি নেই এই রাজ্যে, এই শহরে! 

কেন ধর্মের ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে একবিংশ শতকে এই কলকাতা শহরে গুটিকয় মানুষ সরকারি ভাতা পাবেন! শুধু তারা হিন্দু ব্রাহ্মণ বলে!
যেই রকম অনিষ্ট হয়েছে মৌলবী ও মুয়াজ্জিনদের ভাতা দিয়ে, ঠিক তেমনই অমঙ্গল হবে এই শ্মশান ব্রাহ্মণদের ভাতায়। 

এই ক্ষতি একদিনে বোঝা যাবে না, এই ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি। যেমন বোঝা যায় নি মৌলবীদের ভাতায় ও অন্য বহু অনুষাঙ্গিকে।

এতে মানুষের সাথে মানুষের ব্যবধান শুধু বাড়বে, কমবে না।

ইস্কনের প্রেক্ষাপট অনেকের জানা; ওদের নিজেদের ধর্ম প্রচারের যথেষ্ট অর্থ আছে। সেই ইস্কনে গিয়ে ঘোষণা হলো সরকার ওদের ৭০০ একর জমি দেবে। কেন? ওরা ধর্ম প্রচার করছেন দীর্ঘদিন ধরে। অসুবিধা তো হয় নি। কেন ওরা সরকারি জমির সুবিধা পাবে! 

বরং সেই জমিতে শিল্প হলে বহু মানুষের দীর্ঘমেয়াদি লাভ হবে। সরকারি প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে।

ওদের জমি দিলে আরো যত হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বিভিন্ন আদিবাসী উপগোষ্ঠী আছে - তারা কেন পাবে না?  এই দাবি আজকে না হলেও কালকে যে উঠবে। 

সবচাইতে বড় কথা সরকারের কাজ কি? ধর্মের ভিত্তিতে জমি, ভাতা দেওয়া নাকি রাজ্যের মানুষের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন করা!

ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাইবার বদ অভ্যাস অনেকদিনের, তবু দুঃখের সাথে বলি, স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এই রাজ্যে এ জিনিস আগে দেখি নি। ধর্মের, তার বর্ণের, তার মুরুব্বিদের সরকারি ভাতা আসলে দীর্ঘদিনের বিভেদের শক্তির সরাসরি সরকারি বিধিবদ্ধ তোষণ। এর সাথে সাধারণ মানুষের, তাদের ধর্মাচারণের সম্পর্ক নেই।

আর, একটা ভুল দিয়ে আগের ভুলকে শুদ্ধ করা যায় না। 

ইস্কনে ৭০০ একর জমি ও কলকাতা শহরে শ্মশান-ব্রাহ্মণদের ভাতা দিয়ে রামের বিরুদ্ধে লড়াই চলে না। ধর্ম দিয়ে ধর্মের লড়াই হয়েছে মধ্য যুগে, ক্রুসেডে। কংগ্রেস সেই নরম হিন্দুত্ব প্রচেষ্টা নিয়েছে, হেরে ভুড্ডু হয়ে গেছে।

সে পথ পরিত্যক্ত। 

বড় বড় বক্তৃতায় গাল  ভরবে না, ভাতাতে খাঁই মিটবে না, জমিতে অসন্তোষ প্রশমিত হবে না, ভাষার আবেগ কাজ করবে না।

মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের অসম্মানের প্রচেষ্টার লড়াই দীর্ঘমেয়াদি। 

তার জন্য দরকার ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, রাজ্য ব্যতিরেকে মানুষকে একজোট করা, মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করা।

আম্বেদকর  বলেছিলেন,  Democracy is not merely a form of government. .. It is essentially an attitude of respect and reverence towards fellow men.

সেই সম্মান হারিয়ে যাচ্ছে। সেই মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সকলের। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন