সোমবার, ৪ মে, ২০০৯

বিদেশে কর্মরত ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

বিদেশ ব্যপারটা আমাদের অনেকের কাছেই বেশ স্বপ্নময় একটা অনুভূতি। বিশেষকরে যাঁরা কখনোই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে পা রাখেননি তাঁদের ক্ষেত্রে তো কথাটা অনেকটাই ফলে যায়। শহুরে বাঙালির পক্ষে বিদেশের ছোঁয়াচ এড়ানো কঠিন। আজ এবাড়ির ছেলে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলপানি পাকড়ায় তো কাল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ওবাড়ির মেয়ে কালাপানি পার হয়। আপনার বাড়ির দুপাশের দুই প্রতিবেশির কথাই কইচি মশায়, আপনার ভাগ্যে যে সেই শিকে ছেঁড়েনি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আসমানী ডানায় ভর করে যদি সত্যি ঘুরে আসতেন স্যার, তাহলে এই লেখা কি আর হাতে তুলে দেখতেন? সংস্কৃতির জন্য তো “বাঙ্গালি মননের সঙ্গী” আছেই। আমারও দাদা আপনার মতোই অবস্থা। দুপাশে না হোক, ডান পাশের বাড়ির ছেলেটি বিদেশ ভ্রমন করে বছরে অন্তত একবার তো বটেই (আর বাড়ির বাঁ দিকে পানা পুকুর)। সে কর্মসূত্রে বিদেশ থেকে ফিরলে দু-চারটে চকোলেট, সিগারেট (বদলোকে বলে বাড়তি) আমার ও পাওনা হয়।

কিছুদিন আগে একদিন সন্ধেবেলা দেখি বাড়ির সামনে ট্যাক্সি। আর তাতে পেল্লায় দুখানা স্যুটকেস ঢোকাবার চেষ্টায় ছেলেটি গলদঘর্ম হচ্ছে। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম – “ ভায়া আবার চল্লে নাকি?”। হেসে উত্তর দিল – “ হ্যাঁ, আবার বাক্স-প্যাঁটরা বেঁধে বেরিয়ে পড়তে হলো”। এটা একবিংশ শতাব্দী। বিদেশ যাত্রা কপালে না থাক, একটা ই-মেইল ঠিকানা অন্তত আমার আছে। ঝট করে একটা চিরকূটে সেইটা লিখে দিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বেশ গর্বের সঙ্গে বললাম – “সময় পেলে মেইল কোরো”।

তা সে চলে যাবার কিছুদিন পর তার কথা প্রায় ভুলেই গেছি। সে বিদেশে গিয়ে কেমন তোফা আরামসে দিন কাটাচ্ছে সেই বাবদে খবর নিয়ে তাকে এক কলম লিখেও ছিলাম ই-মেইল এ। সে ট্যাক্সি তে ওঠার আগে নিজের ঠিকানাটা মনে করে দিয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে মাসখানেক পার হয়েছে। একদিন ছুটির দিন দেখে পাড়ার সাইবার ক্যাফে তে ( যেখানে খাবার এবং পানীয় পাওয়া যায় সেটা কি তবে খাইবার ক্যাফে?) ই-মেইল খুলে দেখি সেই ছেলেটি কিছু লিখেছে। প্রথমে ভেবে ছিলাম “কেমন চলছে? আমি ভালো” গোছের কিছু একটা হবে। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখি তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু লেখা। শুরু করেছিলাম বেশ কৌতুহল নিয়ে। কিন্তু পড়তে পড়তে দেখলাম মনটা কিঞ্চিৎ ভারি হয়ে গেল। শুনবেন সে কি লিখেছিলো? তার জবানীতেই লিখছি, কোথাও কোন পরিবর্তন না করে।

- সক্কাল বেলা উঠতে হয় এখানে। সেই ভোর ৪টে। উঠেই প্রথম কাজ, একরাশ ঘুম চোখে নিয়ে গ্যাস জ্বেলে ভাত বসানো। নইলে খাবো কি? চোখের ভেতর কর কর করে আর একটু ঘুমের জন্য। ভাত হতে হতে বাথরুমের সব কাজ সারতে হয়। চান টান করে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে ভাতের ফ্যান গালা, আর ফ্রীজ থেকে গতকাল রাতের তরকারি বের করে প্যাক করা। অন্যদিকে হিম-ঠান্ডা দু টুকরো পাউরুটিতে হয় জ্যাম মাখিয়ে নয়ত ততোধিক বিস্বাদ একটা সালামি, ওই দুটো পাউরুটির মধ্যে ভরে কোনরকমে জল দিয়ে গিলে খেয়ে নেওয়া। তারপর বাসন মেজে, বিছানা তুলে, হুড়োহুড়ি করে জামাকাপড় গলিয়ে (সব কিছু ধোপদুরস্থ এবং ফিটফাট হওয়া একান্ত প্রয়োজনিয়), ১০ মিনিটের হাঁটা পথ ৬ মিনিটে পেরিয়ে ভোর ৫ টা ১০ এর বাস ধরা। বাইরে তখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বেশ কিছুটা নিচে, তার ওপরে শনশনে হাওয়া।

বাসে ১৫ মিনিটে রেল স্টেশন। এটা প্রান্তিক স্টেশন, তাই বসতে পাওয়ার ঝামেলা নেই। ৫ টা ৩৪ এর ট্রেন এ, জানলার ধারে বসে ল্যাপটপটা ( নিজের নয়, কোম্পানির দেওয়া) বের করে দিনের কাজ শুরু করি। পৌঁছেই একটা মিটিং এ ঢুকতে হয়, এটা রোজকার রুটিন। ট্রেন পেরোয় একের পর এক স্টেশন। সময় পেরোয় তার চেয়েও দ্রূতগতিতে। গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই মিটিং এর প্রয়োজনিয় কাজকর্ম সেরে ফেলতে হবে। যেখানে ট্রেন এ উঠেছিলাম সেই স্টেশনটা ছিলো দোতলায়, আর আমার গন্তব্য স্টেশন মাটির নিচে। কারন যেখানে আমার অফিস, সেইটা একটা বিশাল শহর, সেখানে থাকার মতো রেস্ত বা হিম্মত ( যত বড় শহর, তার ততো বদনাম) কোনোটাই আমার নেই। কাজেই দুই – দুই মোট চার ঘন্টার দৈনিক রেল-যাত্রা আমার বরাদ্দ। ট্রেন থামলে হুড়মুড় করে নামি, আবার হুড়মুড় করেই সিঁড়ি বেয়ে মাটির ওপরে উঠে আসি। শনশনে হাওয়া সারা শরীরে একটা থাপ্পড় মেরে যায়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত পা চালাই। আরো ২০ মিনিট পায়ে হাঁটতে হবে এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়, আর কপাল খারাপ হলে তুষারপাতের মাঝে। একবার একটা ওভারকোটের কথা ভেবেছিলাম। দাম দেখে সাহসে কুলোয়নি। ট্যাক্সি নিলে চলবে না, পকেটে অতো পয়সা নেই। তুষারপাতের মধ্যেই মাঝে মাঝে আবার বৃষ্টিও হয়। দু-দিন ভিজেছি তাইতে। রাস্তার একদিকে সমুদ্র, আর অন্যদিকে সারি সারি আকাশ ছোঁওয়া বাড়ি। ঠান্ডায় হাত পা জমে যায়। ক্লান্তিতে এবং ঘুমে কোমর-পিঠ ভেঙে পড়তে চায়। কিন্তু উপায় নেই, সস্তার মজুর যে। ওই যে অফিসটা দেখা যাচ্ছে। আর এই টুকু যেতে পারলেই একটু উষ্ণতা পাওয়া যাবে। কাঁপুনিটা কমবে আর আঙ্গুল গুলোয় সাড় ফিরে আসবে।

অফিসে ঢুকে এক কাপ গরম......... সময় নেই, সময় নেই, মিটিং এর দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখুনি ঢুকতে হবে কনফারেন্স রুমে। সেখানে ঢুকে সাজাই, কাগজপত্র, প্রোজেক্টর, টেলিফোন। এখূনি ক্লায়েন্টের লোকজন এসে পড়বে, তার আগে সব ব্যবস্থা নিখুঁত হওয়া চাই। ক্লায়েন্টের দিকের লোকজন আসতে থাকে। হাতে গরম কফির কাপ, কারোর হাতে সদ্য সেঁকা মুচমুচে স্যান্ডুইচ। মনেপড়ে যায় সকালের খাওয়া সেই দু-পিস পাউরুটি কখন হজম হয়ে গেছে এই ঠান্ডায় হেঁটে আসতে আসতে। তবু হাসিমুখে গলায় ঝূলতে থাকা টাই টা টানটান করে নিজেকে “প্রেজেন্টেবল” করার চেষ্টা করে যেতে হয়। যদি ক্লায়েন্টের কাছ থেকে পাওয়া যায় একটা প্রশংসা। সবকিছু চেপে রেখে, হাসিটি ঝুলিয়ে রাখি ঠোঁটের ডগায়। মিটিং শেষ হয় আমার ঘাড়ে আজকের রাজ্যের কাজের বোঝা চাপিয়ে। মুখ গুঁজে পড়ে থাকি কম্পিউটারের পর্দার সামনে। ঘড়ির কাঁটা বেলা ১২ টার ঘর পেরয়। পেটের ভেতর আগুন জ্বলতে থাকে। সাত ঘন্টা আগে খাওয়া ২ টুকরো পাউরুটি সেই আগুনটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনা। টিফিন কৌটোটা খুলি। জমে পাথর হয়ে যাওয়া ভাত আর আলু চামচ দিয়ে কেটে কেটে মুখে তূলি। কৌটোর আকার পেটের খিদের চেয়ে একটু ছোট মনে হয়, তাই পেট ভরে জল খেয়ে নি। পেট ভর্তিকরে খেতেও ভয় লাগে, যদি ঘুম আসে তাতে? খেয়ে উঠে এক কাপ কালো কফি নিয়ে বসি। ঘুম তাড়াবার এ হলো মোক্ষম অস্ত্র (এবং এটা ফ্রী তে পাওয়া যায়)। আবার কম্পিউটারের পর্দায়। কি-বোর্ডের ওপরে ঝড়ের মত আঙুল চলে। একে একে বাড়ি যায় সবাই। পাঁচটার পর কেঊ কাজ করেনা এদেশে। ডেডলাইন নিয়ে হিমসিম খাই আমি। কাজ শেষ করতেই হবে। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে সাতটার ঘর পেরোয়। দৌড়ে বেরোই ভুতুড়ে অফিস থেকে। যারা কাজ করে এখানে, তারা অনেক আগেই চলে গেছে। আমি সস্তার বিদেশী মজুর, এসব নিয়ম আমার ওপর বর্তায়না। বিশাল চেহারার সিকিওরিটি গার্ড, আমার দিকে করুনার চোখে তাকায় দেঊড়িতে। আবার সেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় ২০ মিনিট হেঁটে পৌঁছই স্টেশনে। ট্রেন আসে, গন্তব্যে পৌঁছই আরো ২ ঘন্টা পরে। উর্ধশ্বাসে ছুটি প্লাটফর্ম দিয়ে, নয়ত বাসটা ফস্কাবো। দূরে বাস এর পেছনের ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা লাল আলোটা দেখতে পাই। জনমানবহীন কোনো এক বিদেশী গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে হিম-ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে থাকি পরের বাসের অপেক্ষায়। আরো আধঘন্টা পরে আসার কথা সেটার।

ঘরে ঢুকি, রান্না চাপাই। নইলে খেতে দেবে কে? কোনোমতে অল্প কিছু রান্না করে খেতে বসি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে ওঠে। কলকাতার অফিস থেকে রোজকার নিয়ম মাফিক ফোন আসে এই সময়। ফোনে কথা চলতে থাকে। রুটি শুকোয় থালায়। শুকোতে থাকে। রাত ১২ টার কিছু পরে ফোন রাখে ওরা। গোগ্রাসে গিলতে থাকি জুতোর শুকতলার মতো ঠান্ডা রুটি আর তরকারি। শুতে যাই। আগামীকালের জন্য ঘড়িতে ৪ টের সময় আলার্ম দিতে যাবার সময় মনে পড়ে যায় আজ ছিলো পয়লা বৈশাখ।

এইখানেই ওর চিঠি শেষ। হয়ত সবাই এই ভাবে থাকেনা। এটা হয়ত নেহাতই একটা খন্ডচিত্র। বিশ্বায়নের যুগে, এই রকম সস্তা মজুর হতে কার ই বা ভালো লাগে বলুন? মনকে তাই প্রবোধ দি, এ হলো নিতান্তই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কোন রকমে একটা দায়সারা উত্তর দিই চিঠিটার। সাইবার ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হলো, এই ভাবে প্রায় ভূমিদাসের মতো জীবনযাপনের অর্থ কি? শুধুই কি দুটো পয়সা? নাকি আজও আমাদের মন থেকে ঔপনিবেশিক দাসত্ব পুরোপুরি যায়নি? স্পষ্টতঃ ওর নিজের কাছেই এটা পরিস্কার, যে পেশাগত চাহিদার বাইরেও ওকে আরো অনেক কিছু দিতে হচ্ছে। এবং নিজের কাছে, নিজেরই সম্মানহানী ঘটছে। ওর পড়াশোনা রয়েছে, বুদ্ধিমান, একে কি দেশে একটা জীবিকার ......।

চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়। সামনে গোলমাল শুরু হয়েছে। কারা যেন একটা বাসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কৃষিজমি অধিগ্রহন করে শিল্পস্থাপনের বিরুদ্ধে এ হলো রাজনৈতিক আন্দোলন। আগামীকাল বাংলা বন্ধ।

৩টি মন্তব্য:

  1. hmmm.... bides e amio thaki... unfortunately IT te noi... research e...

    sotti kotha bolte ki, alada kore kono tofat khunje pelam na.. amar-o pray eki dosha.

    উত্তরমুছুন
  2. hmmm.... bides e amio thaki... unfortunately IT te noi... research e...

    sotti kotha bolte ki, alada kore kono tofat khunje pelam na.. amar-o pray eki dosha.

    উত্তরমুছুন
  3. Ami america-r ekti University-te research korchhi... hyaan, porar chaap, kajer dayitto, barir kaj-- sob-i hoyto ekhane relatively anek beshi. But tar modhye haa-hutasher kichhu khnuje payina ami. Independantly nijerta nije kore nebar modhye afsosh kothaye? Tachhara, deshe thekeo jodi kormo khetre ba porar janya anya kono pradesh-e thakte hoto, sekhaneo eki dasha-i hoto! R honestly bolte gele ki, majhe majhe eka eka sob korte amaro bhalo lage na.. but tai bole etotao kritodas dasha sabar hoy na.

    Golpo-ta emnite akorshoniyo, but chhoto-khato kichhu inconsistency na bole parlam na... bari theke lunch anata sudhu deshi modhye nei, anek bideshrao koren, r microwave ofc-e nei bhaba-ta kothin. America-r apt-e rice-cooker, microwave, toaster nei.. strange! Walmart-er ready-to-eat khub expensive noy bodhoy!

    উত্তরমুছুন