শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

​সেদিন প্রভাতে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরছি। হাতে একটা মাঝারি সাইজের ট্রলিব্যাগ, চাকা লাগানো। তবে রাস্তার অবস্থা তো এমন নয় যে তার ওপর দিয়ে সেই ব্যাগ টেনে নিয়ে হাঁটা যাবে। চাকাগুলো একটা গর্তে ঢুকলে আর বেরোবে না। তবে ব্যাগে বিশেষ কিছু নেই। শীতকাল হলে মা বড়ি আর পাটালি ভরে দেয়, এখন গরম, সে সবের সময় নয়। যদিও বলছিল, কটা নারকোল ছাড়িয়ে নিয়ে যা। হুঁ, মাজদিয়া থেকে টেনে টেনে ব্যাঙ্গালোরে নারকেল আমি বয়ে নিয়ে যাব আর কী!

গ্রামের সমস্ত প্রভাতে অনিবার্যভাবে একটা পবিত্রতার গন্ধ লেগে থাকে। উঠোনে গোবরছড়া দেয় কাকিমারা, ফুল তুলে বেতের সাজিতে ভরে পাশের বাড়ির মেয়েটি, কাঁসার বালতিতে গরুর দুধ দোয়াতে আসে ও পাড়ার বৌটা, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে অনিচ্ছুক শিশুকণ্ঠে ভেসে আসে ইমনের সুরে – ধনধন মূরত কৃষ্ণমুরারী। আমার অবশ্য এ সবের সৌন্দর্য উপভোগ করার উপায় নেই, মন ভারাক্রান্ত। মা কান্নাকাটি করে। বাবা নিস্পৃহ, প্রণাম করলে সবাইকে প্রতিনমস্কার করা তাঁর স্বভাব। ইদানিং তার সাথে যোগ হয়েছে – আবার যখন আসবি, আমার সাথে যে দেখা হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। আমার হঠাৎ তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে। মনে হয়, দূর, আত্মীয়-পরিজন ফেলে কী যে হাতিঘোড়া করছি, এখানে থাকলেই তো হয়। ধুপ করে বসে পড়ি তক্তাপোষে। বাবাই তাড়া লাগায়, ওঠ, যা, দেরি হলে ট্রেন চলে যাবে।

বাড়ি থেকে স্টেশন অলসভাবেও হেঁটে গেলে বড়জোর দশ মিনিট। আমি আমাদের গলিটা থেকে বড়রাস্তায় উঠেছি কি উঠিনি, পেছনে ভটভটি নিয়ে হাজির খোনে। ওর ভাল নাম প্রকাশ, ডাকনাম ক্ষৌণীশ থেকে খোনে। আমাদের লাগোয়া বাড়ির বাল্যবন্ধু, একসঙ্গে আমরা স্কুলে পড়েছি বারো ক্লাশ অবধি। এখনো সূর্য ওঠার কিছুটা বাকি, তবে ওর চোখে এখনই কালো রোদচশমা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক মেরে আমাকে বলল, মিঠু! চলে যাচ্ছিস? কখন এলি?

আমি বললাম, আমার তো জানিসই। কাল রাত্রে।
- হুম, তোর তো এই রকমই ব্যাপার। তো আমাকে ডাকবি তো। আমি থাকতে একা একা হেঁটে হেঁটে তুই এতটা রাস্তা যাবি? তুই শহুরে মানুষ, তোর কি হাঁটাহাঁটি অব্যেস আছে?

খোনে জানে না আমি সওয়া দু ঘন্টায় হাফ ম্যারাথন দৌড়াতে পারি, ওটা দু ঘন্টায় নামানোর জন্যে লড়ছি। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে ওর মোটর সাইকেলের সওয়ারি হয়ে যাই। অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়ে খোনে বলে, তো এখনো সেই ব্যাঙ্গালোরেই আছিস তো, না কী? তোদের ব্যাঙ্গালোরে একবার যাব, বুঝলি? গিয়ে দেখে আসব কেমন সেই স্বপ্নের দেশ।

ও এখন কী করছে সেটা জিজ্ঞেস করতে জানলাম খোনে এবার পঞ্চায়েত ইলেকশনে কংগ্রেস প্রার্থী। এর আগে সিপিএম থেকেও ও লড়েছে, এবং হেরেছে। এবারেও খোনের ভোটে হারা একেবারে নিশ্চিত, জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়াও বিচিত্র না, তবে ও নিঃসন্দেহ যে ওই জিতবে। আমাকে বলল, এরা তো ভোটের স্ট্র্যাটেজি ব্যাপারটা জানে না, কংগ্রেস হল ন্যাশনালিস্ট পার্টি। আমাদের সব হাইকম্যান্ড থেকে নির্দেশ আসে। সনিয়া গান্ধী বলে দেবে কী কী করতে হবে। এদের মত উঁচাটে পাড়ার দাদাগিরি আমাদের পার্টির উদ্দেশ্য না। দেড়শো বছরের ঐতিহ্য এই পার্টির। গান্ধীজী শুরু করে গেছিল, সে কী আজকের কথা!

খোনের ভটভটি ঢুকে গেল একেবারে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। কাকে হঠাৎ নজরে পড়তে চেঁচিয়ে উঠল, এই মদনা, শালাচ্ছেলে একেনে কী কচ্চিস? মাঠে যাসনি আজ? শোন, এদিকে আয়।

মদন নামের যুবকটি কাছে আসতেই খোনে বলল, যা একটা টিকিট কেটে নিয়ায় তো। মিঠু কি শিয়ালদা অবদি যাবি, না দমদম? একই ভাড়া অবশ্য, যা যা একটা শিয়ালদার টিকিট কেটে নিয়ায়। এই নে টাকা।

খোনে নিজের পকেট থেকে টাকা বের করতে যাচ্ছে দেখে আমি ফট করে মানিব্যাগ বার করে মদনের হাতে একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দি। আমাদেরটা ডাউন প্ল্যাটফর্ম, টিকিটঘর আপের দিকে। মদন প্ল্যাটফর্ম থেকে লাইনে লাফিয়ে পড়ে ওদিকে চলে যায়।

- চ, চা খাবি চ।
- আমার চা খাওয়ার তেমন অব্যেস নেই রে খোনে।
- ও এখনো ধরিসনি? তুই সেই একই রকম থেকে গেলি। এখনও কি আঙুল দিয়ে হাওয়ায় এবিসিডি লিখিস? ঘুমানোর সময় মাথা নাড়াস? চ, সামনের দিকে চ। তুই না খাস, আমি একটু চা খাই।
- কিন্তু মদনা?
- আরে ও ঠিক খুঁজে নেবে। ব্যস্ত হচ্চিস কেন?

প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানের পাশেই একজন বিরাট একটা মাটির জালায় জল ভরে তাতে একটা শিশি থেকে ঢেলে সবুজ রং মেশাচ্ছিল। তার পাশে পাঁচ ছটা চটের বস্তায় পটল ভর্তি। এ রকম নধর পটল আমাদের ওদিকে দেখাই যায় না প্রায়। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সে বলল, যাচ্চিস?
আমি বললাম, হুঁ।

কিন্তু কে এ? আমাকে চেনে, অথচ আমি চিনতে পারছি না! নাকি আমাকে অন্য কারও সাথে গুলিয়ে ফেলেছে?

চায়ের দোকানে খোনে লেবু চা অর্ডার করতেই আমি বললাম, আমার জন্যেও একটা বলে দে। ততক্ষণে মদনও টিকিট এনে সেখানে হাজির। খোনে ওর হাত থেকে টিকিটটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখল। ফেরত টাকাগুলো এক এক করে গুণলো। শিয়ালদার পঁচিশ টাকা ভাড়া। সাতটা দশটাকার নোট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে পাঁচটাকার কয়েনটা নিয়ে মদনের হাতে দিয়ে বলল, যা ভাগ। বিকেলে হাটখোলার মাঠে আসিস।

আমি খোনেকে বললাম, ওখানে পটলে রং মেশাচ্ছে লোকটা কে রে? আমাকে চেনে মনে হল!
- ওমা, তুই ওকে চিনতে পাল্লি নে? আমাদের বাদলা। তোদের বাড়ি এসে পড়ে গেছে স্যারের কাচে। সংস্কৃত ক্লাসে একবার নন্দবাবুর কাছে বেধড়ক ক্যালানি খেল, মনে নেই?
- ঘোষপাড়ার বাদলা?
- হ্যাঁ, বাদলা আবার কটা স্যারের কাচে পড়তে আসত? ওই।
- এখন কী করে?
- কী আবার করবে? কাঁচামালের ভ্যান্ডারি করে। ছটা চব্বিশের ট্রেনে ওর মাল যাবে, এটায় না।

ধোঁয়াওঠা কাঁচের গ্লাসে লেবু চার স্বাদ মন্দ না। আমি গ্লাস হাতে এগিয়ে গেলাম বাদলার দিকে। পেছন পেছন খোনেও। ওই শুরু করল, এই দ্যাখ বাদলা, শহরে গেলে বাবুদের হাল কী হয়। তোকে চিনতেই পারছে না।
বাদলা বলল, ধুস, মিঠু আমায় চিনবে না? হতেই পারে না। কাকিমার সাথে আমার ডেলি দেখা হয়। মিঠু, মাকে জিগ্যেস করে দেকিস, গতবার যে বড়ি দিল আড়াই কেজির, তার পাকা চালকুমড়ো জুগাড় করে দিল কে? এই তো কদিন আগে একটা কাঁঠাল দিয়ে এলাম কাকিমাকে। স্যার দেখলাম বসে বসে টিভি দেখছেন।

আমি হাসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, পটলে কী মেশাচ্ছিস?
- রং। এসব তো বাবুদের পেটেই যাবে, কলকাতার বাবুদের। তারা একটু বেশি সবুজ পছন্দ করেন। তাই আর একটু সবুজ করে দিই।
- কিন্তু বাদলা, তোর পটল তো এমনিতেই দারুণ সবুজ রে। আমারই ইচ্ছে করছে ক কেজি বয়ে নিয়ে যেতে ব্যাঙ্গালোরে।
- তো নে না। যতখুশি নে।
- কিন্তু তুই যে কী কালার মেশাচ্ছিস।
- তাতে কী? সবাই মেশায়।
- এগুলো ভাল জিনিস না রে বাদলা। এই রংগুলো
- ভাল জিনিস না মানে?
- মানে এগুলো সব এক একটা পয়জন বলতে পারিস।
- পয়জন, মানে বিষ? বলিস কী! একেনে সবাই এই মাল পটলে দ্যায়।
- হুম, বিষই। এমন বিষ না যে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মরে যাবে। তবে শরীরের পক্ষে খুব খারাপ। আগে সবুজ করার জন্যে তুঁতে দিত। তুঁতে জানিস তো, ঠাকুমা দিদিমারা মুখে রাখত দাঁত শুলোলে। তুঁতের জীবাণু মারার ক্ষমতা আছে, যদিও বেশি পেটে গেলে সেও বিষ। এখন এই যে শিশিতে দেখছি, এটা তুঁতে না। এ একধরণের অর্গ্যানিক ডাই, এটা সম্ভবত ম্যালাকাইট গ্রীন। বিষাক্ত জিনিস। আগে অন্যদেশে খাবারে সবুজ রং করতে ইউজ হত, কিন্তু এখন সব জায়গায় ব্যান্‌ড্‌।
- তাই?
- হ্যাঁ। ভেবে দেখ, একটা মা তার আদরের বাচ্চাটাকে তোর এই পটলের তরকারি খাওয়াচ্ছে। আর তার ছোট্ট শরীরে সবার অজান্তে জমা হচ্ছে বিন্দু বিন্দু বিষ। বাচ্চাটার মাঝে মাঝে পেটব্যথা হয়, ডাক্তারবদ্যি কেউ ধরতে পারে না কী রোগ। সেগুলো এই সব থেকে হতে পারে।

সবুজ শিশিটা ছুঁড়ে দূরে এক ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল বাদলা। বলল, আমরা কী এসব জানি? লেখাপড়া শিখতে পারিনি। ভাগ্যিস তুই বললি। অকারণে পাপের ভাগী হতে চাইনে আর।

প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছিল। ওদের হাত নাড়িয়ে আমার ট্রলিব্যাগ হাতে আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম।

পয়লা ফেব্রুয়ারি ২০১৪

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন