বুধবার, ১৫ মে, ২০১৯

ভুবনের মাসিগণের কুম্ভীরাশ্রু ~ ডঃ বিষাণ বসু

বিদ্যেসাগরের মাথা কাটা গ্যাছে। তাই নিয়ে জোর শোরগোল। আপামর বাঙালীর নাকি মাথা কাটা গ্যাছে। তা বেশ! কথায় বলে, মাথা নেই, তার মাথাব্যথা।
রামকৃষ্ণদেব নাকি ঈশ্বরচন্দ্রকে বলেছিলেন, তুমি তো বাবা এমনিতেই সিদ্ধ। সিদ্ধ হলে কী হয়। নরম হয়। তা, বাবা, তোমার মনটি তো গরীব-দুঃখীর দুখে কাঁদে, এমনই নরম। তুমি যদি সিদ্ধ না হও, তাহলে সিদ্ধপুরুষ কে!!
তা গদাধরবাবুর জানা ছিল না, শুধু সিদ্ধ হয়েই নরম হয় না, মাছ নরম হয় পচলে। এই যে বাঙালী ঝাঁকের কই নরম হয়েছে, মূর্তি ভাঙার শোকে একদম ভেঙে পড়েছে, তার মূলে ওই, পচন।
সে নরম আবার এমনই নরম, যে, একেবারে ন্যাতপেতে হয়ে আছে। হাড়-মাস-মাথা-শিরদাঁড়া আলাদা করাই মুশকিল, এক্কেরে জেলিফিশতুল্য। একটা পুরো জাতি চোদু গোপাল হয়ে বসে আছে। যাহা পায়, তাহা খায়, সে এমনকি এবিপি আনন্দ হলেও।
প্রতিবাদ থেকে পোতিবাদ হয়ে অভ্যেসটাই যখন বাদ হয়ে গেল, বিদ্যাসাগর মশাইকে এর মধ্যে টানাহেঁচড়া করা কেন!!!
শিক্ষাদীক্ষায় হইহই করে পেছনের দিকে এগিয়ে চলার সময়, এমনকি লেখাপড়ার মত একটা ব্যাপারের মধ্যে প্রাইভেট স্কুল এডুকেশন ব্যবস্থা লাগু করে সরকারি ইস্কুলগুলো লাটে তুলে দেওয়ার সময় বিদ্যেসাগরমশাইকে ফুলবেলপাতা দেওয়া হচ্ছিল। আজ মূর্তি ভাঙার মুহূর্তে হাহাকার করা তো আমাদেরই সাজে!!!!
দুচারটে ধর্ষণ-টর্ষণ খবরের কাগজের মাঝের পাতায় ছাপা হয়। রেপিস্টকে পালাতে সাহায্য করে দিব্যি ভোটে দাঁড়ানো যেতে পারে। বিদ্যেসাগরের মূর্তিতে ফুলবেলপাতা আমরা চড়াচ্ছিলাম। দায়িত্ব নিয়ে।
ধর্ম, না ধর্মাচরণকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় এনে ফেলে জাতিবিদ্বেষ-ধর্মবিদ্বেষকে যখন ভোটে কনভার্ট করার স্ট্র‍্যাটেজি সাজানো হচ্ছিল, তখনও বিশ্বাস করুন স্যার, আমরা কিন্তু কিচ্ছুটি বলিনি। শুধু আপনার মূর্তির পাদদেশে সাজানোর জন্য বেলপাতা বাছছিলাম। যে নবজাগরণের হাত ধরে দেশের জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছিল, সেইসব "ভুলভাল" ইতিহাস ছেড়ে আমরা নতুনভাবে "জাতীয়তাবাদী" হচ্ছিলাম। আর বলছিলাম, ওরা যদি মহরমে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করে, তাহলে এরাই বা করবে না কেন, রামনবমীতে!!! বিদ্যাসাগর স্যার, বিশ্বাস করুন, আমরা কিন্তু "ওরা" নই, আবার "এরা"-ও নই, আমরা জাস্ট নিরপেক্ষ। আসলে ডমিন্যান্ট মেজরিটির হয়ে "নিরপেক্ষতা"-র অর্থ ঠিক কী, আমরা বুঝতে চাইনি। কেননা, আমাদের পেছনে অত দম কোথায়!!!
যাক গে সেসব কথা।
মোদ্দা ব্যাপারটা হল, বিদ্যাসাগরমশাই বেঁচে থাকতেই পালিয়েছিলেন। লোকটার, আর কিছু না থাক, দূরদৃষ্টি ছিল। তাঁর নামের কলেজটিতে বাছাই কিছু খিস্তি এবং পকেটে ইঁট নিয়ে যাঁরা শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হয়েছিলেন, সেইসব ক্ষুরধার বিদ্যার্থীদের মানসচক্ষে দেখতে পেয়েই তিনি সাঁওতাল পরগণায় পালিয়েছিলেন। সময় থাকতে থাকতেই। কাজেই, সেই খিস্তি ও ইঁটের প্রতিবাদে যাঁরা মিছিল থেকে হইহই করে বিদ্যাসাগর কলেজে সগৌরবে প্রবেশ করলেন, তাঁদের মুখোমুখি তাঁকে হতে হয় নি।
কাজেই, চোখের জল মুছুন। বিদ্যাসাগরমশাই তেমন একটা চোট পান নি। রিল্যাক্স।
বর্ণপরিচয় পড়েছেন তো? গল্পটল্পগুলো তো জানা আছে নিশ্চয়ই?
তা ভুবনের গল্পটা মনে পড়ে? পুরোনো গল্প। একটু বাসি হয়ে গিয়েছে। আজকাল চুরিটুরিতে শাস্তি তেমন একটা হয় না (ফাঁসির তো প্রশ্নই নেই)। একজন ভোটপ্রার্থী তো বুক ফুলিয়ে বলেইছেন, জেলে থাকাটাই ভোট পাওয়ার জন্যে তাঁর ইউএসপি। কিন্তু, কথাটা সেই নিয়ে নয়।
গল্পের শেষটা মনে করে দেখুন।
সাজাপ্রাপ্ত ভুবন তার সাজার আগের মুহূর্তে মাসিকে ডেকে পাঠায়। বলে, মাসিকে কানেকানে কিছু বলতে চায়। হ্যাঁ, সেই মাসি, যিনি কিনা ভুবনের ছোটখাটো অপরাধ দেখে চুপ থেকে, দেখেও না দেখার ভান করে মাধবকে দাগী অপরাধীতে পরিণত হতে সাহায্য করেছিলেন।
তা সেই মাসি ভুবনের মুখের কাছে কান নিয়ে আসতেই, ভুবন মাসির সেই কান কামড়ে কেটে নেয়। পরের কথাটুকু বর্ণপরিচয় থেকেই।
"পরে ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, মাসি! তুমিই আমার এই ফাঁসির কারণ। যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে সময়ে যদি তুমি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে আমার এ দশা ঘটিত না। তাহা কর নাই, এজন্য তোমার এই পুরস্কার হইল।"
না, এইসব ঘটনা আর কিছু নয়। জাস্ট একটু একটু করে কানের কামড়। ভুবনরা বেড়েছে। বাড়ছে। অবাধে।
আমরা সবাই ভুবনের কানকাটা মাসি।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন