জার্মান শব্দের সঠিক
উচ্চারন বাংলায় লেখা খুব কঠিন। আলি সাহেব হলে হয়ত পারতেন। আমার সে দুঃসাহস কোথায়? কাজেই
“Mein Widerstand” এই শব্দরূপকে কোনক্রমে
খাড়া করেছি। এটা একটা বইয়ের নাম, এবং বলাই বাহুল্য, লেখক জার্মান। এক সময় ওপার
বাংলার ছিন্নমূল মানুষকে “জার্মান” বলে মজা করে ডাকা হতো। অবশ্য সে মজার মধ্যে
নেহাত মজাই ছিলো, কোন ভাবে ছোট করার প্রয়াস ছিলোনা। বাঙাল আর জার্মান, দুজনেরই
নাকি একই রকম গোঁয়ার। কিছু করবো ভাবলে করেই ছাড়ে। যাই হোক, এই বিদঘুটে নামওয়ালা বইয়ের
লেখক ফ্রিডরিষ কেলনার ছিলেন জার্মান সরকারের মাঝারি গোছের কেরানি। লিনৎস্ আর
লাউবাখ অঞ্চলে প্রধানত সরকারি আইন দফতরে কাজ করেছেন। তাঁর কর্মজীবনের একটা বড় অংশই
কাটে হিটলারের শাষনাধীন জার্মানীতে। তাঁর লেখা বইয়ের নামের বাংলা তর্জমা করলে
দাঁড়ায় – “আমার বিরোধীতা”। আসলে বই লিখবেন বলে লেখেননি। বলা চলে এ হলো একটা নোটবই।
প্রথম পাতায় কেলনার লিখেছেন – “ওদের ক্ষমতা প্রচুর, ওরা আমার কন্ঠস্বর রোধ করে
দেবে, বর্তমান সময়ে নাৎসিদের সঙ্গে আমি লড়তে পারবো না। তাই ঠিক করেছি, আমি ওদের
সঙ্গে ভবিষ্যত সময়ে লড়বো। আমার চোখে দেখা ওদের বর্বরোচিত সবকিছুকে লিপীবদ্ধ করে
রাখছি, আর ওদের থামাবার উপায় ও লিখে রাখছি”। কেলনার সাহেব জাত জার্মান, লড়াইয়ের
গোঁ তিনি ছাড়েননি, কেলনার সাহেব জাত জার্মান, তাই বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গিতে নিজের এবং
প্রতিপক্ষের ক্ষমতা যাচাই করে লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি স্থির করেছেন। তাঁর নোটবইতে
কেলনার সাহেব নিজের চোখে দেখা ও শোনা প্রতিটি অপরাধ লিপীবদ্ধ করেছেন, তার
প্রামানিক খবরের কাগজের কাটিং সেঁটে রেখেছেন, আর কিছু ক্ষেত্রে, যে টুকু পেরেছেন,
প্রামানিক অন্য নথিপত্রও নোটবই তে রেখে দিয়েছেন। নিখুঁত পেশাদার কাজ। ধাপে ধাপে
সাজানো। আইনের দফতরের কর্মী বলে, আইনকানুন সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা ছিলো তাঁর। কোন
প্রমান গ্রাহ্য হবে, কোনটা হবেনা, নিশ্চিত ভাবেই জানতেন। ন্যুরেমবার্গের বিচার
হয়েছিলো নাৎসি মাথাদের। কিন্তু এমনটা মনে করা উচিত নয়, এনারাই সব। প্রতিটি মহল্লায়
, জনপদে অসংখ্য অপরাধ ঘটেছে। যুদ্ধ শেষের জার্মানিতে এই সব জল্লাদ শয়তানদের
খোঁজ-তল্লাস ও সাখ্যপ্রমান মোটেই সোজা ছিলো না। কেলনার সাহেব তাঁর সমস্ত প্রমান
সমেত নোটবইটি তুলে দেন আদালতের হাতে। বহু ঘাঘু নাৎসি শয়তানকে খুঁজে বের করে শাস্তি
দেওয়া সম্ভব হয়। এমনকি বহু বছর পরে ধরা পড়া কিছু নাৎসিকেও শাস্তি দেওয়া যায় এই
সাখ্যপ্রমান থেকে। ১৯৬৮ সালে এই নোটবই ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। অতি সম্প্রতি, ২০১১
সালে এই নোটবই, আস্ত একখানা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
অনেক দুরের দেশ জার্মানি।
তবু কেন জানি আজকে ফ্রিডরিষ কেলনার আর তাঁর এই বিরোধিতার কথা বড্ড মনে পড়ছে। শাষক
বহুগুনে শক্তিশালী, সামনাসামনি বিরোধিতা করতে যাওয়াতে বীরত্বের পরিচয় আছে, কিন্তু
ফল কতটা হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অযথা রক্তক্ষয় আর লাশের রাজনীতি কখনো কোন
দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল করতে পারে না। আজ, ৯ই ফেব্রুয়ারী ২০১৪ সাল, দুপুর বেলা লাখ
লাখ মানুষের সামনে বিমান বসু একটা খুব কাজের কথা বলেছেন। মমতা ব্যানার্জি কয়েক দিন
আগে বলেছিলেন, এলাকায় এলাকায় তালিকা তৈরি করতে। যাঁরা এখনো তৃনমূল কংগ্রেসের সঙ্গে
কাজ করছেন না, বা কাজের বিরোধীতা করছেন, তাঁদের নামের তালিকা। আজ দুপুরে,
মধ্যাহ্নের সূর্য্যকে আর সামনে হাজির লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ আর শ-খানেক টিভি
ক্যামেরাকে সাক্ষ্যী সামনে বিমান বসু বললেন – তালিকা এদিকেও তৈরি হচ্ছে, এবং কাজের
হিসেব রাখা হচ্ছে। যারা জনগনের শত্রু, যারা মা বোনের ইজ্জত লুটছে, যারা দিনের পর
দিন মনুষ্যত্বের অপমান করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, তাদের তালিকা। ক্ষমা করা হবে না
কাউকে। একজনকেও নয়। লেনিন বলেছিলেন – “A man in power is more powerful than a powerful man”। বামপন্থি
মানুষ দুর্বল , তাঁদের মনের জোর নেই, তাঁরা লড়তে জানেন না, এরকম কেউ বলছেনা। বা
বললেও আমরা শুনছি না। হঠকারী পদক্ষেপ নয়। চাই সংঘবদ্ধতার শক্তি। সাংগঠনিক শক্তি।
বিমান বসু যখন বললেন – আগামী দিনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে, লড়াইয়ের শপথ নিতে, আজকের
ব্রিগেডের লক্ষ লক্ষ গলা আকাশ কাঁপিয়ে সেই শপথ নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে গেলো। যারা
অবরোধ এড়িয়ে, হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে, হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে জেলার প্রত্যন্ত
অঞ্চল থেকে ছুটে এসেছে, তাদের ঘৃনা, প্রতিস্পর্ধা আর ক্রোধের হুঙ্কারে কেঁপে গেছে কেউ
কেউ। তাই পরে দেখেলাম টিভি তে কোন নেতা বলছেন দিশাহীন ব্রিগেড, কেউ বলছেন নীতিহীন
বাম। কিন্তু সবার চেয়ে সরল ভাষায় টিভি ক্যামেরার সামনে বলে গেলেন এক গ্রাম্য তরুন।
বললেন, তিনটে বিধায়ক গেছে, ওরা যাওয়াই ভালো। কিন্তু বামফ্রন্ট আমরা, এই সাধারন
মানুষ। আমরা আছি, থাকবো।
বিরোধিতা, আর প্রতিরোধ,
সেটা গাড়ির বনেটে নেচে, বা রাস্তায় বসে পড়ে হবে না। হবে মনের ভেতর , বুকের ভেতর,
আর হাতে হাত রেখে। কোন রকম বড় প্রচার, ফেস্টুন ব্যানার আর দামি ফ্লেক্স ছাড়াই আজ
সাধারন মানুষ যে বিরোধিতা দেখালেন, তাকে সেলাম জানাই। আর হ্যাঁ, তালিকা প্রস্তুত
করবো। আজ থেকে। শক্তিশালী শাষকের সঙ্গে রাস্তায় নেমে লড়াই নয়। তার বন্দুকের গুলি
খেয়ে অকালে ঝরে যাওয়া নয়। বরং সংঘবদ্ধ হওয়া, আর নিরবে মনের ভেতরে প্রতিরোধ গড়ে
তোলা। আজ বাদে কাল আমাদের দিন আসবেই। নেতারা নয়, সাধারন মানুষের বামফ্রন্ট। আজকের
ব্রিগেড সেকথাই প্রমান করে গেলো। আগামী কাল, বামফ্রন্টের বিজয় সমাবেশে এই মানুষ
গুলোই আসবেন। ততদিন, তালিকা তৈরি রাখুন। কেউ যেন বাদ না পড়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন