শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীদের রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণের ঘৃণ্য চেষ্টা ~ ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী



কী আস্পর্ধা! ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীরা উঠেপড়ে প্রমাণ করতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথও নাকি তাঁদেরই মত সাম্প্রদায়িক ও মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন! সমাজ মাধ্যমে ছড়ানো তাঁদের পোস্টটি দেখলে আপাতভাবে মনে হতে পারে সেটি বহু গবেষণা করে সূত্র উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, সুতরাং প্রামাণ্য। আদপে কোথাও কবিগুরুকে ভুল উদ্ধৃত করা হয়েছে, কোথাও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কোন বড় একটা নিবন্ধের কোন এক অধ্যায়ের একটি বাক্য অপ্রাসঙ্গিকভাবে তুলে আনা হয়েছে। কোনটির আবার রেফারেন্সের অস্তিত্বই নেই, স্বরচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো, হিন্দুত্ববাদীদের দপ্তরে বসে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে রচনা করা হয়েছে। আসলে কবিগুরুর আটটি উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেদের ধর্মান্ধতাজনিত মুসলমান-বিদ্বেষকে জায়েজ প্রমাণ করতে চেয়েছেন তাঁরা।

যাঁরা ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি করার উদ্দেশ্যে সমাজ মাধ্যমে এই পোস্ট ক্রমাগত শেয়ার, ফরোয়ার্ড করছেন, তাঁরাও কেউ রবীন্দ্ররচনাবলী পড়ে দেখা দূর-অস্ত্, পাতা উল্টেও দেখেন নি কোনদিন। এরাজ্যের তস্করদের পোষা চেয়ার-মোছা বুদ্ধিজীবীদেরও এই ভাইরাল পোস্ট নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না! অবশ্য প্রত্যাশিতও ছিল না। একটু বড় লেখা, তবু ধৈর্য্য ধরে পড়লে বোঝা যাবে বিশ্বের দরবারে বাঙালীর গর্বের পরিচয় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁর লেখা গান দুটি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত, তাঁর বক্তব্য কীভাবে বিকৃত করছে হিন্দুত্ববাদী ধর্মান্ধরা।

*উদ্ধৃতি ১* - 'যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে।' (অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র' একাদশ খণ্ডের ১১৮-১২২ পৃষ্ঠায়)

*প্রকৃত তথ্য* - রবীন্দ্রনাথ ঐ চিঠিতে লিখেছেন, 'বিদেশী সাম্রাজ্যের এতটা দাক্ষিণ্য ইংরেজজাতের ছাড়া আর কোনো জাতের হাত দিয়ে হতে পারত না। হয়তো এই দানের সঙ্গে সঙ্গে সুবুদ্ধিও আছে। জগৎ জুড়ে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘূর্ণিবাতাস জেগে উঠছে তাতে ভারতবর্ষের মন না পেলে ভারতবর্ষকে শেষ পর্যন্ত আয়ত্ত করা সম্ভব হতে পারে না। যে মুসলমানকে আজ ওরা সকলরকমে প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানই একদিন মুষল ধরবে। যাই হোক, লুব্ধতা স্বভাবে প্রবল থাকলে স্ববুদ্ধির দূরদর্শিত কাজ করতে পারে না। ... আমাদের তরফে একটা কথা বলবার আছে, ইংরেজের শাসনে যতই দাক্ষিণ্য থাক আজ পর্য্যস্ত না মিলল আমাদের উপযুক্ত শিক্ষা, না জুটল যথেষ্ট পরিমাণে পেটের ভাত, না ঘটল স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা।'

স্পষ্টতই 'ওরা' বলতে ব্রিটিশ শাসকদের বোঝানো হচ্ছে, ব্রিটিশ শাসকদের স্বভাবে প্রবল লুব্ধতার কথা বলা হচ্ছে এবং 'মুষল ধরবে' বলতে মুসলমানেরা যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে সেকথাই বলছেন রবীন্দ্রনাথ। বাস্তবেও তা ঘটেছে। ১৯৩৪ সালে 'কমিউনাল এওয়ার্ড' এবং ভারতবাসীকে স্বায়ত্ত্ব শাসন দেওয়ার যে 'দাক্ষিণ্য' দেখাচ্ছিল ব্রিটিশ সরকার তারই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছিলেন। বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ আশঙ্কিত ছিলেন ব্রিটিশদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিতে। লিঙ্ক - 

*উদ্ধৃতি ২* - 'চল্লিশ লাখ হিন্দু একলাখ মুসলিমদের ভয়ে মারাত্মকভাবে অভিভূত।' ( আনন্দবাজার পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, ৫.৯.১৯২৩)

*প্রকৃত তথ্য* - রবীন্দ্র রচনাবলীর কোথাও এইরকম কোনও লেখা পাওয়া যায় না। ১০২ বছর আগের ঐদিনের পত্রিকা অনলাইন আর্কাইভে পেলাম না, পেলে বোঝা যেত আদৌ রবীন্দ্রনাথ একথা বলেছিলেন কিনা, আর বললেও কোন প্রসঙ্গে, কী প্রেক্ষিতে বলেছেন। তবে 'ধর্মমোহ' কবিতায় তিনি লিখেছেন- 

"যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে/ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে -/ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,/এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।"

রবীন্দ্র রচনাবলীর আরেক জায়গায় পাওয়া যায়, "হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানদেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়– অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent non-co-operation।"
লিঙ্ক -

*উদ্ধৃতি ৩* - 'যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।' (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স,১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)

*প্রকৃত তথ্য* - 'যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।', এই লাইনটি 'কালান্তর'-এর 'স্বামী শ্রদ্ধানন্দ' প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। সুচতুরভাবে শুধুমাত্র এই একটি লাইনকে তুলে এনে, অগ্রপশ্চাৎ কিছু না দেখিয়ে ভিন্ন বার্তা প্রেরণ করা হচ্ছে। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার বলছেন—

'ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুর্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই, অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত। বিদেশীর রাজ্যে রাজপুরুষদের সঙ্গে আমাদের একটা বাহ্য যোগ থাকে, অথচ আন্তরিক সম্বন্ধ থাকে না। বিদেশীয় রাজত্বে এইটেই আমাদের সবচেয়ে পীড়া দেয়। গায়ে-পড়া যোগটা দুর্বলতা ও অপমান আনে। বিদেশী শাসন সম্পর্কে যদি এ কথা খাটে তবে স্বদেশীয়দের সম্বন্ধে সে আরও কত সত্য। এক দেশে পাশাপাশি থাকতে হবে, অথচ পরস্পরের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্বন্ধ থাকবে না, হয়তো বা প্রয়োজনের থাকতে পারে— সেইখানেই যে ছিদ্র— ছিদ্র নয়, কলির সিংহদ্বার। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যেখানে এতখানি ব্যবধান সেখানেই আকাশ ভেদ করে ওঠে অমঙ্গলের জয়তোরণ। আমাদের দেশে কল্যাণের রথযাত্রায় যখনই সকলে মিলে টানতে চেষ্টা করা হয়েছে— কংগ্রেস প্রভৃতি নানা প্রচেষ্টা দ্বারা, সে-রথ কোথায় এসে থেমে যায়, ভেঙে পড়ে? যেখানে গর্তগুলো হাঁ ক'রে আছে হাজার বছর ধরে।

আমাদের দেশে যখন স্বদেশী-আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলেম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয় নি, বিরুদ্ধ ছিল। জননায়কেরা কেউ কেউ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক। জানি, ওরা যোগ দেয় নি। কিন্তু, কেন দেয় নি। তখন বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এত প্রবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য! কিন্তু, এতবড়ো আবেগ শুধু হিন্দুসমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল, মুসলমানসমাজকে স্পর্শ করল না! সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয় নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি।

....জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে। তার পর ওদের ডেকে একদিন বলেছি, 'আমরা ভাই, তোমাকেও আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে।' তখন হঠাৎ দেখি অপর পক্ষ লাল টক্‌টকে নতুন ফেজ মাথায় দিয়ে বলে, আমরা পৃথক। আমরা বিস্মিত হয়ে বলি, রাষ্ট্র ব্যাপারে পরস্পর পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায়। বাধা ঐ জাজিম-তোলা আসনে বহুদিনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছোটো নয়। ওখানে অকূল অতল কালাপানি। বক্তৃতামঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই পার হওয়া যায় না।
আপনার লোককেও যে পর করেছে, পরের সঙ্গেও যার আত্মীয়তা নেই, সে তো ঘাটে এসেছে, তার ঘর কোথায়। আর তার শ্বাসই বা কতক্ষণ। আজ আমাদের অনুতাপের দিন, আজ অপরাধের ক্ষালন করতে হবে। সত্যিকার প্রায়শ্চিত্ত যদি করি তবেই শত্রু আমাদের মিত্র হবে.... '

*উদ্ধৃতি ৪* - 'কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে।' (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)

*প্রকৃত তথ্য* - আবার প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে একটা বাক্য তুলে আনা হয়েছে। কবি অন্যত্র লিখেছেন, 'একটা দিন আসিল যখন হিন্দু আপন হিন্দুত্ব লইয়া গৌরব করিতে উদ্যত হইল। তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মানিয়া লইয়া নিজেরা চুপচাপ পড়িয়া থাকিত তবে হিন্দু খুব খুশি হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। এখন সে মুসলমানরূপেই প্রবল হইতে চায়, হিন্দুর সঙ্গে মিশিয়া গিয়া প্রবল হইতে চায় না।" 

রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি ও জানি একজন সমন্বয়বাদী ধারণায় বিশ্বাসী দার্শনিক হিসেবে। ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে, দেশ বা সমাজের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁকে সমন্বয়বাদী রূপে দেখা গেছে। এখানেও বোধহয় ছিল সমন্বয়ের চেষ্টা। উন্নত, আধুনিক ভারতবর্ষ নির্মাণে ইংরেজ ভূমিকা নেবে – দীর্ঘদিন এমন বিশ্বাস তিনি লালন করেছেন। একাধিক প্রবন্ধে তা প্রকাশ পেয়েছে। পেয়েছে ইংরেজের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁর বিশ্বাস। ভাবেননি যে, উপনিবেশবাদী শোষক কখনো উপনিবেশকে স্বদেশ হিসেবে ভাবে না। রবীন্দ্রনাথের-স্বদেশভাবনা - লিঙ্ক - https://www.kaliokalam.com/?s=%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE

*উদ্ধৃতি ৫* - এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮,শান্তিনিকেতন)

*প্রকৃত তথ্য* - এখানে কবি মুসলমান সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি তাঁর ঘৃণাকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। সুলতানি ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে, ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিন্দুমন্দির, জৈনমন্দির ধ্বংস করে তার উপরে উঠেছে মসজিদ। অতএব, বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাতের কথা একবর্ণও কি মিথ্যে? বরং এখানে তিনি বলেছেন যে ওই সুলতানি আমলেও কবির, নানক, রবিদাস, দাদুদয়ালের মতো সাধকগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁরা মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ এখানে বলছেন-

সত্যের আঘাত কেবল সত্যই গ্রহণ করতে পারে। এইজন্য প্রবল আঘাতের মুখে প্রত্যেক জাতি, হয়, আপনার শ্রেষ্ঠ সত্যকে সমুজ্জ্বল করে প্রকাশ করে নয়, আপনার মিথ্যা সম্বলকে উড়িয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়। ভারতবর্ষেরও যখন আত্মরক্ষার দিন উপস্থিত হয়েছিল তখন সাধকের পর সাধক এসে ভারতবর্ষের চিরসত্যকে প্রকাশ করে ধরেছিলেন। সেই যুগের নানক, রবিদাস, কবীর, দাদু প্রভৃতি সাধুদের জীবন ও রচনা যাঁরা আলোচনা করছেন তাঁরা সেই সময়কার ধর্ম-ইতিহাসের যবনিকা অপসারিত করে যখন দেখাবেন তখন দেখতে পাব ভারতবর্ষ তখন আত্মসম্পদ সম্বন্ধে কী রকম সবলে সচেতন হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষ তখন দেখিয়েছিল, মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়। দেখিয়েছিল ভারতবর্ষের মর্মস্থলে সত্যের এমন একটি বিপুল সাধনা সঞ্চিত হয়ে আছে যা সকল সত্যকে আত্মীয় বলে গ্রহণ করতে পারে। এইজন্যেই সত্যের আঘাত তার বাইরে এসে যতই ঠেকুক তার মর্মে গিয়ে কখনো বাজে না, তাকে বিনাশ করে না।' লিঙ্ক -

 
*উদ্ধৃতি ৬* - হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, পরিচয়)

*প্রকৃত তথ্য* - রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'আমাদের দেশে ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ঐক্যলাভের চেষ্টা যখনই প্রবল হইল, অর্থাৎ যখনই নিজের সত্তা সম্বন্ধে আমাদের বিশেষভাবে চেতনার উদ্রেক হইল তখনই আমরা ইচ্ছা করিলাম বটে মুসলমানদিগকেও আমাদের সঙ্গে এক করিয়া লই, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। এক করিয়া লইতে পারিলে আমাদের সুবিধা হইতে পারিত বটে, কিন্তু সুবিধা হইলেই যে এক করা যায় তাহা নহে। হিন্দু - মুসলমানের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজনসাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্যকে যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজনকে মানিবে না।
হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুইপক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,— সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।
মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কি না, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসংগত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।' লিঙ্ক -


*উদ্ধৃতি ৭* - 'ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে।' (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৮৫,ইতিহাস)

*প্রকৃত তথ্য* - তিনি লিখছেন, 'এ দিকে অনতিপূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খণ্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচণ্ড আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহারা যেন ভিন্ন ভিন্ন দুর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খণ্ড তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে অজ্ঞাত হইয়া বিরাজ করিতেছিল। কখন প্রচণ্ড সূর্যের উদয় হইল এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তুষারস্রুত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎকে চতুর্দিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইল।
তখন শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত; এবং বৌদ্ধধর্ম বিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতোহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। তখন ধর্মে সমাজে শাস্ত্রে কোনো বিষয়ে নবীনতা ছিল না, গতি ছিল না, বৃদ্ধি ছিল না, সকল বিষয়েই যেন পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, নূতন আশা করিবার বিষয় নাই। সে সময়ে নূতনসৃষ্ট মুসলমানজাতির বিশ্ববিজয়োদীপ্ত নবীন বল সম্বরণ করিবার উপযোগী কোনো একটা উদ্দীপনা ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল না।
নবভাবোৎসাহে এবং ঐক্যপ্রবণ ধর্মবলে একটা জাতি যে কিরূপ মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করে পরবর্তীকালে শিখগণ তাহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছিল। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুন্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। মুসলমানদের যুদ্ধের মধ্যে এক দিকে ধর্মোৎসাহ, অপর দিকে রাজ্য অথবা অর্থ-লোভ ছিল; কিন্তু হিন্দুরা চিতা জ্বালাইয়া স্ত্রীকন্যা ধ্বংস করিয়া আবালবৃদ্ধ মরিয়াছে– মরা উচিত বিবেচনা করিয়া; বাঁচা তাহাদের শিক্ষাবিরুদ্ধ সংস্কারবিরুদ্ধ বলিয়া। তাহাকে বীরত্ব বলিতে পার কিন্তু তাহাকে যুদ্ধ বলে না। তাহার মধ্যে উদ্দেশ্য অথবা রাষ্ট্রনীতি কিছুই ছিল না।'
'মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস'
লিঙ্ক - 

*উদ্ধৃতি ৮* - 'প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না।' (হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)

*প্রকৃত তথ্য* - হেমন্তীবালা বলে কেউ ছিল না, যিনি ছিলেন তাঁর নাম হেমন্তবালাদেবী। তাঁকে কবি ২৬৪-টি চিঠি লিখেছেন, তার মধ্যে একটি চিঠি থেকে প্রসঙ্গবিহীন ভাবে এই অংশটি নেওয়া হয়েছে। অথচ ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে ঐ হেমন্তবালাদেবীকে অন্য একটি চিঠিতে কবি লিখছেন, 'সমস্ত মুসলমান জাতের উপর হিন্দুর বণ জন্মে যাচ্চে। অথচ এ কথা নিশ্চিত সত্য তাদের মধ্যে অনেকে আছে যারা ভালো লোক, ঠিকমত পরিচয় পেলে যাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে কোথাও বাঁধত না। .... মুসলমানেরা যদি সম্পূর্ণভাবে পর হোতো তাহলে এ ক্ষতি আমাদের পক্ষে তেমন সর্বনেশে হোতো না - কিন্ত দেশের দিক দিয়ে তারা আমাদের আপন এ কথাটা কোনো উৎপাতেই অস্বীকৃত হতে পারে না।' ধর্মান্ধদের দাবী নস্যাৎ করে কবির সম্প্রীতির বার্তা এখানেই স্পষ্ট প্রতিভাত।
লিঙ্ক - 

শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

কাঠি ও বারুদ ~ সন্দীপন চক্রবর্তী

জল তো দাদা এমনিতে শান্তই। ঢিল মেরে কেউ ঢেউ তুলে দিলে কী হয়, বলা যায় না!

ইদের প্রস্তুতির রং তখন লেগে আছে জেলাটা জুড়ে। নানা বিপণিতে বিভিন্ন ছাড়ের ব্যবস্থা, কেনাকাটার ভিড়ে শামিল সব সম্প্রদায়ের, সব ধরনের মানুষ। সেই সময়েই দেখা সানোয়ার ইসলামের সঙ্গে। 

পদ্মা দেখার জন্য রঘুনাথগঞ্জের প্রান্তিক গ্রামে ঢুকে সানোয়ারের সঙ্গে মোলাকাত। সেকলিপুরে সরু রাস্তা বেয়ে এগিয়ে বিএসএফ ছাউনিতে কাগজ-পত্র এবং সঙ্গের ব্যাগ বা থলে দেখিয়ে নৌকোর সওয়ারি নিচ্ছেন কত লোক। নদী পার হলে আরও কয়েক কিলোমিটার পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত। চড়া পড়ে পদ্মা সেখানে শীর্ণকায়। তবে পরিষ্কার, টলটলে জল! চোখের অদ্ভুত আরাম, পারে গিয়ে দাঁড়ালেও মন শান্ত হয়। সেই তল্লাটেই মনিহারি দোকান চালানো সা‌নোয়ার বলেছিলেন শান্ত জলে ঢিল মেরে কল্লোল তুলতে চাওয়ার কথা। 

এই আলাপচারিতার পরে মেরেকেটে দিন পনেরো পেরোতে না পেরোতেই হিংসার আগুনে পুড়েছে মুর্শিদাবাদে ওই জঙ্গিপুরের বেশ কিছু এলাকা। ধুলিয়ান, সুতি, শমসেরগঞ্জ। দেদার লুঠপাট হয়েছে, পুলিশের গাড়িতে হামলা হয়েছে, আগুন জ্বলেছে। চলে গিয়েছে তিনটি প্রাণ। আহতের সংখ্যা বেশ কিছু। উপলক্ষ, কেন্দ্রীয় সরকারের আনা ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদের চেহারা কয়েক বছর আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরোধিতায় বিক্ষোভকে মনে করিয়ে দিচ্ছে অনেকটাই। ঘটনার পরে অবধারিত ভাবে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী বিজেপির উচ্চ গ্রামের তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে।

মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। মুর্শিদাবাদের ঘটনার জন্য তিনি বিজেপি তো বটেই, শান্তি রক্ষায় উদ্যোগী না-হওয়ার জন্য আঙুল তুলেছেন কংগ্রেসের দিকেও। বিএসএফ-কে দোষী করেছেন। আর সার্বিক পরিকল্পনার নেপথ্যের কারিগর চিহ্নিত করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে আবেদন করেছেন শাহকে সামলে (কন্ট্রোল) রাখার! 

বসিরহাট, সন্দেশখালি বা শমসেরগঞ্জ হোক, রাজ্যের কোনও জায়গায় অশান্তির কিছু ঘটলেই চক্রান্তের অভিযোগ রাজ্যের শাসক পক্ষের গলায় অহরহ শোনা যায়। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক ঘটনায় 'চক্রান্তে'র কথা মাথায় রেখেও কেউ যদি প্রশ্ন তোলে— বিরোধী দল বিজেপি বাইরে থেকে গুন্ডা বা দুষ্কৃতী আনল, বিএসএফ কিছু টাকা দিয়ে বাচ্চা ছেলেদের দিয়ে পাথর ছোঁড়াল, কেউ এসে গুলি চালিয়ে দিল, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের অভিযোগ মতো এই সবক'টা ঘটনাই এ ভাবে বিনা বাধায় ঘটে গেলে প্রশাসন করছিল কী? পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ কোথায় ছিল? অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দেখেও পুলিশ প্রথম দিকে কেন তৎপর হল না? মুখ্যমন্ত্রী এই পর্বে একাধিক বার শান্তি বজায় রাখার আবেদন করেছেন ঠিকই। কিন্তু আবেদনই কি একমাত্র এবং শেষ কথা? দুষ্কৃতী-রাজ যদি জাঁকিয়ে বসতে চায়, আইন হাতে তুলে নিয়ে কোনও অপশক্তি যদি জীবন, জীবিকা, সম্পত্তি ধ্বংসের খেলায় নামে, প্রশাসনের তখন দায়িত্ব কী?

ধুলিয়ানের জাফরাবাদে উন্মত্ত তাণ্ডবকারীদের হাতে খুন হয়ে গিয়েছেন বাবা ও ছেলে। পারিবারিক ব্যবসা আছে তাঁদের। বাবা ছিলেন সিপিএমের সক্রিয় কর্মী, বয়সের কারণে পরে আর সদস্যপদ নবীকরণ করেননি। ওই রানিপাড়ায় হামলাকারীদের লুটপাট ঠ‌েকানোর চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা আরও উন্মত্ত হয়ে, দল ভারী করে পাড়ায় ঢুকে আসে। ধারালো, ভোঁতা নানা সরঞ্জাম নিয়ে হামলা চালায়, যার পরিণতি, বাড়ির সামনেই বাবা-ছেলের মৃত্যু। একের পর এক বাড়িতে হামলার দাগ বাসিন্দারাই দেখিয়েছেন। পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী যখন এলাকায় গিয়েছেন, বাসিন্দারা সমস্বরে অভিযোগ করেছেন, তাণ্ডব চলাকালীন খবর দেওয়া হলেও পুলিশ সেখানে আসতে চায়নি। গাড়িতে থানা মিনিটদশেকের দূরত্বে হলেও সে দিন হিংস্র বাহিনীর মুখে অসহায় হয়ে লড়ে যেতে হয়েছে বাসিন্দাদের। রাজনৈতিক দলের সফরের সময়ে ওঠা ভিডিয়োয় ধরা পড়ছে বাসিন্দাদের ক্ষোভ। কেন সে দিন পুলিশ ও'ভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকল, তার উত্তর কি বিরোধী দল বা বিএসএফ দেবে!

সুতির কাসেমনগরে মারা গিয়েছেন ২১ বছরের আর এক যুবক। তাঁর শরীরে গুলির ক্ষত ছিল। পরিবারের বক্তব্য, পুলিশই তাঁকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গিপুরের হাসপাতালে ভর্তি করায়। বুলেট বার করে নেওয়া হয়। তার পরে বলা হয় বহরমপুরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে। জঙ্গিপুর থেকে হাসপাতালের কোনও অ্যাম্বুল্যান্স ওই পরিবার পায়নি। ওই গোলমালের মধ্যে টাকা দিয়ে গাড়ি জোগাড় করে বহরমপুরে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলেও রক্তক্ষরণ চলতে থাকা যুবককে বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালে ভর্তি আরও কয়েকজনের গুলির আঘাত আছে, স্থানীয় মানুষ এবং পরিবারের লোকেরাই বলছেন। পুলিশি তৎপরতায় তাঁদেরও বুলেট বার করে নেওয়া হয়েছে।

শাসক শিবিরের অন্দরেও আলোচনা আছে শমসেরগঞ্জ এবং সুতি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের নিয়ে। গোলমাল সেখানে পরতে পরতে বেড়েছে, ওই এলাকার পুলিশই আর্ত বাসিন্দাদের ডাক পেয়েও যায়নি বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকদের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের অভ্যন্তরেও চর্চা আছে। এবং ঘটনার কয়েক দিন পরে সরকারি আদেশ জারি করে দুই থানায় নতুন আইসি (আগে ইনস্পেক্টর স্তরের কেউ দায়িত্বে ছিলেন না ওখানে) নিয়োগ করা হয়েছে, পুরনো আধিকারিকদের আপাতত পাঠানো হয়েছে পুলিশ লাইনে। পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) গঠন করে তদন্ত চলাকালীন এই বদলির পদক্ষেপে কিছু ইঙ্গিত মিলছে কি?

গোটা ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, নিয়োগ-দুর্নীতি এবং ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি হারানোর সঙ্কট ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই এমন এক হিংসালীলা চলতে দেওয়া হল কি না, খুব অসঙ্গত প্রশ্ন হবে কি? বেশ কিছু দিন ধরেই বাংলা জুড়ে হিন্দুত্ববাদী জিগির তোলার চেষ্টা চলছে চড়া সুরে। রামনবমী পালনকে ঘিরে হুঙ্কারের বহর কারওরই নজর এড়ানোর কথা নয়। কিন্তু হাতে জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে যারা ঘুরছে, তাদের জন্য বারুদের স্তূপ মজুত রাখা কি একই কৌশলের অঙ্গ নয়? নাকি সেটা কিছু কম অপরাধ?

এই আঁধারে ওই সানোয়ারের কথাটাই ফিরে ফিরে ভাবায়। ''জল তো দাদা এমনিতে শান্তই। ঢিল মেরে কেউ ঢেউ তুলে দিলে কী হয়, বলা যায় না!''

শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

বিবিসি ও মাষ্টারদা ~ কনাদ মুখোপাধ্যায়

১৯৩০ সালে ১৮ই এপ্রিল রাত সাড়ে আটটায় বিবিসি তার নির্ধারিত ইংরিজি খবরের বদলে আধ ঘণ্টা বেটোভেনের সিম্ফনি শুনিয়েছিল। ভারতীয় শিক্ষিত সমাজ এই অদ্ভুৎ পরিবর্তনে যার পর নাই অবাক হয়। পরের দিন জানা যায় ১৮ই এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেছে সশস্ত্র বিপ্লবীরা।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অবিস্মরণীয় ঘটনা খবর সম্প্রচার করতে হলে স্বীকার করতেই হতো বিবিসির মতো কুলীন সংবাদ সংস্থাকে তাই তারা বেটোভেনের স্বরণাপন্ন হয়েছিলো। আজকের মিডিয়া যখন এক বিষয় থেকে লম্ফ দিয়ে আরেক বিষয়ে লাফ দেয় তাতে নতুনত্ব কিছু নেই, আছে পূর্বজের আনুগত্যের উত্তরাধিকার।

বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলায় বর্গী হানা ও গণহত্যা ~ শুভ্র সুন্দর

বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে হিংস্র গনহত্যা ঘটে নাগপুরের হিন্দু রাজার নেতৃত্বে

            হ্যাঁ, ঠিক শুনছেন, বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য, ভয়ংকর গণহত্যা ঘটে হিন্দু রাজাদের নেতৃত্বে। মূলত নাগপুরের রাজা রাঘোজি ভোঁসলের নেতৃত্বে। রাঘোজি ভোঁসলে ছিলেন নাগপুরের মহারাজা আর তিনি কাজ করতেন মহারাষ্ট্রের পুনের পেশোয়া বাজিরাও এর অধীনে। পেশোয়া বাজিরাও ও ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। সেই পেশোয়া অর্থাৎ প্রধাণ মন্ত্রী আবার কাজ করতেন সাতারা র ছত্রপতি দের অধীনে। সেইসময় ছত্রপতি ছিলেন সাহুজি রাও ভোঁসলে ১। 

            যাইহোক, মারাঠা ছত্রপতি সে শিবাজী হোক বা তার উত্তরসূরী, ইনকামের দিক থেকে এনারা ছিলেন তোলাবাজ, লুঠেরা। বিভিন্ন রাজ্য কে আক্রমণ করতেন, তারপর তাদের পরাজিত করতে পারলে, তাদের উপর বিশাল পরিমান বার্ষিক খাজনা বা তোলা বসাতেন না দিলে আবার আক্রমন করবেন এই ভয় দেখিয়ে। আর এই আক্রমণের সময় যা কিছু দুইচোখে দেখতেন তা লুঠ করে আনতেন ও নির্দ্বিধায় গণহত্যা করতেন। শিবাজীর নাতি সাহু প্রথম এই পেশোয়া বাজীরাও কে নিযুক্ত করেন। আর বাজীরাও এর অধীনে থাকা সামরিক বাহিনীর প্রধাণ দের বাজীরাও এক একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ক্ষমতা দেন কিছু শর্তের ভিত্তিতে। কিন্তু, পরবর্তী কালে সামরিক বাহিনীর প্রধাণরা, সেই অঞ্চলগুলির সর্বেসর্বা বা মহারাজা হয়ে ওঠেন। যেমন মালোয়ার সিন্ধিয়া বংশ, গোয়ালিওর এর সিন্ধিয়া বংশ, ইন্দোরের হোলকার বংশ, বরোদার গায়কোয়ার বংশ এবং নাগপুরের ভোঁসলে বংশ।

           এই নাগপুরের ভোঁসলে বংশের প্রথম রাজা রাঘোজি ভোঁসলে ১৭৪১ সালে প্রথম বাংলা আক্রমণ করেন। বাংলা তখন অধুনা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ছিল। তখন বাংলার মোঘল নবাব আলীবর্দী খাঁ। রাজা রাঘোজি ভোঁসলে তার মারাঠা সৈন্য বাহিনী নিয়ে আক্রমন করেন বাংলা। মারাঠা সৈন্যবাহিনীর নাম ছিল মারাঠী ভাষায় "বর্গীর"। এই "বর্গীর" একটি পার্সিয়ান শব্দ যার মানে "ঘোরসওয়ার"। এই বর্গীর বাহিনী দের মূল উদ্দেশ্য ছিল লুঠ ধর্ষন করা। আর তার জন্য তারা গণহত্যায় পিছ পা হতো না। ডাচ ইতিহাসবিদ লিখেছেন, প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালী কে হত্যা করেছিল এই বর্গীর বাহিনী, ১৭৪১ সাল থেকে ১৭৫১ সালের মধ্যে মোট ৬ বার আক্রমণ করে। বর্গীর বাহিনী বিহার ও উড়িষ্যার অনেকটা অঞ্চল দখল করে ফেলে যখন হূগলী নদীর কাছাকাছি চলে আসে তখন আলিবর্দী খাঁ বাংলা র মানুষ কে এই অত্যাচার থেকে বাঁচাবার জন্য তাদের সঙ্গে "চৌথ" চুক্তি তে রাজি হয়।"চৌথ" অর্থাৎ, উৎপাদনের ২৫% খাজনা সব মানুষের উপর চাপিয়ে, তা বর্গীদের হাতে তুলে দিতে হবে। 

            তখনকার দিনে তার মূল্য নির্ধারণ হযেছিল বছরে ১২ লক্ষ টাকা। মানে বুঝতেই পারছেন এখন তার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকার সমান। এছাড়া প্রথম দুই তিন বছর পুরো খাজনা না দিতে পাড়ায় ১৭৪৩ সালে একসাথে ৩২ লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য করা হয় নবাব আলীবর্দী খাঁ কে। তার পর থেকে প্রতিবছর ওই ১২ লক্ষ টাকা তোলা আদায়। সঠিক সময়ে সেই টাকা না পেলেই তারা বাংলার গ্রামে ঢুকে গ্রামবাসীদের থেকে টাকা আদায় করতো। না দিতে পারলে, নৃশংস অত্যাচার করা হতো, যেমন নাক, কান ও স্তন কেটে নেওয়া, জলের ট্যান্কে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দমবন্ধ করে মারা হতো, মহিলাদের ধর্ষন করা হতো,গ্রামের পর গ্রাম আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতো ইত্যাদি।হলওয়েল, সলিমুল্লাহ, গঙ্গারাম শাস্ত্রী প্রমুখের রচনায় মরাঠাদের বীভৎসতার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় "মহারাষ্ট্র পুরান" এ গঙ্গারাম লেখেন, " এবছর তারা কাওকেই ছারে নি। ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, সাধারণ মানুষ কাওকেই না। এমনকি হাজারে হাজারে গরু র গলা কেটে দিয়ে গেছে, গ্রামবাসী দের অর্থনৈতিক ভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য।" মহারাষ্ট্র পুরানে উল্লেখিত "মাঠে ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া।/সোনা রুপা লুঠে নেয়, আর সব ছাড়া।।/কারু হাত কাটে, কারু নাক কান।/একি চোটে কারু বধয়ে পরাণ।/ভাল ভাল স্ত্রীলোক যত ধরিয়া লইয়া যায়।/অঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলায়।।/এক জনে ছাড়ে তবে আর জনা ধরে।/তারা ত্রাহি শব্দ করে।।''

            বর্গীর বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি ছিলেন,  মারাঠা সর্দার ভাস্কর পণ্ডিত। তারা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে ব্যাপক লুঠতরাজ চালাতে থাকেন! পরে ১৭৪৪ সালে আলীবর্দী খাঁ ভাস্কর পণ্ডিত কে ডেকে পাঠান শান্তি চুক্তির নামে। সেই মিটিং এর তাঁবু তেই ইয়ং সিরাজউদোল্লার সাহায্যে, গুপ্তসেনারা ভাস্কর পণ্ডিত ও তার সহযোগী ২১ জন সেনাপতি কে খুন করে । এর পর ১৭৪৬ সালে বর্গীর বাহিনীর দায়িত্ব নেন জানজি রাঘোজি ভোঁসলে এর পুত্র জানজি ভোঁসলে।জানজি ভোঁসলের নেতৃত্বে বর্গীরা আবার বাংলা আক্রমণ করে, যদিও ১৭৪৭ সালে, তিনি আলীবর্দী খাঁ এর সঙ্গে বর্ধমানের যুদ্ধে হেরে গিয়ে মেদিনীপুরের দিকে চলে যান।এরপর বর্ধমান ও মূর্শিদাবাদ বর্গীদের হাত থেকে উদ্ধার হলেও, বাংলার মেদিনীপুর ও উড়িষ্যায় বর্গীদের প্রভাব থেকেই যায়। 

             ঝাড়গ্রামের কুলটিকরি। আর পশ্চিম মেদিনীপুরে কেশিয়াড়ি। কুলটিকরি থেকে কেশিয়াড়ি যাওয়ার পথে পড়ে কিয়ারচাঁদ। এই কিয়ারচাঁদের বিরাট এলাকায় শয়ে শয়ে লম্বা, চৌকা নানা রকম পাথর পোঁতা আছে। সাধারণ ভাবে বোঝা যায় না কী এগুলো। কিন্তু জনশ্রুতি বলছে, এই পাথরগুলোর সঙ্গে বর্গিদের যোগ রয়েছে। এলাকার বাসিন্দারা বলেন, তাঁরা বংশানুক্রমে শুনেছেন, বর্গিদের অত্যাচারে ভয় পেয়ে স্থানীয় জমিদার সারি সারি পাথর পুঁতেছিলেন। সন্ধ্যার সময় ওই সব পাথরের গায়ে মশাল জ্বেলে বেঁধে দেওয়া হত। দূর থেকে মনে হত, মশালধারী সৈন্য গড় পাহারা দিচ্ছে।

           ১৭৫১ সালে আলিবর্দী খাঁ উড়িষ্যা কে রাজা রাঘোজি ভোঁসলের নামে লিখে দিলে, বর্গী আক্রমণ থামে। তবে বর্গী রা কোনোদিন ই কোলকাতা কে আক্রমণ করে নি। মূলত গ্রামেই তারা আক্রমণ করতো। হয়তো ব্রিটিশ দের ভয় করতো। যদিও কোলকাতা কে রক্ষা করার জন্য ৫ কিমি লম্বা একটা খাল কাটা হয়েছিল যার এই পারে বর্গীরা কোনোদিন ঢোকে নাই। সেই খালটি আমরা এখন আপার সার্কুলার রোড নামে চিনি। ওহ, কোলকাতায় তারা শুধু জগৎ সেঠ এর বাড়ি লুঠ করেছিল।

            মারাঠি হিন্দু সম্রাট রা, যে শুধুই বাংলা আক্রমন করে বাঙালী হিন্দু দের হত্যা করেছিল তা না। তারা বিভিন্ন রাজ্য কেই আক্রমণ করতো। ১৭৫৯ সালে তারা তিরুপতি মন্দির লুঠ ও ধ্বংস করে। ১৭৯১ সালে রঘুনাথ রাও পটবর্ধনের নেতৃত্বে, মাইসোর রাজ্য আক্রমণ করে ফেরার পথে "সৃঙেরি" মন্দির লুঠ ও ধ্বংস করে মারাঠি সেনা। যদিও, সেই সময়ের মাইসোরের নবাব টিপু সুলতান মুসলিম রাজা হয়েও এই মন্দির আবার সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেন। নিজে মন্দিরের মূর্তির জন্য অলংকার কিনে দেন।

            এই বর্গী রাজা রা এতোটাই অত্যাচারী ছিল, যে, সেই শোলে সিনেমার "শো যা, নেহিতো গব্বর আ যায়েগা" র মতো করে বাংলার গ্রামে গ্রামে মায়েরা বাচ্ছা দের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো এই বলে যে, 

                        "খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে।
                          বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে? 
                          ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কী? 
                          আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।"

            ইতিহাসের থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হয়। এই বর্গী রা হিন্দু হলেও তারা হিন্দুদের উপর অত্যাচার করতে এতোটুকু ভাবে নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, এই অত্যাচার বাঙালীরা হিন্দু বলেই হয়েছে, তা নয়। বর্গিরা আচমকা ঘোড়ায় চড়ে 'হর হর মহাদেব' বলে গ্রামে ঢুকে পড়ত। লুঠ টাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তাই নাগপুরের রাজা যতোই হিন্দু হোক, "হর হর মহাদেব" বা "জয় শ্রীরাম" যাই বলুন  তারা যে, হিন্দু বলে ছার দেবেন এটা ভাবা খুব ই ভুল, লুঠ টাই তাদের উদ্দেশ্য, ইতিহাস সাক্ষী।।

সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫

ওয়াকফ আইন নিয়ে আপত্তির জায়গাগুলো ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

এই লেখার মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ওয়াকফ বিল (যদিও এই লেখার সময় সেটি আইনে পরিণত) এর আপত্তির জায়গাগুলো চিহ্নিত করার আগে বিল তথা বর্তমান চালু আইনের কিঞ্চিৎ পটভূমিকা প্রয়োজন যেটা আপত্তির জায়গাগুলো অনুধাবন করতে আমাদের সাহায্য করবে। 

১.১. ওয়াকফ- বিষয়টি কী: ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন অনুসারে, ওয়াকফ বলতে মুসলিম আইনে স্বীকৃত ধার্মিক, ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে যেকোনো ব্যক্তির স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির স্থায়ী উৎসর্গকে বোঝায়। এইভাবে উৎসর্গ করা সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলা হয়। যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি এভাবে উৎসর্গ করেন তাকে ওয়াকফি বলা হয় এবং যে ব্যক্তি এই সম্পত্তি পরিচালনা করেন তাকে মুতাওয়াল্লি (পরিচালক এবং প্রশাসক) বলা হয়। ওয়াকফ তিন ধরণের। (১) ওয়াকফউলিল্লাহ অর্থাৎ পাবলিক ওয়াকফ), (২) ওয়াকফ-আল-আওলাদ (শিশুদের জন্য ওয়াকফ) এবং (৩) মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগাহ, কবরস্থান, পিরোস্তান, ঈদগাহ ইত্যাদি ব্যবহারকারীদের দ্বারা ওয়াকফ। পাবলিক ওয়াকফ ধর্মীয় এবং দাতব্য উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় যা জনসাধারণের জন্য এবং ওয়াকফ-আল-আওলাদ হল একজনের সন্তান/আত্মীয়দের কল্যাণের জন্য তৈরি একটি ওয়াকফ।  ব্যবহারকারীর দ্বারা ওয়াকফ বলতে বোঝায় যেখানে কোনও জমি বা ভবনের অংশ স্থায়ীভাবে কোনও ধর্মীয় বা ধার্মিক উদ্দেশ্যে যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হয়।

১.২. মুতাওয়াল্লি কে: ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনাকারী ব্যক্তিকে "মুতাওয়াল্লি" বলা হয়। মুতাওয়াল্লির আইনি অবস্থান হল ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপক বা সুপারিনটেনডেন্টের। মুতাওয়াল্লিরা আবার দুটি শ্রেণীর; নিযুক্ত এবং রেকর্ডকৃত। ওয়াকফ কর্তৃক সম্পাদিত, উত্তরাধিকারের নির্দিষ্ট নিয়মের সাথে, হস্তান্তর দলিলের সংস্করণ অনুসারে রেকর্ডকৃত মুতাওয়াল্লিদের বলা হয় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যেখানে উত্তরাধিকারের কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই বা ওয়াকফ দলিল নেই, বোর্ড কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুতাওয়াল্লি নিযুক্ত হন।

১.৩. ওয়াকিফ বা দাতা কে: ওয়াকফ বা দাতা বলতে বোঝায় যে কোনও ব্যক্তি সর্বশক্তিমানের নামে কোনও স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি উৎসর্গ করে যা মুসলিম আইন দ্বারা ধার্মিক, ধর্মীয় বা দাতব্য হিসাবে স্বীকৃত। দুইটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক) যিনি দান করবেন তাকে ঐ সম্পত্তির আইনত মালিক এবং সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে। দুই) একবার কোনও সম্পত্তি উৎসর্গ করা হলে দাতা  সেই সম্পত্তির ওপর তার সম্পূর্ণ অধিকার হারাবেন এবং এই ধরনের সম্পত্তি কখনই বিচ্ছিন্ন, বন্ধক বা হস্তান্তর করা যাবে না, ফেরত নেওয়া যাবে না, বিক্রি করা যাবে না, উপহার দেওয়া যাবে না বা অন্য নামে দানপত্র করা যাবে না, কিংবা উত্তরাধিকার হিসাবে সন্তান-সন্ততিরা পাবে না। 

১ ৪. ওয়াকফ এর ধর্মীয় পটভূমি: "ওয়াকফ" (আরবি: وقف‎) শব্দটি হাবুস নামেও পরিচিত, আরবি শব্দ "ওয়াকফা" থেকে উৎপত্তি, যার অর্থ আটকে রাখা, আটকে রাখা বা বেঁধে রাখা। বলা হয় যে, একবার দ্বিতীয় খলিফা আব্দুল্লাহ বিন ওমর খাইবার এলাকায় এক টুকরো জমি অধিগ্রহণ করেন এবং নবী মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করেন যে কীভাবে এর সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায়। নবী বলেন, "সম্পত্তি বেঁধে দাও এবং মানুষের কল্যাণে উপার্জিত অর্থ উৎসর্গ করো, এবং এটি বিক্রি করা বা উপহার বা উত্তরাধিকারের বিষয়বস্তু করা যাবে না, এর উৎপাদিত ফসল তোমাদের সন্তানদের, তোমাদের আত্মীয়স্বজন এবং দরিদ্রদের এবং আল্লাহর পথে উৎসর্গ করো"। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, প্রথম ওয়াকফ গঠন হয় হজরত মহম্মদের জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরামর্শে। মুখাই-রিক নামে একজন ইহুদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হজরত মহম্মদকে ৭ টি ফলের বাগান দান করতে চাইলে হজরত মহম্মদ তাঁকে পরামর্শ দেন ওয়াকফ তৈরি করে ঐ সম্পত্তি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে ইসলামের সেবায় ব্যবহার করতে। 

১.৫. ওয়াকফ এর আইনি পটভূমি: ভারতে ওয়াকফ গঠিত হয় মধ্যযুগে ইসলামের আগমনের পরে। সুলতানি আমলে, মুঘল আমলে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাবে, মুলতানে, নিজামশাহের আমলে অবিভক্ত অন্ধ্রে, নবাব শাহী আমলে বাংলায় এবং অন্যান্য রাজ্যে বহু ওয়াকফ সম্পত্তি গঠিত হয়। এইসব ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহৃত হতো দাতব্যমূলক কাজে এবং মুসলমান জনগণের সেবায়। ঐ অর্থে তৈরি করা হতো মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবরখানা এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ। সেই ধারা এখনো অব্যাহত। পরবর্তী পর্যায়ে মুঘল শাসনামলে, আওরঙ্গজেব "ফতোয়াই-ই-আলমগীরি" এর মাধ্যমে ওয়াকফ সংক্রান্ত আইন সহ মুসলিম আইনগুলিকে সংহিতাবদ্ধ করেছিলেন যা ব্রিটিশ যুগে প্রিভি কাউন্সিলের সময়কাল পর্যন্ত বৈধ ছিল। ভারতে, মুসলিম ওয়াকফ বৈধকরণ আইন, ১৯১৩, মুসলিম ওয়াকফ আইন ১৯২৩ ব্রিটিশ আমলে প্রিভি কাউন্সিলের সময় প্রচলিত ছিল। এর পরে বেঙ্গল ওয়াকফ আইন, ১৯৩৪, অস্তিত্ব লাভ করে এবং তারপরে, ওয়াকফ আইন, ১৯৫৪ (কেন্দ্রীয় আইন) যা বলবৎ ছিল পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া (যেখানে বেঙ্গল ওয়াকফ আইন, ১৯৩৪ বলবৎ ছিল কেন্দ্রীয় আইন জারি হওয়ার আগ পর্যন্ত।

১.৬। দেশ স্বাধীন হলে ভারত সরকার ঐ আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন তৈরি করে। পরে ১৯৫৯, ১৯৬৪, ১৯৬৯, ১৯৮৪ সালে কিছু কিছু সংশোধন করা হয়। পরে যৌথ সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৯৫ সালে নতুন ভাবে ওয়াকফ আইন তৈরি করে। বর্তমানে এই আইনকেই প্রিন্সিপাল আইন বলা হয়। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদীয় সিলেক্ট কমিটির সুপারিশের উপর ভিত্তি করে ওই আইনের বেশ কিছু সংশোধনী যুক্ত করে। ১৯৫৪ এবং ১৯৯৫ সালের আইনের ভিত্তিতেই রাজ্যে রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ড গঠিত হয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৫ সালের আইনের উপর ৪০টির বেশি সংশোধনী এনেছে।

এইবার বর্তমান সংশোধনী বিল এর বিভিন্ন আপত্তির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা যাক  

২ ১. সংশোধনীতে বলা হয়েছে ওয়াকফ আইন WAQF Act কথাটির পরিবর্তে এই আইনটির নাম হবে ''Unified Wakf Management, Empowerment, Efficiency and Development Act''। বিলের ১৩(২এ) অংশে বলা হয়েছে বোহরা সম্প্রদায় এবং আফগানি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব রাখতে পৃথক পৃথক বোর্ড করা হবে। অর্থাৎ  বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গি হতে মুসিলম জনসাধারণকে ভাগ করতে চাওয়া হয়েছে। বর্তমান বোর্ডগুলি সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কাজ করে। 

২.২. বিল অনুযায়ী কেবলমাত্র একজন মুসলিম যিনি প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ধর্ম পালন করছেন এমন ব্যক্তিই ওয়াকফ সম্পত্তি দান করতে পারেন। ১৯৯৫ সালের আইনে বলা ছিল যে কোনও ব্যক্তি তা করতে পারেন। এটা তার সাংবিধানিক অধিকার। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ হতে সেই অধিকারকে খর্ব করতে চাওয়া হয়েছে যাতে অমুসলিমরা কেউ ওয়াকফে সম্পত্তি দান না করেন। সংশোধিত আইনের ফলে মুসলিম অমুসলিম ভ্রাতৃত্বের এই প্রকাশ আর সম্ভব হবে না।

২.৩. ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সদস্যরা মুসলিম সম্প্রদায়ের হবেন। অথচ বিলে বলা হয়েছে ঐ কাউন্সিলে অন্তন্ত দু'জন অমুসলিম থাকবেন। অমুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনা থেকে নিষিদ্ধ করার ইসলামিক আদেশ সত্ত্বেও, সংশোধিত আইনে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি মুসলমানদের তাদের ধর্ম পালনের সাংবিধানিক অধিকারের উপর আক্রমণ।

২.৪. ১৯৯৫ আইনে বলা ছিল ওয়াকফ সম্পত্তি বিষয়ে যে সব ট্রাইবুনাল গঠিত হবে সেখানে মুসলিম আইন সম্পর্কে দক্ষতা আছে এমন ব্যক্তিকে রাখতেই হবে। বিলে এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্যটা কি বুঝতে অসুবিধা হয় না।

২.৪. বিলে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে দু'জন মহিলা সদস্য থাকবেন। অথচ ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে ''at least two women members''  অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের আইনে দুইয়ের বেশি থাকারও সুযোগ রাখা ছিল। এখন বলা হচ্ছে দু'জন থাকবেন। এটা কেন?

২.৫. পূর্বের আইন মোতাবেক রাজ্য সরকার ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হিসাবে সাংসদ ও বিধায়ক ক্ষেত্র হতে মুসলিম সাংসদ ও বিধায়কদের মধ্য হতে মনোনীত করতো। বর্তমানে বিলে বলা হয়েছে মুসলিম হতে হবে এমন নয়, যে কোন সাংসদ, বিধায়ক থাকতে পারবেন। মন্দির ট্রাস্ট বডিতে এই ফর্মুলা মানা হবে তো?

২.৪. এই বিল অনুযায়ী ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ধারণের ক্ষমতা সার্ভে কমিশনারের কাছ থেকে সরকার নিযুক্ত রাজস্ব কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করে, সরকার উপাসনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা এবং বৃত্তিমূলক কেন্দ্রগুলিকে জব্দ করার লক্ষ্য নিয়েছে, যার ফলে ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করা হবে। বিলে আরও বলা হয়েছে যে কোনও ওয়াকফ সম্পত্তির নথি সহ রেজিষ্ট্রকরণ বাধ্যতামূলক এবং তা করতে হবে জেলাশাসকের কাছে। কেন এটা হবে? মৌখিক অনুমতির ভিত্তিতে বহু ওয়াকফ তৈরি (Wakf by use) হয়েছে এবং তা লাগু আছে। সেগুলির তাহলে কি হবে? দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার ওয়াকফ সম্পত্তির নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতামূলক নতুন আদেশটি সরকারের গোপন কর্মসূচিকেই উন্মোচিত করে, সেগুলি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে।

২.৫. ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ তৈরি হলে রাজ্য সরকারগুলি ওয়াকফ ট্রাইবুনাল তৈরি করবে এবং ৭(১) ধারায় বলা আছে সেই ট্রাইব্যুনালের রায় চূড়ান্ত। বর্তমান বিলে ৭(১) ধারাকে তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলাশাসকদের। এক্সিকিউটিভদের এই জুডিশিয়ারি ক্ষমতাদান এর মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করা হচ্ছে।

২.৫. এই বিল অনুযায়ী কোনও ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারের অধীনে থাকলে তা আর ওয়াকফ সম্পত্তি থাকবে না। তা কেন হবে? মালিকানা কেন ওয়াকফ হারাবে? বরং সরকারের দেখা উচিত যেসব সরকারি সম্পত্তির মালিকানা ওয়াকফের নামে আছে অথচ সরকার ভোগ করছে তার মধ্যে যেগুলি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব তা দিতে হবে।

২.৬. এই বিল অনুযায়ী0l কেন্দ্রীয় সরকার রেজিস্ট্রিকৃত ওয়াকফ সম্পত্তির হিসাব পরীক্ষা করার বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারবে। ১৯৯৫ সালের আইনে ওয়াকফ বোর্ড এবং রাজ্য সরকার এই কাজ করতো। এটা রাজ্য সরকারের কাজের উপর এবং ওয়াকফ বোর্ডগুলির ক্ষমতার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে 
ওয়াকফ বোর্ডগুলি তদারকি করে রাজ্য সরকার। এই বিল প্রণয়নের সময়ে কেন্দ্র সরকার রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে আলোচনা করেনি। কৃষিনীতি (বর্তমানে বাতিল), শ্রমনীতি, এমন কি শিক্ষা নীতি রচনায় কেন্দ্র একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। এই পদক্ষেপে আসলে ভারতের সংবিধান স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রীয়  কাঠামোর ওপরেই আঘাত।

২.৭. সর্বশেষে ওয়াকফ আইনের ৪০ ধারা বাতিল করার মাধ্যমে, ওয়াকফ বোর্ড ওয়াকফ সম্পত্তির প্রকৃতি নির্ধারণের কর্তৃত্ব হারাবে। ওয়াকফ সম্পত্তিগুলি মূলত চারটি বিভাগে পড়ে: দলিল অনুসারে ওয়াকফ (নথিভুক্ত), মৌখিক ঘোষণা অনুসারে ওয়াকফ (মৌখিকভাবে ঘোষিত), ব্যবহারের মাধ্যমে ওয়াকফ (দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত), এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জমি। নতুন সংশোধনীর অধীনে, দেশের বেশিরভাগ ওয়াকফ সম্পত্তি - যা মৌখিকভাবে বা ব্যবহারের মাধ্যমে ঘোষিত - সরকারী দখলের ঝুঁকিতে পড়বে।উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং কেরালার মতো বৃহত্তম ওয়াকফ হোল্ডিং সহ রাজ্যগুলি এই ঝুঁকির সামনে

সবশেষে যেটা বলার তা হল এই যে বিষয়টা মোটেই এমন নয় যে এই বিল আসার আগে ওয়াকফ নিয়ে যা চলছে সেটা খুব গ্রহণযোগ্য। ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা এবং পরিমাণ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। কেননা দেশে সে ধরনের বিজ্ঞানসম্মত কোনও সমীক্ষা হয়নি। নিবন্ধিত হয় নি এমন বহু ওয়াকফ আছে। তবে সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল সূত্রে জানা যায় সারা দেশে কমবেশি ৮ লক্ষ ৭০ হাজার ওয়াকফ সম্পত্তি আছে এবং সেগুলিতে মোট জমির পরিমাণ ৯ লক্ষ ৪০ হাজার একরের মতো। এর বাজার মূল্য ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী দেশের স্থায়ী সম্পদ বিশিষ্ট ওয়াকফের সংখ্যা ৮ লক্ষ ৭২ হাজার ৩২৮ টি এবং অস্থায়ী সম্পদ বিশিষ্ট ওয়াকফ সংখ্যা হলো ১৬,৭১৩ টি। এর মধ্যে ডিজিটাল রেকর্ডভুক্ত করা সম্ভব সম্ভব হয়েছে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৯৯৫ টি ওয়াকফের। পশ্চিমবাংলায় ১ লক্ষের বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। যার মধ্যে রেকর্ড ভুক্ত ৮০ হাজারেরও বেশি। যেটা বাম আমলে হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে দেশে প্রতিরক্ষা ও রেল দপ্তরের পরে সবচেয়ে বড় জমির মালিকানা হলো ওয়াকফ সম্পত্তি। 

এই বিপুল সম্পত্তির অনেকটাই বেআইনি ভাবে ব্যক্তিস্বার্থে ভোগ দখল করছেন এমন কিছু মানুষ যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, আদপে ওই সম্পত্তি সাধারণ গরীব মানুষের কাজে লাগছে না। তাই আইনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করবেন না। কিন্তু আইন সংশোধন সংস্কারের নামে সংবিধান প্রদত্ত ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করার চেষ্টা হলে সমস্ত শুভুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বিভাজনকারী ওয়াকফ সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবি জানাতে হবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে। এটাই আবেদন।

বুধবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৫

বঞ্চিত কারা? ~ বিহঙ্গ দত্ত

বঞ্চিত কারা? 



১) ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও গ্রুপ সি, ডি লেভেলের এক্সামে যারা প্রবল দুর্নীতিগ্রস্ত লিস্টের ভিতর নিজেদের শিরদাঁড়ার জোরে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন তারা বঞ্চিত। দুর্ভাগ্যক্রমে এদের সংখ্যা জানা সম্ভব হচ্ছে না। সৌজন্যে আমাদের মহামান্য পর্ষদ। তারা নথি নেই বলে দাবি করছেন। কিন্তু নথি ডেস্ট্রয় করবার পরেও একাধিক সময়ে তাদের ঝুলি থেকে টুকুর টুকুর করে স্ক্যাণ্ড কপি বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন আরটিআই-তে। অতএব চাকুরিজীবীদের মধ্যে বঞ্চিত শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র এরাই। 

বঞ্চিত কারা? 

২) ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও গ্রুপ সি, ডি লেভেলের এক্সামে কয়েক লাখ পরীক্ষার্থী যোগ্যতার সঙ্গে তুমুল ভালো নম্বর পেয়েও ইন্টারভিউতে কল পায়নি। আজ তারা হাঁ করে ওইসব রত্নখচিত ওএমআর  শিটগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছে কেউ ৯ টি কোশ্চেনের অ্যানসার করেছে, কেউ ১২ টি। কেউ শূন্য খাতা জমা রেখেছে এবং তারা সসম্মানে চাকরিতে বহাল রয়েছে। এদের চোখের জল আর কুৎসিততম অবহেলার খেয়াল কেউ কোনওদিন রাখেনি। বঞ্চিত এরা।  আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন ২৬০০০ সিট হলে বঞ্চিত কী করে দুই আড়াই লাখ হয়ে যায়? কেউ যদি ৫৫-এ  ০৪ পেয়ে চাকুরিরত হতে পারেন তাহলে যে ৪৪ পেয়েছিল সে কী দোষ করল? 
কয়েকদিন আগে নিউজ চ্যানেলগুলোতে এক কান্নাবাসা ভিডিও দেখছিলাম। 
অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ... 
আমার চাকরি চলে গেছে। অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ... আমি কিছু করিনি। একটাও দুর্নীতি করিনি। অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ... আমার অ্যাকাডেমিক স্কোর ফুল আছে। অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ... আমার কাছে ওএমআর আছে। আমি ৫৫ এ ৩৮ পেয়েছিলাম। অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ... 

দাদা, আমি ৫১ পেয়েছিলাম। আমার সাবজেক্ট বাংলা। সেখানে হাই কম্পিটিশন! কাট অফ ছিল ৫৩। সেটা হতেই পারে। এসএসসি চিরকালই পাগলের মতো টাফ এক্সাম। কিন্তু আপনি কোন সাবজেক্টের কোন ক্যাটাগরি দাদা, যেখানে ৩৮ কাট অফ ছিল? 

কাল কলকাতা টিভিতে ভাগ্যশ্রী বেরা নাম্নী এক চাকুরিজীবী দর্দভরা কাহিনী শোনালেন। ভদ্রমহিলার চাকরি গেছে। এসএসসি-র সাইটে জ্বলজ্বল করছে তার ওএমআর। তিনি ০৯ পেয়েছেন ৫৫ তে। গিয়ে দেখে আসতে পারেন। এনারা যদি যোগ্য হন তাহলে ওই আড়াই লাখ পরীক্ষার্থী কী দোষ করলেন?  

সর্বাপেক্ষা বঞ্চিত কারা? 

৩) এবার হাত কাঁপছে। নাহ, আমরা কেউ সর্বাপেক্ষা বঞ্চিত নই। পেটে যৎসামান্য বিদ্যা আছে। গতরে এখনও খেটে খাওয়ার শক্তি আছে। যুঝে নেব। যে সকল না ফোটা ফুলের দল স্কুলবাড়ির সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে আর দেখছে গেটে তালা ঝুলে গেছে বহুস্কুলের, যারা প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে হাঁ করে বসে আছে আর মিড ডে মিলের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরছে, যাদেরকে এই শয় তান রাষ্ট্র প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে স্কুল তোমাদের জন্য লঙ্গরখানা মাত্র, তার বেশি কিছু আশা কোরো না, যাদের ভবিষ্যতের খবর কোনও ঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন, কোনও জবাব চাইছে ময়ূখরঞ্জন কোনও যাহা বলিব সত্য বলিব-রা রাখবে না সেই সকল শিক্ষায় পরাঙ্মুখ, মুকুলে বিনষ্ট,  সততায় বীতরাগ হতে থাকা কঙ্কালসার ভবিষ্যত সর্বাপেক্ষা বঞ্চিত। এই স্লো পয়জনিং-এর কোনও ক্ষমা নাই। ক্ষমা নেই রাষ্ট্রের। ক্ষমা নেই সরকারের। ক্ষমা নেই পর্ষদের। ক্ষমা নেই বিরোধী দলগুলোর। ক্ষমা নেই আমাদের প্রত্যেকের। 

আমাদের জাস্ট দম নেই এদেরকে সুন্দর ভবিষ্যত বা বর্তমান দেওয়ার। কোন মুখে আয়নার সামনে দাঁড়াব বলুন?  

তো এই হল, বঞ্চিতদের তালিকা। এরপর আরেকটা লেখা আসবে। লাভবান কারা? সঙ্গে আর একটা অংশও থাকবে। প্ররোচিত কারা? 
পারলে পড়ে দেখবেন।

শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলার শিক্ষক কেলেঙ্কারি আর আন্তর্জাতিক বাঙালি বুদ্ধিজীবী ~ ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

সুপ্রিম কোর্ট বাংলার সরকারি বিদ্যালয় থেকে প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষকের বরখাস্ত বহাল রেখেছে, কারণ তৃণমূল কংগ্রেস এই চাকরিগুলোর বেশিরভাগই সর্বোচ্চ দরের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। বাংলার সরকারি বিদ্যালয় ব্যবস্থার এই ধ্বংস থেকে পুনরুদ্ধার হতে বেশ কয়েক দশক লাগবে। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসন বাংলার সরকারি বিদ্যালয় এর জন্য খরচকে তৃণমূলের ব্যক্তিগত আয়ের উৎসে পরিণত করেছে। এখন বাংলার কয়েক প্রজন্মের শিশুরা এর মূল্য দেবে। এমনিতেই রাজ্যে যথেষ্ট চাকরি নেই বলে জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ রাজ্য ছেড়ে চলে যায়, সেই প্রবণতা আরো বাড়বে। কিন্তু রাজ্যের বাইরে অন্যান্যদের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য যে মৌলিক সাক্ষরতা, সংখ্যাজ্ঞান বা কম্পিউটার দক্ষতা প্রয়োজন, এবার তারা সেগুলো ছাড়াই চলে যাবে। ফলে গায়ে গতরে খেটে খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজ তারা পাবেনা। 

পশ্চিমবঙ্গে ছেলেদের বিদ্যালয় ত্যাগের হার ইতিমধ্যেই বেশি এবং ক্রমাগত বাড়ছে, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার এই ধ্বংস অবশ্যই সেটাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলার শিশুদের ভবিষ্যতের প্রতি আগ্রহ আছে এমন কেউই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী শাসকের প্রতি গভীর ঘৃণা পোষণ করা ছাড়া অন্য কিছু করতে পারবে না।

তবে কিভাবে আমরা এখানে পৌঁছলাম, তা বুঝতে আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। এই সংকট এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তৈরি হয়েছে। সবাই জানত যে বাংলার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকরিগুলি পাইকারি হারে সর্বোচ্চ দরের ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। সবাই জানত যে পুরো ব্যবস্থাটি শীঘ্রই ভেঙে পড়বে। তবুও বাংলার তথাকথিত স্বাধীন বুদ্ধিজীবীদের ফুলেফেঁপে ওঠা গোষ্ঠীর প্রায় সবাই, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র / দিল্লি / লন্ডন / নিউইয়র্ক ভিত্তিক বিশ্বব্যাপী খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিরা - এই ধীরগতির ট্রেন দুর্ঘটনার বিষয়ে নীরব ছিলেন। এমনকি এরই মধ্যে তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছুঁড়ে দেওয়া বঙ্গশ্রী /বঙ্গবিভূষণ বা অন্য যেকোনো ছোটখাটো পুরস্কার আনন্দের সাথেই গ্রহণ করেছিলেন।

অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট, যার প্রধান কাজ  বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলি তুলে ধরা এবং জনসমক্ষে আলোচনার সূচনা করা, তারা বাংলার শিক্ষার সবচেয়ে মৌলিক বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলা ছাড়া সবকিছুই করেছে। বর্তমানে বাংলায় সক্রিয় ফিল্ড এক্সপেরিমেন্ট বোদ্ধা এবং ক্রমবর্ধমান RCT গোষ্ঠী - যাদের মধ্যে খুব কম জনই স্থানীয় তৃণমূল রাজনৈতিক নেতা এবং আমলাদের সমর্থন ছাড়া এক পা-ও নড়তে পারেন না - তারা নিশ্চিত করেছেন যে তারা রাজ্যের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবেন। যারা নিউইয়র্কের ক্যাম্পাস থেকে টুইট করেন বা বার্কলে থেকে কলকাতার বার্ষিক জনসভা এবং টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারের জন্য আসেন তারা তাদের টুইট, জনসভা এবং টেলিগ্রাফ সাক্ষাৎকার ট্রাম্প এবং মোদীর মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করেছেন।

এই কেলেঙ্কারি আসলে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তৈরি হওয়া একটা ধীরগতির ট্রেন দুর্ঘটনা, যা জনসাধারণের চোখের সামনে ঘটেছে। নিছক টাকা চুরির মাধ্যমে বাংলার একটি গোটা প্রজন্মের শিশুদের জীবনযাত্রা একটু একটু করে ধ্বংস করা হয়েছে। আর যাদের যাদের বৌদ্ধিক এবং একাডেমিক দায়িত্ব ছিল এই ধরনের ট্র্যাজেডিগুলি লক্ষ্য করা, চিৎকার করে সবাইকে জানানো এবং সতর্ক করা, ঠিক সেইসব ব্যক্তিদের কাছ থেকে সামান্যতম প্রতিবাদ ছাড়াই ঘটেছে এই কেলেঙ্কারী।

এরপরও এনাদের ক্ষমা করা সম্ভব?

🖋️ প্রফেসর ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত (ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট)

অনুবাদ: প্রফেসর শুভাশীষ মোদক চৌধুরী (ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড) 

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও তৃণমূলের শ্রেণী চরিত্র ~ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

যা হয়েছে এবং হচ্ছে তা যে খুব খারাপ হচ্ছে তা প্রায় সবাই বোঝে ('প্রায়' বললাম কারণ আমার ফ্রেন্ডলিস্টেই এমন লোকজন আছে যারা মনে করে যে দুর্নীতিটা ততটা খারাপ নয় কিন্তু রায়টা জঘন্য)। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন হচ্ছে।

'স্টাডিজ় ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স'-এ জ়াদ মাহমুদ এবং সোহম ভট্টাচার্য লিখিত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে- 'দ্য রুটস অফ আ পপুলিস্ট রেজিম: এগজ়ামিনিং দ্য তৃণমূল কংগ্রেস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল'। ওরা সেখানে নজর দিয়েছে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের যে প্রার্থীরা ভোটে দাঁড়ান, তাঁদের শ্রেণি ও পেশাগত পরিচিতির দিকে। এবং ওরা এটা দেখিয়েছে যে তাঁদের এই শ্রেণি এবং পেশা কী ভাবে রাজ্যের বাজেট ও নীতিকে প্রভাবিত করেছে।

প্রথমত, এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের কাছে ঘোষিত সম্পদের নিক্তিতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা সব থেকে ধনী। ২০২১ সালে তৃণমূল প্রার্থীদের গড় সম্পদ ২ কোটি ৮৫ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬১৪ টাকা। কিন্তু তার থেকেও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই সম্পদ বেড়েছে ৮.৮৫ শতাংশ হারে, কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এই বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ২০.১০ শতাংশ। এই প্রার্থীদের সঙ্গে জনসাধারণের গড় সম্পদের ফারাক কত? ২০১৮-১৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে মানুষের গড় সম্পদের পরিমাণ ৭ লক্ষ ৮৯ হাজার টাকা, আর শহরাঞ্চলে তার মান ১৯ লক্ষ ৬৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ, তৃণমূল প্রার্থীরা রাজ্যের বিত্তশালী মানুষজন। প্রশ্ন হল, এই বিত্তের উৎস কোন পেশা?

২০১১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ব্যবসায়িক শ্রেণির আধিপত্য বেড়েছে। বাম দলগুলি ছাড়া সব দলেই। তারই সঙ্গে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে তৃণমূলের প্রার্থী বিন্যাসে। চাকুরিজীবী শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব ক্রমশ কমেছে। তৃণমূল প্রার্থীদের মধ্যে ২০১১ সালের নির্বাচনে চাকুরিজীবী লোকজনের অনুপাত ছিল ৪৫.৭৪ শতাংশ, তা ২০১৬ সালে হয়েছে ৪১.৭৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালের নির্বাচনে ৩৪.৪৮ শতাংশ। এই ব্যবসায়ীরা কিন্তু বৃহৎ কর্পোরেট শিল্পপতি নন। এঁরা মূলত স্থানীয় পুঁজির মালিক, যাদের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার উপর। অর্থাৎ, রিসর্ট, ট্র‌্যাভেল এজেন্সি, খুচরো ও পাইকারি বাণিজ্য, চালকল, অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারি স্কুল এবং নার্সিং হোম। 
শাসক দলের এই শ্রেণিচরিত্রের প্রভাব পড়েছে তাদের বাজেট বরাদ্দেও। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাজ্য সরকারের যে মূলধনী ব্যয়, তার মাত্র ৬.২ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে শিল্পক্ষেত্রের জন্য, মাত্র ১০.৯ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রের জন্য। অথচ গ্রামোন্নয়ন এবং বিশেষ এলাকা উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হয়েছে ২১.৫ শতাংশ, পরিবহণ খাতে ২৬.৪ শতাংশ। ফলে শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমলেও বেড়েছে পাইকারি ও খুচরো ব্যবসা এবং রিয়েল এস্টেট, এই দু'টি ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার।  

বাম আমলে সরকারি চাকুরে, শিক্ষক এবং অধ্যাপকরা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আধিপত্যের কিছু যথার্থ সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই এই শ্রেণির সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় একটা 'স্টেক' ছিল। তখনও সে ভাবে বেসরকারি স্কুল-কলেজ তৈরি হয়নি, এবং হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশের পক্ষেই সেখানে ছেলেমেয়েদের পাঠানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু জ়াদ এবং সোহমের গবেষণায় যে শ্রেণিকে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে দেখা যাচ্ছে, সেই নয়া এলিটদের ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির বিশেষ সাযুজ্য নেই। ধনী হওয়ার সুবাদে তারা সহজেই বেসরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েকে পাঠাতে পারে, এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই সেই স্কুল-কলেজের মালিক।
তাদের ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য শিক্ষার গড় গুণমান খুব উন্নত হওয়ার প্রয়োজন, এমনও নয়। মনে রাখা দরকার, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাফে আড়াই লক্ষ কমে গিয়েছে। ক্রমশ ভালো স্কুলগুলো নিজেদের রাজ্য বোর্ড থেকে সরিয়ে নিচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সব ক্ষেত্রেই বোঝা যাবে, কিন্তু আপাতত স্থানীয় পুঁজির তেমন কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। 
আপাতদৃষ্টিতে ভোটেও এর প্রভাব পড়ে না। কারণ, বেসরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য যতই নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে, ততই বাড়বে 'রিলিফ'-এর প্রয়োজনীয়তা, অর্থাৎ নানা রকম অনুদানমূলক স্কিম, এবং যারা এই 'রিলিফ' জোগাচ্ছে, তাদের প্রতি সমর্থন। এই ঘটনা সারা ভারতেই দেখা যাচ্ছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের মতো তুলনামূলক ভাবে দরিদ্র রাজ্যে তা আরও প্রকট।
মোটের উপর ছবিটা এ রকমই। যা ঘটল, তা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।

রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৫

এক বিপ্লবীর সাথে আরেক বিপ্লবীর অসমাপ্ত কথপোকথন ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

ভগত সিং কে আজকের স্মরণ করার যে তাগিদ আছে সেটা বুঝতে গেলে একটু প্রেক্ষিত দরকার। তার পার্টির মতাদর্শ একটু জানা দরকার। পার্টির প্রথম দিকের একটি দলিল দিয়ে আলোচনা শুরু হতে পারে।

খুব পরিষ্কারভাবে ওই দলিল জানাচ্ছে যে, "রাজনীতির আঙিনায় বিপ্লবী পার্টির আশু লক্ষ হ'ল সংগঠিত ও সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এক 'ফেডারেল রিপাবলিক অফ ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইন্ডিয়া' গঠন করা। যখন ভারতের প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রূপায়ণ করার ক্ষমতা জন্মাবে তখনই কেবল ভারতের নতুন সংবিধান তৈরি ও ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এই প্রজাতন্ত্রের বুনিয়াদি ভিত্তি হবে সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং সেই সমস্ত ব্যবস্থার বিলোপ যা মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণকে সম্ভবপর করে যেমন রেলওয়ে ও যোগাযোগের অন্য মাধ্যমগুলি খনিসমূহ, ও বড় বড় শিল্প যেমন ইস্পাত কারখানা, জাহাজ কারখানা ইত্যাদির জাতীয়করণ করা হবে।" (সূত্রঃ ১)

সমাজতন্ত্রের নানান চেহারা এর আগে বা পরে ভারতবাসী দেখেছেন, শুনেছেন। এই দলিল প্রথমবার খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিল, ভারতের মাটিতে তা কেমন চেহারা নিতে পারে। সাম্প্রতিককালের বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণ এর এই জামানায় প্রাসঙ্গিক। 

স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্রের চেহারাটা কেমন হবে সেই প্রসঙ্গে কেবলমাত্র সার্বজনীন ভোটাধিকার নয়, দলিল আরো এক পা এগিয়ে বললো যে "ওই প্রজাতন্ত্রে নির্বাচকমন্ডলী তথা ভোটারদের পূর্ন অধিকার থাকবে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রিকল করার বা ফিরিয়ে আনার কারণ সেটা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র একটা তামাশায় পরিণত হবে।" (সূত্রঃ ১)

ততকালীন ভারতের মূলধারার অন্যান্য দলগুলি ও ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে হিংসা বনাম অহিংসার নীতিতে একটি সমালোচনা ছিল। সে সম্পর্কে জবাব দিতে গিয়ে ওই দলিল জানায় যে, "টেররিজম বা সন্ত্রাসবাদ এবং এনারকিজম বা নৈরাজ্যবাদ নিয়ে দু একটি কথা বলতে গেলে যা বলা যায় যে শব্দদুটি নিয়ে নষ্টামি চলছে। বিপ্লব প্রসঙ্গে কোনো কথা উঠলেই অবধারিত ভাবে শব্দদুটির অপপ্রয়োগ হচ্ছে কারণ ঐ দিয়ে বিপ্লবীদের বদনাম করা সুবিধাজনক।" (সূত্রঃ ১)

দলিল একেবারে দ্বিধাহীন ভাবে জানালো যে, "ভারতীয় বিপ্লবীরা  সন্ত্রাসবাদী নয়, নৈরাজ্যবাদীও নয়। তারা (অর্থাৎ হিন্দুস্তান রিপাবলিকানরা) দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে চলে না সেজন্য তাদের নৈরাজ্যবাদী বলা চলে না। সন্ত্রাসবাদও কোনোকালে তাদের লক্ষ্য নয় তাই তাদের সন্ত্রাসবাদীও আখ্যা দেওয়া যায় না। তারা কখনোই বিশ্বাস করে না যে সন্ত্রাসবাদ একাই কেবল স্বাধীনতা এনে দিতে পারে এবং স্রেফ সন্ত্রাসবাদের জন্যই সন্ত্রাসবাদ, এই নীতি চায় না যদিও প্রত্যাঘাত হানার জন্য মাঝে মধ্যে এই ফলদায়ক পদ্ধতি তাদের অবলম্বন করতে হয়।" (সূত্রঃ ১) 

তৎকালীন ভারতের আর পাঁচটা দল/গোষ্ঠী যারা সশস্ত্র সহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িত ছিল তাদের সাথে তফাৎটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায় হিন্দুস্তান রিপাবলিকানদের দলিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে নজর দিলেই। তা'হল, ইউরোপের প্রধানধারার বামপন্থীদলগুলির ঢঙে আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি গ্রহণ। দলিল বলছে, "বিপ্লবী পার্টি কেবলমাত্র জাতীয় নয়, প্রকৃতিগতভাবে আন্তর্জাতিক কারণ তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের বিবিধ স্বার্থ্যরক্ষার প্রতি সম্মান জানানোর মাধ্যমে বিশ্বে ঐকতান স্থাপন করা।" (সূত্রঃ ১)

ভগত সিংকে বোঝার জন্য, তিনি যে দলের সদস্য, সক্রিয় কর্মী ও নেতা ছিলেন সেই দলের মতাদর্শগত অবস্থান নিয়ে সামান্য আলোচনা করা হ'ল। এবার সরাসরি তাঁর কাজকর্মের দিকে চোখ ফেরানো যাক। তাঁর সক্রিয় বিপ্লবী কাজ যেমন বোমা নিক্ষেপ স্যান্ডার্স হত্যা ইত্যাদি বহুল প্রচারিত কাজকর্ম বাদ দিয়ে তাঁর অন্য দু একটি কম আলোচিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অবদান সামনে আসা প্রয়োজন।

যে সময়টা ভগত সিং সক্রিয় রাজনীতিতে আসছেন সেই সময়ে ভারতের নানান ঘটনার মধ্যে অন্যতম হ'ল সাম্প্রদায়িক হিংসা, দাঙ্গা। পার্টি দলিলে বিষয়টিকে এইভাবে রাখা হয়েছিল, "কমুনাল কোশ্চেন বিষয়ে বিপ্লবী পার্টি মনস্থির করেছে যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমস্ত  অধিকার মেনে নেওয়া হবে যেমনটা তারা দাবি জানাবে এই শর্ত সাপেক্ষে যে সেগুলি অন্য সম্প্রদায়ের স্বার্থের সাথে সংঘাত ঘটাবে না এবং শেষ পর্যন্ত অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে জীবন্ত জৈবিক এক মিলন ঘটাবে।" (সূত্রঃ ১)

পার্টি কর্মসূচির এই ধারাকে মাথায় রেখে আরো একধাপ এগিয়ে গেলেন ভগত সিং। পার্টি মুখপত্রে প্রবন্ধে লিখলেন, "আমরা যদি এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলির মূল শেকড় খুঁজতে যাই, দেখবো কারণ হ'ল অর্থনৈতিক। যে যাই করুক না কেন, পেট ভরানোর প্রশ্নটা সবকিছুরই তলদেশে থাকে। কার্ল মার্ক্স এর তিনটি প্রধান প্রবচনের মধ্যে এটি একটি। এই প্রবচনের জন্যই তগলিব, তানজিম, শুদ্ধি (হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক প্র্যাকটিস) জাতীয় অভ্যাস গুলি শুরু হয়েছে এবং যার ফলে আমরা এই নিদারুণ অবস্থায় পৌঁছেছি।" (সূত্রঃ ২)

একথা আমরা যদি মনে রাখি যে কার্ল মার্ক্স কে উদ্ধৃত করে প্রবন্ধ রচয়িতা এই তরুণ ভারতীয় বিপ্লবীর বয়েস তখন মাত্র ১৯ বছর, তাহলে আমাদের বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। তরুণ বিপ্লবী আরো লিখছেন, "জনগণকে একে অন্যের বিরুদ্ধে মারপিট করা থেকে বিরত থাকার জন্য জরুরি হ'ল শ্রেণী সচেতনতা। গরিব চাষি-মজুরদের একথা পরিষ্কারভাবে বোঝাতে হবে যে তাদের প্রকৃত শত্রু হ'ল পুঁজিপতিরা, যাতে তারা তাদের (পুঁজিপতিদের) পাতা ফাঁদে পা না দেয়। এটা আপনার স্বার্থ যে ধর্ম, বর্ণ, জাত পাত, জাতীয়তার নামে সবধরনের বিভেদ-বৈষম্য দূর হয় এবং রাষ্ট্রক্ষমতা আপনার হাতে আসে। এই সব প্রচেষ্টা কোনোভাবেই আপনার কোনো ক্ষতি করবে না বরঞ্চ একদিন আপনার শৃঙ্খল  ছিন্ন করবে, আপনাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দেবে " (সূত্রঃ ২)

ওপরের লেখা থেকে স্পষ্ট যে মার্ক্সবাদের প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই ওই তরুন বিপ্লবী হয়ে উঠছেন মার্ক্সবাদী। "মার্ক্সিস্ট ইন আ মেকিং"। তাই প্রায় একলব্যের ঢঙে প্রশিক্ষিত কেমন অনায়াসে ভারতের মাটিতে প্রয়োগ করলেন সেই বিশ্ববিক্ষার তত্ত্ব।

পরের আরেকটি প্রবন্ধে চোখ বলাবো আমরা। পিকরিক এসিড বা নাইট্রো গ্লিসারিনের বিভিন্ন উপাদান নিপুণভাবে মিশিয়ে ট্রেজারি বেঞ্চ এর দিকে ছুঁড়ে দেওয়ার অসীম সাহসী কাজের চেয়ে কোনো অংশে কম সাহসী নয় সেই ভারতের অবিসংবাদী নেতার হরিজন তত্ত্বের ওপর ছোঁড়া তার এই বোমা। তরুণ বিপ্লবী কলম ধরলেন ভারতের আরেকটি সমস্যা নিয়ে যেটি এতই একান্ত ভাবে ভারতীয় যে ধ্রুপদী মার্ক্সবাদী রচনা ঘেঁটেও এর সমাধান পাওয়া দুষ্কর। ভারতের জাতপাতের সমস্যা।

তরুণ বিপ্লবী লিখছেন, "কর্কশ সত্যি এটাই যে তোমরা (হিন্দুরা) তাদের (দলিতদের) সাথে গরুছাগলের চেয়েও খারাপ ব্যবহার করে থাকো, তারা তাই তোমাদের ত্যাগ করে অন্য ধর্মের আশ্রয় নেবে যেখানে তারা আশা করে যে একটু বেশি অধিকার উপভোগ করতে পারবে, সহ নাগরিকের মতো বাঁচতে পারবে।" (সূত্রঃ ৩)।

প্রকৃত শ্রেণী চেতনা সম্পন্ন বিপ্লবীর মতোই ভগত সিং দলিতদের নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করার আহ্বান জানালেন, "যারা মুক্ত হয়ে যাবেন, তারাই প্রথম আঘাতটা হানবেন।  মনে রাখতে হবে যে সুবিধাভোগী শ্রেণীর প্রত্যেকে নিজের নিজের অধিকারগুলিকে উপভোগ করার জন্য বাঁচিয়ে রাখতে চায়, দলিত শ্রেণীকে নিপীড়ন করে তাকে তার জুতোর তলায় চেপে রাখতে চায়। সেজন্য আর সময় নষ্ট করো না, নিজের পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ানোর জন্য একজোট হও আর সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করো। তারপরে দেখই না কে তোমাদের প্রাপ্য টুকু দিতে অস্বীকার করার মতো আস্পর্ধা দেখায়"। (সূত্রঃ ৩)

আর পাঁচজন নিছক আগুনখেকো নেতার মতো কথার ফুলঝুড়ি নয়, ভগত সিং এর মননশীলতার পরিচয় তার আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণী ক্ষমতায়। তিনি লিখলেন, " কারুর দয়ার ওপর নির্ভরশীল থেকো না, ওদের সম্বন্ধে কোনো মায়া যেন না থাকে। সতর্ক থাকো যাতে আমলাতন্ত্রের ফাঁদে পড়তে না হয় কারণ তোমার মিত্রপক্ষ হওয়াতো দূরের কথা ওরা ওদের সুরতালে তোমাকে নাচতে বাধ্য করবে। এই পুঁজিবাদী-আমলাতন্ত্রের গাঁটছড়া তোমার শোষণ-বঞ্চনার মূলে। সেজন্য ওদের পরিত্যাগ করো। তুমি হচ্ছ প্রকৃত খেটে-খাওয়া শ্রেণী, ওয়ার্কিং ক্লাস। শ্রমজীবিরা এক হও - শৃঙ্খল ছাড়া তোমাদের হারাবার কিছু নেই।" (সূত্রঃ ৩)
 
অতীব পরিচিত একটি আন্তর্জাতিক স্লোগানকে ভারতের মাটিতে ভারতীয় সমস্যার মোকাবিলায় ব্যবহার করছেন একজন বিপ্লবী যার বয়েস মাত্র কুড়ি তখন। তিনি ডাক দিচ্ছেন, "সামাজিক বিক্ষোভ-আন্দোলন থেকে বিপ্লব শুরু করুন আর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপ্লবের জন্য কোমড়বন্ধটা কষে আঁটুন। আপনারা, কেবল আপনারাই হলেন জাতির পিলার, স্তম্ভ, তার অন্তর্লীন শক্তি। ঘুমন্ত সিংহের দল জাগ্রত হন, বিদ্রোহের পতাকা ঊর্ধে তুলে ধরুন।" (সূত্রঃ ৩)
 
কেবল মুখপত্র প্রচার পুস্তিকায় মাস এপিল সম্পন্ন লেখা নয়, জেলের ভেতর থেকে কলম ধরছেন ফাঁসির আসামি এই বিপ্লবী। মর্ডান রিভিউ এর এডিটর যখন তাঁর বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে ন্যারেটিভ নামাচ্ছেন তখন ঝলসে উঠছে ২১ বছরের তরুণের কলম। প্রতিবাদ পত্রে লিখছেন, "আমরা ওই স্লোগানের (ইনকিলাব জিন্দাবাদ) উদ্গাতা নই।  ওই আওয়াজ রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনে উঠেছিল।  (সূত্রঃ ৪)

প্রিভিলেজড ক্লাসের প্রতিভূ ওই পোষা বুদ্ধিজীবীর মননশীলতার মুখোশ খুলে দিয়ে বিপ্লবী উদ্দিপনার মর্মস্পর্শী বয়ান আনছেন ভগত সিং, "এই ধরণের প্রতিটি চিৎকৃত ঘোষণার একটি সাধারণ বোধকে চিহ্নিত করে যার কিছুটা অর্জিত বাকিটা সহজাত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা যখন স্লোগান দিই "যতীন দাস অমর রহে" তখন তার মানে এই নয় বা আমরা বোঝাতে চাই না যে যতীন দাস শারীরিকভাবে জীবন্ত থাকবেন। তার মানে এই যে যতীন দাসের জীবনের মহান আদর্শ, তার সেই অদম্য প্রাণশক্তি যা তাকে অকথ্য যন্ত্রণা ও চূড়ান্ত আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে গিয়ে মহান শহীদ হতে সাহায্য করেছিল আমরা যেন সেই সাহস দেখাতে পারি আমাদের আদর্শের জন্য।" (সূত্রঃ ৪)

বহু বছর আগে যে সাবধানবানী রচিত হয়েছিল, তা আজও প্রাসঙ্গিক কি না সে বিচারের ভার পাঠক-পাঠিকার ওপরে, "প্রলেতারিয়েত এর আশা ভরসা এখন কেন্দ্রীভূত হয়েছে সমাজতন্ত্রের ওপরে কেবল যা পারে সমস্ত সামাজিক বৈষম্য মুছে এক স্বাধীন, সম্পুর্ন স্বাধীন ভারত স্থাপনা করতে।" (সূত্রঃ ৫)

ফাঁসির মঞ্চ থেকে দু'পা দূরে দাঁড়িয়েও একজন বিপ্লবীর ভুল হয় না আরেকজন বিপ্লবীকে চিনতে। ভগত সিং টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছেন, "আজ লেনিন দিবসে আমরা তাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি যারা মহান লেনিনের আরব্ধ কাজগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট। রাশিয়াতে যে মহান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, আমরা তার সাফল্য কামনা করছি। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী শ্রেণীর মুক্তি সংগ্রামের ধ্বনিতে আমরা আমাদের আওয়াজ মেলাচ্ছি। প্রলেটারিয়েতদের জয় অনিবার্য। পুঁজিবাদ পরাজিত হবে। সাম্রাজ্যবাদ খতম।" (সূত্রঃ ৬)

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর তাদের দেশীয় দোসররা ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছিল এই বিপ্লবীকে কারণ ওরা ভয় পেয়েছিল যে একে বাঁচিয়ে রাখলে ভারতে বিপ্লব হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। আমরা পেয়েও পাইনি আমাদের লেনিনকে। কে বলতে পারে, বেঁচে থাকলে হয়তো আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন একজন ভারতীয় যার নাম বিশ্বের মুক্তিকামী জনতা লেনিনের মতো একই রকম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন।  

এই লেখাটি শেষ করা যাক ভগত সিং এর পুস্তক প্রেম নিয়ে। উনি বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায় (১৯১৩-২১) প্রায় পঞ্চাশখানা, ও পরে কলেজের সময় প্রায় ২০০ খানা বই শেষ করেছিলেন। ৮ই এপ্রিল, ১৯২৯ থেকে ২৩শে মার্চ, ১৯৩১, কারাবাসের এই দিনগুলোতে তার পঠিত বইয়ের সংখ্যা আনুমানিক ৩০০ হবে।  মন্মথনাথ গুপ্তা তার স্মৃতিচারণে ভগত সিং এর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো স্মরণ করতে গিয়ে বলেছেন, "জল্লাদ রা যখন এসে ওনাকে বলে, এবার ফাঁসিকাঠে ওঠার সময় হয়ে গেছে, তখন ভগত সিং তার সেলে একটি বইয়ে তন্ময় হয়েছিলেন। ওদের বলেন, "একটু দাঁড়িয়ে যাও। দেখছো না, একজন বিপ্লবী আরেকজন বিপ্লবীর সাথে কথা বলছে।" [সূত্র ৭]

তার কথায় ব্রিটিশ জল্লাদ বাহিনী সত্যিই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ভগত সিং বইয়ের পাতাটা শেষ করে বইটা মুড়ে বন্ধ করে এগিয়ে যান ফাঁসিকাঠের দিকে, দৃপ্ত পায়ে। কী অদ্ভুত মানুষ !

যে বইটা ভগত সিং আর কোনদিনই শেষ করে যেতে পারেন নি সেই বইটার লেখিকার নাম ছিল ক্লারা জেটকিন। জার্মান প্রবাদপ্রতিম কম্যুনিস্ট নেত্রী। আর বইটার নাম ছিল, "রেমিনিসেন্সস অফ লেনিন", লেনিনের স্মৃতিচারণ। এক বিপ্লবীর সাথে আরেক বিপ্লবীর কথোপকথন অসমাপ্তই থেকে গেল চিরকালের মতো। 

আজ শহীদ দিবস। ভগত সিং অমর রহে। শহীদ ভগত সিং আমাদের অধরা স্বপ্নের ভারতীয় নায়ক। শহীদ তোমায় লাল সেলাম।

তথ্যসূত্রঃ 
(১) বিজয় কুমার (রামপ্রসাদ বিসমিল এর ছদ্মনাম) স্বাক্ষরিত দি রেভলিউশনারী নামের চার পাতার দলিল, সেন্ট্রাল কাউন্সিল, রিপাবলিক পার্টি, ১৯২৭

(২) ধর্মভর ফাসাদ তে উনহা দে ইলাজ (ধর্ম ভিত্তিক দাঙ্গা ও তার সমাধান), ভগত সিং, কীর্তি পত্রিকা, জুন, ১৯২৭ সংখ্যা

(৩) অচ্ছুৎ কা সওয়াল (অচ্ছুৎ বিষয়ক পরিপ্রশ্ন), কীর্তি পত্রিকা, জুন, ১৯২৮ সংখ্যা

(৪) মর্ডান রিভিউ এই সম্পাদককে লিখিত পত্র , ২৪শে ডিসেম্বর, ১৯২৯

(৫) হিন্দুস্তান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন এর ইশতেহার, ১৯২৯ এর লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে প্রচারিত

(৬) ২১শে জানুয়ারি, ১৯৩০ কোর্ট থেকে পাঠানো ভগত সিং এর টেলিগ্রাম, শহীদভগতসিং.অর্গ

(৭) বাইয়োগ্রাফি অফ ভগৎ সিং, এম এম জুনেজা, মর্ডান পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ১৩২

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

বন্ধু ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য


একটা চড়ুই  জল থৈথৈ বৃষ্টিদিনে ভেজে 
গাছগুলো সব সবুজ হল, নতুন সাজে সেজে।।
দুটো চড়ুই সকাল হলে উঠোন বারান্দায়
ঝগড়া করে ইচ্ছে হলে, দু একটা গান গায়।।
তিনটে চড়ুই বায়না করে ভর্তি হবে স্কুলে
পড়াশুনোর ধার ধারে না, সবকিছু যায় ভুলে।।
চারটে চড়ুই বিকেলবেলা ধানক্ষেতে রোদ্দুরে
ভীষণ তাড়া ফিরবে বাড়ি, অনেকটা পথ উড়ে।।
পাঁচটা চড়ুই গরমকালে খানিক ছায়ার খোঁজে
তেষ্টা পেলে জল দিও প্লিজ, সবাই কি আর বোঝে।।
ছটা চড়ুই গাছের ডালে নয়তো ধানের ক্ষেতে
বগল বাজায়, ডিগবাজি খায় মনের আনন্দেতে।।
সাতটা চড়ুই দোল খেত বেশ টেলিগ্রাফের তারে
হাজার হাজার জ্বলত জোনাক রাতের অন্ধকারে।।
আটটা চড়ুই দিগন্ত নীল দিচ্ছে ডানা মেলে
আমিও যেতাম তোদের সাথে একটু খবর পেলে।।
নটা চড়ুই এদিক ওদিক দেখেছ নিশ্চয়
ছোট্ট তো খুব কি আর বোঝে সবকিছুতেই ভয়।।
দশটা চড়ুই বন্ধু ছিল, ছুটির দুপুরবেলা
লুকোচুরি মেঘ রোদ্দুর সমস্তদিন খেলা।। 

আজ বিশ্ব চড়ুই দিবস।

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

শুয়োর ~ ডাঃ কৌস্তুভ রায়

যখন  নিজস্ব হার্লে-ডেভিডসন বাড়িতে এসেছিল তখনকার কয়েকটা কথা লিখলে বোধহয়  পাঠককুল নিশ্চয়ই বিরক্ত হবেন না। আপনারা অনেকেই জানেন, বা জানেন না, যে  হার্লে - ডেভিডসন মোটরসাইকেল আসতো মস্ত একটা পিচবোর্ডের বাক্স করে। তলায়  লোহার ফ্রেমে আটকানো মোটরসাইকেলটা থাকত, আর মস্ত পিচবোর্ডের বাক্সটা ওপরে  চাপানো থাকতো। তলার নাটবোল্টগুলো খুলে ফেললে বাক্সটা আলগা হয়ে যেত তখন দুজন  লোক ওটা ধরে তুলে বার করে নিলে মোটরসাইকেলটা দৃশ্যমান হতো। বাক্সের গায়ে  এটা সেটার সাথে একটা কথা লেখা থাকতো - ইয়োর হগ হ্যাজ অ্যারাইভড।

এবারে  আসি - হগ মানে কি? ইংরাজীতে হগ মানে হয় বুনো শুয়োর। অর্থাৎ গুগল  ট্রান্সস্লেটরের মত বাংলা করলে দাঁড়ায় - 'বাপধন, তোমার শুয়োর এসে গেছে।'  এখানে কিন্তু হগ মানে অন্য - হগ পুরো কথাটা হল - এইচ. এ. জি. মানে হার্লে  ওনারস্ গ্রুপ। অর্থাৎ আমি এখন থেকে হগ হলাম। যদিও আমার মাথায় এখনও ঢুকল না  যে গোটা গ্রুপটা কি করে একজনের বাড়িতে আসতে পারে। তা হবে বা, লিখেছে যখন -  আমেরিক্যানদের ব্যাপার স্যাপার, আদার ব্যাপারী অত জাহাজের খপর জিজ্ঞাসা  করতে নেই। কিন্তু ওটা লেখা থাকত। এটা শুনে আমার এক কাছের বন্ধু জিজ্ঞাসা  করেছিল - মানে তুই আলটিমেটলি শুযোর হলি। তখন ছিলাম রোগা ডিগডিগে, ছাতি বার  ইঞ্চি, পেট বার ইঞ্চি, কোমর বার ইঞ্চি, অর্থাৎ একদম বাচ্চা শুয়োর। এটা আরও  প্রমাণ হল যখন গোটা কলকাতা হার্লে ডেভিডসন শো রুম খুঁজেও আমার জন্য একটা  লেদার জ্যাকেট পাওয়া গেল না। অবশেষে সেটা আমেরিকা থেকে স্পেশাল করে আনাতে  হয়েছিল। এবং সাইজটা ছিল - আমেরিক্যান বাচ্চাদের বড় সাইজ।
সে যাই হোক  হার্লে নেবার পর দেখলাম আমি জাতে উঠেছি। অনেকেই যারা নাক সিঁটকে চলে যেত  আমি শেরপা কিংবা একটা পেট্রল অ্যামবাসাডার চালাই বলে, তারা গদগদ চিত্তে  আমাকে আজাদ হিন্দ ধাবায় অথবা হিন্দুস্থান হোটেলে গিয়ে বাইকার্স ব্রাদারহুডে  যোগ দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন - এমনকি আমি কোনোদিন লাদাখ যাইনি বলে  অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মনে করিয়ে দিলেন যে যেকোন বাইকারের জীবনে লাদাখ  রিটার্ণ ব্যাজ ঝোলানো নাকি অবশ্যকর্তব্য। এছাড়াও এপ্রান্ত ওপ্রান্ত থেকে  অনুষ্ঠানে ডাক আসতে লাগল। অনেক অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি পেছনের একটা চেয়ারে  গুটিসুটি মেরে বসে পড়ে লক্ষ্য করি যে - স্টেজে গিয়ে একজন আর একজনের থেকে  দেড় ইঞ্চি বড় হবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে এটাও  লক্ষ্য করলাম আমি দাদা বা ভাই থেকে স্যার - এ উন্নীত হযেছি। (অবশ্যই  ব্যতিক্রম আছে, থাকবেই) আমি আলটিমেটলি এটা বুঝলাম যে মানুষে মোটরসাইকেল  তৈরী করে না, মোটরসাইকেলে মানুষ থুড়ি "স্যার" ওরফে শুয়োর  তৈরী করে।

কিন্তু  কি হল? আদতে আমি একটা গেঁয়ো আখাম্বা ভূত, ওরফে বর্তমানে ছোট্ট, বাচ্চা  শুয়োর - তার পেডিগ্রী যাবে কোথায়? তাই আমি আমার মত করে বাইকার্স ব্রাদারহুড  বলতে যা বুঝেছি তা লিখতে বসলাম।

"অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে, পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে। 
জীর্ণ ফাটলধরা এককোণে তারি, অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী"
১৯৯৭  - ৯৮ সালের কথা হবে। উত্তরপ্রদেশের এক গ্রাম্য জায়গা ধরে এগোচ্ছি, ওখানকার  স্টেট হাইওয়ে, দুপাশে আমগাছের সারি, রাস্তায় ট্রাকের-বাসের-গাড়ির চাকায়  পিষ্ট হওয়া আম। গরমকাল, মে মাস, হু হু করে লু বইছে, মুখ গামছায় ঢাকা,  চম্বলের দস্যুর মতো মুখের চেহারা, এর আগে দু বার শেরপার ইঞ্জিন সিজ হয়ে  রাস্তায় গাড়ি বন্ধ হয়ে গেছিল, ঠান্ডা আর হতেই চায় না, তাও লাথিয়ে লাথিয়ে  ২০-৩০ মিনিট পর 'এস্টাট' করা গেছে। এখান থেকে নানশোনা আরও ৪৫ কিলোমিটার  ওখান থেকে রাতের আশ্রয় খেরিপুর বা খৈরীপুর আরও ৯০ কিলোমিটার। বিরক্ত  লাগছিল। ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটার দেখাচ্ছে স্পিডোমিটার, যাচ্ছি বোধহয় আরও কম।  গরমে বোধহয় ওটারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মোটরসাইকেলে কেউ বেড়াতে আসে?  যত্তসব......
হঠাৎ একটা কড় কড় আওয়াজ করে আবার গাড়িটা বন্ধ হয়ে গেল।  ধ্যাত্তেরী। আবার সিজার? না অন্য কিছু? যাই হোক একটু ছায়া দেখে দাঁড় করালাম  বাহনকে। পিচ রাস্তার উপড়ে থেবড়ে বসলাম, ব্যাথাওয়ালা পেছনে বেশ সেঁক দেবার  মতো আরাম লাগলো।
উপরে আমগাছ, দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত  মাঠ......দিগন্তবিস্তৃত বলতে একদম যা বোঝায় ঠিক তাই। একটু দূরে রাস্তার  থেকে শ-দুই ফুট দূরে একটা ঝোপ মতো, গোটা দুই বড় গাছ, একটা জায়গা থেকে ধোঁয়া  উঠছে।
গাড়িটাকে ঠেলে নিয়ে গেলাম। বড় রাস্তা থেকে একটু হাল্কা পায়ে চলা  দাগ চলে গেছে ঝোপের দিকে। আার মনে হল ধোঁয়া মানে লোক আছে বা ছিল বা  থাকবে....ইত্যাদি প্রভৃতি।
একটা হিরো পুক মোপেড দাঁড় করানো ঝোপটার কাছে,  তার উপরে কিছু সাদা কাপড় শুকোতে দেওয়া আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হল  রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা পশ্চিমবাংলার। হিসেব করলাম মনে মনে - পশ্চিমবাংলা  থেকে মোপেড নিয়ে কেউ এতদূর আসতেই পারে না। আমি প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দূরে  আছি কলকাতা থেকে। তার মানে কেউ এটাকে কিনে এনেছিল মল্লিকবাজার থেকে কিলোদরে  - তারপর একটু সারিয়ে-সুরিয়ে বোধহয় মাঠে আসে ক্ষেতি দেখতে। নম্বরটা বাহুল্য  হলেও রয়ে গেছে। যাই হোক চোরডাকাত না হলেই ভাল। তারপরেই মনে হল এই রে  খেয়েছে....নির্ঘাত কেউ প্রাতঃকৃত্য করতে ঢুকেছে এখানে আর  আমি....ইয়ে........
যাই হোক, একটু বসলাম মোপেডটার কাছে। একটু বাদে মনে  হল, প্রাতকৃত্য ভাল কথা...তাহলে ধোঁয়া থাকবে কেন? এই গরমে ধোঁয়া দিয়ে  মশামাছি তাড়িয়ে এই পান্ডববর্জিত জায়গায় কেউ ইয়ে করতে বসে না। যাই হোক আর  একটু এগিয়ে দেখলাম গামছা পরা একটি লোক একটা মেকশিফ্ট্ উনুন বানিয়ে একটু  চটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে কিছু বসিয়েছে। যাই হোক বললাম....."নমস্তে,  থোড়া পিনে কা পানি হোগা?" আমার খাবার জলও তলানিতে তখন।
লোকটি বিনা বাক্যব্যয়ে একটা বোতল এগিয়ে দিল, ঘোলাটে জল, তাই সই। নেই মামার থেকে কানা মামা ভাল - কানা মামি আরও ভাল।
লোকটি ঠেঁটো হিন্দিতে বলল - "বৈঠিয়ে জারা, হাম থোড়া পিনে কা পানি লে আইই।"
খাণিকক্ষণ  বাদে ফিরে এসে পরিষ্কার বাংলা শুনলাম কানের কাছে...."কোথা থেকে আসা হচ্ছে  বাবুমশায়ের" শুনেই সাংঘাতিক শক খেলাম একটা ....বুঝলাম রেজিস্ট্রিশন নম্বরটা  যথার্থ পশ্চিমবঙ্গের, এবং মালিক ওটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কোথাও।  কোনওরকমে বললাম "আপনি বাঙালী?" এবারে উত্তর এল - "না দাদা"। সন্দেহের চোখে  তাকালাম - নির্ভুল বাংলা উচ্চারণ, কোথাও কোন টান নেই। আবার কানে এল "এ  বাংলার শরীর নয়, তবে বাংলায় অনেকদিন ছিলাম। আপার গাড়ির চেহারা আর নম্বর  দেখে বুঝলাম আপনি বাঙালী, তাই বাঙলায় কথা বললাম। তা চললেন কোথায় আর  দাঁড়ালেনই বা কেন? এইসব জায়গায় তো কেউ দাঁড়ায় না।"
বললাম "গাড়ি খারাপ  হয়েছে.....মিস্ত্রি ডাকতে হবে না হয়তো, সাথেই যন্ত্রপাতি স্পেয়ার সব আছে।  একটু গাড়িটা ঠান্ডা হলে দেখে নিয়ে সারাব।"
খানিকক্ষণ আবার কোন কথা  নেই....গুণগুণ করে গান করতে করতে ভদ্রলোক ভাতে ফুঁ দিতে লাগলেন। অসাধারণ  গানের গলা - সম্ভবতঃ কোন ভজন হবে। একটু বাদে গুণগুণ থামিয়ে বললেন "স্কুলে  যা পড়েছিলাম তার সাথে তখন একাত্ম হতে পারি নি এখন তার মানে বুঝছি।"
উনি  হয়ত কিছু বুঝেছিলেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি কিছুই বুঝলাম  না....একমনে গাড়িটা কি করে ঠিক করব তাই ভাবতে লাগলাম। বেলা পড়ে আসতে লাগল,  আমগাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যদেব পশ্চিমদিকে চললেন। রান্তা দিয়ে হুশ হুশ করে চলে  যাওয়া মাঝে মাঝে কোন গাড়ি ছাড়া পিনড্রপ সাইলেন্স। কান মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল।
একটু বাদে ডাক এল....."দাদা, দুটো প্রসাদ মুখে দিয়ে নিন, নুন নেই, রাগ করবেন না। আজকে ওপরওয়ালা এইরকমই মাপিয়েছেন।"
দেখি  একটা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ছবি। বিবর্ণ হয়ে গেছে। তার সামনে একটা ছোট থালাতে  করে একটু ভাত আর শাক। পাশেই বোতলে ঠাকুরের খাবার জন্য সেই ঘোলা জল।
খুব কুণ্ঠিত হয়ে বললাম আরে না না আপনি খান ....আমি যা হোক করে চালিয়ে নেব।
হাসলেন,  বললেন "কে কাকে খাওয়ায় ভাই.....আপনি এসে গেলেন, একটু না হয় আনন্দ করেই  দুভাইয়ে খেলাম। আনন্দটাকে কেন বিসর্জন দেন দাদা?" আর কথা বাড়ানো গেল না।
খেতে  বসলাম - দুটো তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের থালা, তাতে একটু করে ভাত, আর কোন  শাকসেদ্ধ, তাতে আবার একটু সয়াবিনের বড়ি ফেলা। ভাতের যা পরিমাণ তাতে কারোরই  পেট ভরার কথা নয়। স্বাভাবিক....আমি একজনের কষ্টার্জিত খাবারে ভাগ বসিয়েছি।
খাওয়া  শেষ হবার পরে পেছনে একটা ডোবাতে গিয়ে আঁচিয়েও আসা হোল। এবারে গাড়ি খুলে  আমি খুটখাট করতে লাগলাম আর উনি চিৎপটাং হয়ে শুয়ে ঘুমাতে লাগলেন। নাক ডাকার  শব্দ আসতে লাগল। আমার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে গাড়ি পারাবত থেকে পর্বত হয়ে গোঁ  ধরে বসতে লাগল। নট নড়নচড়ন।
যখন রোগ আবিষ্কার করা গেল তখন বেলা শেষ,  দিনের আলোয় রোগের উপশমের কাজটা করতে পারলেও গাড়ি ফিট করে খেরিপুর যাওয়া  প্রায় কেন, একদমই অসম্ভব।
ভদ্রলোক জেগে উঠে বললেন "রাতে কি বানাবো  বাবাজী?" আটা আছে সাথে....।" যেন বাড়ির লোকের গলা শুনছি - "আজ রাতে কি  খাওয়া হবে?" আঁৎকে উঠে বললাম "রাতটা কি এখানে কাটাবেন?" ভদ্রলোকের গলায় কোন  তাপ উত্তাপ পাওয়া গেল না, বললেন "তা নয়তো কি? আপনাকে ফেলে রেখে আমি চলে  যাব? সেটি হবে না বাবাজী"
রাত নামল, কোটি কোটি তারার মেলা, হাওয়া দিতে  লাগল, একটু ঠান্ডা হল চরাচর, ভদ্রলোক সুমধুর গলায় গাইতে লাগলেন "খন্ডন ভব  বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়......" আমি চুপ করে বসে বসে শুনতে লাগলাম। নিশা  ঘন হতে লাগল, আবার গান শুরু হল - "তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি  ধাই...." গান শেষ হলে বললেন...ছোটবেলায় রামকৃষ্ণ মিশনে পড়েছিলাম, পরে  শান্তিনিকেতনে।"
শুধু এটুকুই জানতে পেরেছিলাম ওনার সম্পর্কে....নামটাও  জানি নি, জানার মতো কৌতুহল-ও হয় নি। ফোন নম্বর তখন ভারতবর্ষে সুলভ ছিল না,  উনি পরিব্রাজক, কোন ঠিকানাও নেই....খালি মনে হচ্ছিল বেশি কথা বলে কি হবে?  আমি তো কিছুই জানি না।
রাত্রে মোটামোটা হাতে চাপা পোড়া রুটি প্রসাদ পেয়েছিলাম। তারপর চাদর বিছিয়ে মহাকাশের তলায় ঘুম।
পরের  দিনের ঘটনা সংক্ষিপ্ত - আমার গাড়ি ঠিক হয়ে যাবার পর সব গুছিয়ে নিয়ে দুজন  দুদিকে যাত্রা করলাম। যতদূর মনে আছে উনি যাচ্ছিলেন বারাণসীর দিকে। জড়িয়ে  ধরে বলেছিলেন, "দ্যাখো দেখি প্রেমময় ঠাকুরের কীর্তি, সব জায়গায় সঙ্গী  পাঠিয়ে দেন। পরে কোথাও আবার ঠিক দেখা হয়ে যাবে বাবাজী, অথবা যদি শরীর চলে  যায় আর হবে না"। বলে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে  লাগলাম .....সামান্য সংসার নিয়ে পঞ্চাশ সিসির হিরো পুক চলেছে দিগন্তের  দিকে। সাদা কাপড় দিগন্তে মিলিয়ে গেল ঝাপসা হয়ে চোখের জলের সাথে।
আজও অবধি আর দেখা হয় নি।

এরপর  যখন শুনি বাইকার্স ব্রাদারহুড জিন্দাবাদ - আজাদ হিন্দ ধাবায় গিয়ে, তখন  বুঝি আমি খরচার খাতায়......। এটা পড়ার পর আমি খুব শিওর অনেক "বাইকার" এর  মনের কথা হবে.....

হতচ্ছাড়া শুয়োর - তোমাকে আর লাদাখ যেতে হবে না, তুমি গোল্লায় অথবা জাহান্নম যেখানে খুশি যাও।