শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৮

জাস্টিস ফর আসিফা ~ আশীষ দাস

আমেরিকায় গত কয়েক বছর ধরে একটা আন্দোলন হয়েছিল, "ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার" বলে। একটু খোঁজখবর রাখা লোকমাত্রেই জানবেন আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষ এখনো বেশ ভালই রয়েছে। বিশেষত পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের হেনস্থা হবার ঘটনা আকছার হয়। সামান্য ট্রাফিক ভায়োলেশন যেখানে শ্বেতাঙ্গদের সতর্ক করে বা সামান্য জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয় সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রেপ্তার করা, কৃষ্ণাঙ্গ কেউ দামী গাড়িতে গেলে চোর সন্দেহে তার কাগজপত্র চেক করা এসব তো রয়েইছে, ২০১৩ সালে এক কৃষ্ণাঙ্গ নাবালকের পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর আন্দোলনের তীব্রতা আরো বাড়ে। এবার এই আন্দোলনের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় #ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার বলে একটি ট্রেন্ড চালু হয়। কিছু রাইট উইঙ্গ, মূলত শ্বেতাঙ্গ, এই সময়ে একটি অন্য হ্যাশট্যাগ চালু করে। সেটি ছিল #অললাইভসম্যাটার। আপাত দৃষ্টিতে খুব সত্যি কথা। সবার জীবনেরই দাম আছে। কিন্তু ভেবে দেখুন যেখানে অত্যাচারের শিকার হচ্ছে মূলত কৃষ্ণাঙ্গরা, আন্দোলনটাই সেইজন্য, সেখানে এরকম ভাবে জেনারালাইজ করার কারণ কী? সকল মানবের জীবনের প্রতি ভালবাসা? না এই যে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি পার্টিকুলার অবিচার, সেটাকে লঘু করে দেখানো? একটি নির্দিষ্ট অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে পৃথিবীর সকল অবিচার দিয়ে ঢেকে দেওয়া কি উদ্দেশ্যপ্রাণোদিত নয়? আপনি চাইলে অন্য অবিচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামুন, নামতেই পারেন। কিন্তু ঘরে বসে থেকে যারা একটা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়ছে তাদের আন্দোলনটাকে লঘু করে দিলে আমি বুঝবো আপনি আসলে অবিচারকারীর হাতই শক্ত করছেন।

***

এই একই জিনিস দেখা যাচ্ছে আসিফার ঘটনাটি নিয়ে। এটি রেপ, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত করার জন্য ঘটানো পরিকল্পিত রেপ। আপনি এখানে অল রেপিস্ট শুড বি পানিশড বলে সেই কাজটাই করছেন যেটা মডারেট হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টরা করেছিল ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সময়। অবশ্যই অল রেপিস্ট শুড বি পানিশড, আপনি প্রতিটা রেপের পর প্রতিবাদ করুন না। কিন্তু এই রেপটির যে ধর্মীয়-রাজনৈতিক চরিত্র সেটিকে মুছে দেওয়াই যদি আপনার "অল রেপিস্ট শুড বি পানিশড" বলার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আপনিও এক্ষেত্রে সেই মৌলবাদী বর্বরগুলোর হাতই শক্ত করছেন। মনে রাখবেন ধর্ষকের ধর্ম হয়না, কিন্তু ভারতে রাজনীতির ধর্ম হয়। আর এই ধর্ষণটি একটি রাজনৈতিক ধর্ষণ, তাই এখানে ধর্ম নেই হলে এড়িয়ে গেলে হবেনা। যেমন আমেরিকায় সেই কৃষ্ণাঙ্গ নাবালকের হত্যাটি শুধুই পুলিশি গাফিলতি বলে রেসিজমকে এড়িয়ে গেলে সেটা সত্যগোপনই হবে।
আখলাক, পেহলু খান, আফরাজুল হয়ে আসিফা - এটা একটা প্যাটার্ন। এগুলোর বিরুদ্ধে বিশেষ ভাবে সরব হবার কারণ এগুলো র‍্যাণ্ডম অপরাধ নয়, একটা পার্টিকুলার কমিউনিটিকে অপ্রেস করার, ভয় দেখানোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।

***

এবার আরেকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। আমি কোনভাবেই রেপিস্টকে প্রকাশ্যে থেঁতলে মারা, পুরুষাঙ্গ কেটে লঙ্কা ডলে দেওয়া এসব সমর্থন করিনা। পার্সোনালি আমি ক্যাপিটাল পানিশমেন্টেরও বিরোধী, তবে ভারতে যেহেতু এখন তা চালু আছে তাই সেটা হলে আপত্তি অন্তত করবোনা। ভারতের সংবিধান অনুযায়ীই এই রেপিস্টদেরও বিচার এবং সাজা হওয়া উচিত। বড়জোর ফাস্টট্র‍্যাক কোর্ট বসানো যায় যত শীঘ্র সম্ভব সাজা সুনিশ্চিত করতে। যদি আপনি বলেন "নিজের মা বোনের সাথে হলে কী করতে?" তাহলে আমার উত্তর হবে আমি খুন করে ফেলতে চাইতাম রেপিস্টকে। আর ঠিক এই কারণেই আমার হাতে শাস্তির ভার দেওয়া নেই। কারণ আমি সেই কাজটা করলে সেটা বিচার হত না, প্রতিহিংসা হত। ট্যারান্টিনোর হেটফুল এইট সিনেমায় একটা ডায়লগ আছে। "আ জাস্টিস সার্ভড উইদাউট ডিসপ্যাশন ইস নো জাস্টিস অ্যাট অল" (এক্স্যাক্ট কোট মনে নেই, এরকমই খানিকটা)। অর্থাৎ বিচার এবং শাস্তি তারই দেওয়া উচিত যার মনে আসামীর সম্পর্কে কোন আবেগ নেই। সেই বিচার আসামীর বন্ধু করলে যেমন অবিচার হবার সম্ভাবনা তেমনই আসামীর সম্পর্কে মনে ঘৃণা পোষণকারী করলেও। তাই ধর্ষিতার বাড়ির লোক ধর্ষককে সর্বসমক্ষে থেঁতলে মেরে ফেললে সেটা বিচার না, প্রতিহিংসা। আর প্রতিহিংসাকে বিচারের নামে চালালে কবে যে প্রতি উড়ে গিয়ে শুধু হিংসাকেও বিচার বলে চালানোর চেষ্টা হবে, সেটা নির্ণয় করা অসম্ভব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন