বেজায় পেট গরম। AC চালিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির।।কাল আবার ডার্বি। ..আবার হার?| টেবিলের উপর রুমালটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল ``মাচা !'' কি আপদ! রুমালটা মাচা মাচা করে কেন?
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টক্টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
আমি বললাম, ``কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।''
অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, ``মুশকিল অবার কি? ছিল একটা পোকা , হয়ে গেল দিব্যি একটা মাছ । এ তো হামেশাই হচ্ছে।''
আমি খানিক ভেবে বললাম, ``তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের বেড়াল নও, আসলে তুমি হচ্ছ রুমাল।''
বেড়াল বলল, ``বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, অবনমন ও বলতে পার।'' আমি বললাম, ``অবনমন কেন?''
শুনে বেড়ালটা ``তাও জানো না?'' বলে এক চোখ বুজে ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ অবনমন এর কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ``ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।''
বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, ``হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে--- অবনমন এর মা , বেড়ালের চন্দ্রবিন্দু, রুমালের চা --- হল মাঁচা । কেমন, হল তো?''
আমি বললাম, ``চন্দ্রবিন্দু কেন?' বেড়ালটা আবার হাসলো -- "এটাও বুঝতে পারছ না ভায়া?"
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে বেড়ালটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত্ বলে উঠল, ``গরম লাগে তো সেকেন্ড ডিভিশন এও তো খেলতে পারো।''
আমি বললাম, ``বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর সেটা করা যায় না?''
বেড়াল বলল, ``কেন, সে আর মুশকিল কি?''
আমি বললাম, `পাবলিক এর ভয় , সমর্থকেরা কি বলবে? তুমি কোনো উপায় জানো? তাহলে বাতলে দাও ''
বেড়াল একগাল হেসে বলল, ``তা আর জানি নে? কলকাতা , ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, তারপর শীর্ষাসন , কঠিন অনুশীলন , no ফাকিবাজি। মাঝে মাঝে প্রাণায়াম ও করতে পারো তো , খুব কাজের জিনিস ।''
আমি বললাম 'প্রাণায়াম করলেই জিতে যাবো?'
বেড়াল রেগে গিয়ে বলল 'সেটা আমি কখন বললাম ।ওটা করলে ধৈর্য বাড়বে । হার টাকে sportingly মেনে নিতে পারবে '
আমি বললাম, ``'তা হলে দায়িত্ব টা তুমি নিতে পার?''
শুনে বেড়ালটা হঠাত্কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, ``উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।''
আমি বললাম, ``গেছোদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?''
বেড়াল বলল, ``গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? Austrelia''
আমি বললাম, ``কোথায় গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়?''
বেড়াল খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``কিরকম?''
বেড়াল বলল, ``সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি গাঁজার ঠেকে। যদি মতিহারি যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর দুগ্গা পুজোর ভাসানে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবজার ছট পুজো কমিটির মিটিং attend করতে । কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?''
বেড়াল বলল, ``সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে---''
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ``সে কিরকম হিসেব?''
বেড়াল বলল, ``সে ভারি শক্ত। জ্যামিতি ছিল ছোটোবেলায়?'' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর গেছোদাদা ।'' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর তুমি,'' বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তার পর হঠাত্ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর চন্দ্রবিন্দু।'' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, ``এই মনে কর তিব্বত---'' ``এই মনে কর গেছোবৌদি ইলিশ রান্না করছে---'' ``এই মনে কর গাছের গায়ে একটা ফুটো---ইলিশ ভাপা ,ইলিশ পাতুরি, দৈ ইলিশ ... ''
এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, ``দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না .... ক্ষিদে পাচ্ছে''
বেড়াল বলল, ``ও আচ্ছা, তোমার তো আবার পেট গরম ..ইলিশ হজম হবে না ।'' আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, বেড়ালের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাত্ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি বেড়ালটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করে হাসছে।
কি আর করি, ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে বসলাম । বসতেই কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, ``লাস্ট কবে বড় ট্রফি হাতে নিয়েছ খোকা ?''
আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, ``কই জবাব দিচ্ছ না যে? শেষ কবে জিতেছ?'' তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা দাঁড়কাক শ্লেট পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখছে, আর এক-একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি বললাম, ``২০১২ ''
কাকটা অমনি দুলে-দুলে মাথা নেড়ে বলল, ``হয় নি, হয় নি, ফেল্।''
আমার ভয়ানক রাগ হল। বললাম, ``নিশ্চয় হয়েছে। ২০১২ কলকাতা ফুটবল লীগ।''
কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল। তার পর বলল, ``দু হাজার বারোর নামে হরিবল , হাতে রইল কাচকলা , ঘন্টার মাথা !''
আমি বললাম, ``তবে যে বলছিলে ২০১২ তে পাই নি ? এখন কেন?''
কাক বলল, ``কাচকলা কোনো ট্রফির নাম নয় । তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো ট্রফি হয় নি। ওটা ছিল, রানার্স ট্রফি । আমি যদি ঠিক সময় বুঝে ধরে না ফেলতাম, তা হলে এতক্ষণে ওটাকেই বড় ট্রফি বলে চালিয়ে দিতে ।''
আমি বললাম, ``এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনি নি। ট্রফি মানে ট্রফি , তা সে বড় হোক ছোটো হোক অথবা পুচকে । তা সে পাড়ার খেলা হলেও ট্রফি আবার স্বান্তনা পুরস্কার হলেও ।''
কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, ``তোমাদের ক্লাবে winners ট্রফির কোনো দাম নেই বুঝি?''
আমি বললাম, ``winners ট্রফি!! সেটা কিরকম?''
কাক বলল, ``পাসের ক্লাবে কদিন থাকতে, তা হলে বুঝতে।ওদের তো ট্রফি রাখার আর জায়গাই নেই ।প্রতি বছর এত্তগুলো করে । এই তো কদিন খেটেখুটে খানিকটে সময় জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল।'' বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।
এমন সময়ে হঠাত্গাছের একটা ফোকর থেকে কি যেন একটা সুড়ুত্ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল। চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ রঙের দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো তাতে কলকে-টলকে কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক। টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন কি-সব লিখেছে।
বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে হুঁকোতে দু-এক টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ``কই হিসেবটা হল?কবে শেষ বার ট্রফি পেয়েছিল''
কাক খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, এই হল বলে।''
বুড়ো বলল, ``কি আশ্চর্য! উনিশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো হিসেবটা হয়ে উঠল না?''
কাক দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে পেনসিল চুষল তার পর জিজ্ঞাসা করল, ``কতদিন বললে উনিশ ?তা সে লাগবে না সে কি আজকের কথা -- stone age ছিল তখন ''
কাক অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, ``লাগ্ লাগ্ লাগ্ দু হাজার বারো ।''
বুড়ো বলল, ``এগারো ।'' কাক বলল, ``দশ ।'' বুড়ো বলল, ``নয় ।'' ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।
ডাকতে-ডাকতে কাকটা হঠাত্ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ``তুমি ডাকছ না যে?''
আমি বললাম, ``খামকা ডাকতে যাব কেন? আমি তো জানি ২০০৯ সুপার কাপ ''
বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাত্আমার আওয়াজ শুনেই সে বন্বন্ করে আট দশ পাক ঘুরে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
তার পরে হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, ``I League (ন্যাশনাল ফুটবল League) এ ১৩-১০ ,ফেডারেশন কাপে ৮-৫,Calcutta ফুটবল লীগ এ ৪৮-৪৩ , I.F.A. শিল্ড এ ২০-৭,ডুরান্ড কাপে ৮-৬, রোভার্স কাপে ৪-৪, এয়ারলাইন্স ট্রফি তে ৭-১ -- আর পারছি না আমি হিসেব করতে ।সর্ব সাকুল্যে ১১৫-৮৫।''
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, ``এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি ইলতুতমিস? নিশ্চই রেফারির কারসাজি । ব্যাটাদের বিশ্বাস নেই ''
বুড়ো বলল, ``বিশ্বাস না হয়, wikipedia দেখ।''
দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায়।
তার পর বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, ``ওজন কত?''
আমি বললাম, ``জানি না!''
বুড়ো তার দুটো আঙুল দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে-টিপে বলল, `থাক অনেক হয়েছে ওটা সবাই জানে।২-৩ তো হবেই চোখ বুজে `।''
আমি বললাম, ``সেকি, পটল টার ওজনই তো একুশ সের, সে আমার চাইতে দেড় বছরের ছোটো।''
কাকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ``সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।''
বুড়ো বলল, ``তা হলে লিখে নাও--- ওজন আড়াই সের, বয়েস একশ চব্বিশ।''
আমি বললাম, ``দূত্!আমার বয়স হল আট বছর তিনমাস, বলে কিনা একশ চব্বিশ।''
বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ``বাড়তি না কমতি?'' কাক মাথা নিচু করে বলল , 'পড়তি । আবার ঝরতি ও বলতে পারো।'
আমি বললাম, ``সে আবার কি?''
বুড়ো বলল, ``বলি বয়েসটা এখন বাড়ছে না কমছে?''
আমি বললাম, ``বয়েস আবার কমবে কি? তবে লাস্ট ৫-৬ বছর ধরে কোনো হিসেব কাজ করছে না''
বুড়ো বলল, ``তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি! কোনদিন দেখব বয়েস বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি বছর পার হয়ে গেছে। শেষটায় ঝাপি বন্ধ হয়ে যায় আর কি ! যা দিন কাল লোকের ক্ষোভ ক্রমশ যে হারে বাড়ছে নতুন ফর্মুলা আবিস্কার না হয়ে যায় আবার ।আর ওদের ই বা দোষ কিসের এইটুকু আপদার তো থাকতেই পারে ।কষ্ট হয় দেখলে ''
আমি বললাম, ``তা তো হবেই। আশি বছর বয়েস হলে মানুষ বুড়ো হবে না!''
বুড়ো বলল, ``তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি বছর বয়েস হবে কেন? সেবার তো অবনমন ছিল, এক কম হবে''।.ঠিক কি না ?. শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেলো।
কাক বলল, ``তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্পট্ সেরে নি।
(সুকুমার রায়ের আশ্রয় নিলাম)
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টক্টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
আমি বললাম, ``কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।''
অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, ``মুশকিল অবার কি? ছিল একটা পোকা , হয়ে গেল দিব্যি একটা মাছ । এ তো হামেশাই হচ্ছে।''
আমি খানিক ভেবে বললাম, ``তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের বেড়াল নও, আসলে তুমি হচ্ছ রুমাল।''
বেড়াল বলল, ``বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, অবনমন ও বলতে পার।'' আমি বললাম, ``অবনমন কেন?''
শুনে বেড়ালটা ``তাও জানো না?'' বলে এক চোখ বুজে ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ অবনমন এর কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ``ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।''
বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, ``হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে--- অবনমন এর মা , বেড়ালের চন্দ্রবিন্দু, রুমালের চা --- হল মাঁচা । কেমন, হল তো?''
আমি বললাম, ``চন্দ্রবিন্দু কেন?' বেড়ালটা আবার হাসলো -- "এটাও বুঝতে পারছ না ভায়া?"
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে বেড়ালটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত্ বলে উঠল, ``গরম লাগে তো সেকেন্ড ডিভিশন এও তো খেলতে পারো।''
আমি বললাম, ``বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর সেটা করা যায় না?''
বেড়াল বলল, ``কেন, সে আর মুশকিল কি?''
আমি বললাম, `পাবলিক এর ভয় , সমর্থকেরা কি বলবে? তুমি কোনো উপায় জানো? তাহলে বাতলে দাও ''
বেড়াল একগাল হেসে বলল, ``তা আর জানি নে? কলকাতা , ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, তারপর শীর্ষাসন , কঠিন অনুশীলন , no ফাকিবাজি। মাঝে মাঝে প্রাণায়াম ও করতে পারো তো , খুব কাজের জিনিস ।''
আমি বললাম 'প্রাণায়াম করলেই জিতে যাবো?'
বেড়াল রেগে গিয়ে বলল 'সেটা আমি কখন বললাম ।ওটা করলে ধৈর্য বাড়বে । হার টাকে sportingly মেনে নিতে পারবে '
আমি বললাম, ``'তা হলে দায়িত্ব টা তুমি নিতে পার?''
শুনে বেড়ালটা হঠাত্কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, ``উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।''
আমি বললাম, ``গেছোদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?''
বেড়াল বলল, ``গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? Austrelia''
আমি বললাম, ``কোথায় গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়?''
বেড়াল খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``কিরকম?''
বেড়াল বলল, ``সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি গাঁজার ঠেকে। যদি মতিহারি যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর দুগ্গা পুজোর ভাসানে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবজার ছট পুজো কমিটির মিটিং attend করতে । কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?''
বেড়াল বলল, ``সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে---''
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ``সে কিরকম হিসেব?''
বেড়াল বলল, ``সে ভারি শক্ত। জ্যামিতি ছিল ছোটোবেলায়?'' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর গেছোদাদা ।'' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর তুমি,'' বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তার পর হঠাত্ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর চন্দ্রবিন্দু।'' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, ``এই মনে কর তিব্বত---'' ``এই মনে কর গেছোবৌদি ইলিশ রান্না করছে---'' ``এই মনে কর গাছের গায়ে একটা ফুটো---ইলিশ ভাপা ,ইলিশ পাতুরি, দৈ ইলিশ ... ''
এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, ``দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না .... ক্ষিদে পাচ্ছে''
বেড়াল বলল, ``ও আচ্ছা, তোমার তো আবার পেট গরম ..ইলিশ হজম হবে না ।'' আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, বেড়ালের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাত্ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি বেড়ালটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করে হাসছে।
কি আর করি, ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে বসলাম । বসতেই কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, ``লাস্ট কবে বড় ট্রফি হাতে নিয়েছ খোকা ?''
আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, ``কই জবাব দিচ্ছ না যে? শেষ কবে জিতেছ?'' তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা দাঁড়কাক শ্লেট পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখছে, আর এক-একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি বললাম, ``২০১২ ''
কাকটা অমনি দুলে-দুলে মাথা নেড়ে বলল, ``হয় নি, হয় নি, ফেল্।''
আমার ভয়ানক রাগ হল। বললাম, ``নিশ্চয় হয়েছে। ২০১২ কলকাতা ফুটবল লীগ।''
কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল। তার পর বলল, ``দু হাজার বারোর নামে হরিবল , হাতে রইল কাচকলা , ঘন্টার মাথা !''
আমি বললাম, ``তবে যে বলছিলে ২০১২ তে পাই নি ? এখন কেন?''
কাক বলল, ``কাচকলা কোনো ট্রফির নাম নয় । তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো ট্রফি হয় নি। ওটা ছিল, রানার্স ট্রফি । আমি যদি ঠিক সময় বুঝে ধরে না ফেলতাম, তা হলে এতক্ষণে ওটাকেই বড় ট্রফি বলে চালিয়ে দিতে ।''
আমি বললাম, ``এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনি নি। ট্রফি মানে ট্রফি , তা সে বড় হোক ছোটো হোক অথবা পুচকে । তা সে পাড়ার খেলা হলেও ট্রফি আবার স্বান্তনা পুরস্কার হলেও ।''
কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, ``তোমাদের ক্লাবে winners ট্রফির কোনো দাম নেই বুঝি?''
আমি বললাম, ``winners ট্রফি!! সেটা কিরকম?''
কাক বলল, ``পাসের ক্লাবে কদিন থাকতে, তা হলে বুঝতে।ওদের তো ট্রফি রাখার আর জায়গাই নেই ।প্রতি বছর এত্তগুলো করে । এই তো কদিন খেটেখুটে খানিকটে সময় জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল।'' বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।
এমন সময়ে হঠাত্গাছের একটা ফোকর থেকে কি যেন একটা সুড়ুত্ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল। চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ রঙের দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো তাতে কলকে-টলকে কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক। টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন কি-সব লিখেছে।
বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে হুঁকোতে দু-এক টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ``কই হিসেবটা হল?কবে শেষ বার ট্রফি পেয়েছিল''
কাক খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, এই হল বলে।''
বুড়ো বলল, ``কি আশ্চর্য! উনিশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো হিসেবটা হয়ে উঠল না?''
কাক দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে পেনসিল চুষল তার পর জিজ্ঞাসা করল, ``কতদিন বললে উনিশ ?তা সে লাগবে না সে কি আজকের কথা -- stone age ছিল তখন ''
কাক অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, ``লাগ্ লাগ্ লাগ্ দু হাজার বারো ।''
বুড়ো বলল, ``এগারো ।'' কাক বলল, ``দশ ।'' বুড়ো বলল, ``নয় ।'' ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।
ডাকতে-ডাকতে কাকটা হঠাত্ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ``তুমি ডাকছ না যে?''
আমি বললাম, ``খামকা ডাকতে যাব কেন? আমি তো জানি ২০০৯ সুপার কাপ ''
বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাত্আমার আওয়াজ শুনেই সে বন্বন্ করে আট দশ পাক ঘুরে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
তার পরে হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, ``I League (ন্যাশনাল ফুটবল League) এ ১৩-১০ ,ফেডারেশন কাপে ৮-৫,Calcutta ফুটবল লীগ এ ৪৮-৪৩ , I.F.A. শিল্ড এ ২০-৭,ডুরান্ড কাপে ৮-৬, রোভার্স কাপে ৪-৪, এয়ারলাইন্স ট্রফি তে ৭-১ -- আর পারছি না আমি হিসেব করতে ।সর্ব সাকুল্যে ১১৫-৮৫।''
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, ``এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি ইলতুতমিস? নিশ্চই রেফারির কারসাজি । ব্যাটাদের বিশ্বাস নেই ''
বুড়ো বলল, ``বিশ্বাস না হয়, wikipedia দেখ।''
দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায়।
তার পর বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, ``ওজন কত?''
আমি বললাম, ``জানি না!''
বুড়ো তার দুটো আঙুল দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে-টিপে বলল, `থাক অনেক হয়েছে ওটা সবাই জানে।২-৩ তো হবেই চোখ বুজে `।''
আমি বললাম, ``সেকি, পটল টার ওজনই তো একুশ সের, সে আমার চাইতে দেড় বছরের ছোটো।''
কাকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ``সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।''
বুড়ো বলল, ``তা হলে লিখে নাও--- ওজন আড়াই সের, বয়েস একশ চব্বিশ।''
আমি বললাম, ``দূত্!আমার বয়স হল আট বছর তিনমাস, বলে কিনা একশ চব্বিশ।''
বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ``বাড়তি না কমতি?'' কাক মাথা নিচু করে বলল , 'পড়তি । আবার ঝরতি ও বলতে পারো।'
আমি বললাম, ``সে আবার কি?''
বুড়ো বলল, ``বলি বয়েসটা এখন বাড়ছে না কমছে?''
আমি বললাম, ``বয়েস আবার কমবে কি? তবে লাস্ট ৫-৬ বছর ধরে কোনো হিসেব কাজ করছে না''
বুড়ো বলল, ``তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি! কোনদিন দেখব বয়েস বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি বছর পার হয়ে গেছে। শেষটায় ঝাপি বন্ধ হয়ে যায় আর কি ! যা দিন কাল লোকের ক্ষোভ ক্রমশ যে হারে বাড়ছে নতুন ফর্মুলা আবিস্কার না হয়ে যায় আবার ।আর ওদের ই বা দোষ কিসের এইটুকু আপদার তো থাকতেই পারে ।কষ্ট হয় দেখলে ''
আমি বললাম, ``তা তো হবেই। আশি বছর বয়েস হলে মানুষ বুড়ো হবে না!''
বুড়ো বলল, ``তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি বছর বয়েস হবে কেন? সেবার তো অবনমন ছিল, এক কম হবে''।.ঠিক কি না ?. শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেলো।
কাক বলল, ``তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্পট্ সেরে নি।
(সুকুমার রায়ের আশ্রয় নিলাম)
গেছো দাদা ক
উত্তরমুছুন