রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

অঙ্ক আর বিপ্লবের ডুয়েল ~ শুভময় মৈত্র


[যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেই নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা এবং লেখা বারবার ফিরে আসে ভাবনায়। যখনই সেখানে কোন অকাজে যাই, সেসব কেজোকথার শেষে বেরোতে বেরোতে সন্ধে। চারপাশে ঝকঝকে পড়ুয়াদের কলতান, পাখির কিচিরমিচির, একটু দূর থেকে ভেসে আসা বাসের হর্নের মধ্যে হঠাৎ করে সময়যানে ফিরতে হয় সাড়ে তিন দশক। অনেক কিছুর মতই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এরকম এক পুরনো লেখা, যা হয়তো দু-এক জায়গায় ছাপা হয়েছে আগে, তবে সেভাবে পেশাদারী কোন কাগজে নয়। তাই আর কারও কোন অনুমতি না নিয়েই আপনাদের সামনে আর একবার টুকেই দিলাম পুরনো সেই তথ্য আর কল্পনার মিশেল, দু এক জায়গায় অল্প এদিক ওদিক করে। গবেষণার ক্ষেত্রে হলে নিশ্চিত চাকরি যেত, ওই যাকে বলে কিনা সেল্ফ প্লেজিয়ারিজম। সেকথা থাক। আগে পড়েছেন সে সম্ভাবনা খুবই কম। আর পড়ে থাকলে তো এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েই গেলেন। লেখাটি আমাদের এক অতিপ্রিয় অঙ্কের মাস্টারমশাই অধ্যাপক তরুণ কুমার মুখার্জীর স্মৃতিতে, সংক্ষেপে যিনি পরিচিত ছিলেন টিকেএম নামে। বহু বছর আগে যখন এই লেখাটা প্রথম লিখি, তখন তিনি সকলের মধ্যেই ছিলেন। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এ বছরের জুলাই মাসে যখন নতুন করে এই লেখাটি খুঁজে পেতে রিভাইজ করছি, ঠিক তার কদিন আগেই ফ্রান্সের নির্বাচনে তৃতীয় থেকে একলাফে প্রথম স্থানে চলে এসেছে বামপন্থীরা। এই লেখার প্রেক্ষিত সেই ফ্রান্সকে নিয়েই, তবে দু-আড়াই শতক আগে।]  

ছিপছিপে লম্বা চেহারার তরুণ-বাবু হেঁটে যাচ্ছেন লাল চেয়ারের পাশ দিয়ে। শিরদাঁড়া সোজা, কাঁধে ঝোলান একটা সপ্তর্ষিমন্ডল আকারের আঁকড়া দেওয়া কাঠের ছাতা। এইট-বি বাস-স্ট্যান্ড এর দিক থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে একটু বাঁ দিকে গেলে ছাত্র সংসদের অফিস। রাজ্যে বহু রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও অতি বামদের দাপট এই কচি সংসদে কখনও কমে নি। সেখান থেকে সোজা হাঁটলে ডান দিকে খেলার মাঠ আর বাঁদিকে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লাল চেয়ার। থুড়ি জায়গাটা আছে, কিন্তু সিমেন্টে বাঁধানো সেই প্লাস্টিকের চেয়ার গুলো আর নেই। সময়টা আশির দশকের শেষ ভাগ, সেপ্টেম্বর মাস প্রায় ফুরিয়ে এসেছে - কলকাতায় পুজোর গন্ধ। স্যার অঙ্কের ক্লাস শেষ করে ফিরছেন। তাঁর হাঁটার গতির সঙ্গে তাল সামলাতে ছাত্রদের রীতিমত ছুটতে হচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁকে ধরে ফেলল প্রণব। সঙ্গে আমরা আরও অনেকে। যাদবপুরের ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্ররা। কি দুর্ভাগ্য যে প্রযুক্তি বা বিজ্ঞান যাই পড়ো না কেন, অঙ্কের হাত থেকে নিস্তার নেই। ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দিয়েছেন তরুণবাবু। আমাদের মত পরীক্ষায় নিয়মিত গাড্ডু খাওয়া ছেলেদের ধান্দা কি করে দু-এক নম্বর বাড়ানো যায়। "স্যার, এখানটা কেন কেটেছেন? আর একটু নম্বর কি এখানে বাড়ত না? আর এক নম্বর বাড়লেই আমার চল্লিশ হয়ে যেত", ইত্যাদি ইত্যাদি। তরুণবাবু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কারো নম্বর বাড়িয়ে দিচ্ছেন, কাউকে বা একটা ছোট্ট ধমক। উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া প্রণবের বক্তব্য অবশ্য অন্য। সে পুরো নম্বর পেয়েছে। কিন্তু তার একটা অঙ্কে সামান্য ভুল আছে, সেখানে স্যার নম্বর কাটেন নি। সে তাই নম্বর কমাতে ছুটেছে। প্রণবের দাবী শুনে চোখ কুঁচকে তাকালেন তরুণবাবু। "বুঝলে হে ছোকরা, অঙ্কের কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেটা বোঝার মত বয়স তোমার এখনো হয় নি। যোগ বিয়োগে ভুল হলেই নম্বর কাটা যায় না। ঠিকঠাক বুঝেছ কিনা সেটা দেখতে হয়। তুমি ভেবো না যে আমি মন দিয়ে খাতা দেখি নি। তোমার ভুলটা কোন ভুল-ই নয়। এ বয়েসে মানুষ তো কতরকমের ভুল-ই করে। কিন্তু কোন এক মে মাসের শেষ দিনে তোমাদের বয়সী একটা ছেলে যা ভুল করেছিল সে কথা ভাবলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।"





আমাদের চোখ চকচক করে উঠল। তার মানে গল্প আছে। আমাদের বয়সী, অর্থাৎ ঊনিশ-কুড়ি। স্যারের গৌরচন্দ্রিকা মানে তো অঙ্কের কোন এক মস্তান লোকের জীবন নিয়ে জমজমাট আলোচনার সূত্রপাত। কিন্তু এত অল্প বয়েসের কে সেই লোক যার ভুল কিনা স্যারের মন খিঁচড়ে দেয়? সে আবার কি গোলমাল পাকাল? স্যারের গল্প কত বছর আগের কে জানে! ঘটনা সুদূর অতীতে যাই হোক না কেন, ঘটমান বর্তমানে আলগা ঘামে ভেজা বিকেলটা যে অসাধারণ কাটতে চলেছে সেটার একটা ক্ষীণ আভাস পাওয়া গেল। ততক্ষণে আমরা লাইব্রেরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ডানদিকে ঘুরেই বউদির ক্যান্টিন। স্যারের পয়সায় হাতে গরম ফিসফ্রাই, বিকেলের শেষ রোদ্দুর আর তার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হেঁটে বেড়াবে অঙ্ক আর ইতিহাস। ফাটা প্লাস্টিকের টেবিলের পাশে গোল করে রাখা চার পাঁচটা চেয়ার। স্যারকে ঘিরে আমরা বসে পড়লাম। প্রণব, সুমিত, অরিন্দম, দেবজ্যোতি আর আমি। অঙ্কের নম্বরের নিরিখে বেশি থেকে কম, একশো থেকে আঠেরো।

"সে ছোকরা জন্মেছিল ১৮১১ সালের ২৫শে অক্টোবর। প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলীতে বর‍্যো-লা-রেইন নামের একটা ছোট্ট জায়গায়। ১৭৯২ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় এই জায়গার নাম বদলে রাখা হয়েছিল বর‍্যো-লা-এগালিতে, অর্থাৎ সমতার কথা ঢুকে গেছিল নামের মধ্যে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হল, তবে সে ইতিহাস গত হলে পুরনো নামটা আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৮১২ তে। নাহ, অনেকক্ষণ তোদের ঝুলিয়ে রেখেছি। সে সময়ের গোটা প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এবার বলেই ফেলা যাক, লোকটার নাম এভারিস্তে গ্যালোয়া। শুনেছিস কেউ?" তুমি থেকে ততক্ষণে আমরা তুই হয়ে গেছি। ফলে বোঝা গেল যে স্যারের মেজাজ দারুণ ফুরফুরে। তার মানে গল্প জমবে এবং কিছুক্ষণ পরে আর একবার চা সিঙ্গারার সম্ভাবনা প্রবল। বাংলা বানানে 'ণ'/'ন' না জানলে আমরা যেমনভাবে মাঝামাঝি লিখি সেরকম একটা মুখের ভাব করছিলাম। কিন্তু প্রণব এখানেও একশো। "হ্যাঁ স্যার জানি। অঙ্কের যাদুকর, মৃত্যু ডুয়েল লড়তে গিয়ে। ৩১শে মে, ১৮৩২, মাত্র ২০ বছর বয়েসে। ইতিহাসে কিছু বিতর্ক আছে, কিন্তু এরকম শোনা যায় যে মৃত্যুর আগের রাতে সে শেষ করে যায় এক অসাধারণ গবেষণা, যেটা গণিতজ্ঞদের মধ্যে গ্যালোয়া ফিল্ড নামে প্রসিদ্ধ।"

— "তাহলে তোরা সবই জানিস। কালকে ক্লাসে ওটাই পড়াব।" স্যার প্রায় উঠে পড়লেন। "না না স্যার, কিচ্ছু জানি না, সত্যি বলছি।"  হৈ হৈ করে আমরা লাফিয়ে উঠলাম। আমাদের দৃষ্টির আগুনে দুর্দান্ত ফরসা প্রণব ততক্ষণে ম্লানমুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজছে। বারো ক্লাসে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এক নম্বরে থেকে শান্তি হয় নি, সঙ্গে কোথাকার কোন ফরাসী গণিতজ্ঞ, সে ব্যাটাকেও গুলে খেয়েছে। আর তার জন্যে কিনা জমজমাট একটা ধারাবিবরণীর সঙ্গে চা সিঙ্গারা ফসকে যেতে বসেছে। যাদবপুরের বিশাল খেলার মাঠের দিক থেকে পথ খুঁজে নেওয়া টুকরো হাওয়া, ঝিল পেরিয়ে পাঁচিলের ওপারে রেল লাইন থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসা ট্রেনের ঘটঘট, সঙ্গে প্যারিসের রাস্তায় মনে মনে হেঁটে বেড়ানো, এতো কিছু একসঙ্গে দফারফা হয়ে যাওয়ার যোগাড়। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন, পাশে প্রণব-ও। প্রণবের কাঁধে হাত রাখলেন স্যার। "তোর হবে। যা চা বলে আয়।" সমান লম্বা দুজন মানুষ। একই রকম ছিপছিপে চেহারা। একজন প্রায় ষাট, অন্যজন তার তিন ভাগের এক ভাগ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমরা। আমার অঙ্কে আঠেরো পাওয়া ভাঙ্গা মন ততক্ষণে দুঃখ ভুলে প্যারিসের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যেন-এর ঘোলা জলে ছলাত-ছল। (এবার অলিম্পিকে যার ওপর শোভাযাত্রা সহকারে উদ্বোধন, অর্থাৎ যখন এই লেখা রিভাইজ করছি সেই সময়।) অঙ্কে গোল পেলে কি হবে, ভূগোলে আমাকে হারায় কে? আমি তো ইতিমধ্যে হাঁটা লাগিয়েছি প্যারিসের পোড়া ইঁট সাজানো সরু গলিপথে।

— "গ্যালোয়ার বাবা উদারপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অষ্টাদশ লুই যখন ১৮১৪ সালে ক্ষমতায় ফিরে এলেন তখন তিনি গ্রামের মোড়লও হয়েছিলেন। গ্যালোয়ার মা ছিলেন জজের মেয়ে। ছোটবেলায় ছেলের পড়াশোনা তাঁকেই দেখতে হতো, স্বামী মোড়ল হলে যা হয় আর কি। ঠিক বারো বছরে ইশকুলে ঢোকে গ্যালোয়া। বছর-দুই ল্যাটিন আর পুরনো সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ভালই চলছিল, কিন্তু এর মধ্যেই অঙ্কের নেশা তাকে পেয়ে বসে। হাতের কাছে পেয়ে যায় আর এক ফরাসী গণিতজ্ঞ অ্যাড্রিয়েন-মেরী লেজেন্ডার-এর (১৮ সেপ্টেম্বর ১৭৫২ — ১০ জানুয়ারী ১৮৩৩) লেখা জ্যামিতির বই। তোরা যেমন করে ফেলুদা পড়িস, সেই গতিতে জ্যামিতির ঐ কঠিন বই এক নিঃশ্বাসে নামিয়ে দিয়েছিল বাচ্ছা ছেলেটা। বছর পনেরো পেরতে না পেরতেই আর এক ফরাসী দিকপাল জোসেফ-লুই ল্যাগ্রাঞ্জের (২৫ জানুয়ারী ১৭৩৬ — ১০ এপ্রিল ১৮১৩) গবেষণার কাজকর্মও হজম করে ফেলেছিল সে।" চায়ে বেশ জোরে একটা চুমুক দিলেন তরুণ-বাবু। স্যারের কথার ফাঁকে অঙ্কের এইসব প্লাতিনি জিদান-দের চেনা নাম শুনে প্রণব মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পাশেই সদা সতর্ক সুমিত। কখনো কাঁধ চেপে ধরে, কখনো চিমটি কেটে রুখে যাচ্ছে তাকে। নব্বুই-এর দশকের গোড়ায় ইন্টারনেট ছিল না। ফলে আমাদের কাছে আজকালকার পড়ুয়াদের তুলনায় খবর থাকত অনেক কম। তার ওপর লেজেন্ডার সিম্বল কিম্বা ল্যাগ্রাঞ্জের ইন্টারপোলেশন আমাদের মত ফাঁকিবাজদের সঙ্গে যোগাযোগ করত শুধু পরীক্ষার আগের রাতে। তাই এই নামগুলো স্যারের বর্ণণা থেকে আমার কাছে ভেসে আসছিল আবছা আবিল্যির মত।

— "তোরা যেমন বাবার পয়সায় কোচিং এ পড়ে বারো ক্লাসের পর একবারে যাদবপুরে ঢুকে গেছিস, গ্যালোয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ হয় নি। সেই সময় ফ্রান্সে অঙ্ক শেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল ইকোলে পলিটেকনিক। ইন্টারভিউ-এ ভাল না করায় সে বেচারি সেখানে সুযোগ পেল না। তার বদলে পড়তে হল ইকোলে প্রিপারেটরিতে, যেটা কিনা সেই সময় অনেক কমা একটা জায়গা। তবে এটা মাথায় রাখিস যে সেই জায়গার নাম এখন ইকোলে নরমালে, আজকের দিনে বেশ নামজাদা। এখানকার মাস্টারদের সঙ্গে গ্যালোয়ার দহরম মহরম বেশ ভালই ছিল। ১৮২৮-এ এখানে ভর্তি হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ভগ্নাংশের ওপর একটা বেশ ভালো কাজও করেছিল গ্যালোয়া। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্য পলিনোমিয়াল ইকুয়েশন, আর সে সমস্ত অঙ্কও এর মধ্যে শুরু করে দিয়েছিল সে। তার বয়েসটা ভাব একবার। তখন মাত্র আঠারো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, অঙ্কের খাতায় তুই আজকে যে নম্বর পেয়েছিস সেটাই।" আমার দিকে কটমট করে তাকালেন স্যার। "পরের পরীক্ষায় সামলে নেব ঠিক।" মিনমিন করে বললাম আমি। এর বেশি আর কি-ই বা বলতে পারি? চোখের সামনে তখন সিনেমার মত চলে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল গম্বুজ দিয়ে বানানো প্যারিসের এক ইউনিভার্সিটি। ছাইরঙা ইটের রাস্তা শেষ হয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, দুপাশে ফোয়ারা আর সাজানো ফুলগাছের সারি। সেখানে ঢুকে অনেকটা গাড়িবারান্দার মত বিশাল জায়গা আর তার দুপাশে উঁচু উঁচু ক্লাসঘর, জানলার কাঁচগুলো রামধনুর রঙে রাঙানো। আমাদের তরুণবাবুর মতই পড়াচ্ছেন এক ফরাসী অধ্যাপক। গায়ে বকলস লাগান সাদা জামা, পরনে কালো প্যান্ট। আমার চারপাশে বিভিন্ন ডেস্কে বসে ঝলমলে চেহারার সব রাজপুত্তুর রাজকন্যেরা। সামনে বড় বড় তিনটে বোর্ডে একটানা লিখে যাচ্ছেন অধ্যাপক, মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। পেন্ডুলামের মত দুলে উঠছে লালচে চুলে মুক্তোর হার ঢেকে যাওয়া ফরাসী রাজকন্যেদের ঘাড়। রাজপুত্রেরা প্রায় স্থির। তাদের চোখ কখনো বোর্ডের দিকে, কখনো বা নিজেদের বাঁধানো খাতায়।

— "এর মধ্যে গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে বিভিন্ন গোলমালে জড়িয়ে পড়ে ১৮২৯ সালে আত্মহত্যা করে বসেন গ্যালোয়ার বাবা। সেই সব ঝামেলার মধ্যে তার কদিন পরেই আবার ইকোলে পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে গ্যালোয়া। কিন্তু ভাগ্যদেবী এবারেও সহায়তা করলেন না। গ্যালোয়া তার নিজের গবেষণার কাজ যেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল সেটা মানতে পারলেন না পরীক্ষকেরা। সেই বছরের একদম শেষের দিকে ইকোলে প্রিপারেটরিতে থেকেই ডিগ্রি পেল সে। যদিও সে পরীক্ষাতেও নাকি গ্যালোয়ার সমস্ত ব্যাখ্যা বুঝতে পারেন নি পরীক্ষকেরা। এর মধ্যে গবেষণা অবশ্য থেমে থাকে নি। দুর্ভাগ্য যে বার বার তার গবেষণাপত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই সময়কার বিশেষজ্ঞরা। শেষপর্যন্ত ১৮৩০-এ গ্যালোয়ার তিনখানা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যার মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপুর্ণ অংশ গ্যালোয়া থিওরী নামে সারা পৃথিবীতে আজ বিখ্যাত।" স্যার বোধহয় আর একটু হলেই সে সব থিওরী বোঝানোর একটা সৎ প্রয়াসে সামিল হতেন। কিন্তু অরিন্দমের ছোট্ট হাই আর দেবজ্যোতির আরামোড়া ভাঙ্গা দেখে বিরত হলেন।

— "একঘেয়ে লাগছে বুঝি? কিন্তু গল্পের আসল জায়গাটাই তো বাকি। তবে তোদের যদি ভাল না লাগে তাহলে আজকে এই পর্যন্তই থাক। পরে না হয় বাকিটা শুনে নিবি। বাড়ি ফেরার সময় তো তো প্রায় হয়েই এলো।" স্যার আবার উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গী করলেন। এবার কিন্তু প্রণবই বাঁচালো। "পাঁচটা কুড়ির ট্রেন চলে গাছে স্যার। এর পরেরটা ছটা পঁয়তাল্লিশ।" আড়চোখে নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে পাঁচটা বেজেছে। স্যার হাতে ঘড়ি পরেন না, আর আশির দশকে কলকাতায় মোবাইলের আবির্ভাব হয় নি। "ঠিক আছে, তাহলে শেষ করে ফেলাই যাক।" স্যার আবার শুরু করলেন। "প্যারিসে তখন চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময় ১৮৩০-এর জুলাই মাস। রাজা দশম চার্লসকে উল্টে দেওয়া হয় এইসময়ে। ২৬শে জুলাই এই বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার জন্যে একগাদা জোরালো দমননীতি জারি করার চেষ্টা করেন রাজা। তার মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও খর্ব করা হয়। কিন্তু এসব করে কি আর বিদ্রোহ রোখা যায়? প্যারিসে সেদিন বেশ গরম ছিল, বুঝলি। সঙ্গে জনগণের মাথাও। ২৭ তারিখ সকাল থেকেই লোকজন পথে নামতে শুরু করে। আর ২৯ তারিখের মধ্যেই রাজার রাজত্বের পতন এবং মূর্ছা। এইসব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গ্যালোয়াও জড়িয়ে পড়েছিল। সারা প্যারিসের মানুষ যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন ছাত্ররাও পিছিয়ে ছিল না। ইকোলে পলিটেকনিকের পড়ুয়ারা বিদ্রোহে যোগ দিলেও, ইকোলে প্রিপারেটরিতের অধিকর্তা সেখানকার ছাত্রদের আটকে রেখেছিলেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে খবরের কাগজে চিঠি লেখে গ্যালোয়া এবং এই কারণে পরবর্তীকালে সে বহিষ্কৃত হয় ইউনিভার্সিটি থেকে। যদিও তার আগে সে নিজে থেকেই সেখানকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।"

— "জুলাই মাসের গোলমালের পরে ক্ষমতা দখল করেন লুই-ফিলিপ। এই সময় রিপাবলিকানদের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেয় গ্যালোয়া। সে দলের নাম ছিল ন্যাশনাল গার্ড। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবাদে ঐ সময় এই দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় আর এদের কিছু লোককে ভরা হয় জেলে। তারা অবশ্য কয়েকমাসের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যায়। সেই উপলক্ষে ১৮৩১-এর ৯-ই মে এক বিপুল পানভোজনের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে রাজা লুই-ফিলিপ থেকে আলেক্সান্ডার দ্যুমার মত বিখ্যাত লেখক-ও উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে যে রাজার সামনে মদের গেলাস তুলে উচ্ছ্বাস দেখানোর সময় গ্যালোয়া নাকি একটা ছুরি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। রাজা অনুমান করেন যে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে গ্যালোয়া এবং সেই অপরাধে তাকে পরের দিনই জেলে ঢোকানো হয়। অবশ্য মাসখানেক বাদেই জেল থেকে মুক্তি পায় সে।" একটানা বলে একটু দম নেওয়ার জন্যে থামলেন তরুণবাবু। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, "বাস্তিল দূর্গের পতন কবে হয়েছিল?" অঙ্কে টঙ্ক না হলেও, ইতিহাসে আমি মোটেই পাতিহাঁস নই। ফলে গড়গড় করে বলতে শুরু করলাম। "ওটা ফ্রান্সের স্বাধীনতা দিবস স্যার। ১৪-ই জুলাই, ১৭৮৯। বিপ্লবের ধাক্কায় বাস্তিল দূর্গের পতন। দিনটাকে ওরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে।"

— "ঠিকই বলেছিস। আমার গল্পের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট।" আমাকে চট করে থামিয়ে দিয়ে আবার শুরু করলেন স্যার। "১৮৩১ সালে ওই দিনটা উদযাপনের আনন্দে গ্যালোয়া এক সশস্ত্র মিছিলের নেতৃত্ব দিতে বেরিয়ে পরে। গায়ে পোশাক ছিল ন্যাশনাল গার্ড-দের, যেটা তখন সম্পুর্ণ বেআইনি। এই অপরাধে আবার ৬ মাসের জন্যে জেলে পোরা হয় তাকে। এবার জেলে থাকার সময় গ্যালোয়া ফের গবেষণাতে মন দেয়। ২৯-শে এপ্রিল, ১৮৩২-এ জেল থেকে ছাড়া পায় সে। কিন্তু আবার শুরু হয়ে যায় জোরদার বৈপ্লবিক কর্মকান্ড। যদিও জটিল বীজগণিত নিয়ে কাজ চলতে থাকে একইসঙ্গে। ভাবাই যায় না যে ছেলেটা কি করে একহাতে ঐরকম ঝুঁকির রাজনীতি আর অন্যহাতে গভীর অঙ্ক সমান্তরালভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। তোদের এক একটা ইউনিয়নের নেতা তো অঙ্কের খাতা ফাঁকা রাখাই বেশি পছন্দ করে।" মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন স্যার। বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পারছিলেন। আমি তখন ভাবছি যে পরের পরীক্ষাতে মাথায় শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে আর হাতে ছুরি নিয়ে যোদ্ধার বেশে মোকাবিলা করব অঙ্ক প্রশ্নের। তাতে যদি কয়েকমাস জেলে যেতে হয় তাও ভাল, কিছুদিন তো অঙ্ক থেকে মুক্তি!

— "গ্যালোয়ার জীবনটা যদি শুধু অঙ্ক আর বিপ্লব এই দুই বিন্দুকে যোগ করা সরলরেখার মধ্যে দিয়ে চলত তাহলে হয়ত গল্পটা এভাবে শেষ হত না। কিন্তু বাধ সাধল এক তৃতীয় বিন্দু। যে মহিলার নাম স্তেফানিয়ে-ফেলিসি পোতেরিন দ্যু মোতেল। সে সময় গ্যালোয়া যে হোস্টেলে থাকত সেখানকার ডাক্তারের মেয়ে ছিল এই দ্যু মোতেল। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নাকি রাজনৈতিক শত্রুতা সে কথা আজও সঠিক জানা যায় নি, কিন্তু এটা জানা যায় যে এই মহিলা সম্পর্কিত কোন এক ঘটনায় ডুয়েল-এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসে গ্যালোয়া। আলেক্সান্ডার দ্যুমার ভাষ্য অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী যুবকের নাম পেসচেউক্স দ্য'হারবিনভিলে। যাদের মুক্তি উপলক্ষে বিরাট পান ভোজনের আয়োজন হয়েছিল, সে নাকি তাদেরই একজন। অন্য একটা মত বলে সম্ভবত সেই ছেলের নাম আরনেস্ট ডুচাটেলেট, যে গ্যালোয়ার সঙ্গে একইসময়ে জেলে গেছিল সশস্ত্র মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ডুয়েল হয়েছিল ৩০-শে মে। লড়তে গিয়ে তলপেটে গুলি লাগে গ্যালোয়ার। পরদিন সকালে সে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে নাকি তার ভাইকে বলে গেছিল - কাঁদিস না আলফ্রেড, কুড়িতে মরার জন্যে আমাকে সমস্ত সাহস একসঙ্গে জড়ো করতে হয়েছে।" আমরা সবাই চুপ। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন। নজরে আসে নি কখন শরতের সন্ধেটা ঝুপ করে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে।

------
~Saibal

শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৫

গোয়ালন্দর মুরগিমাংসর ঝোল ~ রঞ্জিত গুহ



বেঁচে বর্তে থাকা একদা পূর্ববঙ্গীয় অতি বৃদ্ধ কারও হয়তোবা এখনও জিহ্বায় গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটার সুবিখ্যাত মুরগিমাংসর ঝোলের স্বাদ লেগে আছে। পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের ( যমুনা) সঙ্গম গোয়ালন্দ থেকে নারায়নগঞ্জের স্টিমার পথে মাল্লারা নিজেদের জন্য এই মুরগীর ঝোল রান্না করত। ক্রমে ক্রমে আমজনতার প্রিয় পদ হয়ে ওঠে।   কলকাতার লক্ষ্মীবাবুর আসলি সোনাচাঁদি দোকানের মত  গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটায় এখন সারি সারি মকবুল চাচার আসলি দোকান।এই মুরগী মাংসের ঝোলের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।এই বিশিষ্ট স্বাদের রান্না নিয়ে অনেক লোকগাথা তৈরি হয়েছে। রন্ধনপ্রণালীর আদি উদগাতা কে তা নিয়েও বেশ আকচাআকচি আছে।দেশবিদেশের রন্ধন বিশারদরা এই রান্নার  রেসিপি জানতে গোপনে হোটেল কর্মচারী সেজে থেকে গেছেন বলে গল্পকথা হাওয়ায় ভাসে। এইসব গল্পকথা নিয়ে একবার  এক শারদীয় পত্রিকায় এক উপন্যাস লেখা হয়েছে।  দেশভাগের পটভূমিতে খানিকটা রহস্য মিশেল দিয়ে প্রেম ও বন্ধুত্বের টানাপোড়েন। পড়তে মন্দ লাগেনা। হোটেল বা হোটেল জীবন নিয়ে বাংলায় কয়েকটা উপন্যাস আছে। একটা মাত্র রান্নার পদ নিয়ে একটা উপন্যাস এর আগে আমি পড়িনি। 

 অনেক বছর আগে এই পদের ঘরোয়া  রন্ধনপ্রণালী জেনেছিলাম জলপাইগুড়ি হাকিম পাড়ার এক প্রিয় বন্ধুর মায়ের কাছে।মাসীমা প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন।  এই সহস্রাব্দের শুরুতে বন্ধুর পাকশালায় হাতেকলমে বার কয়েক রেঁধেছি এই পদ। বেশ ঝকমারি আছে।  সে সব লিখে রাখিনি। ভুলেও যাইনি। সেই বন্ধুর গোয়ালন্দে এখনও যাতায়াত আছে।  দিন কয়েক আগে  ফোনে  জলযন্ত্রনায় বিপর্যস্ত বন্ধুর খোঁজ খবর নেওয়ার ফাঁকে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় হল।কথায় কথায়  সেই সব পুরানো কথার ঢেউ উঠল।রন্ধনপ্রণালীটাও ঝালিয়ে নিলাম।



প্রস্তুতি,  অর্থাৎ কিনা ম্যারিনেট করা।
১) ব্রয়লারে তেমন স্বাদ হবেনা। যাকে বলে দেশী মুরগি কেটে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নুন মাখিয়ে  মিনিট দশেক ঢাকা থাকবে।
২) কালোজিরে বাটা দিয়ে ভালো করে মেখে আবার ঢাকা দশমিনিট। 
৩) আদা জিরে কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে মিনিট পাঁচেক ঢাকা।
৪) সরষে তেল দিয়ে মেখে আবার ঢাকা।পাঁচ মিনিট। 
** আদা জিরে লঙ্কা কালোজিরে নুন তেল একসাথে মুরগীর সাথে মাখলে হবেনা কিন্তু।

কড়াইয়ে খুব ঢিমে আঁচে গরম করা সরষে তেলে থেতলানো রসুন কোয়া ভেজে , অনেকটা পেয়াজ কুঁচি   আধ ভাজা করে আদা কুঁচি দিয়ে আন্দাজমত নুন ছড়িয়ে দিতে হবে।
এরপর
১) ঐ কড়াইয়ে অর্ধেকের বেশি মাংস দিয়ে নেড়েচেড়ে ঢাকা চাপা। চাপা উঠিয়ে নেড়েচেড়ে আবার চাপা।
২) দু-চারটে শুকনো লঙ্কা দিয়ে ঢাকা।
৩) বাকি মাংস কড়াইয়ে দিয়ে হলুদবাটা জলে গুলে ঢেলে দিতে হবে। নেড়েচেড়ে আরও খানিকটা আন্দাজমত জল দিয়ে ঢাকার আগে খোসা ছাড়ানো কয়েক টুকরো আলু দিতে হবে। 
৪)ঝোল ফোটা শুরু হলে  আঁচ আরও কমিয়ে  শুকনো লঙ্কা বাটা ও খুব অল্প সরষে বাটা জলে গুলে কড়াইয়ে  দিতে হবে। ফুটুক কয়েক মিনিট। 
এইবার রাঁধুনিরা দ্বিমত বা বহুমত। 
১) কুঁচো চিংড়ি কড়া করে ভেজে দু'হাতের তালুতে পিষে গুড়ো করে ঝোলে দিয়ে টগবগ করে ফুটিয়ে নামিয়ে নাও।
২) যেকোনো কুঁচো মাছ কড়া ভেজে গুড়ো করে দিতে হবে।
৩) লইট্যা বা হিদল( পুঁটি)  শুঁটকি পেয়াজ লঙ্কা  রশুন বেশ কড়া ভেজে পেস্ট করে মাংসের সাথে মিলিয়ে দাও।
** আমি চিংড়ি ভাজা গুড়ো দিয়ে করেছি।

নামাবার আগে কয়েকটা কাঁচালঙ্কা চিরে ছড়িয়ে দিতে হবে।সবার পাতেই যেন একটা দুটো পড়ে।
পাতে দেওয়ার আগে সামান্য ঝোল জিভে দিয়ে বুঝে নিতে হবে নুন কমবেশি হয়েছে কিনা।

** গরম না থাকলে এ ঝোলের স্বাদ অর্ধেক কমে যায়।

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫

৪০টি নৌযান এবং ৬২৩ জন মেয়ে ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

পাশের বাড়ির বৌদি, বিগত যৌবনা হলেও সাজগোজ করতে কিঞ্চিৎ ভালোবাসেন। আপনি আড় চোখে দেখেন আর পাড়ার চায়ের ঠেকের খাপ পঞ্চায়েতে তাকে আখ্যা দেন ঢলানি মেয়েছেলে বলে। অফিসে নতুন কাজে জয়েন করা মেয়েটি স্বচ্ছন্দে সবার সাথে মেলামেশা করছে দেখে আপনি তাকে আখ্যা দেন বেহায়া বলে। বন্ধু'র কনিষ্ঠ কন্যা, সদ্য কলেজ ছাত্রীকে জিন্স পরতে দেখলে, সিগারেট ফুঁকতে দেখলে আপনার স্থির সিদ্ধান্ত হয়, মামনি গোল্লায় গেছে। কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় মেট্রো রেল কামরায় হাতল ধরা মহিলার শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত দেখলে আপনার ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাঁড়ানো মেয়েদের কথা মনে পড়ে। একটা সময় পশ্চিম ইউরোপের ইতালিতে মেয়েদের দেখে আপনার মতো কিছু নীতি পুলিশ সাজা কাকু/ কাকিমা ওই সিদ্ধান্তে আসতেন যে ওদেশের মেয়েগুলি কিঞ্চিৎ বেহায়া, ঢলানী ও বয়ে যাওয়া এম্পটি হেডেড। 

অথচ কি আশ্চর্য্য দেখুন ওদেশের সেই মেয়েগুলি দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময় কি অবাক কান্ডই না ঘটিয়ে ছিল। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে ওই ইতালি দেশটাতেই ফ্যাসি*বাদ নামক কুখ্যাত মতবাদের জন্ম। ইউরোপের আর পাঁচটা দেশেও ফ্যাসি*স্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওই দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী, যাদের পার্টিজান বলে, সেটা গঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু আপনার কি জানা আছে যে দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সংগ্রামী মানুষ দ্বারা গঠিত সেই বাহিনীর  এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানে প্রায় চল্লিশ শতাংশ সদস্য ছিল মহিলা ? যারা পুরুষ কমরেডদের পাশাপাশি স্টেনগান হাতে নিয়ে লড়াই দিয়েছিল ? আজ্ঞে হ্যাঁ যেই "বেহায়া", "ঢলানি" "মেয়েছেলে"র দল। আপনাকে কেউ কি কোনোদিন বলেছে যে ওই মেয়েদের মধ্যে চার হাজার ছশ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল, দু হাজার সাতশো পঞ্চাশ জনকে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওই মহিলাদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি কিন্তু। ফ্যাসি*বাদীদের পরাজয় হয়েছিল। আঠাশ এপ্রিল, ১৯৪৫ ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় নায়ককে পার্টিজানরা গুলি করে মারে। মেরে ফেলে দিয়ে যায় মিলান এর প্রধান রেল স্টেশনের চত্বরে। যার পরে ক্রুদ্ধ বিক্ষুব্ধ জনতা পাশবিক আক্রোশে সেই একনায়কের মৃতদেহ উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয় ল্যাম্পপোস্টে, জনতা জড়ো হয়ে উল্লাস করে সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে। এর পরে সবাই ঘরে ফেরে। মেয়েরা বন্দুক ফেলে ফিরে যায় অভ্যস্ত জীবনে, ঘরকন্নয়, গেরস্থালির কাজে, মাঠে ফসল তোলার কাজে, ফ্যাশন শো এর রেম্পে। 

গত কয়েকদিনের মধ্যে চুয়াল্লিশটি দেশের চল্লিশটি নৌযান নিয়ে গঠিত বেসামরিক নৌবহর যার নাম সুমুদ ফ্লোটিলা রওয়ানা দিয়েছিল ইসরায়েলি হানায় বিধ্বস্ত গাজায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছিয়ে দিতে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী জুড়ে বেসামরিক, বেসরকারি প্রতিবাদ। ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স ওই নৌযান গুলিকে সাগরের বুকেই ইন্টার্সেপ্ট করেছে। অভিযাত্রীদের এই অসম সাহসী অভিযানকে ঘিরে শুরু হয়েছে দক্ষিণপন্থীদের কুৎসা প্রচার। এই প্রচারকারীদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য এই আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী গ্রেটা থুনবার্গ, রিমা হাসান ও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য মহিলারা। তাদের চরিত্রে কালি ছেটানো চলছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সেই ফ্যাসিস্ট ইতালিতে। 

আশার কথা এটাই যে সেই ইতালির মতো আজকের ইতালিতেও খেটে খাওয়া মানুষজন এই অভিযাত্রীদের পাশেই দাঁড়িয়েছে সেই দেশের চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের হুশিয়ারি সত্ত্বেও। রাজপথে তাঁদের কন্ঠে ফিরে এসেছে সেই পুরনো ফ্যাসিস্ট বিরোধী "বেলা চাও" গানের সুর ও স্বর। তাদের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে কলকাতা সহ পৃথিবীর প্রায় সব শহরের বুকে হচ্ছে মিছিল, জমায়েত। বেলা চাও বারে বারে ফিরে আসছে আমাদের মধ্যে। 

ফেরেনি কেবল ফ্যাসিস্ট/ নাৎসি বাহিনীর হাতে শহীদের মৃত্যু বরণ করা ছশো তেইশ জন মহিলা পার্টিজান। কোনো অজানা সবুজ পাহাড়ের কোলে, আরো সবুজ শান্ত গাছের ছায়ায় তারা চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে। তাদের মিনি স্কার্ট হাই হিলের খুট খুট শব্দে মুখরিত হবে না আর মিলানের পাথর বাঁধানো রাস্তা। যখনই কেউ  প্রতিবাদে গর্জে ওঠা মেয়েদের "ঢলানি মেয়েছেলে" বলে অপবাদ দেয়, তাদের শরীর নিয়ে নোংরা কথা বলে তাদের বদনাম করতে চায়, তখনই কেন জানি সেই শহীদ পার্টিজান বাহিনীর মেয়েদের কথা মনে পড়ে যায়। গুডবাই বিউটিফুল। বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও।

শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৫

গান স্যালুট ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত


বিকেল পাঁচটা'র সময় সেদিন এক খুনির হাতে ধরা ইতালিয়ান পিস্তল থেকে গুলি ছুটে গিয়ে গিয়ে ফুঁড়ে দিয়েছিল এক অশক্ত বৃদ্ধের শরীর। বেরেটা সেমি অটোম্যাটিক মডেল নম্বর M1934, সিরিয়াল নম্বর 606824 এর থেকে বেরিয়ে আসা পয়েন্ট 380 ক্যালিবারের গুলি। 



কে এই বৃদ্ধ ? এই বৃদ্ধ যার অনশন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অবিসংবাদী নেতা সাভারকার বিবৃতি দিয়েছিলেন: "সময় এসেছে যে, গান্ধীজির স্বাস্থ্যের গুরুতর অবস্থা নিয়ে যারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তাঁর মূল্যবান জীবন বাঁচানোর কোনো চেষ্টা বাকি না রাখতে যারা ইচ্ছুক তাদের অবিলম্বে উপলব্ধি করা উচিত যে আমরা এটি পছন্দ করি বা না করি, গান্ধীজীর জীবন বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকর হওয়ার একমাত্র উপায় এখন মহাত্মা গান্ধীর কাছে একটি জাতীয় আবেদন জারি করা যা তার সময় শেষ হওয়ার আগে তার উপবাস ভাঙার জন্য আবেদন।" " [সূত্রঃ ১]

এটা বিস্ময়কর ঠেকলে সুধী পাঠক, আমরা দেখে নিতে পারি ওই হত্যাকান্ডের মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সাভারকারের আরেকটি উক্তি। বৃদ্ধের জন্মদিনে সাভারকার অভিনন্দন জানালেন: "তাঁর ৭৫ তম জন্মদিনে আমি মহাত্মা গান্ধীজি এবং আমাদের জাতিকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। ঈশ্বর তাঁকে দীর্ঘ জীবন এবং শক্তিশালী স্বাস্থ্য দান করুন" [সূত্র ২:]

কিম্বা আরো বিস্ময়কর উক্তি যেখানে জেল থেকে গান্ধীজির ছাড়া পাওয়ায় সাভারকার আনন্দ প্রকাশ করে লিখছেন: "গান্ধীজির বার্ধক্য এবং সাম্প্রতিক গুরুতর অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্যের অবনতি বিবেচনা করে সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছে এই খবরে সমগ্র জাতি স্বস্তি বোধ করছে। এটা ছিল একটি মানবিক প্রচেষ্টা। আমি গান্ধীজির দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। আমি আশা করি সরকার এখন পণ্ডিত নেহেরু এবং সেই সমস্ত ভদ্রলোকদের মুক্তি দেবে যাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিচার না করেই কারাবন্দী করা হয়েছে, অথবা প্রকাশ্যে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি, যাতে দেশ জানতে পারে যে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কী। [সূত্রঃ ৩]

হাত্যার দায়ে অভিযুক্ত কোনো আসামি সেই নিহত মানুষটি সর্ম্পকে এমন মূল্যায়ন করেছেন এই উদাহরণ খুব একটা আছে বলে তো আমরা জানি না। যাই হোক, সাভরকার তো ছাড়া পেয়েছিলেন শেষ অবধি কিন্তু তিনি যাকে ক্রিমিনাল আখ্যা দিয়েছিলেন, তার এককালের সহকর্মী কাম শিষ্য সেই গডসের কার্যকলাপে আমরা একটু মনোনিবেশ করি। হত্যাকারী গডসে ও তার সঙ্গীরা বহুদিন ধরেই ওই বৃদ্ধকে খুন করার জন্য উপযুক্ত অস্ত্র খুঁজছিল। অস্ত্রটি তাদের হাতে আসে হত্যাকাণ্ডের ঠিক দু'দিন আগে। "গডসে ২৮শে জানুয়ারি ট্রেনে করে গোয়ালীয়র আসে এবং গোয়ালীয়রবাসী ডা: দত্তাত্রেয় পারচুরে, গঙ্গাধর দন্ডবতে, ও সূর্যদেব শর্মা এর সহায়তায় এই পিস্তলটি জোগাড় করে।" [সূত্রঃ ৪]

ডা: পারচুরে তার গ্রেপ্তারের পরে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে জবানবন্দিতে জানায় যে সে ওই পিস্তলটি সংগ্রহ করেছে দন্ডবতে'র কাছ থেকে। দন্ডবতে জানায় যে সে সংগ্ৰহ করেছে জগদীশ প্রসাদ গোয়েল এর কাছ থেকে। জগদীশ প্রসাদ গোয়েল কার কাছ থেকে এই পিস্তল সংগ্রহ করেছিল সেটা জানা যায় নি, মুখ খুলতে রাজি হয় নি। "এটা সম্ভব যে মুখ খুলতে নারাজ হয়ে গোয়েল সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আড়াল করতে চেয়েছে।" [সূত্রঃ ৫]

প্রথমে প্লেনে করে দিল্লি আর তার পরে ট্রেনে করে গডসেদের গোয়ালীয়র যাওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল একটা নিখুঁত যন্ত্রের প্রয়োজন। পাওয়ার পরে গডসে ও আপ্তে দিল্লি ফিরে আসে ২৯ তারিখ সকালে।" [সূত্রঃ ৬]

কে ঐ পারচুরে ? গোয়ালীয়র এর ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, কৃতি ছাত্র, পাস করা চিকিৎসক। তিনি কেন বেরেটা পিস্তল সংগ্রহ করতে যাবেন ?  তাঁর পরিচয়ের আরেকটা দিক হল, তিনি হিন্দুমহাসভার সক্রিয় কর্মকর্তা,  এবং স্থানীয় 'হিন্দু রাষ্ট্র সেনা'র নির্বাচিত ডিরেক্টর। গোয়েল ছিল তার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর একজন সদস্য। [সূত্রঃ ৬]।

খুনি'র মোডাস অপারেন্ডির খানিকটা জানা গেল। খুনীর বিচারটাও কিন্তু খুব কৌতূহলজনক। পাছে একপেশে ন্যারেটিভ এর দায়ে অভিযুক্ত হতে হয় তাই আমরা আবার শরণাপন্ন হবো খুনীর মেন্টর এর। গান্ধীজিকে 'মহাত্মা' সম্বোধন করে তার জঘন্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে সাভারকার লিখলেন, "মহাত্মা গান্ধীর হত্যার আকস্মিক ও মর্মান্তিক সংবাদ আমার কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমি একটি প্রেস-নোটে প্রকাশ্যে এটিকে একটি ভয়াবহ এবং ভ্রাতৃঘাতী অপরাধ বলে নিন্দা জানাই, যা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘটছে। এবং আজও আমি গান্ধীজীর হত্যার দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাই।" [সূত্রঃ ৭]

গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে সহ অন্যান্যদের পরিষ্কার ক্রিমিনাল আখ্যা দিলেন সাভারকার এবং তিনি তার শিষ্যদের কাজের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলেন: "অনেক অপরাধী তাদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গুরু এবং পথপ্রদর্শকদের প্রতি উচ্চ শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য পোষণ করে এবং তাদের নীতি অনুসরণ করার দাবি করে। কিন্তু গুরু বা পথপ্রদর্শকের তার অনুসারীদের অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টি কি কেবল সেই অপরাধীদের তাদের গুরুদের প্রতি আনুগত্য এবং শ্রদ্ধার দাবির ভিত্তিতে অনুমান করা এবং প্রমাণিত করা যেতে পারে? [সূত্র: ৭]

শুধু কথামাত্র নয়, কাজেও সাভাকার দেখিয়েছিলেন যে তিনি গান্ধী হত্যাকারীদের কতটা ঘৃণা করেন। গোপাল গডসের উকিল পি এল ইনমাদারের ভাষায়, 
"পুরো বিচার চলাকালীন, আমি কখনও সাভারকরকে এমনকি নাথুরামের দিকে তাকাতে এমনকি ও মাথা ঘোরাতে দেখিনি, যিনি তার পাশে বসে থাকতেন; নাথুরামের সাথে কথা বলা তো অনেক দূরের কথা... সাভারকর সেখানে স্ফিংসের মতো নীরবে বসে ছিলেন, কাঠগড়ায় থাকা তার সহ-অভিযুক্তকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে" [সূত্রঃ ৮]

তার গুরু, আদর্শ-প্রতিমার এই আচরণে হত্যাকারী নাথুরাম গডসে কতটা বিচলিত হয়েছিলেন ও দুঃখ পেয়েছিলেন তার নমুনা সেই উকিল ইনমাদারের ভাষায়: "নাথুরামের সাথে আমার বিভিন্ন আলোচনার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি এতে গভীরভাবে আহত হয়েছেন - লাল কেল্লার বিচারের সমস্ত দিনগুলিতে আদালতে বা লাল কেল্লা কারাগারে তাতিয়ারাও [সাভারকর] তার সাথে সুপরিকল্পিতভাবে সর্ম্পকছেদ প্রদর্শন করেছিলেন। নাথুরাম কীভাবে তাতিয়ারাওয়ের হাতের স্পর্শ, সহানুভূতির একটি শব্দ, অথবা অন্তত করুণার একটি দৃষ্টিপাত দেখার জন্য আকুল ছিলেন? সিমলা হাইকোর্টে তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাতের সময়ও নাথুরাম এই বিষয়ে তার আহত অনুভূতির কথা উল্লেখ করেছিলেন।" [সূত্রঃ ৮]

এইবারে আসা যাক আসল বিষযে, হত্যাকান্ডের মোটিভ। কেন সেদিন বিকেলে খুন হতে হয়েছিল ওই বৃদ্ধকে। তিনি কি অপরাধ করেছিলেন। 

খুনের একটু আগে পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ সাল। গোটা দেশ এর বড় অংশ  স্বাধীনতার আনন্দে মাতোয়ারা। ওই বৃদ্ধের "সবচেয়ে বড় শিষ্য" তখন ক্ষমতার গদিতে বসার আনন্দে তাঁর অন্য সঙ্গী সাথীদের নিয়ে দিল্লির আলো উজ্জ্বল সেন্ট্রাল হলে "নিয়তির সাথে অভিসার" এর গল্প শোনাচ্ছেন দেশ তথা বিশ্বকে তখন দাঙ্গা বিধস্ত কলকাতার বেলেঘাটায় ওই বৃদ্ধ অনশন করছেন, চরকা কাটছেন। প্রতিবাদে। হিন্দু-মুসলিম, তাঁর প্রিয় সন্তানদের মারামারি খুনোখুনির প্রতিবাদে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এক সৈনিক।

কলকাতা শান্ত হলে তিনি যাবেন দাঙ্গা বিধস্ত পাঞ্জাবে এমনটাই তাঁর ইচ্ছে। তাঁর সাধের জওহরলাল, প্যাটেলদের অনেক কাজ। দেশ চালাতে হবে। তাই তিনিই যাবেন বৃদ্ধ অশক্ত শরীর নিয়ে। কারণ তিনি জানেন যে এখনও ভারতের জীবিত সবচেয়ে বড় মাস লিডার তিনিই। ওসব জহর, প্যাটেল কিস্যু নয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন জানতেন এই সৈনিক একাই একটা সৈন্যদল। তিনি লিখেছেন, "মাই ডিয়ার গান্ধীজি, পাঞ্জাবে আমাদের হাতে আছে ৫৫,০০০ সেনা আর বিশাল মাপের রায়ওটিং। এদিকে বাংলায় আছে একজন মানুষ দিয়ে গড়া সৈন্যদল আর সেখানে কোনও রায়ওটিং নেই" [সূত্রঃ ৯]

'ওয়ান ম্যান আর্মি' সেই বৃদ্ধ তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন নি। তার জন্য তাঁর বহু অনশন দীর্ন অশক্ত শরীর দায়ী নয়। দায়ী অন্যকিছু। ৭ই সেপ্টেম্বর পাঞ্জাব যাবেন বলে দিল্লি রওয়ানা হলেও দিল্লিতে আটকে গেলেন। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দলে দলে আগত শিখ আর হিন্দু রিফিউজিদের ক্রোধের আগুনে তখন পুড়তে শুরু করেছে দিল্লির মুসলিম মহল্লা। বৃদ্ধ অনশনে বসলেন। আর অন্য দিকে "বাম" নেহেরু বনাম "দক্ষিণ" প্যাটেল এর প্যাঁচ কষাকষি। দ্বিতীয় জন গান্ধীর ইচ্ছে মেনে নিয়ে প্রথম ক্যাবিনেটে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ মেনে নিলেও মনে মনে মানেন নি। 

পাকিস্তানের প্রতি জঙ্গি মনোভাব হোক আর কংগ্রেস পার্টি প্রেসিডেন্ট পদে দক্ষিণপন্থী পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডনকে দাঁড় করানো হোক, গান্ধীর তথাকথিত ডান হাত আর বাঁ হাত তখন ক্ষমতার অলিন্দে লড়াই করা দুই প্রতিপক্ষ। বৃদ্ধ আবার অনশনে। [সূত্রঃ ১০]

দেশের অবস্থা শোচনীয়। বৃদ্ধ একা হয়ে গেছেন। নিঃসঙ্গ। প্রিয় শিষ্যরা না পারছে তাকে ফেলতে না পারছে গিলতে। গডসে আপ্তে "নিখুঁত" পিস্তল জোগাড়ে ব্যস্ত। 

বৃদ্ধের মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর আরেক অনুচর এর কথা। নিখোঁজ। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী মৃত। বৃদ্ধের ভাষায় "নেতাজি ওয়াজ লাইক এ সন টু মি"। বৃদ্ধের মনে পড়ে যাচ্ছে তার আশীর্বাদ চেয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রভিনসিয়াল ভারত সরকার ঘোষণার এবং "দিল্লি চলো" আদেশ ঘোষণার প্রাক্কালে নেতাজির সেই ডাক, 
"ভারতের স্বাধীনতা র শেষ মহারণ শুরু হয়ে গেছে। জাতির জনক, ভারতের মুক্তির এই পবিত্র যুদ্ধের জন্য আমরা আপনার আশির্বাদ ও শুভেচ্ছা চাইছি।" [সূত্র ১১] 

আজাদ হিন্দ ফৌজ এর বন্দী সেনানীদের সাথে আলাপ আলোচনার পর বৃদ্ধের নিজস্ব বিশ্লেষণ একটু দেখে নেওয়া যাক,  "যদিও আইএনএ তাঁদের আশু লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, তাঁদের জমার খাতায় গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে মহত্তম হ'ল এক পতাকার তলে ভারতের সব ধরণের ধর্ম, সম্প্ৰদায়, জাতির মানুষকে একজোট করা, তাদের মধ্যে একতা ও সংহতির এক উদ্দীপনা প্রবিষ্ট করা যার মধ্যে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক ভাবনা বর্জিত হয়েছে" [সূত্রঃ ১২]

১২ই সেপ্টেম্বর, আরএসএসের প্রধান গুরু গোলওয়ালকর এর সাথে গান্ধীজি র বৈঠক হল, গান্ধীজি  তাঁকে দাঙ্গা থামানোর অনুরোধ করলেন এবং সোজাসুজি বললেন যে সঙ্ঘের হাত রক্তে মাখা, গোলওয়ালকর উচ্চ সুরে তা অস্বীকার করলেন। [সূত্র ১৩]। বৃদ্ধ বোঝেন নি যে সেইদিনই তাঁর মৃত্যু পরোয়ানায় সই হয়ে গেল। আশাবাদী বৃদ্ধ নিজের জীবনের পরোয়া না করে ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে গেলেন দিল্লির ভাঙি কলোনিতে অবস্থিত আরএসএসের শাখায় তাঁর শান্তির বাণী প্রচার করতে। 

সুধী পাঠক এতক্ষনে নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছেন সেই হত্যাকারীর মোটিভ। নিঃসঙ্গ অশক্ত ওই বৃদ্ধ বেঁচে থাকতে ভারতের মাটিতে সাম্প্রদায়িক হানাহানির সংস্কৃতি কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। বৃদ্ধ ব্যাগড়া দেবেনই। আর দেশের লোক ওই "বোকা বুড়ো" এর কথায় এখনও নেচে ওঠে, বৃদ্ধ অনশন শুরু করলে তাদের সেন্টিমেন্ট এর বন্যা বয়ে যায়। অতএব মরতে হবেই বৃদ্ধ আপদকে। তাতে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কেউ তাকে মূর্তি বানিয়ে ফুর্তি চালিয়ে যাবে, আর কেউ ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখবে সাম্প্রদায়িক ঘেন্না ছড়িয়ে। 

সুধী পাঠক, ক্ষমা করবেন, বৃদ্ধের জন্মদিনে তাঁর আর পাঁচজন ভক্তের মতো "রামধুন" শুনবো না, কারণ আমরা তাঁর ভক্ত নই। আমরা বরং শুনবো সেই গান যা এক হরিজন বস্তিতে তাঁকে শুনিয়েছিলেন গানটির সুরকার আজাদ হিন্দ ফৌজ এর ক্যাপ্টেন রাম সিং। বেহালার ছড় সুর তুলছে "কদম কদম বাড়ায়ে যা"। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শহীদ ওয়ান ম্যান আর্মির সম্মানে ফৌজের গান চাই। স্যালুট। গডসে বনাম গান্ধীর এই যুদ্ধে আমরা গান্ধীর পক্ষে। 

সূত্র১: পাইওনিয়ার, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩
সূত্র ২: প্রেস নোট, ২রা অক্টোবর, ১৯৪৩
সূত্র ৩: প্রেস নোট, ৭ই মে, ১৯৪৪
সূত্র ৪: চার্জশিট গান্ধী মার্ডার কেস
সূত্র ৫: মনোহর মালগাঁওকর, দি মেন হু কিল্ড গান্ধী
সূত্র ৬: জাস্টিস জি ডি খোসলা, দি মার্ডার অফ মহাত্মা
সূত্র ৭: সাভারকার এর বিবৃতি, ২০শে নভেম্বর, ১৯৪৮
সূত্র ৮: ইনামদার, আত্মকথা
সূত্র ৯: রাজমোহন গান্ধী, মোহনদাস, এ ট্রু স্টোরি অফ এ ম্যান, হিজ পিপল এন্ড এন এম্পায়ার
সূত্র ১০: অমিত কাপুর, দি এজ অফ এওকেনিং
সূত্র ১১: আজাদ হিন্দ রেডিও 'র : ৬'ই জুলাই ১৯৪৪, রেঙ্গুন ব্রডকাস্ট
সূত্র ১২: হরিজন পত্রিকা, ১৪-০৪-১৯৪৬ সংখ্যা।
সূত্র ১৩: দিনেন্দ্র ঝা, গোলয়ালকর - দ্যা মিথ বিহাইন্ড দ্যা ম্যান।

বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর, ২০২৫

যদি তোর ডাক শুনে কেউ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত




সেবাগ্রামে থাকার সময় গান্ধীজি সময় পেলেই লম্বা হাঁটা লাগাতেন। ১৯৩৯ এর ডিসেম্বর আশ্রম থেকে বেড়িয়ে গান্ধীজি দেখলেন  হাতে পুঁটুলি নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলেন। গান্ধীজি চিনতে পারলেন, শাস্ত্রীজি। গান্ধীজির মুখে একটা চিন্তার ছায়া পড়লো। শাস্ত্রীজি সেটা লক্ষ করেই বললেন, "আপনার কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলাম না। হরিদ্বারে বসে নিজের হাতে কাটা সুতো আপনার হাতে তুলে দিতে এসেছি। আমি আশ্রমের ভেতরে যাবো না, এই গাছতলায় শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেবো  সকালে চলে যাবো"। কে এই শাস্ত্রীজি, কেনই বা তিনি আশ্রমে না ঢুকেই চলে যেতে চাইছেন এটা জানতে গেলে আমাদের একটু ফিরে যেতে হবে।

গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং তার সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। উনি ও অন্য নেতারা গ্রেপ্তার হন, পুনের ইয়েরওয়ারা জেলে পাঠানো হয়। জেলে থাকার সময়, গান্ধীজি জেলসুপার ভান্ডারী সাহেবের কাছে দত্তাত্রেয় পারচুরে শাস্ত্রী নামের সহবন্দী সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। উনি ভান্ডারী কে অনুরোধ করেন খোঁজ নিতে যে কোথায় শাস্ত্রীজিকে আটকে রাখা আছে, ভান্ডারী কে বলেন " যদি উনি আমার সংগে একসাথে থাকেন তাহলে আমরা একে অন্যকে সংগ দিতে দিতে পারি, আলাপ আলোচনা করে সময় কাটাতে পারি।

ভান্ডারী তার উত্তরে বলেন, " শাস্ত্রীজির কুষ্ঠ আছে বলে তাকে জেলের অন্য সেকশনে রাখা হয়েছে।" এটা শুনে গান্ধীজি স্তম্ভিত হয়ে যান। শাস্ত্রীজি একজন পড়াশোনা করা শিক্ষিত, পন্ডিত মানুষ যার বেদ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। এরপরে গাঁধীজি শাস্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন মন খারাপ না করতে এবং অনুরোধ জানান চিঠিপত্র এর মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতে, কোনো প্রয়োজন এ সাহায্য চাইতে।

শাস্ত্রীজি তার উত্তরে লেখেন, " যদি সম্ভব হয় তাহলে কিছু তুলোর ব্যবস্থা করবেন যাতে আমি আমার ক্ষত গুলি পরিস্কার রাখতে পারি; আর যদি কিছু বই এর ব্যবস্থা করা যায়। চিঠি পাওয়ার পরে মহাদেব দেশাই যখন গাঁধীজি কে দেখতে আসেন জেলে, তখন গাঁন্ধীজির নির্দেশে দেশাই ওইসব ব্যাবস্থা করেন ও শাস্ত্রীজিকে খবর পাঠান যে "শরীর আমাদের অসুস্থ হতে পারে কিন্তু চৈতন্য আমাদের জাগিয়ে রাখবে।" গান্ধীজীর এই চিঠি "মৃত সঞ্জীবনী এর মতো কাজ করে শাস্ত্রীজির জন্য এবং তিনি গাঁধীজির এই কথাতে বিপুলভাবে উজ্জীবিত হন।
 
কোনোও সময়ে গাঁধীজি জেলে অনশন করতেন। তাঁর জীবন যখন একটা সুতোয় ঝুলছে, সেই সময়ে সরকার সমঝোতা করেছে।  কে গাঁধীজিকে অনশন ভঙ্গ এর সময় প্রথম ফলের রস খাওয়াবে সে প্রশ্ন উঠে এসেছে। বাপু চেয়েছিলেন শাস্ত্রীজি এই কাজের ভার নিক। সরকার বাহাদুর মেনে নেওয়ার পরে সেটাই হয়। শাস্ত্রী এগিয়ে আসেন।। জেলার ভাণ্ডারী সাহেব এই দৃশ্য দেখে নিজের চোখের জল আটকাতে পারেন নি।

কুষ্ঠরোগীর প্রতি গান্ধীজির এই মনোভাবের শুরু কিন্ত অনেক আগে। দক্ষিণ আফ্রিকায়, নাটাল এ এক জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন গাঁধীজি। হটাৎ খেয়াল করলেন দূরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একদল লোক খুব মন দিয়ে তাঁর কথা শুনছে। হাত নেড়ে কাছে এসে ভিড়ের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য ডাকলেও তারা সাড়া দিল না। 

গাঁন্ধীজি ওদের দিকে এগিয়ে এলেন ব্যাপারটা বোঝার জন্য। এগিয়ে আসা মাত্রই ওদের একজন চেঁচিয়ে উঠলো, "গান্ধীভাই আমাদের কাছে আসবেন না।। আমরা লেপার, কুষ্ঠরুগী।" এসব শোনার পরেও গান্ধী এগিয়ে এলেন, কথা বললেন ওদের সাথে।কয়েকজনের হাতের আঙ্গুল খসে গেছে তো কারুর পায়ের আঙ্গুল। কারুর ভুরুর লোম উঠে গেছে। ওরা কে কি চিকিৎসার সুযোগ পায়, গান্ধী জানতে চাইলেন। উত্তর শুনে স্তম্ভিত, স্তব্ধ।

ওদের কথায়, " কোনো ডাক্তার আমাদের চিকিৎসা করতে চায় না; আমরাই যে যার নিজের চিকিৎসা করি নিমপাতার রস দিয়ে।" যখন জানতে চাওয়া হল যে ওই রসে কোনো উপকার হচ্ছে কি না, তখন সবারই উত্তর না, ওরা কেবল ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। 

ঠিক ওই মুহূর্তে গান্ধীজি ঠিক করলেন যে ওই মানুষগুলির জন্য ওনাকে কিছু করতেই হবে। উনি ওদের বাড়িতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন কিন্তু দিনের বেলায় কারুর সাহস হল না তার বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ার। গান্ধীজি যখন রাতে ঘুমোতে যাচ্ছেন তখন ওরা গিয়ে উপস্থিত। ওদের ডেকে নিলেন ভেতরে। ওদের ঘা পরিষ্কার করে দিলেন, কিছু খাবার দাবার বের করে খাওয়ালেন, আর ওদের জীবন কাহিনী শুনলেন, কিভাবে ওরা গ্রামের বাইরে একটা খণ্ডহরে বাসা করে থাকে আর বাঁচার চেষ্টা করে। 

ওদের জলের অভাব, নাগাল পায় না, তাই বরুনদেব যখন কৃপা করে মুখ তুলে চান তখন ওরা সেই বারিধারাতে স্নান করে। তা না হলে ওরা ওদের সেই ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড় ই না কেচে দিনের পর দিন পড়ে থাকে কারণ স্নান করার বা কাপড় কাচার জল থেকে ওরা বঞ্চিত। গ্রামের আনন্দ-অনুষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট দিয়েই পেট ভরাতে হয়। জীবন কাহিনী বর্ণনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে লোকগুলি বিদায় নিতে চায়। গান্ধীজি বিদায়ের সময় বলেন যে তিনি ওদের জন্য কিছু করতে চান। করেওছিলেন,  পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা, ওষুধপত্র এর ব্যবস্থা।

সেবাগ্রামের সেই দিনটাতে ফেরত যাই আমরা। 
এই সেই শাস্ত্রীজি। গাঁধীজি  দক্ষিণ ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক ভেলাধুনকে নির্দেশ দেন শাস্ত্রীজির জন্য একটি নতুন ধুতি ও বেনিয়ান আনতে। পরের দিন যথানিয়মে প্রার্থনা সভায় মিলিত হলেন সব আশ্রমিকরা। যেখানে গাঁধীজি ঘোষণা করেন, "আজ আমাদের মধ্যে বেদ ও অন্যান্য বিষয়ে পারঙ্গম একজন পন্ডিত মানুষ শাস্ত্রীজি আমাদের মধ্যে উপস্থিত। উনি কুষ্ঠ রোগ এ ভুগছেন। আপনারা কি ওনাকে সমর্থন করবেন  ও ওনাকে এই আশ্রমে থাকতে দেবেন ? " 

চারদিকে তখন সূচ পতনের নীরবতা। আশ্রমিকদের অনুৎসাহিত মনোবাসনা বুঝে গাঁধীজি আবেদন রাখলেন, " যদি আপনাদের বিবেক অনুমোদন দেয় তাহলেই আপনারা সম্মতি দেবেন।" গান্ধীজীর কথায় সেদিন কাজ হয়েছিল। মানুষ তার কথায় ভরসা রেখেছিল। শাস্ত্রীজি আশ্রমেই থেকে যান। আশ্রমের পূর্বদিকে তার জন্য একটি কুটির তৈরি হয়। গান্ধীজি প্রতিদিন সময় পেলে নিজের হাতে তার সেবা করতেন, ক্ষতস্থান ধুয়ে দিতেন, জামাকাপড় পড়িয়ে দিতেন।  তার সাথে সংস্কৃত কাব্য আবৃত্তি করতেন। ডাঃ জীবরাজ মেহেতা এর দেওয়া ওষুধ সেবনের পরে শাস্ত্রীজির উন্নতি দেখে গাঁধীজি খুবই সন্তুষ্ট হন। কাছেই দত্তপুরে ওয়ার্ধায় মনোহর দেওয়ান কুষ্ঠ পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলেন। শাস্ত্রীজি সেখানে স্থানান্তরিত হ'ন ও আমৃত্যু সেখানেই থেকে যান। গান্ধীজি এই মনোহর দেওয়ান কে "প্রকৃত মহাত্মা" খেতাবে সম্ভাষিত করেন। 

কুষ্ঠরোগ নিয়ে গান্ধীজির এই অবদানের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। (এক) এটি কোনো বিচ্ছিন্ন লোক দেখানো ঘটনা নয়। এর ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। আগ্রহী পাঠক-পাঠিকার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম দেওয়া হল। ( দুই) গান্ধীজির এই সেবার মনোভাবের সাথে আগাগোড়া বিজ্ঞান জড়িয়ে ছিল। দেশ বিদেশের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী যারা কুষ্ঠরোগ নির্মূল করার অভিযানে জড়িত তারা অনেকেই নিয়মিতভাবে ওয়ার্ধা সেবাগ্রামে এসেছেন গান্ধীজির সাথে আলাপ আলোচনা পরামর্শ করেছেন। উনি আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে কিভাবে এই রোগ দূর করা যায় তাতে উৎসাহী ছিলেন। 

ভারতবর্ষ তথা বিশ্বে বহু রাজনীতিবিদ জন্মেছেন বা জন্ম নেবেন। কিন্তু একটি রোগের জন্য একজন রাজনীতিবিদ এর এমন অবদান এর দৃষ্টান্ত সম্ভবত আর নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে গান্ধীবাদী রাজনীতির অনুসারীরাও এই বিষয়ে গান্ধীজির অবদান নিয়ে বিস্মৃতপ্রায়, গান্ধিবিরোধীদের কথা তো বাদই দিলাম। আমরা যে রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হই না কেন, একটা অসুখ ঘিরে কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে একজন মানুষের প্রায় একক লড়াইকে,  একটা সামাজিক আন্দোলনের স্রষ্টাকে সেলাম জানাতে বাধ্য। আজ ওঁর জন্মদিনে জনস্বাস্থ্যের এক সামান্য কর্মী হিসেবে শ্রদ্ধার্ঘ্য সেই মানুষটিকে যার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত এর নাম, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে"।

সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম:
১৮৯৪-৯৫: ডারবান: রাস্তায় গান্ধীজির সাথে কুষ্ঠরোগীর সাক্ষাৎ।
১৮৯৭: ডারবান: নিজের বাড়িতে গান্ধীজি কুষ্ঠরোগীর পরিচর্যা করলেন।
১৯০৫: দক্ষিণ আফ্রিকা: ভারতে কাজ করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন একজন মিশনারিকে নিয়ে গান্ধীজি একটি ছোট প্রবন্ধ লিখলেন।
১৯১৩-১৪: পুনে: সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে উদ্ধার করলেন।
১৯১৩-১৫: মাদ্রাজ: একজন কুষ্ঠরোগী যিনি বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন তার ক্ষতস্থান গান্ধীজি নিজের কাপড় দিয়ে মুছে দিলেন।
১৯১৭: চম্পারণ: বিখ্যাত চম্পারণ যাত্রার সময় গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে সঙ্গে করে  পৌঁছে দিলেন গন্তব্যে।
১৯২৫: কটক: ১৯শে আগস্ট, গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৫: পুরুলিয়া: ১২ই সেপ্টেম্বর গান্ধীজি পুরুলিয়া কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৭: কটক: ২১শে ডিসেম্বর গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওয়ার্ড ছেড়ে চলে আসার আগে কয়েকজনের সাথে মেলালেন হাত।
১৯২৯: আলমোড়া: কাঁসাই, বাগেশ্বর এর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম: কস্তুরবা ট্রাস্ট গঠিত হ'ল। কুষ্ঠরোগ নিয়ে কর্মসূচি ওই ট্রাস্টের অন্যতম লক্ষ্য।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম:  গান্ধীজি দত্তপুর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন ও তার কর্ণধার মনোহর দেওয়ানকে "প্রকৃত মহাত্মা" বলে আখ্যা দিলেন।
১৯৪৫: সেবাগ্রাম: ৯ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বিখ্যাত কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ডঃ ককরেন এসে দেখা করলেন গান্ধীজির সাথে।
১৯৪৬: মাদ্রাজ: ৪ঠা ফেব্রুয়ারি চেনগেলপুট উইলিংডন কুষ্ঠ হাসপাতালে রুগীদের সাথে দেখা করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৭: ১২ই জানুয়ারি গান্ধীজি হরিজন পত্রিকায় কলম ধরলেন সিন্ধ প্রদেশের কুষ্ঠরোগীদের বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাকরণ নিয়ে উত্থাপিত বিল কে ধিক্কার জানিয়ে।
১৯৪৭: নোয়াখালী:  ৫ই ফেব্রুয়ারি তার প্রার্থনা শেষে সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগী ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব এর কথা উল্লেখ করলেন।
১৯৪৭: কলকাতা: ৪ঠা সেপ্টেম্বর গান্ধীজি দেখতে গেলেন গোবরা মানসিক হাসপাতাল, বললেন যে এদের দুর্দশা কুষ্ঠরোগীদের চেয়েও খারাপ।
১৯৪৭: দিল্লি: ২৩শে ও ২৪শে অকটবর পরপর দু'দিন প্রার্থনা শেষের সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগের উল্লেখ করলেন। বার্তা পাঠালেন সারা ভারত কুষ্ঠরোগ কর্মী সম্মেলনে।
১৯৫৪: ৩০শে জানুয়ারি অর্থাৎ গান্ধী হত্যার দিনটিকে সারা ভারত জুড়ে কুষ্ঠ-বিরোধী দিবস হিসেবে পালন শুরু।

মহালয়া চণ্ডীপাঠ ~ শঙ্খ দে



১৯৭৬ এর 'দেবী দুর্গতিহারিনী'তে উত্তম কুমার আর চিরাচরিত ভদ্রবাবু ছাড়াও বাঙালি কিন্তু মহালয়ার সকালে অন্য একজনের কণ্ঠেও চণ্ডীপাঠ শুনেছে।
নাহ্ এটা না জানায় আপনার বাঙালিয়ানা ক্ষুন্ন হবেনা, কারণ তথ্যটা খুব কম মানুষই জানে।
হ্যাঁ, এবার নামটা বলি 'নাজির আহমেদ'। কি? চমকালেন?!

হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন, যেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র উচ্চারণ নিয়েই অনেক মানুষের আপত্তি ছিল সেখানে ভারতের স্বাধীনতার আগের শেষ পাঁচ বছর একটানা আকাশবাণীর সদর থেকে গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল একজন শুধু অব্রাহ্মণ না, একজন অহিন্দুর কণ্ঠ। দেশ ভাগ না হলে হয় তো আজও সেটাই শুনতাম আমরা।

আসলে ঘটনাটা ঘটে খুবই আশ্চর্যভাবে, ১৯৪২ এর মহালয়ার ভোরে স্টুডিওতে আসতে দেররি করছেন ভদ্রবাবু, এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে.. অতঃকিম্?
তরুণ বাচিক শিল্পী নাজির এসে প্রস্তাব দিল, "আমি স্কুলে থাকতে সংস্কৃতে পাকা ছিলাম, ম্যাট্রিকে লেটার মার্কসও আছে, অনুমতি দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।"
কোনো রাস্তা না পেয়ে পঙ্কজ মল্লিক বললেন, "বেশ তবে করো যদি পারো।"
কিছু পরে স্টুডিওতে এসে হাজির বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, স্তোত্র উচ্চারণ শুনে তিনিও মুগ্ধ হয়ে বললেন, "নাজিরই করুক না, বেশ করছে তো।"

অদ্ভুতভাবে পরের বছরও একই ঘটনা, ভদ্রবাবু বলেন, "আহাঃ পঙ্কজদা, নাজির উঠতি শিল্পী, আমরা বুড়োরা আর কতদিন করবো? এরপর থেকে ওইই করুক না। গলা তো ছেলের খাসা।"

এরপর থেকে ১৯৪৬ এর শরৎ পর্যন্ত এই দায়ভার সামলে গেছেন এই মুসলমান ছেলেটাই। 
মাঝে একটা বেশ বড়ো বদল ঘটে গিয়েছিল অবশ্য, কিন্তু তার খোঁজও কেউ রাখে না। ১৯৪৪-৪৫ এর মধ্যে কতৃপক্ষের সাথে মনোমালিন্যের জন্য দ্বায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান পঙ্কজ মল্লিক, তার জায়গায় আসেন উঠতি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রথম বছর একই সুরে কোনোকিছু না পাল্টে একই ভাবে অনুষ্ঠান হলেও দ্বিতীয় বছরে অন্যরকম কিছু করতে গিয়ে জনগণের মধ্যে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৪৬ এ পঙ্কজ বাবু ফিরে এলে আবার পুরোনো মেজাজে ফেরে মহিষাসুরমর্দিনী।

কিন্তু ভাগ্যের ফের, ১৯৪৭ এর দেশভাগ। নাজির আহমেদ ফিরলেন নিজের মাটিতে। ঢাকা রেডিওতে যোগ দেন তিনি এবং আবার পুরোনো জায়গায় ফিরতেই হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে।

তবে শুধু বাচিক শিল্পীর কথা কেন, যন্ত্র শিল্পীরা কেন বাদ যাবেন?

সারেঙ্গী নিয়ে বসতেন মুন্সী, চেলো নিয়ে তারই ভাই আলী আর হারমোনিয়ামে মোহাম্মদ। এরা তিনজন তো হিন্দু নয়ই উপরন্তু বাঙালিও নন। মাতৃ ভাষা উর্দু। আর সেই জন্যই ওদের করে ফেলা কিছু ভুলে আমাদের মহালয়ার সকাল অন্য মাত্রা পায়। কি সেই ভুল?

রিহার্সাল শুরুর আগে সবাইকে বোঝানো হয় বাংলা পাঠ চলাকালীন তারা আবহ বাজাবেন কিন্তু সংস্কৃত স্তোত্র উচ্চারণ করার সময় তা থেমে যাবে, কিন্তু ওরা বোঝেননি ভাষা সমস্যায়। বীরেন বাবু ভাষা পাল্টে বাংলা থেকে সংস্কৃততে চলে গেলেও ওঁরা বুঝতে না পেরে বাজাতেই থাকে, সবাই দেখতেও থাকে যে কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তিনজন বাজিয়ে চলেছেন আর অদ্ভুত ভাবে তা মিলেও যাচ্ছে ভাষ্যের সাথে।
শুধু ওদের এই ভুলটার জন্যই পঙ্কজকুমার মল্লিক এর মতো আত্মপ্রত্যয়ী মানুষও নিজের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে সংস্কৃত স্তোত্র উচ্চারনের মাঝেও যন্ত্রানুষঙ্গ যোগ করেন। এ প্রসঙ্গে পরে তিনি বলেছিলেন, "সেদিন মুন্সীদের কান্ডটা আমার চোখ আরও বেশি খুলে দিল হে। আরও বেশি করে স্পষ্ট হল যে সঙ্গীতের কাছে, সুরের কাছে ভাষাটা কোনো ব্যারিয়রই নয়।"

এসবের বাইরেও এই অনুষ্ঠানের অন্যতম একটি গান 'শান্তি দিলে ভরি'র সুরকার কিন্তু হিন্দু নন, মোল্লার ছেলে উস্তাদ সাগীরউদ্দিন খাঁ।

এবার বুঝছেন পঙ্কজ মল্লিকের ওই কথাটা কত বড় সত্যি ?

"উৎসবের আবার বামুন-কায়েত কি? যে ভাষায় নজরুল ইসলাম কীর্তন থেকে শ্যামাসঙ্গীত সব লেখেন সেই ভাষায় কোনো জাতপাত টানবেন না।"


সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আবার ব্যোমকেশ ~ কৌশিক মজুমদার

বড় মুশকিলে পড়িয়াছি। ১৯৭০ সালে আজিকার দিনে শরদিন্দু বাবুর মৃত্যুর পর হইতে আজ অবধি কলম ধরি নাই। অনভ্যাসে বিদ্যা কিঞ্চিৎ হ্রাস পাইয়াছে। তবু বহুযুগ পরে এই মুখপুস্তিকাখানি পাইয়া কিছু লিখিতে সাধ জাগিল। খোকার পুত্র এখন বড় হইয়াছে। সেই আমাকে এই অ্যাকাউন্টখানি খুলিয়া দিয়া কহিল মনের সকল কথা ইহাতে লিপিবদ্ধ করিতে।


কিন্তু কী লিখি? জানি পাঠকদিগের আমার প্রতি এক চরম ক্ষোভ রহিয়াছে। কেন বিশুপাল বধের কাহিনি সম্পূর্ণ করিলাম না? কেন শরদিন্দু বাবুর মৃত্যুর পরেই লেখনী সংবরণ করিলাম? এতদিন এই কথা প্রকাশ করি নাই। আজ জানাই, উহাই ব্যোমকেশের শেষ কেস ছিল এবং উহাতে তাহার সম্পূর্ণ পরাজয় হয়। আমি চাহিয়াছিলাম পাঠকদের নিকট যে ব্যোমকেশ বীরের আসনে আসীন, তাহা যেন বিন্দুমাত্র লাঘব না হয়।

এই অবধি লিখিয়াছি, আচমকা ঘরে ব্যোমকেশ প্রবেশ করিল। মুচকি হাসিয়া কহিল "কি হে, আজ শরদিন্দুবাবুর উপরে ফেসবুকে কিছু লিখছ নাকি?" আমি চমকিত হইয়া কহিলাম "বুঝলে কি করে?" একখানি সিগারেট ধরাইয়া আরামকেদারায় বসিয়া পা নাচাইতে নাচাইতে ব্যোমকেশ কহিল "এ বুঝতে বুদ্ধি লাগে না। গতকাল থেকেই তোমার মধ্যে কেমন একটা অস্থির ভাব দেখছি। তাক থেকে শরদিন্দু বাবুর লাল লাল বইগুলো টেনে বার করছ। কাল অনেক রাত অবধি খোকার থেকে বাংলায় টাইপ করা শিখলে। আজ ওঁর মৃত্যুদিন। এটুকু আমি কেন পুঁটিরাম-ও বুঝতে পারবে"

ভারি রাগ হইল। কহিলাম "প্রিয় চরিত্র" গল্পে উনি তো ঠারেঠোরে তোমাকেই নিজের প্রিয় চরিত্র বলে গেছেন। ভুলে গেলে? তা তুমিই বল ওঁকে নিয়ে কিছু"। ব্যোমকেশের ভ্রুযুগল উত্থিত হইল। খানিক কী যেন ভাবিয়া কহিল "দেখ ভায়া, আমি সত্যান্বেষী। সত্য বই অন্য কিছু জানি না। ফলে কেঠো তথ্য ছাড়া কিছু বলতে পারব না। জন্ম ১৮৯৯ সালে বিহারের পূর্ণিয়াতে। কলকাতায় এসে মেট্রোপলিটন। প্রথম বই কবিতার। নাম যৌবনস্মৃতি। ১৯৩২ সালে পথের কাঁটা। যেটায়…"

"জানি জানি। মূল লেখা আমিই লিখেছিলাম। আমার ভাষা আর বানানের বহর দেখে উনি সেটা শুধরে দেন। এই তো। এই নিয়ে এত বছর বাদে খোঁটা না দিলেও পারতে"
"আরে তোমার লেখার পুরো বিশ্বাস রাখতে পারেন নি বলেই হয়তো বেনীসংহার কাহিনি নিজেই লিখেছেন" বলিয়া ব্যোমকেশ মিটিমিটি হাসিল। "আর তোমার এই সাধু চলিতের গুরুচন্ডালী। বাপ রে!!!"

ভয়ানক ক্ষুব্ধ হইয়া গুম মারিয়া বসিয়া রহিলাম। দেখিলাম অবরুদ্ধ হাসিতে ব্যোমকেশ ফুলিয়া ফুলিয়া  উঠিতেছে। কহিল "আমার সেই ডাক্তার অনুকুল বাবু কিংবা মণিলালের চেয়েও শরদিন্দুবাবু দেখছি তোমার কাছে বড় ভিলেন!" উত্তর না দিয়া উঠিয়া যাইব ভাবিতেছি এমন সময় ব্যোমকেশ সিগারেটে একটা টান দিয়া বলিল "লেখায় আমাদের ভূতান্বেষী বরদার কথাও রেখ। তাঁর আলোচনা তো আজকাল বিশেষ শুনি না"।কথাটা ভুল নয়। গোলগাল আলুর ন্যায় দেখিতে এই ভদ্রলোক যে প্রেতপুরীর সমস্ত খবরাখবর রাখেন তাহা "রক্ত খদ্যোত", "বহুরূপী" র মত কাহিনি পড়িলেই প্রতীয়মান হয়। এই সেদিন খোকার পুত্র সানডে সাসপেন্স নামক এক বেতারকাহিনীতে উহার কীর্তি শুনিয়া শিহরিত হইতেছিল। ব্যোমকেশ যখন তাহাকে জানায় সে স্বয়ং বরদার সঙ্গে মোলাকাত করিয়াছিল, তাহার পৌত্র অবিশ্বাসের হাসি হাসে। এই আজকালকার দিনের ফ্যাশন হইয়াছে। বয়সের মর্যাদা নাই, কিংবা গেঁয়ো যোগী…। যাহা হউক বরদার কথা লিখিতে হইবে। 

দরজায় বেল বাজিল। পুঁটিরাম দরজা খুলিতেই হাসি মুখে পুরন্দর পান্ডের আবির্ভাব। রিটায়ার করিয়া আমাদের পাড়ায় একখানি ফ্ল্যাট লইয়াছেন। প্রত্যহ সকালে একবার করিয়া ঘুরিয়া যান। ব্যোমকেশ আমার এই লেখার কথা জানাইতেই তিনি আনন্দিত হইয়া কহিলেন "এতো খুব ভাল। তবে আমার মতে আপনি ওঁর ঐতিহাসিক কাহিনিগুলো নিয়ে বেশি করে লিখুন। আহা! কি ভাষা! তিনিই প্রথম লেখক যিনি আগের ভুদেব কিংবা রমেশচন্দ্রর মত ইতিহাসের চোঙ দিয়ে গল্পকে বিশ্লেষণ করে নি। ইতিহাস হাতরান নি। ইতিহাস গল্পরসের হানি ঘটায়নি কোথাও। তুমি সন্ধ্যার মেঘ, কালের মন্দিরা, তুঙ্গভদ্রার তীরে, কুমারসম্ভবের কবি-তে তাঁর কল্পনা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। আপনাদের একটা গল্প বলি। ফলিত জ্যোতিষের চর্চা করতেন ভদ্রলোক। নাকি মুখ দেখেই ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। একবার যা হয়েছিল তা মারাত্মক। এক বিখ্যাত মানুষের বাড়ি প্রায়ই যেতেন আড্ডা দিতে। একদিন গেছেন, প্রৌঢ় মানুষটি আনন্দের সঙ্গে শরদিন্দুকে জানালেন তাঁর পুত্র পরীক্ষায় দারুন পাশ দিয়েছে। তিনি খুব খুশি। এবার ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন। শরদিন্দুও দারুণ খুশি। 
ভিতর বাড়ি থেকে ছেলেটি এসে তাঁকে প্রনাম করতেই তাঁর চোখমুখ কেমন বদলে গেল। এদিকে তাঁর বাবা বলে চলেছেন, ভাল সম্বন্ধ এসেছে ছেলের বিয়ের। বিয়ে করেই ছেলে বিদেশ যাবে। ছেলেটি চলে যাবার পর শরদিন্দু গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর খুব দৃঢ়ভাবে বললেন, ছেলেকে পারিবারিক ব্যবসার কাজেই লাগান মশাই। বিদেশে পাঠাবেন না। আর হ্যাঁ, বিয়েটা এখনই দেবেন না। প্রৌঢ় অবাক। কেন এমন বলেছেন শরদিন্দু? শরদিন্দু কিছুই ভেঙে বললেন না। উঠে গেলেন।
ভদ্রলোকের মন খচখচ। তবুও বিয়ে হল ঠিক সময়েই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিয়ের কিছুদন পর থেকেই ছেলেটি খেয়াল করল চোখে ঝাপসা দেখছে। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে পুরো অন্ধ। বিদেশ যাওয়া হল না ছেলেটির। হতে পারে কাকতালীয়। হতে পারে..." 

খেয়াল করি নাই, এর মধ্যেই চায়ের সরঞ্জাম সহ সত্যবতীর প্রবেশ ঘটিয়াছে।পান্ডেজি থামিতেই সে তড়বড় করিয়া কহিল "আমাদের খোকাকেও তো ছেলেবেলায় শরদিন্দুবাবুর লেখা জেনারেল ন্যাপলা, পরীর চুমু, সাপের হাঁচি পড়ে শুনাতাম। আর সদাশিবের গল্পগুলোও দারুণ মজার"

"আমার মোটামুটি লাগে" বলিতেই সত্যবতী এমন কটমট করিয়া আমার দিকে চাহিল, যে পুরাকাল হইলে ভস্ম হইতে কিছুমাত্র সময় লাগিত না। "সে কী ঠাকুরপো! আমার তো তোমার লেখাপড়ার প্রতি বেশ শ্রদ্ধা ছিল। মহারাষ্ট্রের কাহিনিকে বাংলায় এনে অমন দারুণ সব কান্ড আর কে লিখেছেন বল দেখি! আনন্দমেলায় যখন তরুণ মজুমদারের চিত্রনাট্য আর বিমল দাশের ছবিতে প্রকাশ পেত, খোকা যে খোকা, খোকার বাবা, আমি সবাই হামলে পড়তুম, ভুলে গেলে!"
তর্ক বাড়াইলাম না। আমার মুখপুস্তিকার লেখা ঢের বাকি পড়িয়া আছে। অবাক হইয়া বলিলাম "সত্যবতী! তুমিও শরদিন্দু বাবুর ভক্ত!"
"হব নাই বা কেন? কত ভাল রোমান্টিক সব উপন্যাস লিখেছেন ভাব দেখি। দাদার কীর্তি, মেঘদূত, ঝিন্দের বন্দী এমনকি ছোট গল্প ভল্লু সর্দার-ও কত্ সুন্দর। আমার ভারী ভাল লাগে। তোমার লাগে না"
খল হাসিয়া বলিলাম "জানো না বোধহয়, ঝিন্দের বন্দি আসলে প্রিজনার অফ জেন্দার অনুবাদ"
ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়িল।"সব জানি ঠাকুরপো। মাকড়সা নিজের পেটের থেকে সুতো তৈরি করে, আর মৌমাছি অন্য ফুল থেকে মধু নিয়ে আসে। কিন্তু তুমি যদি আমায় মধু ছেড়ে মাকড়সার সুতো খেতে বল তা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি খেলে খাও গে যাও"

অকাট্য যুক্তি। আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বিজয়িনীর হাসি হাসিয়া সত্যবতী কহিল "তুমি বোধহয় সিনেমা থিয়েটার বিশেষ দেখ না ঠাকুরপো। দেখলে জানতে উত্তমকুমার থেকে আবীর, অনির্বান, সব কালের সব সুপুরুষ নায়কই আমাদের ওঁর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন"। ব্যোমকেশ সলজ্জ হাসি দিল। বুঝিলাম এই বিষয়ে আজ আমার জয়লাভ করা অসম্ভব। 

যে লেখা লিখিতে বসিয়াছিলাম তাহা শেষ হইল না। থাক। এতকাল পরে নূতন করিয়া লেখা শুরু না করাই বুঝি ভাল।মৃত্যুর পর কোন কোন লেখক হারাইয়া যান। কেহ আবার চরম স্রোতস্বতী নদীর মত তীব্রবেগে জনমানসে ফিরিয়া আসেন ।শরদিন্দু এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অদ্বিতীয় লেখক।

মৃত্যুদিনে তাঁহাকে প্রণাম জানাই।

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

যতীন দাস ও রক্তঋণ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

"রক্তঋণ"

কে এই টেরেন্স ম্যাকসুইনি? তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহ এর অভিযোগে এই তরুণ আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ব্রিকস্টন  কারাগারে বন্দী করে। ব্রিটিশদের অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ৭৪ দিন অনশনের পর প্রাণ ত্যাগ করেন। আজকের দিনটা তাঁকে নিয়ে নয়, এক "ভেতো" বাঙালিকে নিয়ে। যার নাম যতীন দাস। কে এই যতীন দাস?  হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির সদস্য বিপ্লবী অজয় ঘোষ (পরবর্তীকালে সিপিআই এর সাধারণ সম্পাদক) এর ভাষায়, " কলকাতা থেকে যতীন দাস কে আনা হয়েছিল যাতে তিনি আমাদের বোমা বাঁধতে শেখান।" [সূত্রঃ ১] সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ এসেম্বলি তে ভগৎ সিং যে বোমা ছোঁড়েন সেটি যতীন দাসের বানানো।



আরেক বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোস (তিনি তখনো নেতাজি হননি), তাঁর নিজের ভাষায় তাঁর সাথে বিপ্লবী যতীন দাসের যোগাযোগ ও সম্পর্ক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,  "At the time of the Calcutta Congress in 1928, and after, he had taken a leading part in organising and training volunteers and in the Bengal Volunteer Corps of which the writer was the Chief officer or G.O.C, he held the rank of Major. ….After the Congress was over, the Volunteer Corps was maintained and branches were opened all over the Province. In this arduous work, Jatin had played an important role. "   [সূত্র ১: ]

লাহোর জেলের বিচারাধীন বন্দীদের উপযুক্ত মর্যাদার দাবিতে ভগত সিং এর সাথে যতীন দাস যোগ দেন অনশনে। ৬৩ দিন অনশন এর শেষে লাহোরে যতীন দাসের মৃত্যু হয় কারণ জেলবন্দী অবস্থায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে জোর করে গলায় নল ঢুকিয়ে তরল খাবার খাওয়াতে যায়, যাকে বলা হয় ফোর্স ফিডিং, সেই তরল ভুল করে বুকে ঢুকে নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু। কলকাতায় তাঁর শেষ যাত্রার সময় তাঁর বাবা বঙ্কিম বিহারী দাস অকাল মৃত যুবক পুত্রের মুখের দিকে তাকাতে অস্বীকার করলেন। ফোর্স ফিডিং এর চেষ্টায় নিউমোনিয়া আক্রান্ত যন্ত্রনাবিদ্ধ একটা মুখ। বললেন, "ছেলের সেই শেষ মুখটা মনে রাখতে চাই, যেটা লাহোর যাওয়ার আগে দেখেছিলাম।"

যতীন দাসের মরদেহ কলকাতায় (হাওড়ায়) নিয়ে আসার পরে তাঁর মৃতদেহ সারারাত পাহারা দেওয়ার জন্য থাকলেন সুভাষ। পরের দিন কলকাতা জুড়ে বিশাল মিছিল সহকারে অন্তিম যাত্রা কেওড়াতলার ঘাটের উদ্দেশ্যে। সংগঠন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এর সাথে সেই সুভাষ।  [সূত্র ২:]
পথের ধারে অগণিত মানুষ, মহিলা শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। মিছিলে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে অগণিত ছাত্র যুব। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড। " নবযুগের দধীচি শহীদ বিপ্লবী যতীন দাস লহ প্রণাম"। মুখাগ্নি করলেন দাদা। শেষ অভিবাদন জানালো সুভাষ বসুর নেতৃত্বে বেঙ্গল ভলান্টিয়ারস। [সূত্র: ৩]

সুভাষের নিজের ভাষায়, "So Jatin Das died on September 13. But he died the death of a martyr. After his death the whole country gave him an ovation which few men in the recent history of India has received. As his dead body was removed from Lahore to Calcutta for cremation, people assembled in their thousands or tens of thousands at every station to pay their homage. His martyrdom acted as a profound inspiration to the youths of India and everywhere student and youth organisations began to grow up. " [সূত্র ৪]

স্মরণ সভায় সুভাষ স্মৃতিচারণ করলেন একদা সহকর্মীর। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আবেগে ভেঙে পড়লো তাঁর গলা। তুলে ধরলেন কিভাবে অনশন-ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কিছুদিনের ।মধ্যে  অনশনকারীর মনের মধ্যে আসে এক বৈপ্লবিক রূপান্তর। [সূত্র ১:]

আয়ারল্যান্ড থেকে কলকাতার মেয়রকে পাঠানো টেলিগ্রামে মেরি ম্যাকসুইনি লিখলেন, " Family Terrance Mac Swiney unites patriotic India in grief and pride on death of Jatin Das. Freedom will come"। উত্তরে মেয়র লিখলেন, "India feels grateful for your message. Terrancc Mac Swiney showed the way Ireland Freedom. Jatin Das has followed him" ঠিক এইখানেই দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের সাথে বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের তফাৎ কারণ বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদী হওয়ার সাথে আন্তর্জাতিকতাবাদী ও বটে। তাই ম্যাকসুইনি পরিবারের এই সমবেদনা হাজার মাইল দূরের যতীন দাসের পরিবারের প্রতি। 

শুধু ম্যাকসুইনী পরিবার নয়, Eamon De Valera, আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের মুর্ত প্রতীক টেলিগ্রামে লিখলেন, "Jatin Das has not died in vain. He is the Indian MacSwiney. Freedom is certain" ভ্যালেরার এই আশা বৃথা যায় নি। ভারত দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। [সূত্র: ৩]। 

শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেদিনের রাজপথে নামা ছাত্র যুবরা সঠিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিলেন। অত্যাচারী শাসককে পরাস্ত করার মোক্ষম আয়ুধ প্রস্তুত করতে গেলে আত্মত্যাগ লাগে। লাগে দধীচির হাড়। 

আজ ১৩ই সেপ্টেম্বর। শহীদ দিবস। সেই যতীন দাসের মৃতু বরণের দিন, সেই যতীন দাস কারারুদ্ধ হওয়ার আগে প্রকাশ্যে যার শেষ স্লোগান ছিল "ইনকিলাব জিন্দাবাদ"। আজকে গাজা ভূখণ্ডে প্যালেস্তাইন এর নাগরিকদের ওপর সাম্রাজ্যবাদ এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে স্লোগান তোলা বামপন্থী ছাত্র যুবরাই শহীদ যতীন দাসের প্রকৃত উত্তরাধিকারী, মুচলেকা বীরের অনুগামী কোনো দক্ষিণপন্থীরা নয়, তাদের কোনো নৈতিক অধিকারই নেই বামপন্থীদের আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে, দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার। 

"শহীদ স্মরণে, আপন মরণে রক্তঋণ ....."

তথ্যসূত্রঃ
সূত্র ১: লেনার্ড গর্ডন, ব্রাদার্স এগেইনস্ট দ্যা রাজ
সূত্র ২: সুনীতি ঘোষ, দ্যা ট্র্যাজিক পার্টিশন অফ বেঙ্গল
সূত্র ৩: সি এস ভেনু, যতীন দাস দ্যা মারটার, প্রথম সংস্করণ।
সূত্র ৪: সুভাষ চন্দ্র বোস, দ্যা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল (১৯২০-১৯৪২)

সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চন্দ্রগ্রহণ ও কুসংস্কার ~ অনির্বাণ অনীক

ইতিহাসবিদ ব্রায়ান লেভ্যাক এবং অন্যান্য গবেষকরা দেখিয়েছেন যে ১৪৫০ সালের পর থেকে প্রিন্টিং প্রেস ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর ডাইনি শিকার বা witch hunt আরও তীব্র হয়ে ওঠে।



এর কারণ, প্রিন্টিং প্রেসের মাধ্যমে ডাইনি ও শয়তান সম্পর্কিত বই, ম্যানুয়াল, প্যামফ্লেট দ্রুত ও সস্তায় ছাপা সম্ভব হয়। উদাহরণ হিসেবে ১৪৮৭ সালে প্রকাশিত  berüchtigte Malleus Maleficarum বইটির কথা বলা যায়। এই বইটি ডাইনি সনাক্ত ও শাস্তি দেওয়ার "গাইডবুক" হয়ে উঠেছিল।

সেদিনের প্রিন্টিং প্রেসের জায়গাটি আজ নিয়েছে ফেসবুক, সমাজ মাধ্যম এবং দুনিয়ার নিকৃষ্টতম সংবাদ মাধ্যম ভারতীয় অনলাইন মিডিয়া।  চন্দ্র গ্রহণের প্রাক্কালে ফেসবুকের গ্রুপগুলো গত দুদিন ধরে কুসংস্কারের আড়ত হয়ে উঠেছে।  আলোচনার বিষয় গ্রহণের সময় কী খেতে নেই, কোনদিকে শুয়ে ঘুমাতে নেই, খাবার বিষাক্ত হয় কিনা -  ইত্যাদি মধ্যযুগীয় বাছ বিচার। তাতে ধুয়ো দিয়ে চলেছে গুচ্ছের অনলাইন মিডিয়া।  

গ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার থাকলেও সত্য হলো, এই সময়ে খাওয়া, ঘুমোনো বা গান-নাচ করার মধ্যে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। খাবারও তখন স্বাভাবিক থাকে; বিষাক্ত হয় না, অতিরিক্ত জীবাণু জন্মায় না, কিংবা কোনো "রেডিয়েশন"ও মিশে যায় না। কিন্তু যারা সারসত্যটা বোঝেন, ভারতীয় সমাজের নিয়ন্ত্রণ এককালে তাঁদের হাতে যতটুকু ছিল, আজ সেটুকু নিয়ন্ত্রণও তাঁরা হারিয়েছেন। এই পোস্ট ট্রুথের যুগে মানুষকে বোঝানোর সাধ্যি কারো নেই!    

অনেক মুক্তচিন্তক বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে কুসংস্কার এবং ধর্মমোহের প্রাচীরে ফাটল ধরবে। এ একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। প্রযুক্তি নিজে নিরপেক্ষ। প্রযুক্তি কার হাতে, কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করছে সমাজ বিজ্ঞানের পথে এগোবে নাকি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবে। দুনিয়ার আর দশটি বিষয়ের মতো এই বিষয়টিও পুরো দস্তুর রাজনৈতিক।  আজকের বাংলা তথা ভারত তা পদে পদে প্রমাণ করে ছাড়ছে!

শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ভারতীয় সেমিকন্ডাকটর চিপ ~ পবিত্র দাস

এই ছবিটা নিয়ে গত কয়েকদিন অনেক খবর আর আলোচনা  দেখলাম। একটা বোর্ডের চারপাশে অনেকগুলো সেমিকন্ডাক্টর চিপ গাঁথা। তার মধ্যে নয়নের মণি হল Vikram 32bit processor. দেশ উচ্ছ্বসিত এই সাফল্যে। মাস্টারস্ট্রোক। জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন...ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণত এগুলোর খুব ডিটেইলে যাইনা। এক্ষেত্রে একটু গেলাম। কারণ নিজে সরাসরি এই ইন্ডাস্ট্রিতে, এই একই কাজের সাথে যুক্ত। 
যে চিপগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ডিজাইন করা। এবং সম্ভবত চন্ডীগড় এর সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে। এখানে বলা বাহুল্য সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরি ভারতের একমাত্র যায়গা যেখানে সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরি হয়। প্যাকেজিং নয়, অ্যাসেম্বলি নয়, সরাসরি ওয়েফার তৈরি করা হয়। চিপ তৈরির সবথেকে জটিল, সবথেকে রিস্কি এবং সবথেকে লাভজনক ব্যাবসা। 


কিন্তু এখানে অনেকগুলো কিন্তু আছে। চন্ডীগড় এর এই ল্যাবের টেকনোলজি অন্তত ২৫-৩০ বছর পুরানো। ১৮০ ন্যানোমিটার CMOS নোডের ওপর বেস করে এই প্রসেসর তৈরি হয়েছে। এর নীচে কিছু বানানো সম্ভব নয় সেখানে। প্রযুক্তি বা এক্সপার্টাইজ নেই। কতটা পুরানো এই প্রযুক্তি?  আপনি যে ফোনে এই লেখাটা পড়ছেন, তার প্রসেসর নোড ৩ থেকে ২২ ন্যানোমিটার এর মধ্যে। এবার সেটাকে ১৮০ ন্যানো র সাথে তুলনা করুন। ১ ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ।
 নোড কি? খুব সহজে বললে নোড মানে একটা চিপের মধ্যে একটা ট্রানজিস্টার এর একটা ছোট্ট অংশের মাপ (গেট বলা হয়)। সেটা যত ছোট হবে ট্রানজিস্টার তত ছোট হবে আর তত একটা চিপের মধ্যে বেশী সং্খ্যায় ট্রানজিস্টার ঠেসে দেওয়া যাবে। অনেক বেশী অপারেশন একসাথে করা যাবে। একটা আধুনিক মোবাইলের প্রসেসর চিপের মধ্যে ১০-২০ কোটি ট্রানজিস্টর থাকতে পারে।
১৮০ ন্যানোমিটার নোড কম্পিউটার, মোবাইল বা খুব উন্নত কোনও প্রসেসরে আজ থেকে ২৫ বছর আগে ব্যবহার হত। এখন এই নোড মূলত গাড়ী বা মেডিক্যাল ডিভাইসে ব্যবহার হয়। 
তার মানে তো ইন্ডিয়া দারুণ ব্যবসা করছে গাড়ি বা মেডিক্যাল ডিভাইসের চিপ বানিয়ে? না। একদমই নয়। কারন চন্ডীগড় এর এই ল্যাবে বানিজ্যিক ভাবে একটাও চিপ তৈরি হয়না। এদের একমাত্র কাস্টমার হল ইসরো বা DRDO. কারন সেখানে সস্তায় দেবার বাধ্যবাধকতা নেই আবার বিশাল পরিমাণে কিছু তৈরিও করতে হয় না।
 কেন বানিজ্যিক চিপ তৈরি হয় না? কারন হল প্রফিটেবিলিটি। একটা চিপ বানাতে যদি এক মিলিয়ন ডলার খরচ হয়, তাহলে পরের ১০০ মিলিয়ন চিপ বানাতে ১ ডলার করে খরচ হবে। মনে করুন কয়েক কোটি ট্রানজিস্টর আছে একটা ৫ মিলিমিটার জায়গায়। সেগুলো আবার একটা আরেকটার সাথে বৈদ্যুতিক ভাবে যুক্ত, মানে বাড়ির অয়ারিং আর কি। এবার তাহলে সেরকম একটা সিস্টেমের ভেতর, অন্তত কয়েকশো কোটি জাংশন আর ইন্টারকানেকশন থাকবে। আর সেই ছোট্ট সার্কিট সিলিকনের ওপর বানানো হবে। একটা প্রফিটেবল প্রসেসে ইল্ড ৯০-৯৯% অব্দি হতে পারে। মানে প্রতি ১০০ টা চিপে ৯৯ টা এই কয়েকশো কোটি জিনিসপত্র ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে। কোথাও একটাও ভুল নেই। মাত্র একটা কোথাও কানেকশন খারাপ হলে গোটা চিপ কাজ করবে না। এই লেভেলের প্রযুক্তিগত প্রেসিশন মান্য করা হয়। এবং ইঞ্জিনিয়ার রা সেটা করতে সক্ষম। চিপ ইন্ডাস্ট্রি তে যেসব প্রসেস আছে সেগুলো সম্ভবত মানবজাতির বানানো সবথেকে স্টেবল এবং সবথেকে কন্ট্রোলড প্রসেস। সেগুলোর জন্য দরকার টাকা,প্রচুর স্কিলড ওয়ার্কার আর লাভের কথা না ভেবে প্রচুর প্রাথমিক ইনভেস্টমেন্ট। চন্ডীগড় এর ল্যাবে এগুলোর কোনওটাই নেই। তাই mass প্রোডাকশন হয় না। 
যা দেখছেন এই ছবিতে তার প্রযুক্তি অন্তত ২৫ বছর আগেকার।

মোদী সরকার গুজরাটে একটা ফ্যাবরিকেশন ফেসিলিটি বানানোর চেষ্টা করছে।।এছাড়া অন্য কোনও উদ্যোগ আপাতত নেই। সেট কতটা সফল হবে সময় বলবে।

বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অমৃতা শাহির ~ অরিজিত গুহ

মহব্বতো কি পরখ কা ইয়েহি তো রাস্তা হ্যায়
তেরি তালাশ মে নিকলু তুঝে না পাউ ম্যায়'



 
সাতের দশকের কোনো এক সময়। হিন্দি সিনেমার প্রখ্যাত গীতিকার শাহির লুধিয়ানভির কোনো গানে সুর দেবেন সুরকার জয়দেব। দুজনে মিলে একটা গানের ব্যাপারে আলোচনা করে চলেছেন। শাহির কিছু লিখছেন আর গুনগুনিয়ে সেই লাইনের সুর ভেজে চলেছেন। হঠাৎ জয়দেবের চোখ পড়ল একটা কাপের দিকে। কফির তলানিটা পড়ে শুকিয়ে রয়েছে। বেশ কয়েকদিন আগের কফি খাওয়া একটা নোংরা কাপ। 'এটা এখানে কী করছে?' বলে নোংরা কাপটা হয়ত তুলে অন্য জায়গায় রাখতে যাবেন জয়দেব, খেঁকিয়ে উঠলেন শাহির। 'হাত মত লাগানা'। একদম ছোঁবে না ওটাকে। সরো, সরো বলছি। ঘাবড়ে গেলেন জয়দেব। কি আছে কফির কাপে বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পর শাহির নিজেই বললেন, 'কাপটায় অমৃতা কফি খেয়ে গেছে শেষ যখন এসেছিল। ওর ছোঁয়া লেগে রয়েছে কাপটায়। ওটাতে হাত লাগিও না।'
    জয়দেব বুঝতে পারলেন সবই। শাহির অমৃতার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে কারো বাকি ছিল না সেই সময়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। সম্পর্কের পরিণতি হয়ত কিছু ছিল না। আর ততদিনে প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছরের সম্পর্ক এসে ঠেকেছিল তলানিতে। শাহির তখন গায়ক সুধা মালহোত্রার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তাও হয়ত মাঝেমাঝে অমৃতার সাথে দেখা হত। দুজনে বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। শাহির একের পর এক সিগারেট টেনে যেতেন আর অমৃতা প্রীতম কাপের পর কাপ কফি। কিন্তু দুজনের কেউই কোনো কথা বলতেন না। নিস্তব্ধতার মধ্যেই লোকানো থাকত অনেককিছু। আসলে নৈঃশব্দেরও বাঙ্ময় প্রকাশ আছে কিনা!

   ৩১ আগস্ট ১৯১৯ এ তৎকালীন পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় যখন অমৃতার জন্ম হয়েছিল তার কয়েকবছর আগেই ব্রিটিশ ভারতে ঘটে গেছে এক নৃশংস গণহত্যার কাহিনী। ১৯শে এপ্রিলের জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা ভারত সহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টকেও। এক জ্বলন্ত অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থেকেছিল পাঞ্জাব। তার কয়েকমাস পরে সেই পাঞ্জাবেই জন্ম হয়েছিল অমৃতা নামের আরেক অগ্নিপিণ্ডের। 
   ৪৭ এর দেশভাগ যে দুটো প্রদেশকে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল তার নাম পাঞ্জাব আর বাংলা। এই দুটো প্রদেশই দেশভাগের ফলে তৈরি হওয়া ক্ষত আজও বয়ে নিয়ে চলেছে। পাঞ্জাবের প্রখ্যাত কবি হীর রনঝা কাহিনীর সৃষ্টা ওয়ারিস শাহ কে কবর থেকে তুলে এনে যখন অমৃতা প্রীতম বলেছিলেন তাঁর হীর রনঝা কাহিনীর পৃষ্ঠায় আরেকটা অধ্যায় যোগ করতে, যেখানে শুধু ৪৭ এর পাঞ্জাবের মেয়েদের ভাগ্যবিপর্যয় লিপিবদ্ধ থাকবে, তার বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই কবিতার জগতে স্থান করে নিয়েছিলেন অমৃতা। এর জন্য অবশ্য বাবা কর্তার সিং এর অবদানও ছিল বেশ ভালোরকম। কর্তার সিং নিজেও ছিলেন একজন কবি। বাবার সেই ধারাই বর্তেছিল তাঁর ওপর। প্রথমদিকে সাধারণ কিছু কবিতা লিখলেও লাহোরের প্রগতিশীল পরিবেশের প্রভাবে পড়ে কালজয়ী কিছু সাহিত্য রচনা করা শুরু করেন। অমৃতার যখন এগারো বছর বয়স, তখন বিপত্নীক কর্তার সিং লাহোরে চলে আসেন। তখন থেকেই প্রোগ্রেসিভ লেখাপত্রের সাথে পরিচয় হতে থাকে। তারই ফলশ্রুতি 'আজ আখখান ওয়ারিস শাহ নু'। 'An Ode to Waris Sha'. এছাড়াও দেশভাগের ওপর আরেকটা বই যা তাঁকে অমর করে রাখবে তা হচ্ছে 'পিঞ্জর'। ভীষ্ম সাহানির 'তমস' আর অমৃতা প্রীতমের 'পিঞ্জর' একই সাথে উচ্চারিত নাম। 
  ষোলো বছর বয়সে বাড়ি থেকে ঠিক করে দেওয়া ছেলে প্রীতম সিং এর সাথে বিয়ের পর অমৃতা কউর থেকে অমৃতা প্রীতম বলে পরিচিত হতে থাকেন। তবে ছোটবেলার ওই বিয়েটা কোনোদিনই তাঁকে সুখ বা শান্তি কোনোটাই দেয় নি। ১৯৪৪ সাল নাগাদ লাহোরের এক মুশায়রাতে শাহির লুধিয়ানভির সাথে যখন দেখা হয় তখন শাহির মজেছিলেন অমৃতার রূপে আর অমৃতা মজেছিলেন 'কলম কা জাদুগর' শাহিরের কবিতায়। 
    দেশভাগের পর লাহোর থেকে প্রীতম সিং সস্ত্রীক দিল্লিতে চলে এলে শাহিরের সাথে সম্পর্কে আরো জড়িয়ে পড়তে থাকেন। তাঁদের দুজনের আদানপ্রদান হওয়া কিছু প্রেমপত্র সাহিত্যের এক ক্লাসিক নিদর্শন হয়ে রয়েছে। অমৃতা নিজের বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন শাহিরের হাত ধরে, কিন্তু শাহিরের আদর্শবাদী মূল্যবোধ আর তার থেকেও বড় কথা দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেরানোর মানসিকতা শাহিরকে বাধা দিয়েছিল সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে। অমৃতার কথায়, 

'ম্যায়নে টুটকে প্যেয়ার কিয়া তুমসে
কেয়া তুম ভি উতনা কিয়া মুঝসে

     অমৃতা জানতেন শাহির সম্পর্ককে পূর্ণতা দেবেন না। তাও বারেবারে ছুটে এসেছেন কোনো এক অজানা টানে। এমনকি শাহির যখন জড়িয়ে পড়েছেন সুধা মালহোত্রার সাথে তখনো শাহির ছাড়া আর কারো কথাই ভাবেন নি। প্রীতম সিং এর সাথে বিয়েটা হয়ত ভাঙতই। শাহির সেখানে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন। 

'ম্যায় চুপ শান্ত অওর আদৌল খাড়ি থি
সির্ফ পাস ব্যয়ঠে সমুন্দ্র মে তুফান থা।
ফির সমু্ন্দ্র কো খুদা না জানে কেয়া খয়াল আয়া
উসনে তুফান কি এক পোটলি বান্ধি
মেরে হাথো মে থামাই
ঔর হাস কর কুছ দূর হো গয়া'

বারেবারে অমৃতার কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছেন শাহির। শুধু শাহির শাহির আর শাহির। জীবনে আর অন্য কেউ যেন ছিল না। ১৯৬০ এ বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসার পর শাহিরের কাছে আশ্রয় চান নি। ততদিনে সাহিত্যের জগতে অমৃতা প্রীতম এক বিশিষ্ট নাম। ইতিমধ্যে পুরষ্কারও পেয়ে গেছেন কয়েকটা। তাঁর লেখায় বারেবারে ফিরে আসে মেয়েদের লড়াই আর মেয়েদের আত্মপরিচয়ের কথা। শুরু করেন পাঞ্জাবী কাগজ 'নাগমনি' পার্টনার ইমরোজকে সাথে নিয়ে। এই ইমরোজই শেষ অব্দি জীবনে থেকে গেছিলেন, যদিও কোনোদিনও বিয়ে করেন নি আর ইমরোজকে। লাইফ পার্টনার হিসেবেই থেকে গেছেন উনি।

   অনেকের অভিযোগ ছিল অবশ্য শাহিরের মা'র জন্য নাকি শাহির আর অমৃতার সম্পর্ক পরিণতি পায় নি। কারণ সিঙ্গল মাদার হিসেবে শাহিরকে মানুষ করার পর শাহিরের একটা আলাদা টান ছিল নিজের মায়ের প্রতি। 'ও আপকি বহু বন সকথি থি' অনেক অভিমানে মা'কে বলেছিলেন এই কথাগুলো। কিন্তু ততদিনে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। সত্যিই কি শেষ হয়? তা নাহলে শাহিরই বা লিখবেন কেন 'মেহফিল সে উঠ যানে বালো/ তুম লোগো পার কেয়া ইলজাম/ তুম আবাদ ঘরো কে বাসি/ ম্যায় আওয়ারা ঔর বদনাম।' লেখার সময়ে হয়ত অমৃতাই এসেছিল চোখের সামনে। ঘর করতে না পারার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে সবসময়।

    শেষবার যখন ফিরে আসেন শাহিরের কাছ থেকে, তখন লিখে গেছিলেন 'তুমহারে দরখতি কি তহানি কা যো আসরা মিলা/ মেরে টুটে হুয়ে দিল কা পারিন্দা ঔহি রুক গয়া। যখন তোমার গাছের শাখা খুঁজে পেলাম/ সেখানেই মরে গেল আমার ভাঙা এ মনের পাখি। আর তার সাথে বায়রনের একটা কোট "In her first love, woman loves her lover/ In all the others, all she loves is love."। শাহির বলেছিলেন 'আপ জানে সে পেহলে ইসকা তার্জুমা কর দেঙ্গি?' শাহির অমৃতাকে নিয়ে মনোকষ্টে ভুগলে তাঁকে 'তুম' বলার বদলে 'আপ' বলে ডাকতেন। শাহির লিখেছিলেন তুম চলি যাওগি, পারছাইয়া রহ জায়েঙ্গি/ কুছ না কুছ ইশক কা রানাঈয়া রহ জায়েঙ্গি। 'শাগুন' সিনেমায় মহঃ রফি গানটা গাওয়ার পর শাহির লুধিয়ানভি রফিকে অনুরোধ করেন গানটা আবার রিটেক করার জন্য। ইশক শব্দটা হুস্ন দিয়ে পরিবর্তন করেন। বলেছিলেন অমৃতার জন্য এই লাইনটা লিখেছিলাম। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি জানি, কিন্তু এটাকে যতটা পারা যায় আমার হৃদয় দিয়ে প্রকাশ করব। মহঃ রফি খুশির সাথে গ্রহণ করেছিলেন অনুরোধ। একদম শেষে শাহিরের কথাতেই বলা যায়

'মহব্বত যো আনজাম তক পহুঁছি নেহি
ওয়াহি মহব্বত হ্যায়, বাকি কুছ নেহি'।

আজ ৩১শে অগাস্ট অমৃতা প্রীতমের জন্মদিন। অমৃতা প্রীতম এলে অবধারিতভাবেই চলে আসে শাহির লুধিয়ানভির নাম। দুজনের এই নিরুচ্চারিত ভালোবাসাকে ধরা কারো পক্ষেই হয়ত সম্ভব নয়।


সিনেমার ধারাবিবরণী ~ সুচেতনা দত্ত

জি বাংলায় সিনেমায় একটা বাংলা সিনেমা হচ্ছে।

মুনমুন সেন ফুলশয্যার খাট থেকে জর্জ বেকারকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
জর্জ বেকারকে তাড়িয়ে দিয়ে মুনমুন সেন তার পোষা ডোবারম্যানকে নিয়ে শুয়েছে।
জর্জ বেকার মনের দুঃখে এমন একটা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছে, যে ঘরে একটা কালী মূর্তি, আর তিন দেওয়ালে তিনটে বন্ধ জানলা।
মুনমুন সেন ফুলশয্যার ঘরে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
 জর্জ বেকার তিনটে টেবিল জোড়া লাগিয়ে বিনা চাদরে ঘুমোচ্ছে বলে বেজায় শীত করছে। কারণ বন্ধ জানলার ঘরটার ভিতরে প্রবল ঝড় উঠেছে।
মুনমুন সেনের পাশে শোয়া ডোবারম্যানটা টেলিপ্যাথি করে টের পেয়েছে বন্ধ জানলার ঘরটার ভিতরে সোঁ সোঁ করে ঝড় হচ্ছে বলে জর্জ বেকারের ভীষণ শীত করছে।
নিজের টেলিপ্যাথি ক্ষমতার উপর বিশ্বাস না রেখে ডোবারম্যান নিজের চোখে জর্জ বেকারকে দেখতে যায়।
জর্জ বেকারকে টিউনিং ফর্কের মতো কাঁপতে দেখে ডোবারম্যান মুনমুন সেনের ঘরে ফিরে আসে এবং ঘুমন্ত মুনমুনের গায়ের থেকে চাদরটা মুখে করে খুলে নিয়ে গিয়ে জর্জ বেকারের গায়ে সেই চাদরটা চাপিয়ে দিয়ে এসে ভাল পোষা কুকুরের মতো মুনমুন সেনের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
মুনমুন সেন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে ডোবারম্যানকে জিজ্ঞেস করে "আমার চাদরটা কোথায় গেল রে?"
সেই সময় গদগদ মুখে জর্জ বেকার চাদরটা ফেরত দিতে আসে।
এই চরম ক্লাইম্যাক্সের মুহূর্তে বদমাইশ ডোবারম্যান খাট থেকে নেমে পড়ে কোথায় একটা চলে যায় জর্জ বেকারকে কেস খাইয়ে দিয়ে।
জর্জ বেকারের হাতে চাদরটা দেখে মুনমুন সেন ভাবে রাতে জর্জ বেকার এসে মুনমুনের চাদর খুলে নিয়ে গেছে।
তারপর মুনমুন বেজায় গালাগালি করে রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেছে।
তাই মুনমুনের বাবা কালী ব্যানার্জী সব সম্পত্তি জর্জ বেকারকে লিখে দিয়েছে।

আমি কি সিনেমাটা এরপরেও দেখব?
পুনশ্চঃ  বন্ধুদের অনুরোধে ধারাবিবরণী দিচ্ছি এর পর থেকে।

জর্জ বেকার শ্বশুরের আদেশ পালন করতে চাবাগানে রঞ্জিত মল্লিকের বাংলো থেকে মুনমুনকে ফিরিয়ে আনতে গেছে।
মুনমুন জিজ্ঞেস করেছে জর্জ বেকার কি ওর ভাল চায়? 
জর্জ বেকার হ্যাঁ বলেছে।
মুনমুন উত্তরে বলেছে, তাহলে যেন জর্জ বেকার নিজেকে মুনমুনের "কেয়ারটেকার" বলে পরিচয় দেয়।
জর্জ বেকার এক গাল হেসে বলেছে, "মা কালী আপনাদের সহায় হোন।"

এখন আবার বিজ্ঞাপন বিরতি।

মুনমুনঃ মা কালী সহায় হলে চলবে না। আপনাকে সহায় হতে হবে। আমার বাবাকে গিয়ে বলুন রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে।
জর্জ বেকার (রঞ্জিত মল্লিকের উদ্দেশ্যে) ঃ আই উইশ ইউ অল দা বেস্ট।
জর্জ বেকার (ডোবারম্যানের উদ্দেশ্যে) ঃ চলি রে বিট্টু। আর বোধহয় দেখা হবে না। তোর মায়ের ভাল করে দেখাশোনা করিস।

শয়তান কুকুর কালী ব্যানার্জীর চিঠি রঞ্জিত মল্লিককে দিয়ে দিয়েছে। চিঠিতে লেখা আছে জর্জ বেকার মুনমুনের বর এবং কালী ব্যানার্জীর সব চা বাগানের মালিক।
রঞ্জিত মল্লিক জিপগাড়ি নিয়ে জর্জ বেকারের পিছনে তাড়া করেছে।
রঞ্জিত মল্লিক জর্জ বেকারকে বলছে, "আপনি মালিক, আমি আপনার কর্মচারী।" 
রঞ্জিত মল্লিক মুনমুনকে জর্জ বেকারের সিঁদুর পরতে বলছে। সিঁথি সাদা রাখতে মানা করছে।

মুনমুন সেন কালী ব্যানার্জীকে থ্রেট দিচ্ছে, "দেখি ওর মা কালী ওকে কী করে বাঁচায়!"
কালী ব্যানার্জী থ্রেট খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মরে গেছে।

জর্জ বেকার মুনমুন সেনের ক্লাবের মেম্বারশিপের রিনিউয়াল ফি দিচ্ছে না। মাধবী মুনমুনের হয়ে জর্জ বেকারকে বলছে টাকা দিয়ে দিতে।

বিজ্ঞাপন বিরতি।

সৌমিত্র ব্যানার্জী ভাড়াটে খুনি নিয়ে এসে যেই বলেছে "এবার দেখি সালাকে কে বাঁচায়?" বিট্টু ডোবারম্যান এসে সৌমিত্র ব্যানার্জীর জামা কামড়ে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে একটা গাছের উপর তুলে দিয়েছে সৌমিত্র ব্যানার্জীকে।
তারপর সৌমিত্র ব্যানার্জী ভিতরে সাদা গেঞ্জি পরে আছে দেখে সৌমিত্র ব্যানার্জীর জামা খুলে এনে পাঞ্জাবি পরা জর্জ বেকারের হাতে দিয়ে দিয়েছে।

মুনমুন সেনের বন্ধু শুভ্রার বিয়েতে জর্জ বেকার মুনমুন সেনের হয়ে এক লক্ষ টাকা দিয়ে দিয়েছে। সেই শুভ্রা যে ফুলশয্যার রাতে মুনমুনকে থ্রেট দিয়ে বলেছিল যে মুনমুন যদি জর্জ বেকারকে আর কষ্ট দেয়, তাহলে জর্জ বেকারকে একদিন শুভ্রার ঘরের বিছানায় পাওয়া যাবে।

শুভ্রার বাবা মুনমুনকে বলছে শুভ্রার কন্যাসম্প্রদানের সময় মুনমুন যেন শুভ্রার বাবার পাশে থাকে।

বিজ্ঞাপন বিরতি

শুভ্রার বাবা মুনমুনকে বলছে, "তোর মতো মেয়ে কি স্বামীনিন্দা সহ্য করতে পারে? জর্জ বেকার তোর মতো দেবীকে বৌ হিসেবে পেয়ে ধন্য হয়েছে।"

মুনমুন জর্জকে ঃ তুমি নিজেকে এত ছোট করলে কেন? 
জর্জ ঃ যাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি, তাকে তো আমি বড় করবই।

শুভ্রার বাসরে সৌমিত্র ব্যানার্জী জর্জ বেকারকে গান গাইতে বলেছে বলে মুনমুন রেগে গিয়ে জর্জ বেকারকে নিয়ে বাসর থেকে চলে যেতে চাইছে।

জর্জ বেকার বাসরে "আমি সবার সামনে ছোট হব। মা কালীর নাম করে একটা গান শুনিয়ে দিই" বলে একটা প্রচণ্ড সেল্ফপিটির গান গাইছে। মুনমুন বাসর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ডেকোরেটর আর ক্যাটারারের সাইনবোর্ডে মাথা ঠেকিয়ে জর্জ বেকারের সেল্ফপিটির গান শুনছে।

শুভ্রা নিজের বাসি বিয়ের সকালে এসে মুনমুনকে হাজব্যান্ড সোয়াপিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। 

মুনমুন তাই রাতে কাঁদছে। নিজের খাটের চাদর এনে তিনটে টেবিল জোড়া লাগিয়ে ঘুমন্ত জর্জ বেকারকে চাদরমুড়ি দিয়ে ডোবারম্যান বিট্টুকে খুব বকে দিয়েছে, "আমি নাহয় ওকে ভালবাসি না। কিন্তু তুই তো ওকে ভালবাসিস। কিছু তো করতে পারতিস, দেখছিস না শীতে কষ্ট পাচ্ছে!" বলে। কিন্তু এখন ঘরের ভিতর ঝড় হচ্ছিল না। জর্জ বেকারও এসএইচএমে কাঁপছিল না।

বিজ্ঞাপন বিরতি

রঞ্জিত মল্লিক জর্জ বেকারের সই নিতে এসেছে। জর্জ বেকার রঞ্জিত মল্লিককে বাড়িতে মুনমুনের কাছে পাঠাতে চাইছে। কিন্তু রঞ্জিত মল্লিকের তাড়া আছে, দার্জিলিং মেলে ফিরতে হবে বলছে।

সৌমিত্র ব্যানার্জীকে মুনমুন চড় মেরেছে বলে ওর চ্যালাদের দিয়ে মুনমুনকে মলেস্ট করাচ্ছে। জর্জ বেকার সৌমিত্রকে বলছে মুনমুনকে ছেড়ে দিয়ে জর্জ বেকারকে ধরতে।

সৌমিত্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি, জর্জ বেকারকে বলেছে চা বাগানগুলো সৌমিত্রকে দিয়ে দিতে। আর যতক্ষণে জর্জ বেকার দলিল আনবে ততক্ষণ মুনমুনকে মাঠে নিয়ে গিয়ে মলেস্ট করা হবে।

জর্জ বেকার কাগজ আনতে যাচ্ছিল রাজি হয়ে। কিন্তু রঞ্জিত মল্লিক খুব রেগে গিয়ে একাই সবাইকে মেরে পাট করে দিয়েছে।

সৌমিত্র ব্যানার্জীর ঘাড় ধরে মুনমুনের পায়ে ফেলে রঞ্জিত মল্লিক বলেছে "মাকে যেমন ভক্তিশ্রদ্ধা করো, তেমন করে পায়ে ধরে মা ডেকে ক্ষমা চাও।"
সৌমিত্র মুনমুনকে ঃ "মা আমাকে ক্ষমা করে দাও।"

মুনমুন মা কালীকে অঞ্জলি দিতে দিতে গান গাইছে, "তোমার চরণ ছুঁয়ে বলছি আমি মা, চাই না সোনাদানা... ওর জীবনের আনন্দতে চাই না আমি বেড়া দিতে...ও যেখানে সুখ খুঁজে পায় ওকে দে সেই ঠিকানা।"

বিজ্ঞাপন  বিরতি

মুনমুন সেনকে জর্জ বেকার জড়িয়ে ধরেছে। তাই দেখে বিট্টু ডোবারম্যান আড়মোড়া ভাঙছে।

জর্জ বেকার আর মুনমুন মাধবীকে প্রণাম করতে গেছে। কিন্তু মাধবী নিজের প্রণাম বুঝে না নিয়ে আগে মরে যাওয়া কালী ব্যানার্জীকে প্রণাম করতে বলেছে। যেই প্রণাম করেছে কালী ব্যানার্জীর ছবিতে অমনি সিনেমা শেষ হয়ে গেছে।

অতএব সিনেমার ধারাবিবরণীও শেষ হল।

বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গনেশ পুজোর রমরমা ~ মানস নাথ

অনেকেই আছেন যারা রাজনীতিটা প্রফেশন মনে করেই করেন৷ তাতে দোষের কিছু দেখি না। আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যতই বলুন সমাজসেবা করতে এবং মানুষের জন্য কাজ করতে হলেই রাজনীতিতে আসুন বাস্তবে তা খুব একটা  সম্ভব হয় না৷ কারণ রাজনীতি করতে টাকা লাগে, সমাজসেবা করতেও লাগে। প্লাস নিজের এবং পরিবারের ভরনপোষণ খরচখরচা রয়েছে। তো সারাদিন ধরে অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ালেন, কাঁধে করে মৃতদেহ অন্তেষ্টি করতে নিয়ে গেলেন কিন্তু দিনের শেষে আপনার খরচা আপনাকেই তুলতে হবে। ঠিক কিনা? 



এবার আপনি বলবেন রাজনীতিতে কি পয়সা নাই?  

নেতাদের ফ্ল্যাট ফুঁড়ে কোটি কোটি টাকার বান্ডিল এমনি এমনি বেরোচ্ছে! আহা, সেতো বিগ বিগ নেতা মন্ত্রীদের। থিংক লোকাল৷  আসুন তো হিসাব করি একটা এলাকায় কতজন নেতা থাকতে পারে। সবার উপরে অনুপ্রেরণা আর কালিঘাট, ওটা বাদ দিয়েই হিসাব করছি৷ ধরুন একজন হল এম পি, একজন হল এম এল এ,  একজন হল কাউন্সিলার। পঞ্চায়েত হলে  প্রধান, মেম্বার  এগুলো নির্বাচিত পোস্ট। এছাড়া দলের  সভাপতি বা সেক্রেটারি। দলের ছাত্র যুব শাখার এক দুজন কচি নেতা, যে স্কুল কলেজগুলো দেখবে। এবারে বাদবাকি যারা তারা হল অনুগামী  চ্যালাচামুণ্ডা।

এরা বিভিন্ন নেতার আশেপাশে থাকে, এদের যথেষ্ট কামাই। ইঁট বালুর সাপ্লাই, সিন্ডিকেট, কন্ট্রাকটারি এদেরই হাতে। এখানেই হল আসল ক্ষীর। এর কন্ট্রোল হাতে নেওয়ার জন্যই এত কষ্ট এত ত্যাগ স্বীকার এত সমাজসেবা।

এবার দেখেনি একটা এলাকায় ক্ষমতার ভরকেন্দ্র মানে টাকাপয়সা বিলিবন্টন কার হাতে। এম পি দূরের শুকতারা। এইসব এঁটোকাঁটায় সচারাচর মুখ মারেন না। এম এল এ প্রভাবশালী হলে সুতো তার হাতে থাকে, শিল্পী বুদ্ধিজীবী হলে তার রোল অতিথি শিল্পীর। কর্পোরেশন মিউনিসিপালিটিতে অনেকটাই ক্ষমতা কাউন্সিলারের হাতে। তাই কাউন্সিলর হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতাও বেশি।

এক একটা এলাকায় আট দশজন লবি করতে থাকে কাউন্সিলর পদের জন্য। তার উপর আবার মহিলা বা এস সি / এস টি সংরক্ষিত হলে গেলে পারমুটেশন কম্বিনেশন বদলাতে থাকে।

আচ্ছা এই যে একটা ওয়ার্ডে আট দশজন কাউন্সিলর হওয়ার জন্য লড়াইতে থাকে প্রফেশনের শুরুরদিকে  তাদের ইনভেস্টমেন্ট  কেমন?  প্রথম যোগ্যতা ঠিকঠাক ল্যাজ ধরা। এম পি,  এম এল এ বা পার্টির বড় নেতার সাথে সুসম্পর্ক। যাকে বলে দাদা/ দিদি ধরা। পরের কাজ কিছু চামচা পোষা। যারা তার আশেপাশে থাকবে সমাজসেবা করার সময়। একা একা তো আর মড়া কাঁধে করে শ্মশানে কবরস্থানে যাওয়া যায়  না!  পরের স্টেপে ধরতে হবে কোন শাঁসালো ক্লাব। যারা বেশ নামকরা পুজো করে থাকে। একেবারে বড়বড় দুর্গাপূজা কমিটিগুলোতে ঢোকা তো মুখের কথা নয়। একজিস্টিং বিধায়ক বা কাউন্সিলর সেখানে অলরেডি অনুপ্রেরণায় রয়েছেন৷ তাকে সরিয়ে নতুন নেতা হতে চাওয়া মুখটি জায়গা নেবে কেমন করে?  এর উপর আবার রয়েছে নেপোটিজম৷ নেতার ছেলে মেয়েদের ডায়রেক্ট লাইন৷ 

দুর্গা, কালী এরা হল ওপরতলার। আগে থেকেই বড় নেতাদের স্নেহধন্য। বিশ্বকর্মা এখন রিকসাওয়ালা অটোওয়ালাদের হাতে, কারখানা ফারখানা কবেই উঠে গেছে! লক্ষ্মী কার্তিক ঘরোয়া। সরস্বতী ছোটদের। রবিঠাকুরের আর সেই আগের বাজার নেই। শুরুটা তাই রামনবমী, হনুমান বা গনেশপুজো দিয়েই করা ভালো। এলাকায় কচিনেতার ছবিসহ গনেশ পুজোর ফেস্টুনে ছেয়ে দিতে হবে। পাড়ার এমাথা থেকে ওমাথা মাইক আর ননস্টপ মারাঠি গান। 
 এতকিছুর পরেও কপালে সিঁকে নাও ছিঁড়তে পারে। কিন্তু লেগে থাকার তো কোন বিকল্প নেই রাজনীতিতে৷ ভাবলে একটু খারাপই লাগে। একবার ফস্কে গেলে চার চারটি বছরের অপেক্ষা। দেঁতো হাসি মুখে মেখে নতুন কাউন্সিলারের সাথে মিছিলে মিটিংয়ে অনুষ্ঠানে আলাপে হে হে চালিয়ে যেতে হবে কিন্তু স্বপ্ন মরতে দেওয়া যাবে না। বছরে একবার অন্তত ফ্লেক্সে ব্যানারে নিজের নাম তুলে এলাকাবাসীকে পুজো, দেওয়ালি বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে হবে।আর ছোট ছোট পুজোতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হবে।  এটুকু ইনভেস্টমেন্ট মাস্ট। 

তাহলে কথা হল হাতেখড়ি করতে গনেশ হল প্রথম পছন্দ। সিদ্ধিদাতা বলে কথা।

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফুটলো ছাতিম ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

কোথাও কিছু ফুটলো ছাতিম, কোথাও কিছু পড়লো ঝরে
ভাবতে এ সব ভাল্লাগে না, বর্ণমালার কোন অক্ষরে
লিখছো ফাঁকি আরাত্রিদিন ঋণ মেটানোর ক্লান্ত আভাস
খাতক আমিই নই মহাজন, ধার করে খাই বারোটা মাস

কিন্তু সে সব কূটকচালি, হিসেব নিকেশ, পাওনা দেনা
ভাবছো যখন অনন্যমন, আর কি তোমায় যাচ্ছে চেনা?
আটপহুরের খোলস ছিঁড়ে তুলছো ধনুক লক্ষ্যবেধী
বিদ্ধ করবে? আপত্তি নেই, বিষ যেন হয় মর্মভেদী

আগুন যখন পোড়াচ্ছে রোজ বলবো কি আর কেমন জ্বালা
রঙ মেখেছি শরীর জুড়ে, জগৎ আমার নাট্যশালা
এই মুহূর্তে বাঁচছি প্রবল এই মুহূর্তে যাচ্ছি মরে
ভাবতে এ সব ভাল্লাগে না, কোথায় ছাতিম পড়লো ঝরে

শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫

কলকাতা মেট্রো ~ রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র

বামফ্রন্টের সমস্যা বামফ্রন্ট নিজেই। ভূমিসংস্কার থেকে অপারেশন বর্গা হয়ে, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, ছাত্রীদের স্টাইপেন্ড, একের পর এক নিয়োগ কমিশন গঠন করে সরকারী চাকরির নিয়োগে বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা, দ্রুততা আর নিয়মানুবর্তিতা আনা ইত্যাদি কোনটারই প্রচার তারা করেনি, করতে চায়নি। আমি বামদলের দায়িত্বশীল লোকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, এইরকম প্রচারের বিষয়ে তাদের রীতিমত অনীহা আছে। এরা মনে করেন,  সরকারের স্বাভাবিক কর্তব্যবস্তু দলীয় প্রচারে ব্যবহার করা উচিত নয়! এসব ভদ্রলোকি রাজনীতির বিন্দুবিসর্গ আমার অন্তত বোধগম্য না। ক্রেডিট ঝাঁপার যুগে ক্রেডিট হেলায় হারানো কি রকম রাজনীতি তাও আমার জানা নেই। এই যে একটু পরই বামফ্রন্ট আমলের প্রজেক্টকে নিজের ক্রেডিট হিসেবে দাবী করবেন মোদীজ্বি বা এই প্রজেক্টের শিলান্যাসের ক্রেডিট মমতার বলে দাবী করছে তৃণমূল, এইটাই তো যুগধর্ম। এইটাই তো রাজনীতি।


মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৫

ডাইরেক্ট একশন ডে, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ~ রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র

প্রোপাগান্ডা : " ২৯ জুলাই ১৯৪৬, ময়দানের সভা থেকে জ্যোতি বসুর উপস্থিতিতে সুরাবর্দী ডায়রেক্ট একশন ডে ঘোষণা করে" 


সত্যতা : ২৯ শে জুলাই ১৯৪৬ আদৌ মুসলিম লীগ বা সুরাবর্দির ডাকে কোন সভা হয়নি। ২৯ শে জুলাই ১৯৪৬, ডাক ও তার বিভাগের কর্মীদের ডাকা ধর্মঘটের সমর্থনে বাংলা জুড়ে একটি সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটটির উদ্যোক্তা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিক সংগঠনগুলো। ধর্মঘটের অন্যতম দাবী ছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর জওয়ানদের নিঃশর্ত মুক্তি। ধর্মঘট প্রসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকা লিখেছিল : " General Strike by All Communities; "  দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে 'বৃহত্তম সাধারণ ধর্মঘট' পালিত হয়েছে কলকাতায়। সলিল চৌধুরী এই ধর্মঘটের সমর্থনেই লেখেন তাঁর বিখ্যাত গণসংগীত, " ঢেউ উঠছে কারা টুটছে "।  আর ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে? হ্যাঁ, ২৯ য়ে জুলাই ডায়রেক্ট একশনের কথাও ঘোষিত হয় ঠিকই, তবে তা কলকাতায় ঘোষিত হয়নি। ময়দানেও ঘোষিত হয়নি। হয়েছিল বম্বে বা অধুনা মুম্বাইয়ে। জিন্নাহর বাসগৃহে। ২৯ জুলাই জিন্নাহ তার মালাবার হিলের বাড়িটিতে দেশ এবং বিদেশের সাংবাদিকদের একটি সম্মেলন ডাকেন। ওই সাংবাদিক সম্মেলন থেকেই জিন্না ডাক দেন " ডায়রেক্ট একশন ডে " র। ডায়রেক্ট একশন ডে'র প্রস্তুতি শুরু হয় ৩১ য়ে জুলাই থেকে। আর চূড়ান্ত রূপ পায় ১৬ ই আগস্টে। গোটা প্রক্রিয়াটিতে ২৯ য়ে জুলাইয়ের বাংলার শ্রমিক ধর্মঘটের কোন ভূমিকা ছিল না। লীগ বরং শ্রমিক ধর্মঘটে মুসলমান জনতার অংশগ্রহণে বিরক্তি প্রকাশ করে। লীগপন্থী সংবাদপত্রে ২৯ য়ে জুলাইয়ের ঐতিহাসিক ধর্মঘটকে হুমকি আর হুলিগানিজমের সাফল্য হিসেবে বিদ্রূপ করা হয়।

সাথে রইল ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাসের লেখার অংশ।

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

দেশভাগ ও সেই সময়ের গণসংগ্রাম ~ মানস দাস

গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং নিয়ে এখন খুব নাড়াচাড়া হচ্ছে। ধামাকা বোম্বে ফিল্ম হচ্ছে। দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা এখন বাণিজ্য ও। এমন একটা প্রচার হচ্ছে এখন, যেন দেশভাগ ঐসময় সমস্ত রাজনৈতিক দল, যুযুধান দুই সম্প্রদায় সবাই চেয়েছিল।একথা শুধু মিথ্যে নয় দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা! কার্যত দেশভাগে দ্বিজাতি তত্ত্ব কার্যকর হওয়ায় হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ ছাড়া কেউ উল্লসিত হয় নি।

তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি সি যোশী বলেন, " কলিকাতার দাঙ্গা ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের বিষময় ফল; লীগ নেতৃত্বের ব্যর্থতা, কংগ্রেস লীগ বিরোধের পরিণতি।" কিন্তু যে গৌরবের ইতিহাস অনালোচিত থেকে যায় তার খবর বলা এখন জরুরি। যখন কলকাতার রাস্তায় হিন্দু মুসলমান খুনোখুনি করছে তখন ৪০০০০ হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান শ্রমিক কর্মচারী দক্ষিণ ভারত রেলে অধিকারের দাবিতে ধর্মঘট করছে ( ২৪ আগস্ট -২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬)।

যখন বোম্বে, ঢাকা এবং অন্যত্র দাঙ্গা চলছে তখন পাটনা ও বেগুসরাই তে মিলিটারি পুলিশ,  হিন্দু ও মুসলমান একসাথে অর্থনৈতিক দাবিতে হাঙ্গার স্ট্রাইক করছে। যখন নোয়াখালী তে খুন, দাঙ্গা চলছে তখন সমস্ত জাত পাত কে দূরে ঠেলে সঙ্গবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণী ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার  ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য গর্বের ইতিহাস রচনা করছে আলেপ্পি ও ত্রিভাঙকুরে।

যখন বিহারে গণ হত্যা চলছে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে, তখন তেলেঙ্গানার সমস্ত অংশের বিপ্লবী কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে হায়দ্রাবাদ মিলিটারির কুখ্যাত মার্শাল ল টেরর এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াচ্ছে। নোয়াখালীর দাঙ্গার সময় কিষান সভা তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করছে। অল্প সময়ের মধ্যে হিন্দু মুসলমান ভাগচাষীদের আন্দোলন বন্যার মত ছড়িয়ে পরে। ফসলের তিন ভাগের  দুভাগ দাও।যুদ্ধ স্লোগান ওঠে, " crop today land tomorrow "। নোয়াখালী আর ত্রিপুরা কে ঘিরে ১৯ টি জিলাতে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। ভয় পেয়ে যায় সাম্প্রদায়িক ও জোতদার -জমিদার দের শক্তি। তারা চিৎকার করতে  শুরু করে  তেভাগা  আন্দোলন একটি হিন্দু বিরোধী  আন্দোলন, এতে যোগ দিও না!! দেশভাগের  ঐ  ভাতৃঘাতী দাঙ্গার সময়েও  ছড়িয়ে  আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও জোতদার জমিদার  দের বিরুদ্ধে এরকম অসংখ্য  লড়াই। আর  এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের এই লড়াই জয়যুক্ত হতে  পারেনি। দেশভাগের  পর খণ্ডিত  দুটি দেশ ব্রিটিশদের হটিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে ঠিক। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের বাঁধনে আজও যন্ত্রনা নিয়ে থেকে গিয়েছে। কিন্তু সেই গৌরবজ্জল লড়াই এর কথা আমাদের সবসময় মনে রাখা জরুরি।


শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

হিন্দু মহাসভা ও স্বাধীনতা আন্দোলন ~ দেবত্তম চক্রবর্তী

১৯১৫ সালের ৯ এপ্রিল, হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা'। গান্ধী হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের ডাক দিলেও অসহযোগের তীব্র বিরোধিতা করে কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকে মহাসভা। চৌরিচৌরার হিংসার প্রেক্ষিতে গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরে, ১৯২৩ সালে বিরাট হিন্দু পুনরুত্থান অভিযান শুরু করে তারা। সেই বছর অগস্ট মাসে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের সভাপতিত্বে বারাণসী অধিবেশনে মহাসভা 'শুদ্ধি' কর্মসূচী গ্রহণ করে, 'হিন্দু আত্মরক্ষা বাহিনী' গড়ে তোলারও ডাক দেয়।


 
অসহযোগ-খিলাফতের ব্যর্থতার পরে মুসলমান সমাজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার জন্য, ১৯২৪ সালের ৪ মে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের সভাপতির অভিভাষণে জিন্না বলেন: "...আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, স্বরাজ অর্জনের এক অপরিহার্য শর্ত হল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য। ...আমি এই ক্থা বলতে চাই যে, যেদিন হিন্দু ও মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হবে, সেদিনই ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবে।" 

অথচ, সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়ে হিন্দু মহাসভার অন্যতম নেতা লালা লাজপত রাই ওই বছরেরই ১৪ ডিসেম্বর 'দ্য ট্রিবিউন' পত্রিকায় ঘোষণা করেন: "আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলমানদের চারটি মুসলিম রাজ্য থাকবে: ১) পাঠান প্রদেশ বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, ২) পশ্চিম পাঞ্জাব, ৩) সিন্ধু এবং ৪) পূর্ব বাংলা। যদি ভারতের অন্য কোনও অংশে একটি [আলাদা] প্রদেশ গঠনের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায় থাকে, [তাহলে] তাদেরও একইভাবে গঠন করা উচিত। কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে বোঝা উচিত যে, এটি অখণ্ড ভারতবর্ষ নয়। এর অর্থ হল, ভারতবর্ষকে স্পষ্টত একটি মুসলিম ভারতবর্ষ এবং একটি অমুসলিম ভারতবর্ষে বিভক্ত করা।" 

এই ঘোষণার পরের বছরে অর্থাৎ ১৯২৫ সালে হিন্দু মহাসভার অষ্টম অধিবেশনে সভাপতি হন লাজপত রাই। ওই বছরের বিজয়া দশমীর দিন কেশব বলীরাম হেডগেওয়ার-এর নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করেন 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ' (আরএসএস) নামে এক  নতুন সংগঠন। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে সঙ্ঘের অন্যতম তাত্ত্বিক গুরু ও দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর বলেন: "ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক ভাবা হচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল।" অর্থাৎ তাঁর মতে ব্রিটিশ বিরোধিতা হচ্ছে 'প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি'!

এহ বাহ্য! ১৯৪০ সালে জিন্নার লাহোর প্রস্তাবের ৩ বছর আগে ১৯৩৭ সালে, হিন্দু মহাসভার আহমেদাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে উগ্র হিন্দুত্বের জিগির তুলে বিনায়ক দামোদর সাভারকর খোলাখুলি বলেন: "...ভারতবর্ষে দুটি শত্রুভাবাপন্ন  জাতি পাশাপাশি বাস করে। ...ভারতবর্ষকে আজ আর একক (Unitarian) ও সমজাতীয় (homogeneous) জাতি বলে বিবেচনা করা যায় না। বরং পক্ষান্তরে [এ দেশে] প্রধানত দুটি জাতি রয়েছে: হিন্দু ও মুসলমান।" মনে রাখতে হবে, লাহোর প্রস্তাবের বহু আগেই এভাবে এ দেশে দ্বিজাতি তত্ত্বের সূচনা করে হিন্দু মহাসভা।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সেই প্রসঙ্গে সাভারকর ১৯৪১ সালে ভাগলপুরে হিন্দু মহাসভার ২৩তম অধিবেশনে বলেন: "So far as India's defence is concerned, Hindudom must ally unhesitatingly, in a spirit of responsive co-operation, with the war effort of the Indian government in so far as it is consistent with the Hindu interests, by joining the Army, Navy and the Aerial forces in as large a number as possible and by securing an entry into all ordnance, ammunition and war craft factories।" যদিও ওই সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি নীরব ও নিষ্পৃহ থাকেন, কারণ তাঁর মতে "মুসলমানেরা প্রথমে মুসলমান, শেষে মুসলমান, এবং কদাচ ভারতীয় নয়।" 

অথচ, ক্ষমতার স্বাদ পেলে হিন্দু মহাসভা যে তার দীর্ঘলালিত মুসলমান-বিদ্বেষ এক লহমায় ভুলে যেতে পারে, এমনকি মুসলিম লিগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গড়তেও দ্বিধা করে না, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলির পদত্যাগের পর থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা দেখি, 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দিয়ে যখন গান্ধী-সহ প্যাটেল, নেহরু, আজাদ প্রমুখ কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ জেলে বন্দিজীবন যাপন করছেন, তখন হিন্দু মহাসভার দ্বিতীয় প্রধান নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লাহোর প্রস্তাবের উত্থাপক ফজলুল হকের অর্থমন্ত্রী হিসাবে বাংলায় প্রায় ১১ মাস দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। একই ভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খান আব্দুল জব্বর খানের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলে মুসলিম লিগের প্রধানমন্ত্রী সর্দার আওরঙ্গজেব খানের অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন হিন্দু মহাসভার মেহেরচাঁদ খান্না। আর ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ, সিন্ধু প্রদেশের আইনসভায় পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরেও স্যার গুলাম হুসেন হিদায়েতুল্লার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার প্রয়োজন বোধ করছেন না মহাসভার তিন মন্ত্রী। এর কারণ একটিই। কারণ ১৯৪২-এর ২৮ অগস্ট 'দ্য বম্বে ক্রনিকল' পত্রিকায় হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়ে সাভারকর বলেন: "...যতটা সম্ভব রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি দখল করার জন্য হিন্দু সদস্যদের অবশ্যই প্রতিরক্ষা সংস্থা (Defence bodies) এবং কাউন্সিলে তাদের অবস্থানে অটল থাকতে হবে।" 

ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করার হিন্দু মহাসভার এই নির্দেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪২-এর ২৬ জুলাই বাংলার ছোটলাট জন হার্বার্টকে একটি চিঠি লিখে কংগ্রেসকে মোকাবিলা করার পরিকল্পনা ছকে দেন এই ভাষায়: "... কংগ্রেসের ডাকা সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী আন্দোলনের ফলে এই প্রদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্ট হতে পারে, আমাকে এখন তার উল্লেখ করতে হবে। যুদ্ধের সময়কালে যদি কেউ গণ-অনুভূতিকে এমনভাবে জাগিয়ে তোলার পরিকল্পনা করে যাতে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তাহীনতা ঘটতে পারে, তবে যে কোনও সরকার, তার কার্যক্রমের মেয়াদ যদি স্বল্পকালীনও হয়, তবু সে অবশ্যই এই আন্দোলনকে প্রতিহত করবে।" শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বস্ত মন্ত্রী হিসাবে তিনি আন্দোলন দমন করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একই চিঠিতে ছোটলাটকে জানান: "ব্রিটেনের স্বার্থে নয়, ব্রিটিশরা লাভবান হতে পারে এমন কোনও সুবিধার জন্য নয়, বরং প্রদেশের প্রতিরক্ষা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ব্রিটিশদের ওপর ভারতীয়দের আস্থা রাখতে হবে। আপনি গভর্নর হিসাবে, প্রদেশের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে কাজ করবেন এবং আপনার মন্ত্রীর পরামর্শে সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত হবেন।"

অন্য দিকে আরএসএস-এর তাত্ত্বিক গুরু গোলওয়ালকর দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার খোয়াবে মশগুল থেকে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন: "হিন্দুস্তানের অ-হিন্দু জনগণকে অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষাকে [হিন্দি] গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শিখতে হবে এবং সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গৌরব ছাড়া অন্য কোনও ধারণাই গ্রহণ করতে হবে না।" তাঁর মতে, ". . . in a word they must cease to be foreigners, or may stay in the country, wholly subordinated to the Hindu nation, claiming nothing, deserving no privileges, far less any preferential treatment – not even citizens' rights।" অর্থাৎ সোজা কথায়, কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্যদের কোনও কিছুই দাবি না করে, এমনকি নাগরিক অধিকারটুকুও বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণত হিন্দু জাতির অধীনস্থ হয়ে এ দেশে থাকতে হবে। দেশ সদ্য স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৭ সালের ৭ ডিসেম্বর, দিল্লির রামলীলা ময়দানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিশাল সমাবেশেও তিনি বলেন: "হিন্দু সমাজের সংহতিই আমাদের লক্ষ্য । এই আদর্শকে সামনে রেখে, সঙ্ঘ তার পথে অগ্রসর হবে এবং কোনও কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তিত্ব দ্বারা বাধাগ্রস্ত হবে না।"

এই ঘটনার অল্প কিছু দিন আগে, ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই ভারতীয় সাংবিধানিক গণপরিষদে গৃহীত ভারতের জাতীয় পতাকাটিকেও সাভারকার বাতিল করে দেন। তার এক সপ্তাহ পরে, জুলাই মাসের ২৯ তারিখে তিনি এক বিবৃতি প্রকাশ করে বলেন: "সিন্ধু থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত অবিচ্ছিন্ন ও অবিভক্ত আমাদের মাতৃভূমি ও পুণ্যভূমি হিন্দুস্থানের জন্য একমাত্র ভাগোয়া [গেরুয়া পতাকা]— যার বুকে অঙ্কিত আমাদের জাতিসত্তার আপন উপস্থিতির প্রকাশে উদ্ভাসিত কুণ্ডলিনী ও কৃপাণ— ছাড়া আর অন্য কোনও কর্তৃত্বপূর্ণ পতাকা হতে পারে না। এটি কারও ফরমায়েশে গড়া নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় সত্তার বিবর্তনের সঙ্গে স্ববিকশিত। এই পতাকা আমাদের হিন্দু-ইতিহাসের সমগ্র দৃশ্যপটকে প্রতিফলিত করে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু প্রকৃতপক্ষে এরই পূজারি। ইতিমধ্যেই হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে দক্ষিণের সমুদ্র অবধি এটি উড্ডীন। অন্যান্য দলীয় পতাকাগুলিকে বরদাস্ত করা যেতে পারে। [সেই কারণে] এদের কয়েকটিকে এমনকি কিছুটা সম্মানও করা যেতে পারে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দুরাজত্বের জাতীয় আদর্শ হিসাবে এই হিন্দু-অনুসারী ধ্বজা, এই ভাগোয়া পতাকা ছাড়া আর অন্য কোনও পতাকাকে আনুগত্যের সঙ্গে অভিবাদন জানানো যায় না।" 

এমনকি স্বাধীনতা লাভের পরেও সঙ্ঘ তাদের জাতীয় পতাকাকে অস্বীকার করার ঐতিহ্য অটুট রাখে। এ প্রসঙ্গে গোলওয়ালকর লেখেন: "...আমাদের নেতারা আমাদের দেশের জন্য একটি নতুন পতাকা বেছে নিয়েছেন। তাঁরা এই কাজ করলেন কেন? এটি নিছকই অনুকরণ মাত্র। …আমরা একটি প্রাচীন ও মহান জাতি, যার গৌরবময় অতীত রয়েছে। তাহলে কি আমাদের নিজস্ব কোনও পতাকা ছিল না? এত হাজার বছর ধরে আমাদের কি কোনও জাতীয় প্রতীক ছিল না? নিঃসন্দেহে ছিল। তাহলে আমাদের মনে এই নিদারুণ শূন্যতা কেন?"

যে হিন্দু মহাসভা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সদস্যেরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকেছে, দেশের প্রত্যেকটি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ের সরাসরি বিরোধিতা করে এসেছে, জন্মলগ্ন থেকেই দেশের মানুষকে সুচতুরভাবে হিন্দু-মুসলমানের বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত করেছে, এই সেদিন পর্যন্ত জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত অবমাননা করেছে— আজ তারাই সহসা দেশপ্রেমের ঠিকাদারি নিতে চাইছে একচেটিয়া ভাবে!

এই পরিস্থিতিতে আপনারা আগামীকাল মোদি-শাহ অ্যান্ড কোং-এর নবতম গড্ডলিকা প্রবাহের অন্যতম গড্ডল হবেন কি না, সে কথা ভেবে দেখুন।