বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০০৯

Brigade এবং... ~ শাক্যজিৎ

অতি সম্প্রতি কাগজে দেখলাম ব্রিগেডে জনসমাবেশ করে বামফ্রন্ট পরিবেশের কতটা ক্ষতি করেছে সে বিষয়ে পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত কলকাতা হাইকোর্ট কে পিটিসন দাখিল করেছেন। স্মরনে থাকতে পারে, এই ভদ্রলোকই ময়দানে বইমেলা করার বিরুদ্ধে কোর্টে গেছিলেন, এবং কোর্ট যখন বইমেলাকে নিষিদ্ধ করল, ইনি আনন্দাশ্রু চেপে রাখতে পারেননি।তখন এবং প্রতিক্ষেত্রেই এই ধরনের পরিবেশ নষ্ট হবার অভিযোগ বারেবারে করে গেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। সুভাষ দত্ত-র সমর্থনের একটা বড়ো স্তম্ভ-ই ছিল এবং আছে এই কাগজটি।এক্ষেত্রে সুভাষবাবুকে সমর্থন জানিয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধি দল তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। সুভাষবাবু আপাতদৃষ্টি তে তাঁর কর্তব্য করেছেন, তৃণমূল-ও তার বরাবরের উগ্র বাম-বিরোধিতা বজায় রেখেছে। আমাদের প্রশ্নটা আনন্দবাজারের ভূমিকা নিয়ে। মিছিল হলে তার অসুবিধেটা কোথায়? তার যে বিক্রী কমে, এমন ত নয়। তবুও তার এহেন মিছিল মিটিং সভা সমাবেশের বিরুদ্ধে গলা ফাটানো কেন? সুভাষবাবূই বা কেন বারবার এরকম কাজ করে যাচ্ছেন? প্রশ্ন টা হল, এই কার্যকলাপগুলো কি একটা বিশেষ ট্রেন্ড দেখাচ্ছে, যার মূল নিছক বামফ্রন্ট বিরোধীতা ছেড়ে অনেক গভীরে?কেন বারেবারে আনন্দবাজার বা ওই জাতীয় পত্র-পত্রিকাগুলো এমন কাজ করে আসছে?আমাদের কি এবার সাবধান হবার সময় এসেছে?

শুরু করা যাক অতীত থেকে। কারণ অতীত বিশ্লেষণ করলে, আমাদের বিশ্বাস আজকের এই কাজগুলোর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। অতীতে আনন্দবাজার পত্রিকা কি করেছে? সকলেই জানেন এই কাগজটি নিজেকে বাঙ্গালী রুচি ও সংস্কৃতির একমাত্র ধারক ও বাহক হিসেবে মনে করে। কিন্তু তীব্র আন্টি-কম্যুনিস্ট ভাবধারায় অনুপ্রানিত হয়ে কোন সংস্কৃতি তুলে ধরেছে আমাদের সামনে? ধরা যাক ১৯৬২ সালের ভারত চীন সঙ্ঘর্ষের কথা। যুদ্ধোন্মাদনা জাগিয়ে তোলার জন্য, এবং উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ারে মানুষকে ভাসিয়ে কম্যুনিস্টদের কচুকাটা করবার জন্য আনন্দবাজার উঠে পড়ে লেগেছিল। দেশ পত্রিকার পাতায় শিল্পির স্বাধীনতা বলে একটি কলাম খুলে বিভিন্ন শিল্পি সাহিত্যিক কে দিয়ে লেখাত, যে লেখার মুল প্রতিপাদ্য ছিল কিভাবে তারা একসময় সমাজতন্ত্রের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের উপর গলা চেপে ধরা দেখে তারা সেই আদর্শ পরিত্যাগ করেন। এই কলামের নেতৃত্বে ছিলেন শ্রদ্ধেয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশপ্রেমের সেই ঢক্কানিণাদে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন অনেক বামপন্থী সাহিত্যিক-ও, যেমন নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় বা দীনেশ দাস। মনোজ বসু তাঁর চীন ঘুরে এলাম বই এর হাজার হাজার কপি তখন প্রকাশ্য রাস্তায় সহস্তে পোড়ান, অতীতে চীনার প্রতি ভাল ভাল কথা লেখার পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরুপ। তপন সিনহা বানালেন উগ্র দেশপ্রেমের ছবি আমার দেশ যাকে আনন্দবাজার আখ্যা দিল স্বাধীন গণতন্ত্রের দেশপ্রেমিক শিল্পির এক অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে। সত্যজিত রায় চীনার বিরুদ্ধে একটিও বিষোদ্গার না করায় ক্রুদ্ধ আনন্দবাজার তার সম্পাদকীয় তে প্রশ্ন তোলে জাতির এই সংকট কালে সত্যজিত নীরব কেন? স্থিতধী অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর মতপ্রকাশে ছিলেন অবিচল। একবার আনন্দবাজারের পাতায় অন্যরকম লেখার পরেই গৌরকিশোর ঘোষ ঝাপিয়ে পড়েন, ফতোয়া জারি করেন যে জাতির এই দুর্দিনে এখন ওসব কথা বলা চলবে না। সমরেশ বসু এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র কে হিংস্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয় চীনবিরোধী কথা না বলার জন্য।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রথম দিকটায় আনন্দবাজার ভিয়েতকং দের বলেছিল চীনের দালাল এবং মার্কিন সৈন্যবাহিনী কে আখ্যা দিয়েছিল সাম্যবাদের বিরুদ্ধে মুক্তির প্রাচীর হিসেবে। এবং মজার ব্যাপার, আজকের সুভাষ বাবু দের পূর্বসূরী এক সাহেব, পরিবেশবিদ জন উইলেট ভারত ভ্রমণে এসে দেশ পত্রিকার পাতায় চোখের জল ফেলেন ভিয়েতকং রা মাটির নিচে সুরঙ্গ কেটে কেমনভাবে মাটি আলগা করে ওখানকার গ্রামীণ পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে সে বিষয়ে। কল্লোল নাটকের বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমণ আসে দেশ পত্রিকায় প্রমথনাথ বিশীর কলম থেকে, তিনি নাটকটিকে নিষিদ্ধ করার দাবী জানান। অঙ্গার নাটকের বিরুদ্ধেও অশ্লিলতার অভিযোগ এনেছিল আনন্দবাজার, কারণ সেখানে নাকি বস্তি অঞ্চলের মানুষের নোংরা ভাষা ব্যাবহার করা হয়। সংগ্রামী জনতার শিল্প সাহিত্যে নাটকে এরকম চিত্রায়ণ আনন্দবাজারের সহ্য হয় নি। তাদের প্রবর্তিত ড্রইংরুমের ভাববিলাস, পরকীয়া প্রেম আর নাগরিক হতাশার ট্রাডিশনের সংস্কৃতির বাইরে এ এমন সব নাটক, যা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আদর্শ কে সামনে নিয়ে আসে। তাই নিষিদ্ধ করার দাবী। পরে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি-সুব্রত মুখার্জী দের গুন্ডারা যখন মিনার্ভা তে কল্লোল এর শো ভাংচুর চালায়, সমস্ত শিল্পি-সাহিত্যিক প্রতিবাদে মুখর হলেও নীরব ছিল একমাত্র আনন্দবাজার পত্রিকা।

১৯৭২ সালে প্রবল রিগিং আর সন্ত্রাসের মাধ্যমে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ক্ষমতায় এলে উল্লাসে ফেটে পড়ে আনন্দবাজার লিখেছিল যে বাংলায় সবুজের বিপ্লব ঘটেছে। এই সবুজের দল নবজীবনের জোয়ার নিয়ে আসবে মরা বাংলায়। কি জোয়ার এনেছিল, তা বলাই বাহুল্য। তথ্যের খাতিরে শুধু এটুকুই বলা যাক, ৭২ থেকে ৭৭ কংগ্রেসী সন্ত্রাসে নিহত বামপন্থী কর্মী দের জন্য একটা লাইন-ও খরচ করা হয়নি এই পত্রিকায়। আগ্রহীজন, পুরোনো সংখ্যা লাইব্রেরি তে গিয়ে মিলিয়ে দেখতে পারেন আমার কথা। বাংলাদেশের যুদ্ধের জন্য টন টন চোখের জল ফেলা হয়েছিল, পত্রিকার পোষ্য কবি সাহিত্যিক রা যশোর রোডে গিয়ে ত্রাণ বিলিয়ে এসেছেন, এবং সে ছবি ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। কিন্তু বরানগর বেলেঘাটা কাশীপুর এবং বাংলার সর্বত্র সিপিএম ও নক্সাল কর্মী খুনের একটি খবর-ও নয়।

পাঠক রা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, আনন্দবাজারের এমন কম্যুনিস্ট বিরোধীতার কাহিনী এনে আমি কি এটাই প্রমাণ করতে চাইছি যে আজকেও মিছিলের বিরুদ্ধে আনন্দবাজার বা সুভাষ দত্ত এই কারণেই বলছেন কারন এটা বাম্ফ্রন্টের মিছিল? না, শুধুই বামফ্রন্ট নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আনন্দবাজার তৃণমূলের মিছিলের-ও বিরুদ্ধে। যে কোনো রাজনৈতিক সভা সমাবেশ মিছিলের-ই বিরুদ্ধে এই পত্রিকা টি। কখনো তার অজুহাত নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হওয়া, কখনো পরিবেশ। এক্ষেত্রেও আনন্দবাজার তার পুরনো বামবিরোধী ধারাটি বজায় রেখেছে। কেন বলছি এ কথা?

ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রে যে গোষ্ঠীটি বসে আছে সেটা মুলত জোতদার জমিদার দের একটা চক্র। এদের সমর্থনের ভিত্তি বড় পুঁজিপতি শ্রেণী রা। এই দুই শ্রেণীর আঁতাতের ফলে দিল্লী তে অধিষ্ঠান করে আছে সবচেয়ে পশ্চাদপদ বিজ্ঞানবিরোধী এক দল মুতসুদ্দী শ্রেণী। এদের টিকি বাঁধা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দরজায়। এদের-ই পদলেহনকারী কলকাতায় বসে থাকা বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠীর লেখককূল, যাদের কাছে প্রগতিশীল সাহিত্য মানে পরকীয়া প্রেম। এদের আনুগত্য মূলত কংগ্রেসের প্রতি, শ্রেণীগতভাবে যে দল ক্যাপিটালিস্ট-ল্যান্ডলর্ড এবং মুতসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণীর এক দো-আঁশলা সংস্করণ। বাঙ্গালী জাতির হয়ত এটা দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে তারা সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র গোষ্ঠী, যেখানে বড় স্কেলের মুতসুদ্দি পুঁজি একটা জাতির সংস্কৃতির ঠিকাদারি নিয়ে বসে। রুপার্ট মারডখ যত বড় পুঁজিপতি-ই হন না কেন, তিনি মার্কিন দেশের সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রন করেন, এরকম দাবি স্বয়ং মারডখ-ও করবেন না। যে কোনো দেশের সংবাদপত্র মালিকের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা সত্যি। বাংলায় কোন প্রতিস্পর্ধী শক্তিশালী ধারা না থাকার সুযোগে (লিটল ম্যাগাজিন সংস্কৃতি প্রতিস্পর্ধী হতে পারে, কিন্তু বৃহত পুঁজির সাথে পাল্লা দেবার সাধ্য তাদের এখনও নেই) এবং বামপন্থী আন্দোলনের শক্তিশালী ধারাটা (আইপিটিএ প্রমুখ) বিভিন্ন কারণে নির্জীব হয়ে যাবার কারণে বৃহত পুঁজি শূন্যস্থান পুরণ করে বসে। এদের চরিত্র মুলত মুতসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণীর, কারণ বিকাশের জন্য এরা বরাবর-ই সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল। অতি সম্প্রতি রুপারট মারডখের স্টার গোষ্ঠীর সাথে আনন্দবাজারের গাঁটছড়া বাঁধা এটার একটা প্রমাণ। দেশীয় পুঁজির স্বাধীন বিকাশের পথে যদি আনন্দ গোষ্ঠীর বিকাশ ঘটত তাহলে কি হত সেটাও একটা বড় প্রশ্ন বটে। কিন্তু এরা বরাবর-ই কংগ্রেসের তল্পিবাহক ছিল, আর কংগ্রেসের শ্রেণিচরিত্র কারওর অজানা থাকার কথা নয়।

বরাবর-ই মুতসুদ্দি শ্রেণী নিজের দেশের শিল্প সংস্কৃতির স্বাধীন বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে তার উপর সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বোঝা চাপায়। এটা সে নিজের অস্তিত্ত রক্ষার খাতিরেই করে। আনন্দবাজার-ও তার ব্যাতিক্রম নয়। এরা মুখে দেশপ্রেমের কথা বলে, ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশনের কথা বলে। কিন্তু বিজেপি-কংগ্রেসের মতই, এদের কাছে ইন্টিগ্রেশন মানে পুঁজিপতি দের কাঁচামাল ও বাজারের ইন্টিগ্রেশন। প্রতিটা জাতির নিজের সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাটা রুদ্ধ করে দিয়ে তাদের এক-ই ছাঁচে আনতে হবে, যাতে কেউ মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ না পায়, নিজের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করবার দাবি পর্যন্ত না তুলতে পারে।নাহলে ওই জমিদার জোতদার শ্রেণীর খুব অসুবিধে হয় দেশ চালাতে। দেশকে লুঠ করে সাম্রাজ্যবাদের হাতে কাঁচামাল তুলে দিতে। আর তাই, আমাদের সমস্ত উজ্জ্বল অতীত ভুলিয়ে দেবার খেলা, আমাদের সংগ্রামী ঐতিহ্য কে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস। যেখানে যেটুকু সংগ্রামী উপাদান লুকিয়ে আছে, বামপন্থী ধারা বেঁচে আছে, তাকে ভুলিয়ে দেবার প্রয়াস। এবং এই কাজটাই এই রাজ্যে ধূর্ততার সাথে করে চলেছে আনন্দবাজার।

একটু পড়াশোনা করলেই দেখা যাবে, কেমন ভাবে আমাদের উজ্জ্বল ঐতিহ্য কে আনন্দবাজার কালিমালিপ্ত করেছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকি উপলক্ষ্যে দেশ সংখ্যায় আলোচনার মুল বিষয় ছিল দ্বারকানাথের মদ্যপানে আসক্তি ও রাণি ভিক্টোরিয়ার সাথে তাঁর অবৈধ প্রণয়। দ্বারকানাথ যে একটা জাতির ইতিহাসে প্রগতিশীল বুর্জোয়া শ্রেণীর ভুমিকা সম্পন্ন করে গেছেন, আদি ব্রাম্ভসমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান যে উদিয়মান বুর্জোয়ার ধর্মসংস্কারের এক উদাহরণ, সেসব বাদ দিয়ে বড় হয়ে উঠল তাঁর মদ্যাসক্তি! দেশ পত্রিকায় একটি বহুল প্রচারিত উপন্যাসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে আঁকা হল মদ্যপ ও প্রায় সমকামী হিসেবে। এদিকে তাঁর প্রচন্ড কবিপ্রতিভায় মাইকেল যে একটা ভাষার বিগ্রহ দান করে গেছেন, যা রাশিয়া তে করেছিলেন পুশকিন, যা একটা জাতির নবজাগরণ কে প্রাণপ্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, সে বিষয়ে ওই মহান লেখক নীরব। ওই লেখক-ই অন্য একটি প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র কে বোম্বে ফিল্মের চিত্রনাট্যকার শ্রেণীর লেখক বললেন এবং বিচার করলেন যে মাইকেল এর কবিপ্রতিভা একটা কুসংস্কার মাত্র! গিরীশচন্দ্র ঘোষের মূল্যায়ন এরা করে দুটি মাত্রায়। এক মাত্রায় গিরীশ মাতাল ও নটী বিনোদিনী তাঁর রক্ষিতা। অন্যা ধরণের আলোচনায় প্রাধান্য পায় গিরীশের রামকৃষ্ণ ভক্তি এবং শ্রী চৈতন্য নাটক দেখতে এসে পরমহংসের ভর হওয়া। যেন ওই নাটকটা ছাড়া গিরীশ জীবনে কোনো নাটক লেখেন নি। একবার-ও বলা হয়না গিরীশের প্রচন্ড ব্রিটিশবিরোধী নাটকগুলোর কথা, যে কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর পর পর তিন খানা নাটক নিষিদ্ধ করে দেয়। স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মপ্রচার নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হয়, কিন্তু তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাপ্রসূত লেখাগু্লো নিয়ে এরা নীরব। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী আলোচনা-য় দেশ এর পন্ডিত রঞ্জন চরিত্রের মধ্যে প্রকৃতির ছন্দ খুঁজে পান, যে প্রকৃতি মানুষের নিয়ম নীতির কারাগার ভেঙ্গে সুন্দরের জয় স্থাপিত করবে। অথচ সাধারণ মানুষ পড়লেও বুঝবে রবীন্দ্রনাথ পুঁজীবাদের কি অমোঘ মৃত্যুঘন্টা বাজিয়েছিলেন ওই নাটকে। এবং নাটকটা লেখা হয়েছিল রাশিয়া থেকে ফিরে এসে। সে বিষয়ে ওই পন্ডিতপ্রবরের কলম নীরব। এরাই দিনের পর দিন সুকান্ত ভট্টাচার্য কে বলে গেছে ইম্ম্যাচিওর কবি, যার কবিপ্রতিভা নাকি পাতে দেবার-ই যোগ্য নয়। নজরুল-ও তাই। এখন তো আবার এদেরি একদল ঐতিহাসিক উঠেপড়ে লেগেছেন এটা প্রমাণ করতে যে বাংলার নবজাগরণ ব্যাপারটাই ভুয়ো, উচচশ্রেণীর একদল বাঙ্গালীর ষড়যন্ত্র! এদের কাছে বিদ্যাসাগর ঔপনিবেশিক, কারণ তিনি সাঁওতাল পরগণায় দরিদ্র আদিবাসীদের নাকি মানুষ বলেই গণ্য করতেন না। এদেরি এক জাতভাই কয়েকবছর আগে বই লিখে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে সিপাহি বিদ্রোহ আসলে একটা ভ্রান্ত কুসংস্কার মাত্র। বস্তুত তা ছিল একশ্রেণীর সামন্তপ্রভু দের মধ্যযুগ ফিরিয়ে আনবার জন্য ধর্মযুদ্ধ মাত্র। ব্যাস, আর কিছুই না! দেশ পত্রিকা বহুল প্রচার চালিয়েছিল সে বইয়ের। লজ্জার মাথা খেয়ে সেই ঐতিহাসিক আর এটুকু বলেন নি যে এহেন মধ্যযুগের বর্বরদের দমন করে ইংরেজ সরকার একটা মহৎ কাজ করেছিল!

তা বলে ত এটা নয় যে বঙ্কিম বা বিবেকানন্দের অব্জেক্টিভ বিচার হবে না! নিশ্চয় হবে। বঙ্কিমের ইতি আছে, নেতি আছে। প্রখর সাহিত্যদৃষ্টির পাশাপাশি প্রচন্ড মৌলবাদী বক্তব্য আছে। বিদ্যাসাগরের আছে, রবীন্দ্রনাথের আছে। প্রত্যেক যুগের সবচেয়ে অগ্রসর মানুষদের মধ্যে স্ববিরোধীতা লুকিয়ে থাকে। রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রদের পাশাপাশি নীলকরদের বাংলায় নীল চাষের ইজারা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী-র পাশেই আছে প্রাচীন হিন্দু ধর্মের মহিমা কীর্তন করে সেই আর্য সমাজে ফিরে যাবার ডাক। সব দেশের সব কালের অগ্রসর আলোকপ্রাপ্ত মানুষের চরিত্রের মধ্যে একটা পিছুটান থাকে। টলস্টয়ের স্ববিরোধীতা লেনিনের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছিল। মাও ল্যু সুনের উপর ক্ষেপে গেছিলেন। সবকিছুর-ই বিচার দরকার। কিন্তু কিভাবে? বঙ্কিম কে বোম্বে ফিল্মের চিত্রনাট্যকার বলে? রবীন্দ্রনাথের অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে ভিক্টরিয়া ওকাম্পোর সাথে তাঁর প্রেম অথবা রাণু কে ভানুদাদা বা কাদম্বরী দেবির সাথে তিনি কি কি করেছিলেন শুধু তার রগরগে বিবরণ দিয়ে? মাইকেল কে সমকামী বলে? দেশ ও জাতির প্রতি এদের যে মহৎ কর্তব্য সেটা সবাই জানে বলে এড়িয়ে গিয়ে শুধু নেতির দিকগুলো বা চারিত্রিক অসংগতি তুলে ধরব, এই ধরণের কাজের পেছনে কি উদ্দেশ্য খেলা করে বুঝতে খুব অসুবিধে হয় কি?

শুধু আমাদের ঐতিহ্য? কবি শেলী-র জন্মের দ্বি-শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দেশ-এর বিশেষ সংখ্যায় শেলীর কি কি পরিচয় দেওয়া হল? শেলীর রোম্যান্টিকতা, প্রকৃতিপ্রেম, বিভিন্ন নারীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এসব। যেন শেলী মানেই এক নারীলোলুপ, মদ্যপ্রিয় ভবঘুরে। সুকৌশলে চেপে যাওয়া হল শেলীর বিপ্লবী দিকটা। শেলী যে নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা নামের প্যাম্ফলেট প্রকাশের দায়ে অক্সফোর্ড থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে অশক্ত শরীর নিয়েও ছুটে গেছেন, আগুনঝরানো ভাষণ দিয়েছেন ধর্ম ও বিপ্লব নিয়ে, ওড টু দা ওয়েস্ট উইন্ড কবিতায় সরাসরি ডাক দিয়েছেন বিপ্লবের, সে সব বিষয়ে আশ্চর্যভাবে চুপ দেশ পত্রিকা। মার্ক্স বলেছিলেন অষ্টাদশ শতকে বায়রন বেঁচে থাকলে হতেন এক অধঃপতিত বুর্জোয়া, আর জন্মবিদ্রোহী শেলী হতেন সমাজতন্ত্রের আগুয়ান সৈনিক। সেসব বিষয়ে কিন্তু দেশ পত্রিকার ওই পন্ডিত লক্ষ্যণীয়ভাবে নীরব!

এই হল আমাদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বিষয়ে এদের মনোভাব। এদের হাতে বঙ্কিম আক্রান্ত, সুকান্ত আক্রান্ত, বিদ্যাসাগর, রামমোহন কেউ নিরাপদ নন। এই মুতসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণী, যাদের নিজেদের ঐতিহ্য-ই এখন তাদের অস্তিত্তের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, চায় যেন তেন প্রকারে সেই ঐতিহ্য কে কালিমালিপ্ত করতে, আমাদের সংগ্রামী অতীত ভুলিয়ে দিয়ে একটা গোটা জাতিকে নিস্তেজ করে দিতে। আর সেই সংগ্রামী চরিত্র ভুলিয়ে দেওয়া, এবং আজকের মিছিল মিটিং এর প্রতি এদের যে বিষোদ্গার, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

যেকোনো মিছিল, রাজনৈতিক মিটিং, পথসভার প্রতি এদের তীব্র অনীহা, কারণ তাতে সংগ্রামী মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ রূপ ফুটে ওঠে। ৮ ফেব্রুয়ারি-র ব্রিগেডের পর এদের কাগজের হেডিং ছিল ব্রিগেড ঘিরে নাগরিক দুর্ভোগের ষোলো কলা পূর্ণ, উনুনে ঢালাও রান্না, পার্টি পুলিশ নিস্ক্রিয়। আর ছবি কি দেওয়া হল? সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে এসপ্ল্যানেডে, আর বাস ধরতে নাকাল জনতা। যানজট! মানুষের দুর্ভোগ! এসবের বাইরে আর কোনই ইস্যু নেই। একটা ছবি নেই মিছিলের, তাহলে তো মানুষের সংগ্রামী চেহারাটা ধরা পড়ে যাবে! প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এত মানুষ আসলেন, এক প্রতিবন্ধী যুবক পায়ে টানা সাইকেল চালিয়ে আসলেন, সে সব কোনো খবর দেওয়া যাবে না। তাহলে তো আনন্দবাজারের প্রচারিত নয়া জীবনবোধের হাওয়াবাজী ফেঁসে যাবে! কি দেখায় এই পত্রিকা? এদের শনিবারের বিশেষ সংখ্যায় খবর বেরত কলকাতা সাবালক হচ্ছে। কেন? নাইটক্লাব, ডিস্কথেক, তন্ত্র-মন্ত্রের উদযাপনে শহরের নিশিযাপন নাকি অনেক উত্তেজক এখন! যেন সব যুবক যুবতিদের এখন একটাই গন্তব্য, ডিস্ক! পাতার পর পাতায় শুধু সেসবের খবর, সুড়সুড়ি দেওয়া ছবি। এদের পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প উপন্যাসেও দেখা যায় সেই একই অবক্ষয়ী মুল্যবোধের জয়জয়কার। অবৈধ প্রেম, হিন্দি ছবি মার্কা ভায়োলেন্স আর এদের মধ্যে যারা একটু নাকি চিন্তাশীল বলে খ্যাত, তাদের লেখায় দাম্পত্যের অখাদ্য থাবড়া-খাওয়ার যোগ্য মনস্তাত্তিক কচকচি। নাইটক্লাবে যাওয়া এক স্বল্প সংখ্যক তরুণের পাশাপাশি যে এক বিশাল সংখ্যায় মানুষ প্রতিদিন কারখানায় যাচ্ছে, কলম পিষছে, উদয়াস্ত জীবনসংগ্রামের মাঠে লড়াই করে চলেছে, সেসব লিখলে সে লেখা নাকি রাজনৈতিক ভাবে বায়াসড! আর অতদুরেই বা যাবার দরকার কি! যে ছেলে নাইটক্লাবে যায় দরকার পড়লে সেই অস্ত্র হাতে ব্যারিকেডে ছুটে যেতে পারে, কারন মানুষ আসলে সংগ্রামী। এরা সেই লড়াইটাই চেপে দেয়, তুলে ধরে শুধু তার নাইটক্লাব যাবার ছবি। আর এদেরি পেটোয়া শিল্পি-সাহিত্যিকরা প্রচার করেন যে কোনো প্রকার বাম বা ডানপন্থী শিবিরের অনুগত হওয়া নাকি উচিত নয়, তাহলে শিল্পের জীবনবোধ নাকি আহত হয় মতাদর্শের চাপে। অর্থাৎ রাজনীতির কাছাকাছি আসলে এনাদের সতীত্তে নিউমোনিয়া ধরে! উত্তর-গ্লোবালাইজেশন ভারতে যে সম্পন্ন মধ্যশ্রেণীর রমরমা এরা তাদের রাজনীতি ভুলিয়ে দেবার খেলায় নেমেছে। ব্রিগেডে দূষণ দেখিয়ে কি প্রচার হল? দেখ, রাজনীতি কতটা নোংরা, এর থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল। খাও পিও অফিস কর পাব যাও, আর যদি সমাজ নিয়ে মাথা ঘামাতেই হয় তাহলে দলীয় রাজনীতি বর্জিত সুশীল সমাজের গলতায় ঢোকো। কারণ দলীয় রাজনীতি খারাপ লোকেদের জায়গা, শাইনিং ইন্ডিয়া সেখানে যাবে কেন? তাই এদেরি আশীর্বাদধন্য এক নাটক কলকাতার হ্যামলেট-এ কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি স্লোগান দিতে দিতে একদল মানুষ কলকাতার মিছিল সংস্কৃতি কে চুড়ান্ত অপমান করে বসে, অথবা উইঙ্কল টুইঙ্কল জাতীয় নাটকে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে অধঃপতিত দেখিয়ে এক মহান অরাজনৈতিক আদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়। এরা সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে শামিল ছাত্রসমাজের সঙ্ঘবদ্ধ রূপ অক্লেশে দেখাতে পারে কাগজের প্রথম পাতায়, চীনার বিরূদ্ধে বিদ্রোহী তিব্বতি দের প্রতিবাদ আন্দোলনের ছবি ছাপতে পারে, কিন্তু খেটে খাওয়া শ্রমজীবি জনতার ছবি ছাপালে এদের হিক্কা ওঠে।

এই সূত্রেই গাঁথা এদের বইমেলা বিরোধীতা। ময়দানে বইমেলায় মফসসল থেকে মানুষ আসেন, হাতের কাছে পেয়ে যান অনেক বই। শুধু আনন্দের প্রভুদের নির্দেশিত বই-ই না, তার বাইরেও অসঙ্খ্য বই ও লিটল ম্যাগাজিন কাছে চলে আসে। কিন্তু এত মানুষের চেতনা যদি এরকমভাবে জাগরিত হয়, তাহলে এদের ধর্মে সইবে কেন? এর থেকে অনেক ভাল দিল্লী টাইপের কর্পোরেট অধ্যুষিত বইমেলা, যেখানে সাধারণে ঢুকতে ভয় পাবে। গ্রাম গঞ্জ মফসসলের মানুষের নাগালের বাইরে যেখানে শুধুই বিগ পাবলিশিং হাউসের একছত্র বাজার। পরিবেশ দূষণের অভি্যোগ তো একটা অজুহাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আদি দেশগলো প্রতিদিন যে বিলিয়ন বিলিয়ন টন বর্জ্য ফেলে সমুদ্রের বুকে, কারখানার আবর্জনা থেকে শুরু করে আমাজন অরণ্য কেটে সাফ করে রাবার প্ল্যান্ট বসিয়ে, ক্যান ক্যান বিয়ারের টিন ফেলে, ব্রাজিলের মাইলের পর মাইল কফি ক্ষেতে বোমারু বিমান থেকে বোমা ফেলে জ্বালিয়ে দিয়ে, পরিত্যক্ত পারমাণবিক চুল্লি্র রেডিয়েশন থেকে, সে বিষয়ে সুভাষবাবুরা নীরব কেন? সেগুলো সম্বন্ধে যা খবরাখবর দেবার সেটাও তো পেতে হয় সেই ঘৃণ্য নন্দন দেশহিতৈষী বা প্যামফ্লেটগুলো থেকেই। সুভাষবাবু পারবেন, এগুলোর বর্তমান হালহকিকত সম্বন্ধে কোনো খবরাখবর দিতে?

ব্রাজিলের আমাজন অরণ্য সাফ করে রাবার প্লান্ট স্থাপন করে অরন্য উচ্ছেদ ও আদিবাসি নির্মূলের মার্কিন বিগ ক্যাপিটালিস্ট ভেনচারের বিরুদ্ধে যে আদিবাসি-শ্রমিক যৌথ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই আন্দোলনের নেতা সোসালিস্ট ওয়ার্কার পার্টির সদস্য চিকো মেন্দিস কে ১৯৮৮ সালে পূঁজিপতি দের ভাড়াটে গুন্ডারা হত্যা করে, এবং মেন্দিসকে তারপর থেকে গণ্য করা হয় সারা পৃথিবীতে পরিবেশরক্ষার আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে। সেই চিকো মেন্দিসকে নিয়ে সুভাষবাবু বা আনন্দবাজার পত্রিকা ঠিক কতগুলো লাইনে খরচ করেছিল, এই হিসেবটা সুভাষবাবু যদি আমায় দেন, খুব ভাল হয় তাহলে। পরিবর্তে বইমেলায় বা ব্রিগেডে পরিবেশ দূষণ নিয়ে সুভাষবাবু বা আনন্দবাজার যা যা বলেছে এ পর্যন্ত, সব পরপর উনি চাইলে সাজিয়ে দেব আমি। কাগজের একপাশে থাকবে তারিখ, অন্যপাশে থাকবে সেই তারিখে কি কি সুভাষিতাবলি বর্ষিত হয়েছে, তার বিবরণ।

আসলে সরকারি উদ্যোগে যে কোন সুস্থ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই খোলা বাজারের ফেরিওয়ালাদের গায়ে ফোস্কা পড়ে। প্রতিবছর নন্দনে ফিল্মোতসব-এর সময় দেশ-এ সুচিন্তিত মতামত পড়ে, এভাবে সরকারী অর্থের নয়ছয় করে উতসব না করে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিলে মানুষের সুবিধে হয়, সরকারের দায় কমে, আর ফিল্মের গুণগত মান বাড়ে। বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিলে যদি সবকিছুর গুণগত মান বাড়ত তাহলে জানতে ইচ্ছে করে ওদের আনন্দলোক সীরিয়াস ফিল্মের পত্রিকা না হয়ে ওরকম একটি ভীষণ বস্তু হয়ে উঠল কেন! দেশ-বিদেশের ভাল ফিল্ম সম্বন্ধে এক লাইন-ও না লিখে শুধু বলিউডের নায়িকাদের শরীরবর্ণনা কেন! বেসরকারি মালিকানাতে প্রকাশিত কতগুলো বাণিজ্যিক পত্রিকা তে গদার, কপোলা, ফেলিনি, বার্গম্যান, নিদেনপক্ষে শ্যাম বেনেগালের কোনো ছবি নিয়ে আলোচনা হয়?

সুভাষ দত্তরা আসলে তুচ্ছ, ভাড়াটে সৈন্য মাত্র। এরা যে দিকে সুবিধে পাবে সে দিকেই ঝুঁকবে। এর থেকে অনেক বেশি উদবেগের হল গোটা রাষ্ট্রব্যাবস্থা যেরকমভাবে এক এক করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সেই বিষয়টা। প্রথমে মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা, তারপর ধর্মঘটের অধিকার, তারপর দেওয়াললিখন (মানে সাধারণ মানুষ দেওয়াল থেকে জানতে পারবে না কোন রাজনৈতিক দলের কোন প্রার্থী, মিটিং মিছিল ত আগেই নিষিদ্ধ। যাদের ক্ষমতা আছে তারা জানবে টিভি থেকে, যাদের নেই, তাদের আর রাজনীতি সচেতন হয়ে কি লাভ!), তারপর অতি সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি তে ছাত্রদের ভোটাভুটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া, তারপর এখন কোপ পড়েছে ব্রিগেডে মিটিং এর ওপর। আর সবক্ষেত্রেই এই মিডিয়াগুলো ঢক্কানিনাদ তুঙ্গে তুলছে- ছাত্র রাজনীতি নোংরা, দেওয়াললিখন বর্বর দেশের কাজ, মিছিলে নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হয়। বড় ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছে এরা।একদিকে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, অন্যদিকে আমাদের সংগ্রামী অতীত ভুলিয়ে দিয়ে মতাদর্শগত দিক দিয়ে পঙ্গু করার প্রয়াস। এই কাজে এদের স্বাভাবিক মিত্র দিল্লীর জোতদার-জমিদার শ্রেণী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ইয়াঙ্কি মতবাদ, আর সবচেয়ে বড় শত্রু বামপন্থীরা। কারণ ইতিহাস সাক্ষী, কোনো দেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি সবচেয়ে নিরাপদ কম্যুনিস্টদের হাতে। আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান সংস্কৃতির মহত্তম ধারক ও বাহক এই কম্যুনিস্টদের উচ্ছেদ করলেই অতীতের বিযুক্তিকরণ সম্ভব। তাই চোরাগোপ্তা মার। মিছিলের ওপর চোখরাঙ্গানি। তাই সুহৃদ দত্তরা আক্রান্ত হন। লালগড় বান্দোয়ান জুড়ে বামপন্থী কর্মীদের খুন হতে হয়। রবীন্দ্রনাথ পুড়তে থাকেন, বিবেকানন্দকে নিয়ে আস্ফালন করার সাহস রাখে গৈরিক বাহিনী। বইমেলা আক্রান্ত হয়। আমাদের সমস্ত লড়াইয়ের ইতিহাস, সিপাহী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তীতুমীর, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, স্বাধীনতা আন্দোলন, সবের ওপরে কালি ছিটিয়ে চলে মুতসুদ্দিরা। আর শুদ্ধ পুঁজির দিবাস্বপ্নে ভরপুর খোলা হাওয়ার এই ফেরিওয়ালারা আরো একদিন, আরো একবার আমাদের সমস্ত নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে স্ট্রীপ করায়।

আমাদের সামনে দুটো রাস্তা, বরাবরের মতই। মেনে নেওয়া অথবা রুখে দাঁড়ানো। মেনে নিলে সুভাষ দত্ত দের খুব সুবিধে হয়, আমাদের ক্লান্ত রূগ্ন অবক্ষয়ী জীবনযাত্রার ডকুমেন্টেশন আর গ্লোরিফিকেশন, দুটোই সার্থক হয়। আর যদি উল্টো রাস্তা বেছে নিতে হয়, তাহলে দেশানন্দের সমান্তরাল সাংস্কৃতিক ধারা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের আলোকপ্রাপ্ত অতীত যাতে কিছুতেই বৃহত পুঁজির হাতে হাইজ্যাক না হয়, নজর রাখতে হবে সেদিকে। ওরা যত মিছিল নিয়ে চেঁচাবে, আমরা তত বেশী মিছিল বার করব। তীতুমীর, লালন, নজরুল থেকে আইপিটিএ পর্যন্ত আমাদের সমস্ত মহত্তম পুর্বসাধকদের নাম স্লোগানের মত ছুঁড়ে দেব ওদের মুখের ওপর। দেওয়াল রাঙ্গিয়ে তুলব স্লোগান, পোস্টার আর গ্রাফিত্তি তে। রবীন্দ্রনাথ আমার, বঙ্কিম আমার, বিবেকানন্দ, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন সব আমার। এই ব্রিগেড, এই পরিবেশ, এই সবকিছুই আমাদের। একে রক্ষার দায়টাও আমাদের। আমরাই একে বাঁচাব। ব্রিগেডের আকাশ বাতাসে আগুন লাগিয়ে দেব লাল নিশানের রক্তে। চিকো মেন্দিসের হত্যাকারী আর তাদের ভাড়াটে পরিবেশবিদের সাধ্য হবে না ভবিষ্যতে পরিবেশের নাম মুখে আনতে!

আর যদি কিছুই না করে চুপচাপ সব মেনে নেই? সেটা তুলনামূলক সহজ রাস্তা। করতেই পারি। শুধু এক তথাকথিত অনামা লেখকের দুটি লাইন নিজেদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাইঃ আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর কোল্ড ক্রীম তখন আপনার ত্বকের গভীরে কাজ করে। আপনি যখন সুপ্ত অচেতন শোষক কীট তখন আপনার সর্বাঙ্গ কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলে। আমরা যখন আকাশের আনন্দে মগ্ন ফ্যাসীবাদ তখন নিঃশব্দে প্রবেশ করে।

৪টি মন্তব্য:

  1. dada gram theke manush na niye ese sohorer manush ke gram e niye giye sobha korun na. fanka jaiga dekhlei to apnader chokh tatay. footpath ke tai manush er cholachol er ojogyo kore rekhechen. 60 bochore india'r 2.5 khana state e chara er to kothaw thnai pelen na. dinkaal bodleche comrade, kata-tel, footpath dokhol, raasta bondho kore michil esob chere ektu saamner dike dekhun.

    উত্তরমুছুন
  2. nijer barir dewal joto khusi rangan na moshai naal, neel ba holi'r bandure rong makhiye. onyer koshtoparjito poisay rong kora dewal nai ba rangalen. er khamoka mrigi rugi bibekananda, burjoa kobi rabithakur, muslim der shotru anandamath er rochoyita bankimchandra, oder evaluation bangalr manush onek agei korechen. apnader er onader smoron koriye debar thikadari niye kaaj nei.
    er communist der hate songskriti bishesh kore 'kormo-songoskriti' koto nirapod sobai jaane. tai to 'do-it-know' er shunyo asfalon shune aschi eto din dhore.

    উত্তরমুছুন
  3. khub bhalo lekha. Sudhu.."ইতিহাস সাক্ষী, কোনো দেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি সবচেয়ে নিরাপদ কম্যুনিস্টদের হাতে।" etc kichu jaigai lekhok tar nijer motamot chapate chesta korechen, jodio ta bastob ke protifolityo kore naa.
    echaara baki lekha ta somporkye montobbyo nisproyojon.. tobe eei jaigata na bol-lei noe... "গোটা রাষ্ট্রব্যাবস্থা যেরকমভাবে এক এক করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সেই বিষয়টা। প্রথমে মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা, তারপর ধর্মঘটের অধিকার, তারপর দেওয়াললিখন (মানে সাধারণ মানুষ দেওয়াল থেকে জানতে পারবে না কোন রাজনৈতিক দলের কোন প্রার্থী, মিটিং মিছিল ত আগেই নিষিদ্ধ। যাদের ক্ষমতা আছে তারা জানবে টিভি থেকে, যাদের নেই, তাদের আর রাজনীতি সচেতন হয়ে কি লাভ!), তারপর অতি সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি তে ছাত্রদের ভোটাভুটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া, তারপর এখন কোপ পড়েছে ব্রিগেডে মিটিং এর ওপর। আর সবক্ষেত্রেই এই মিডিয়াগুলো ঢক্কানিনাদ তুঙ্গে তুলছে- ছাত্র রাজনীতি নোংরা, দেওয়াললিখন বর্বর দেশের কাজ, মিছিলে নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হয়। বড় ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছে এরা।একদিকে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, অন্যদিকে আমাদের সংগ্রামী অতীত ভুলিয়ে দিয়ে মতাদর্শগত দিক দিয়ে পঙ্গু করার প্রয়াস।" --- 100% ekmot... eei Anandabazari Aakromon aamra Singur er aandolon er somoy o dekhechi.. Kivabe nirlojjyovabe Rastro Sokty(CPIM) o Tatar Dalali kore Gorib manush er pet-e lathi mara bhodyo Unnoyon er mithya swopno feri kore manush khepiyeche eei Anandabazar.
    Ejatio ekti lekha upohar dewar jonnyo Sakya ke Abhinandan....
    Arup Chakraborty.

    উত্তরমুছুন
  4. anonymous ভাই বোন ইত্যাদিরা....

    কিসে যেন দম না থাকলে লোকে নাম বলে না?

    জাকগে, নিজের বাড়ির দেওয়াল তো রাঙ্গাবই স্যার, আপনার টা আপনাকেই অনুরোধ করছি।
    আর বেশি বিবেকানন্দ মাড়াবেন না, আনন্দবাজার রাগ করবে।

    do-it-now (ধরে নিলাম বানান ভুল টা নেহাত ই ভুল, অজ্ঞানতা নয়) এর পর আপনি অফিসে দেরি করতে পারেন না বলে রাগ হয়েছে?

    আর হ্যাঁ, দাদা/দিদিরা মনে হচ্ছে political economy-র বিষয়টায় এট্টু অজ্ঞ থেকে গেছেন, এমনকি আনন্দবাজারটাও মন দিয়ে পড়েন না, পিছিয়ে পড়েছেন একটু, তাই না?

    উত্তরমুছুন