শুক্রবার, ৩ আগস্ট, ২০১৮

মহাকালের প্রহেলিকা - ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা ~ দীপক সেন


সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সরাইঘাটের * শেষ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন । যারা এইসব কথা বলছিলেন, তাদের অনেককেই এন আর সি র দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশ হওয়ার পর মিষ্টিমুখ করতে দেখলাম। আমি তো ইতিহাসের ছাত্র নই, অত শত বুঝি না, বোধহয় ওরা বিজয়োৎসব করছেন। কিন্তু এন আর সি তো "লিস্ট অফ ইনক্লুশন" " লিস্ট অফ এক্সুলশন" নয়।  তাদের নাম থাকার আনন্দে উল্লাস না চল্লিশ লক্ষ নাম বাদ পড়ায় উল্লাস। আমি অত শত বুঝি না, শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে দেখি সব কিছু আর ক্ষুধিত পাষানের মেহের আলীকে মনে করি। 
         এই চল্লিশ লক্ষের মধ্যে কয়েক লক্ষ নাম আবার অন্তর্ভুক্ত হবে নিশ্চিত, কয়েক লক্ষের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা তাদের হাতে কোন কাগজের নথি নেই, আছে শরীরে পতিত জমি আবাদ করার সোঁদা গন্ধ। কয়েক সহস্র " বিদেশী " কে সনাক্ত করা যাবে যারা অর্থনীতির নিয়ম মেনে কাঁটাতার অতিক্রম করেছিলেন বাঁচার সংগ্রামে।
              আবহমান কালের প্রব্রাজনেই মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল বা হচ্ছে।আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে থেকে হোমোসেমিন্স নামে যে প্রজাতি জন্ম নিয়েছিল বিবর্তনের সূত্র মেনে সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এই প্রজাতি ভিন্ন ভিন্ন ভৌগালিক পরিবেশে বর্ধিত বিকশিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে সমাজ দেশ রাষ্ট্র। সমাজ দিয়েছে অনুশাসন রাষ্ট্র দিয়েছে শাসন, সমাজ বানিয়েছে নিয়ম রাষ্ট্র বানিয়েছে আইন।
        কিন্তু এত সব আয়োজন তো মানবতার স্বার্থে। কিন্তু মানবতাকে অস্বীকার করে যদি কোন সমাজ বা রাষ্ট্র,তবে সমাজবিজ্ঞানের নিয়মে ঝড় উঠে তারপর আবার শান্ত হয়। নির্মল আকাশে আবার শুকতারা ধ্রুবতারা উজ্বল আলো দেয়। এমনি বহমান সভ্যতার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভাবছি এই উল্লাসের ঝড় বড় ক্ষণস্থায়ী। 
       অভিজিৎ নীলোৎপলের মর্মান্তিক মৃত্যুতে যাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, হীমা দাসের গৌরবে যাদের বক্ষ স্ফীত হয়, পতিত জমি আবাদ করতে যাদের শরীর ঘর্মাক্ত হয়, শুধু কাগজের  নথির জন্য তাদের আবেগ ভালোবাসা মাটির মাকে সম্মান করা কোন স্বীকৃতি পাবে না? হে মহাভারত ভুলিও না অর্জুন তোমার একমাত্র বীর নয় একলব্যকে যতই ব্রাত্য কর স্বমহিমায় সে ভাস্বর। হে অর্জুন জননী কুন্তি তুমি কর্ণ কে যতই জলে ভাসাও নিয়তি তাকে ডেকে আনবেই, তোমার অর্জুনকে সে প্রত্যাহ্বান জানাবে , আবার তাচ্ছিল্যে তার প্রাণ ভিক্ষা দেবে। ইতিহাস শুধু বিজয়ীকে মনে রাখে না, ব্রাত্য একলব্যকেও সম্মান করে মনে রাখে।
           চল্লিশ লক্ষকে ব্রাত্য করার আনন্দে যদি কেউ মিস্টি মুখ করে থাক তবে তুমি রবীন্দ্রনাথের "গোরা" পড়নি, কেননা আমাদের আত্মপরিচয় বা জন্মপরিচয়ের ফানুশ  কখন চুপসে যাবে কেউ জানি না। যাদের কে শত্রু পক্ষে ঠেলে দিয়ে অস্ত্রে  শান দিচ্ছ ,যেদিন জানবে সে তোমার জ্ঞাতি গোষ্ঠী সেদিন কি করবে? গ্রীক মহাকাব্যের ট্র‍্যাজিক নায়কদের মত কৃপা ধন্য হবে। ওঅদিপাউসকে ভুলে যেওনা, ভুলে যেও না আউরঙ্গজেবের ছেলে মহম্মদকে। 
      সরাইঘাটের শেষ যুদ্ধের কথা বলছিলে না, তবে শোনো- মহম্মদ আলী জিন্না, কায়েদ ই আজম জিন্নার দুহিতা কোনদিন পাক সীমান্তের ওপারে পা রাখেননি, নেতাজী কন্যা এ দেশের নাগরিকত্ব নেননি। ভায়া, মহাকালের প্রহেলিকাকে মনে রেখ, ইতিহাসের নিষ্ঠুরতাকে মনে রেখ। সামলে চল ভায়া।
* সরাইঘাটের যুদ্ধ--১৬৬৯ সালে মুঘল সেনাপতি রাজা রাম সিংহের সঙ্গে অহম রাজের সেনাপতি লাচিত বড়ফুকনের যুদ্ধ।
------------------------------------
লেখাটি অসম থেকে পাঠিয়েছেন দীপক সেন গুপ্ত।
১/০৮/২০১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন