মঙ্গলবার, ১৮ জুন, ২০১৯

আন্দোলনের চাওয়া-পাওয়া : চিকিৎসক-সংবাদমাধ্যম দ্বৈরথ ~ বিষাণ বসু

গতকাল কারা জিতলেন, আর কারা হারলেন, সেই বিচার করা মুশকিল। কিন্তু, যে লড়াইটা চিকিৎসক বনাম প্রশাসন ছিল, যে লড়াইটা একইসাথে চিকিৎসাপ্রার্থীরও হওয়ার কথা ছিল, প্রশাসনের বিরুদ্ধে - সেই লড়াইটা ঘুরে যাচ্ছিল চিকিৎসক বনাম রোগীপরিজন তথা আমজনতায়। আপাতত, তা হতে পারল না।

বৃহস্পতিবার যে মুখ্যমন্ত্রী চূড়ান্ত তাচ্ছিল্য ও বিরক্তির সুরে কথা বলেছিলেন, তাঁরই সুর বদলে গেল সোমবার। আন্দোলনকারীদের পক্ষে এ এক বড় জয়। আবার, প্রয়োজনমত, এবং জরুরী পরিস্থিতিতে, যিনি নমনীয়তা দেখাতে পারেন, তাঁর, অর্থাৎ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ম্যাচিওরিটিও প্রশংসনীয়। সেক্ষেত্রে, একপাক্ষিক জয়ের প্রশ্ন নেই।

জুনিয়র ডাক্তারেরা নিজেদের দাবীদাওয়া তুলে ধরেছেন। সেজন্যে তাঁদেরকে টুপি খুলে কুর্নিশ।  আবার অনেক কিছু তুলে ধরতে পারেন নি। নিরাপত্তার প্রশ্নটি গুরুত্ব পেয়েছে, কিন্তু ঠিক কোন পথে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আসতে পারে, সেটি আলোচনায় আসে নি। পরিকাঠামোর উন্নতি, পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ - এসব না হলে জুনিয়র ডাক্তারদের অমানুষিক চাপ নিয়েই কাজ করে চলতে হবে, চাপের মধ্যে তাঁরা ধৈর্য হারাতেই থাকবেন, মৃত রোগীর পরিজনের পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার সময়-সুযোগ বা মানসিকতা কোনোটাই থাকবে না। অন্যদিকে পরিকাঠামোহীন পরিস্থিতিতে ঘনিষ্ঠজনের মৃত্যু হলে, পরিজন ক্ষুব্ধ হবেন - এবং ভাববেন, অমুক ডাক্তার দৌড়ে এলেই রোগীর প্রাণ বাঁচত।

দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের প্রশ্ন না ওঠায় মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে দাবীদাওয়াগুলো মেনে নিতে অসুবিধে হয়নি। কোলাপ্সেবেল গেট লাগানো বা পাব্লিক রিলেশন্স অফিসার - কোনোটাতেই প্রশাসনের আপত্তি থাকার কথা নয়। অর্থাৎ, আমাদের এখানে সবই ছিল, শুধু বোঝানোর অসুবিধে - এই বার্তা দেওয়া গেলে প্রশাসন খুশীই হতে পারেন। একটু-আধটু অভিযোগ থাকলে, আসতে পারবেন গ্রীভান্স সেলে। তিনটি ভাষায় জ্বলজ্বল করবে সেই অভিযোগ জানানোর কাউন্টার।

চিকিৎসার খরচ নিয়ে আলোচনা হলেই, অনেকেই বলেন, এত ভাঙচুর সরকারি হাসপাতালে - যেখানে সবই মেলে বিনামূল্যে - অর্থাৎ, চিকিৎসার খরচ মানুষ মেনেই নেন, কিন্তু চিকিৎসা না পেলে ক্ষোভ হবেই, সেইখানে খরচের প্রশ্ন ওঠে না। এইখানে কিছুটা অতিসরলীকরণ আছে। 

চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে সুস্পষ্ট শ্রেণীবিভাজন, তা দুদশক আগেও তেমনভাবে ছিল না। মোটামুটিভাবে, মধ্যবিত্ত বা তার উপরের শ্রেণীর জন্যে বেসরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান - এর নীচে থাকলে সরকারি। হিসেব খুব সরল। এইখানে, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে, এবং সেখানে চিকিৎসা পেতে যাঁরা আসেন, তাঁদেরকে সেকেন্ড ক্লাস হিসেবে ভাবার খেলা আছে। দুর্বল পরিকাঠামোর সুবাদে স্বজন-হারানো পরিজনের মধ্যে একটা বাড়তি হতাশা রয়ে যায় - যদি টাকার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এমনভাবে….. 

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর নেক্সট-ইন-কম্যান্ড ভাইপো বা তাঁদের মেজসেজ নেতারা - চিকিৎসা করাতে কেউই সরকারি পরিকাঠামোর মুখাপেক্ষী নন। সরকারি পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্যে, বেশী কিছু নয়, স্রেফ একটি নিয়মই যথেষ্ট - সরকারী আধিকারিক ও নেতানেত্রী, এঁদের চিকিৎসা, বাধ্যতামূলকভাবেই, হতে হবে সরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানে।       

সরকার স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করেন যৎসামান্য - যেটুকু করেন, তারও বড় অংশ সাইফনিং হয়ে যেতে চলেছে বীমাব্যবসায়ী ও বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের হাতে - সে প্রকল্পের নাম স্বাস্থ্যসাথী বা আয়ুষ্মান ভারত যা-ই হোক না কেন। এর পর পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রশ্নটি আরো দূরে সরে যাবে।

গতকালকের আলোচনায় এইসব প্রসঙ্গ ওঠেনি। জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে এই ম্যাচিওরিটি বা সমস্যার মূলে পৌঁছে যাওয়া সবসময় সম্ভব নয়। সেই পরিণতিবোধ তো অভিজ্ঞতার সাথে আসে। তবু, মুখ্যমন্ত্রীর খাসতালুকে ঝানু আমলা-পুলিশ শীর্ষকর্তাদের সামনে বসে, অবচেতনে মিডিয়ার ক্যামেরা - এই অ্যাওয়ে ম্যাচে তাঁদের পারফর্ম্যান্স প্রশংসনীয়।      

অন্তত আরো একটি ক্ষেত্রে জুনিয়র ভাইবোনেদের এই ম্যাচিওরিটির অভাব স্পষ্ট। চিকিৎসক-প্রশাসনের এই দ্বৈরথ - অন্তত আংশিকভাবে চিকিৎসক-সাংবাদিকের দ্বৈরথে পর্যবসিত হচ্ছে। আন্দোলন চলাকালীন জুনিয়র ডাক্তারদের এক বড় অংশ সাংবাদিকদের সাথে বিবাদে জড়িয়েছেন। গতকালকের পর, বেশ কিছু সাংবাদিক, সোশ্যাল মিডিয়ায় গায়ের ঝাল উগড়ে দিচ্ছেন - চিকিৎসকেরাও ছেড়ে কথা বলছেন না।

এই পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনক। কেননা, সংবাদমাধ্যমের  অন্তত একাংশ পাশে না থাকলে এই আন্দোলন সমাজের একটা বড় অংশকে যেভাবে পাশে পেয়েছে, তা সম্ভব হত না - শুক্রবারের মিছিল মহামিছিলে পরিণত হওয়া বা মুখ্যমন্ত্রীর সুর নরম, কোনোটাই এমনভাবে হতে পারত না। ইলেকট্রনিক মিডিয়াশাসিত এই সময়ে, যেকোনো আন্দোলনেই মিডিয়ার সদর্থক সহযোগিতা জরুরী। পরবর্তীকালেও, আর কিছু নয়, স্রেফ নিরাপত্তার কথা ভাবলেও, মিডিয়ার সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

যেকোনো ঘটনার প্রেক্ষিতেই, শাশ্বত নিরপেক্ষ সত্য বলে তো কিছু হয় না। রোগী মারা গেলে পরিজন ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হন। তাঁর মনে হয়, চিকিৎসক যদি আরেকটু চেষ্টা করতেন, যদি দৌড়ে আসতেন। চিকিৎসক হয়ত জানেন - সম্ভবত নির্ভুলভাবেই জানেন - এই রোগীকে এই পরিকাঠামোয় বাঁচানো সম্ভব ছিল না। মিডিয়া ঠিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কথাটা জানাবেন, সেইটা তাঁর স্বাধীনতা। সেকথা চিকিৎসকের পছন্দ না-ই হতে পারে, কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক অধিকার মেনে নিতেই হয়। এর মধ্যে কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতার প্রশ্ন আসে না।

দ্বিতীয়ত, সংবাদ পরিবেশক বা মাঠেঘাটে খবর সংগ্রহ করা সাংবাদিক, দুজনেই বেতনভুক কর্মচারী মাত্র। মালিকের, এমনকি মুখ্য সম্পাদকের তুল্য স্বাধীনতা তাঁদের কারোরই নেই। ঠিক যেমনভাবে, সিনিয়র ডাক্তারের ভাবনার অনুসারেই চিকিৎসা হয়, যেখানে সেই চিকিৎসা অপছন্দ হলেও জুনিয়র ডাক্তারবাবুকে সিনিয়রের চিকিৎসাভাবনাই কার্যকরী করতে হয় (এমার্জেন্সি পরিস্থিতির প্রশ্ন আলাদা) - সাংবাদিকের ক্ষেত্রেই তা-ই।

তৃতীয়ত, অন্তত দুতিনজন সাংবাদিককে চিনি, যাঁদের মেধা ও পড়াশোনার ব্যাপ্তি আমাকে নিয়ত ঈর্ষান্বিত করে। কাজেই, স্রেফ জয়েন্টে চান্স পান নি বলেই এইসব ফ্রাস্টু পাব্লিক ডাক্তারদের পেছনে কাঠি করছে - এবম্বিধ উন্নাসিকতা হাস্যকর।    

প্লাস, এইটুকু মাথায় রাখতে হবে, অসামরিক পেশার মধ্যে বিশ্বে সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা স্বীকৃত। যেকোনো উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতেই সাংবাদিকেরা মারধর খেয়ে থাকেন - খিস্তিহীন দিন, সম্ভবত, ছুটিছাটা বাদ দিলে, দেখেনই না। এরাজ্যের চিকিৎসকরা অন্তত এই পরিস্থিতির সাথে নিজেদের রিলেট করতে পারবেন। এই অবস্থায়, দুপক্ষের মধ্যে বিবাদ নয়, সহমর্মিতার বোধই প্রত্যাশিত।    

অন্যদিকে, যেসব সাংবাদিক বন্ধুরা, গতকালকের জুনিয়র ডাক্তারদের নম্রসুরে কথা বলাকে নিয়ে খিল্লি করছেন, শ্লেষাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছেন, এমনকি গালিও পাড়ছেন, তাঁদেরকে শুধু একটিই কথা বলার রইল।

অন্তত এই রাজ্যে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, রাজনীতির নেতাদের যেটুকু ইন্টারভিউ সম্প্রচারিত হতে দেখি, সেখানে সাক্ষাতকার যিনি নিচ্ছেন, তাঁকে গদগদ বাদ দিয়ে অন্য কোনো বিশেষণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বিবিসির হার্ড টক তো ছেড়েই দিন, করণ থাপারের ঢঙে ইন্টারভিউ করার কথা এই রাজ্যে কেউ কল্পনা করতে পারেন?? মুখ্যমন্ত্রীর কথা বাদই দিন, এমনকি মেজসেজ নেতাদের সাক্ষাৎকার নিতে গেলেও?

গতকাল কিন্তু এক জুনিয়র ডাক্তার বলতে পেরেছে, উইথ ডিউ রেসপেক্ট, ম্যাডাম, আমরা কিন্তু সারনেম দেখে চিকিৎসা করি না।

আপনারা পারবেন? পেরেছেন? উইথ ডিউ রেসপেক্ট-ই প্রশ্নটা করলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন