শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮

অসুস্থ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ~ বিষান বসু

তিনটে ঘটনা। গত এক সপ্তাহের মধ্যেই।

১. কলকাতা থেকে চারশো কিলোমিটার দূরে। উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ। প্রাইমারী হেলথ সেন্টার। ডাক্তার আছেন। আর বিশেষ কিছু নেই। হার্ট এট্যাকের জটিল রোগীর চিকিৎসা সম্ভব কিনা সেখানে, বুঝতে ডাক্তারি পড়তে হয় না। এমন এক রোগী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এলে, চিকিৎসক রেফার করেন সরকারি সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। রোগী সেইখানে পৌঁছানোর আগেই মারা যান। পরিজন চড়াও হন চিকিৎসকের উপর। নৃশংস মার। লাথিঘুঁষি। এমনকি, ধাতব টেবিল দিয়েও। ডাক্তারবাবু, নিজেই, সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি।

২. খাস কলকাতা। ঢাকুরিয়া আমরি হাসপাতাল। ক্রনিক এলকোহলিক এক যুবক। বয়স কুড়ির কোঠায়। অত্যধিক মদ্যপানজনিত প্যানক্রিয়াটাইটিস। সাথে মাল্টি-অরগ্যান ফেইলিওর। অনেক চিকিৎসার শেষে রোগীর মৃত্যু। পরিজন বিক্ষুব্ধ। ডাক্তাররা খুনী। গ্রেফতার চাই, সম্ভব হলে যাবজ্জীবন বা ফাঁসি। প্রকাশ্য রাজনৈতিক মদতে চলতে থাকে অবরোধ। চিকিৎসকেরা হাসপাতাল থেকে বেরোতে পারেন না অনেক রাত্রি অবধি। পুলিশ-র‍্যাফ নীরব দর্শক।

৩. ভার্চুয়াল দুনিয়া। ফেসবুকে। একটি ছবি। ঝাঁচকচকে এক করিডোর। বসার জায়গা। কেউ বসে নেই অবশ্য। জনশূন্য সেই সুদর্শন করিডোরের নীচে ক্যাপশন। না, বিদেশ নয়, এয়ারপোর্টও নয়। বনগাঁর সরকারি হাসপাতালের ছবি এটি। একজন আবার অত্যুৎসাহী হয়ে, শঙখ ঘোষের লাইন বদলে, লিখে ফেলেন, "দেখ খুলে তোর ত্রিনয়ন/ রাস্তাঘাটে, হাসপাতালে, দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন"। অবশ্য, উন্নয়ন যে রাস্তাঘাট পার হয়ে হাসপাতালে ঢুকে পড়েছে, এই নিয়ে, বোধ হয়, সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকেরা দ্বিমত হবেন না। কিন্তু, থাক সে কথা।

তিনটে ঘটনা। আপাতবিচ্ছিন্ন। যোগসূত্রহীন।

কিন্তু, আসুন না, একটু গভীরে যাই।

শুধু ঝাঁচকচকে করিডোর দিয়ে হাসপাতাল হয় না। হলে ভালো হয় নিশ্চয়ই, কিন্তু, না হলেও চলে। আসল কথা, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। তার ব্যবস্থা কতোটুকু?

চকচকে সুপারস্পেশ্যালিটির গল্পের পর অনেক বছর পার হলো। সুপারস্পেশ্যালিস্ট মিললো কি? ডাক্তার ছাড়াই অত্যাধুনিক চিকিৎসা!! উন্নয়নে বিশ্বাসী হলেও, এতোটা হজম হবে কি?

কিন্তু, ডাক্তার নেই কেন?

উলটো প্রশ্ন করি? ডাক্তার থাকবে কেন?

সরকারি চাকরিতে সুযোগসুবিধা, এখন, নামমাত্র। থাকার ব্যবস্থা প্রায় নেই। হাসপাতালের পরিকাঠামো নড়বড়ে। বিল্ডিং নয়, বাকি যন্ত্রপাতি-ওষুধ এইসবের কথা বলছি। যন্ত্র থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই। আর নিরাপত্তা? হাসাবেন না, প্লীজ।

মাইনে? মহারাষ্ট্র সরকার, প্রত্যন্ত এলাকায় ডাক্তার নিয়োগের জন্যে মাসিক তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেতন ধার্য করেছেন। এখানে, মেরেকেটে পঞ্চাশ হাজার। এমডি-ডিএম করার শেষে এই মাসমাইনেতে ডাক্তার পাওয়া তো স্রেফ আকাশকুসুম।

এরপরেও ডাক্তাররা সরকারি চাকরি করতে চাইতেন। কেননা, অনেকেই, সাধারণ মানুষের কথা ভেবে, সনাতন আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে ডাক্তারিটা করতে চাইতেন। আর, এখনো চান। হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন, লাখ-লাখ টাকা উপার্জনের লোভে, বা হীরের চচ্চড়ি খাওয়ার আশায় সবাই এলাইনে আসেন না। কিন্তু, বর্তমানে, স্বাস্থ্যআমলাদের আশ্চর্য তুঘলকি সিদ্ধান্তে, সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারি কঠিন হয়ে উঠেছে। সাথে সাথে রয়েছে কিছু লুম্পেননেতার দাদাগিরি। সম্মান আর সরকারি ডাক্তারি, প্রায় পরস্পরবিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আর, সরকারি চাকরিতে উচ্চশিক্ষার যে সুযোগ বা অধিকার ছিলো, সরকারবাহাদুর তার সঙ্কুচনে চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। তারসাথে, চাকরি ছাড়তে চাইলে আবেদন প্রত্যাখ্যান, সঙ্গে এতোবছর চাকরির সুযোগসুবিধে হারানো।

অতএব, সরকার বিজ্ঞাপন দিয়েও ডাক্তার পাচ্ছেন না।

সমস্যাটা, বা অসন্তোষের কারণ, সরকার জানেন না, এমন নয়। কিন্তু, তাঁরা ভোট চান, ভোটের জন্য অর্থ চান। সমাধান নয়।

প্রথম, ভোট। ডাক্তারেরা সংখ্যায় হাতেগোনা। ভোটের হিসেবে তাঁদের না আনলেও চলে। কিন্তু, স্বাস্থ্যপরিষেবায় সরকার সচেষ্ট নন, এই বার্তা গেলে, ভোটের রাজনীতিতে বিপদ আছে। তাই, চকচকে বিল্ডিং, নিত্যনতুন শিলান্যাস। সাথে ফাটা রেকর্ড। চেষ্টা করেও ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। মিডিয়াও এই মেসেজই প্রচার করে চলেছে। স্বভাবতই, মানুষের কাছে বার্তা যাচ্ছে, সরকার চাইলেও, ডাক্তারদের অনুৎসাহের কারণেই সদিচ্ছা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ক্ষোভের অভিমুখ সেই চিকিৎসকের প্রতি।

দ্বিতীয়ত, পার্টি ফান্ড। ভোটের খরচ। না, এখানে হিসেবটা ততোখানি সরলরৈখিক নয়। বোঝানোর চেষ্টা করি তাও। মানুষের অসুখবিসুখ তো হবেই। হাসপাতালে যেতে হবেই। বিশেষত, এমন দেশ, যেখানে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বা রোগপ্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগ প্রায় নেই। তা, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে মানুষ চিকিৎসা চাইবেন না, এমন তো নয়। অতএব, লাভ কার? আজ্ঞে হ্যাঁ, বেসরকারী স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের।

সব বেসরকারী পরিকাঠামো একই নয়। মফস্বল বা ছোটো শহরে বেশ কিছু ছোটো নার্সিং হোম আছে, যেখানে সাধ্যের মধ্যে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিলো, বা এখনও আছে। ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের প্যাঁচে ফেলে তাদের নাভিশ্বাস তোলার ব্যবস্থা হলো। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়েছেন। আবার, কিছু বৃহৎ বেসরকারী স্বাস্থ্য-কনগ্লোমারেট, জেলায় ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে, অধিগ্রহণের চেষ্টাও করছেন। কলকাতা শহরে চিকিৎসাব্যবস্থা, এখন, প্রায় পুরোপুরিই, কর্পোরেট দখলে। আগামী এক দশকে, জেলা শহরেও এই চিত্রই দেখা যাবে।

কাজেই, শেষ পর্যন্ত, জয় হোক কর্পোরেটের। এঁদের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকায়, এমন বুকের পাটা কার!!

একটু ভেবে দেখুন, দশ বছর আগেও, বাবা-কাকা অসুস্থ হলে, আপনি ছুটতেন অমুক ডাক্তারবাবুর কাছে। রোগ জটিল হলে, অমুক নামী ডাক্তারের চেম্বারে। এখন কিন্তু, আপনি আর ডাক্তারের নাম খোঁজেন না, আপনি যান নামী হাসপাতালে। পার্থক্যটা কিন্তু অনেক।

হাসপাতালের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চেম্বারে যে ডাক্তারবাবু আপনাকে দেখলেন, তিনিও জানেন, আপনি মোটেই তাঁর কাছে আসেন নি, এসেছেন সেই হাসপাতালের ভরসায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে আপনার সেই রোগীকে পাঠিয়েছেন মাত্র। তিনি যদি রোগীপরিজনকে সন্তুষ্ট ক্রেতা হিসেবে সার্ভিস না দিতে পারেন, তারসাথে হাসপাতালকে যথেষ্ট ব্যবসা দিতে না পারেন, তাহলে কিন্তু পরের বার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে পাঠাবেন, একই হাসপাতালে, পাশের চেম্বারে অপেক্ষারত ডাক্তারের কাছে। আবার, কোনো ডাক্তারবাবু, যদি নিজগুণে রোগীদের কাছে পছন্দের হয়ে ওঠেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ, সচেতনভাবেই, রোগীদের অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠাতে থাকেন। হ্যাঁ, ডাক্তারকে ইনসিকিওর রাখা বা ডাক্তারকে কখনোই হাসপাতালের ব্র‍্যান্ডের চেয়ে বড়ো হতে না দেওয়া, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ঘোষিত নীতির মধ্যেই পড়ে।

মনে রাখবেন, এই কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে সবচেয়ে আদরের কর্মী কিন্তু কোনো ডাক্তার নন। এঁদের নয়নের মণি মার্কেটিং স্টাফ। অর্থাৎ, যাঁরা হাসপাতালে রোগীর জোগান অব্যাহত রাখেন। মার্কেটিং-এর অনেকেই ডাক্তারদের চাইতে অনেকটাই বেশী আয়ও করে থাকেন।

কিন্তু, সরকারের ভূমিকা এখানে কী?

এখনো বলে দিতে হবে? নাঃ, আপনি দেখছি একেবারেই নাদান!

এক, ডাক্তাররা যদি সরকারি চাকরিতে না যান, তাহলে যাবেন কোথায়? আইনের মারপ্যাঁচে ছোটো চেম্বারের দিন শেষ। অতএব, কর্পোরেট। দেশে ডাক্তারের ঘাটতি থাকলেও, কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টের সামনে চাহিদার তুলনায় ডাক্তারের জোগান বেশী, মানে যেমনটি তাঁরা চান। ইনিসিকিওর ডাক্তারদের একাংশ আপোস করতে রাজিও থাকেন। কর্পোরেট ব্যবসার রমরমা এভাবেই।

দুই, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি ভেঙে পড়তে দিয়ে কর্পোরেট হাসপাতালে রোগীর জোগান নিশ্চিত করা।

আর, এর পরে, সরকারবাহাদুর যদি হাসপাতাল চালাতে অপারগ হয়ে, পাব্লিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ করার কথা বলেন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। টেনশন করবেন না, সুখের সেইদিন আর বেশী দূরে নয়।

এতো প্রাপ্তির শেষে, কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসায়ীরা যদি খুদকুঁড়ো ভরে দেন দলীয় তহবিলে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!!

হ্যাঁ, এরপরেও কর্পোরেট হাসপাতালে বিল দেখে অবস্থান-বিক্ষোভ চলবে। মিডিয়া ডেকে ক্যামেরার সামনে বেসরকারী হাসপাতালের কর্তাদের চমকানো চলবে। কেননা, পাছে চিকিৎসাব্যয়ে ঘটিবাটিবেচা মানুষের ক্ষোভ সরকারের পানে ধেয়ে আসে, সেই সম্ভাবনাটি অঙ্কুরেই বিনাশ করা। প্লাস, রুটিন ভেট আসার মাঝে এইটুকু ব্ল্যাকমেইলিং না হলে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে হাতখরচা আসবে কোত্থেকে!

আপনি হয়তো অতো ভেবে দেখেন না। খামোখা অতো ভাবতে আপনার বয়েই গ্যাছে।

কিন্তু, যদি একবার ভেবে দ্যাখেন।

সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার প্যাঁদানোতে নির্বিকার থেকে, আপনি কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিকেই ভেঙে পড়তে দিচ্ছেন।

আর, অন্যদিকে, কোনো বেসরকারি হাসপাতাল কিন্তু লোকসানে চলে না। রাজনৈতিক দলের কাছে তোলা পৌঁছানো বা ভাঙচুরের পর মেরামতি, ঘুরপথে খরচ জোগান পরের রোগীরাই।

কেমন হবে, সেই পরের রোগীটি আপনাকেই হতে হয়?

রাজনীতির কারবারি আর স্বাস্থ্যব্যবসায়ী, তাঁদের কিন্তু সেটিং হয়েই আছে।

আপনার?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন