শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৭

দেশপ্রেম ~ সুশোভন পাত্র

দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভাব-অভিযোগ নির্বাচনী ভাষণে ভালো করে মিশিয়ে নিন। মিশ্রণে প্রতিশ্রুতি'র পাহাড় গুলে, 'আচ্ছে দিনের' বিজ্ঞাপনে ১০ মিনিট ম্যারিনেট করে রাখুন। এই ফাঁকে জনগণের ক্ষোভের আগুনে পিৎজা স্টোন সহ ওভেন ৪৫০ ডিগ্রিতে প্রি-হিট করুন। মিশ্রণ ফুলে ফেঁপে উঠলে; জে.এন.ইউ'র ভিডিও দিয়ে পুরু করে বেলে ফ্ল্যাটব্রেড বানিয়ে ফেলুন। ফ্ল্যাটব্রেডের উপর ৫৬ ইঞ্চি পুরু সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রলেপ লাগিয়ে, পাকিস্তানের সঙ্গে তু-তু-ম্যা-মা'র বার্বিকিউ আর মিডিয়ার টক শো'র হম্বিতম্বি কুচিকুচি করে সাজিয়ে, কাশ্মীরের পেলেট গান আর মোজোরেলা চিজ ছড়িয়ে, জাতীয় পতাকা'র টপিংস দিন। শেষে জাতীয় সঙ্গীত চালিয়ে, ওভেনের পাশে ঠাই দাঁড়িয়ে, ২০ মিনিট বেক করুন। সবদিকে সমান বেক হলে 'চিজ বেসড দেশপ্রেম পিৎজা'য় পরিবারের সব্বাই ভক্তিভরে পেটপূজা করুন। এবার ডিনার শেষে, বিছানায় রতি ক্রিয়া সেরে, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান। কারণ সীমান্তে জওয়ানরা আপনার নিরাপদ ঘুম নিশ্চিত করতেই তো দাঁড়িয়ে আছেন। এখন দুঃস্বপ্নে যদি দেখেন আপনার পিৎজা-পাৎসা'র জীবনে, আমার যুদ্ধ-যুদ্ধ ফ্যান্টাসিজমে আর আমাদের বর্ডার সিনেমা দেখে বগল বাজানোর অভ্যাসের আড়ালে জওয়ানরা আধপেটা খেয়েই দাঁড়িয়ে আছেন; খবরদার 'দেশদ্রোহীর' মত দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকারের দিকে আঙুল তুলে বসবেন না যেন। বরং হালকা পাশ ফিরে, নরম বালিশে মাথা রেখে, আবার ঘুমনোর চেষ্টা করুন। কারণ 'দেশপ্রেম' এই সরকারের পৈতৃক সম্পত্তি। জওয়ান'দের ভাবাবেগ লেপা জাতীয়তাবাদের ব্যবসা করা এই সরকারের পুরনো অভ্যাস।
তেজ বাহাদুর জওয়ান'দের ক্ষুধার্ত এবং আধপেটা রাত্রি কাটানোর অভিযোগ এনেছেন ¹। 'হুইসেলব্লোয়ার' কে শায়েস্তা করতে, তাঁর 'বেয়াড়া অতীতের' পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বি.এস.এফ প্রধান, তেজ বাহাদুর কে তৎক্ষণাৎ বদলি করে দিয়েছেন ² । স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়মমাফিক তদন্তের ঘোষণা করেছে ³ । আর প্রধানমন্ত্রী'র দপ্তর ডাস্টবিনের শোভা বর্ধনের জন্য সেই তদন্তের রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে ⁴ । ঠিক যেমন ২০১৬'র জুলাইয়ে ডাস্টবিনের শোভা বর্ধন করেছিল ক্যাগের সেই রিপোর্ট, যে রিপোর্টে বলা হয়েছিল ইন্ডিয়ান আর্মি জওয়ানদের খাবারে পর্যাপ্ত সবজি ও ফল সরবরাহ করছে না, বলা হয়েছিল ৬৮% জওয়ানই খাবারে গুনগত মান সম্পর্কে 'অসন্তুষ্ট', বলা হয়েছিল বাৎসরিক ১,৪৪০ কোটির আর্মি রেশনের গুণমানে 'অত্যন্ত নিম্ন' এবং আনা হয়েছিল ২২ কোটির আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ  ⁵ ⁶ । অবশ্য আর্মি তে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছিল ২০০৪'ও যখন লেফটেনেন্ট জেনারেল সাহনির'র বিরুদ্ধে সিয়াচেনের জওয়ান'দের মেয়াদ বহির্ভূত রেশন সরবরাহ'র তথ্যপ্রমাণ সামনে আসে ⁷, কিম্বা ২০০৭'ও যখন লেফটেনেন্ট জেনারেল দাহিয়া'র বিরুদ্ধে লাদাখের জওয়ান'দের ফ্রোজেন মিটের টেন্ডারে আর্থিক তছরুপরে অভিযোগ ওঠে ⁸ । আর এখনও কান পাতলেই শোনা যায় যে দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার'রা আর্মি রেশন' সস্তায় পার্শ্ববর্তী দোকানদার'দের বিক্রি করেন ⁹ । 
ডিমনিটাইজেশেন দুর্নীতি মুক্ত হয়নি আর্মি। হওয়ার কথাও ছিল না। কারণ শুধু লিকুইড ক্যাশে এদেশের দুর্নীতির হিসেবে হয় না। শুধু ৫০০/১০০০'র নোটই এদেশে দুর্নীতি করতে শেখায় না। দুর্নীতি করতে শেখায় এদেশের রাজনীতি। দুর্নীতি করতে শেখায় এদেশের অর্থনীতি। দুর্নীতি করতে শেখায় এদেশের গোটা সমাজ ব্যবস্থা। আপনার অন্ধ দেশপ্রেমের বশংবদতায় এই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। আপনার প্রশ্নহীন আনুগত্যে এই দুর্নীতি'র সমাধান হবে না। তাই যেদিন সীমান্তের জওয়ান'দের জরুরী ক্যালোরি'র জরুরী প্রশ্নের সমাধানের সঙ্গে আপোষ করে, এদেশের বিদেশ মন্ত্রী টুইটে ই-কমার্স সংস্থা আমাজন কে, পাপোষে জাতীয় পতাকা অবমাননার অপরাধে ভিসা বাতিলের হুমকি দিয়ে 'দেশপ্রেম' জাহির করেন, সেদিন তাঁকে প্রশ্ন করা জরুরী যে, কোথায় ছিল আপনার দেশপ্রেম যখন আপনার স্বামী স্বরাজ কৌশল ললিত মোদীর ওকালতি করতেন ¹⁰, কোথায় ছিল আপনার দেশপ্রেম যখন লন্ডনের পাঁচতারা হোটেলে আপনি ললিত মোদীর সাথে ডিনার সারতেন ¹¹, কোথায় ছিল আপনার দেশপ্রেম যখন 'সনাতনী শিক্ষা' ছেড়ে আপনার মেয়ে কে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি করতেন ¹² ? জাতীয় পতাকার অবমাননা সেদিনও হয়েছিল যখন সাংবিধানিক সভা তিরঙ্গা কে পতাকার রং হিসেবে বেছে নেওয়ার বিরোধিতা করে আর.এস.এসের মুখপাত্র 'অরগানাইসার', ১৯৪৭'র ৩১'শে জুলাই এবং ১৪'ই অগাস্ট 'হিন্দুস্তান' ও 'হুইদার' নামে দু-দুটো তাবড় সম্পাদকীয় ছেপেছিল ¹³ । জাতীয় পতাকার অবমাননা তখনও হয়েছিল যখন প্রথম এন.ডি.এ ক্ষমতায় আসার আগে কোনদিন সংঘের হেড কোয়ার্টারে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়নি ¹⁴ । জাতীয় পতাকার অবমাননা সেদিন হয়েছিল যখন দ্বিতীয় সংঘচালক এম.এস গোলওয়ালকার নাগপুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন " তিরঙ্গা নয়, আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি একদিন গোটা দেশ গেরুয়া পতাকার কাছেই ঠিক নতজানু হবে" ¹⁵। জাতীয় পতাকার অবমাননা সেদিন হয়েছিল যেদিন মহম্মদ আখলাখের খুনি কে  তিরঙ্গায় ঢাকা হয়েছিল ¹⁶। জাতীয় পতাকার অবমাননা সেদিনও হয়েছিল যেদিন তিরঙ্গা মোড়া জওয়ান'দের কফিন নিয়ে কেলেঙ্কারি হয়েছিলো।  আর জাতীয় পতাকার অবমাননা প্রতিদিনই হয়, যখন ট্রাফিকে বিলাসবহুল গাড়ির জানলায় দু-টাকার বিনিময়ে জাতীয় পতাকায় মোড়া খেতে না পাওয়া শৈশব বিক্রি হয়।
তাই দেশপ্রেম যদি দেখাতেই হয় তাহলে প্রশ্ন করুন, ২৮.৭ কোটি নিরক্ষর দেশবাসী সাক্ষর হবে কবে?  প্রশ্ন করুন ৬২.৬ কোটির ঘরে শৌচাগার তৈরি হবে কবে ¹⁷? প্রশ্ন করুন সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকের পেটের খিদের সুরাহা হবে কবে? প্রশ্ন করুন হনুমানথাপ্পার মত ঋণের দায়ে আত্মঘাতী কৃষকরাও ক্ষতিপূরণ পাবে কবে? জওয়ানদের পাশে যদি দাঁড়াতেই হয় তাহলে জিজ্ঞেস করুন, কাশ্মীরের দাবার বোর্ডে জওয়ানদের বোড়ে বানিয়ে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি বন্ধ হবে কবে? জিজ্ঞেস করুন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কে নিজেদের সাফল্য বলে প্রচার করা সরকার জওয়ান'দের জরুরী পুষ্টি নিশ্চিত করবে কবে? জিজ্ঞেস করুন, উগ্র জাতীয়তাবাদ জিগিরে ক্ষুধার্ত দেশবাসীর রাজনৈতিক ফায়দা তোলা বন্ধ হবে কবে? সরকার বিরুদ্ধে কথা বললেই 'দেশদ্রোহী' দাগিয়ে দেওয়ার অভ্যাসে লাগাম পড়বে কবে? জওয়ান'দের পাশে যদি দাঁড়াতেই হয় তাহলে আগে আয়নার সামনে দাঁড়ান। জওয়ান'দের পাশে যদি দাঁড়াতেই হয় তাহলে আগে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কারণ রক্তে লেখা ইতিহাস সাক্ষী, যুদ্ধ যারা চায়, তাঁরা যুদ্ধে যায় না। আর যারা যুদ্ধে যায়, তারা যুদ্ধ চায় না।।



















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন