NRC লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
NRC লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২০

আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে ~ আর্কাদি গাইদার

আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে।

প্রথমে আরএসএস আসামে 'বংগাল খেদা'র আগুনে ঘী ঢালবে। বাজপেয়ী আসাম আন্দোলনকে সমর্থন করে পার্লামেন্টে বক্তৃতা দেবে। তারপর আসামে গিয়ে বলবে 'এখানে বিদেশীরা এসে সব দখল করে নিচ্ছে। পাঞ্জাবে এরকম করলে আমরা কেটে টুকরো টুকরো করে দিতাম'। এরপর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে বাঙালিদের কচুকাটা আর বিতাড়ন চলবে। 
তারপর বরাক উপত্যকার বাঙালীদের আরএসএস বোঝাবে হিন্দু বাঙালী আমাদের আপন। মুসলিম বাঙালী বহিরাগত। তাদের এনআরসি করে বার করে দেবো। 
তারপর অহমীয়াদের বোঝাবে এনআরসি করে সব বাঙালিকে তাড়াবো। এরকম করে ১৯ লাখ বাঙালী আর সাথে কিছু কোল্যাটারাল হিসেবে বিহারী গোর্খা পাড়ি দেবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। সর্বানন্দ সোনেওয়াল বলবে বাজপেয়ীজি আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয়, আসাম আন্দোলনে ওনার অবদান চিরস্মরণীয়। এরপর ভীত বাঙালী হিন্দুকে বিজেপি বোঝাবে তোমাদের আবার ক্যা এনে ঢুকিয়ে নেবো। আমরাই তোমাদের রক্ষাকর্তা।

আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে।

কাশ্মীরে পন্ডিতদের ওপর আক্রমণের সময় কেন্দ্রে বিজেপির জোট সরকার। কাশ্মীরের গভর্নর আরএসএসের সদস্য জগমোহন পন্ডিতদের উদ্দেশ্য ঘোষণা করবে - ৩,৪ মাসের জন্যে জম্মুতে সাময়িক ভাবে আশ্রয় নাও। এরপর কাশ্মীরের পরিস্থিতি শান্ত করেই তোমাদের আবার ঢুকিয়ে নেবো। পন্ডিতদের স্থানান্তরিত করতে গাদা গাদা সরকারি বাস, প্লেনের আয়োজন করা হবে। এরপর দুবার বাজপেয়ীর সরকার আসবে। দুবার মোদীর সরকার আসবে। স্থানান্তরিত পন্ডিতরা সেই ক্যাম্পেই থাকবে। তার কারন প্রতিবার আপনার মতন বেয়াদবকে প্রশ্ন করবার অবকাশ রাখতে হবে - কাশ্মীরী পন্ডিতদের বিতাড়নের সময় আপনি কি করছিলেন? আর আপনি, যিনি অত খবর রাখেন না, তিনি ভুলেই যাবেন, যে বিতাড়নের সময় কেন্দ্রের সরকারের জোটসঙ্গী বিজেপি কাশ্মীরি পন্ডিতদের বিতাড়ণের সময় দেশজুড়ে রথযাত্রা করছিলো। আর কাশ্মীরি পন্ডিতদের ক্যাম্পে গিয়ে গিয়ে বছরে একবার বিজেপি নেতারা মুসলমানদের গালি দিয়ে বলবে - আমরাই তোমাদের রক্ষাকর্তা। 

আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে।

সেই পার্টিশনের পর থেকেই এই রাজ্যে এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাঙাল উদ্বাস্তুরা আসছে। এই রাজ্যে তো রীতিমতন আন্দোলন করে, সংগ্রাম করে তারা জমি, কাজের অধিকার পেয়েছে। আস্তে আস্তে কাগজ পেয়েছে, ভোটাধিকার পেয়েছে। ভোটাধিকার মানেই নাগরিক, এমনটাই আপনি জানবেন, কারন সংবিধানেই লেখা আছে একমাত্র নাগরিকদের নামই ভোটার তালিকায় উঠবে। এমতবস্থায় ২০০৩ এ বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী এনে বলবে এবার থেকে 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী'র সংজ্ঞা তৈরি হলো। যারাই সঠিক প্রনালী বা সঠিক কাগজ ছাড়া এই দেশে ঢুকবে, তারাই 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী'। এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা আর কখনো কোন উপায় দেশের নাগরিকত্ব পাবে না। শুধু তাই নয়, কারুর বাবা বা মা যদি 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী' হয়, সেও নাগরিকত্ব পাবে না।
এর ফলে কি হবে? এতদিন যেই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় এই দেশে এসেছে উদ্বাস্তু হয়ে, এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই সময়ের সাথে সাথে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড পেয়েছে, ২০০৩ এর এই আইনি সংশোধনীর পর তাদের এবার নাগরিকত্ব পাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। 

আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে। 

২০০৩ থেকে ২০১৪, বিজেপি বলছে আহা রে, এই উদ্বাস্তুদ্বের নাগরিকত্ব পাওয়া আরও সহজ করতে চাই আমরা, তাই তো আমরা ক্যা এনেছি। চলো ভাইসকল উদ্বাস্তু, তোমাদের আমরা আসাম থেকে তাড়িয়েছি, ২০০৩ এ নাগরিকত্ব পাওয়া আটকে দিয়েছি, এবার আমরা ক্যা আনছি বলে আমাদের ভগবান মেনে লাইনে দাড়িয়ে প্রথমে নিজেদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করো, তারপর আমাদের কাছে  নাগরিকত্ব ভিক্ষা চাও। আজ থেকে ১০ বছর পর আবার তখন আমরা সব বেয়াদবকে প্রশ্ন করবো - বাঙালি হিন্দুদের সমস্যার সময় আপনারা কি করছিলেন? 

আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে। 

এই ভাবেই এক হাত থেকে অন্য হাতে কয়েন চালান দেওয়ার ম্যাজিক দেখতে দেখতে আপনার চোখে যখন ঝিলিমিলি লেগে গেছে, সেই সময়কালে বাজপেয়ী আর যশবন্ত সিনহা বিলগ্নিকরণ মন্ত্রক খুলে ফেলবে, আর তাদের যোগ্য উত্তরসূরি নির্মলা সিতারমণ চুপিচুপি ঘোষণা করে দেবে, ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি করবার লক্ষ্যে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ঝটপট বেচে ফেলতে হবে।

আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে।

রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২০

এন-আর-সি যদি ১০০ বছর আগে হত ~ নির্মাল্য সেনগুপ্ত

ভারতে এন-আর-সি যদি ১০০ বছর আগে হত তাহলে সেই সময়কার বিখ্যাত লেখকরা তাদের গল্পে কিভাবে ব্যবহার করতেন? 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ

ধু ধু করিতেছে সেতুপুরের মাঠ। সোনালী বালির উপর চিকিচিকি দেখিয়া অপু ভাবিল, বাহ দিদিকে ডাকিয়া আনিলে ভাল হইত৷ দুর্গা এ যাবৎ অনেকবার তাহাকে বলিয়াছে যে সোনারঙা বালির খোঁজ লইয়া আনিলে অপুকে সে তাহার সঞ্চয় থেকে দুইখানি কড়ি দেবে৷ ওই কড়ির উপর অপুর বড়ই লোভ। সে একখানি গাছের ডাল ভাঙিয়া লইয়া বালির উপর নকশা কাটিতে ব্যস্ত হইল৷ হরিহর কখন আসিবে সে জানে না৷ অপেক্ষা করা ছাড়া এখন উপায়ও নাই৷ দলিল সম্মন্ধে অপু মা'কে জিজ্ঞেস করিয়া উত্তর মেলে নাই কোনও৷ সর্বজয়ার মুখে সে শুনিয়াছে সুদূর দিল্লী নামক কোনও এক গ্রামে নরেন্দ্র মোদী নামক এক রাজা আছেন৷ তিনি প্রজাদের দলিল দেখিতে চান, নহিলে সবাইকে দেশছাড়া করিবে৷ অপু দিদিকে জিজ্ঞেস করিয়াছিল, "দিদি, তবে কি আমাদের নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যেতে হবে? সতুদারাও যাবে?" দুর্গাও এর উত্তর দিতে পারে নাই৷ 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ 

বৃষ্টি থামার কোনও নাম নেই আজ দুপুর থেকেই৷ ডাঁই করা ঘাসের উপর, চাল থেকে চুঁইয়ে টপ টপ করিয়া জলের ফোঁটা পড়িয়া পচা গন্ধ বাহির হইয়াছে বেশ৷ ঘরের ভিতর আদুড় গায়ে শুইয়া আছে মালতী৷ ঘরের ভিতরেও যে সুবাস ছড়াইতেছে তা বলিতে পারি না৷ মালতীর পায়ের কাছে ঘায়ের উপর মাছি ঘুরিতেছে ভনভন৷ সনাতন পাগলের মত ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজিয়া যাইতেছে কিছু। মালতী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়া রইয়াছে সনাতনের দিকে৷ তাহার পিঠের পেশী ওঠানামা করিতেছে জোরে জোরে। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ৷ ঠোঁটের কাছে অল্প বিস্কুটের গুঁড়ো লাগিয়া আছে এখনও৷ সনাতন বলিল, "কাগজ না পেলে ভিটেমাটি চাটি হবে বুঝেচ? অমন করে দেখচ কী? তোমার ভয় লাগে না?" 
মালতী খিলখিলিয়া হাসিয়া ওঠে। বলে, "যেখানেই যাই, যাব তো তোমার সঙ্গেই৷ আমাকে একা ফেলে পালাবে ভেবেচ নাকি? তা হবে না বাপু..." 

জীবনানন্দ দাশঃ 

একটা চুরুট জ্বালিয়ে মাল্যবান চেয়ারে বসে জানলার দিকে তাকাল। মিহি কোনও সুর ভেসে আসে ওই বাড়ি থেকে৷ সে সুরে কোনও কথা নেই, আকুতি নেই, আলো নেই। আলো কোনওদিন নিজের জীবনে চায়ওনি মাল্যবান। উৎপলা কি চেয়েছে? এই দুর্দিনেও উৎপলা শুয়ে থাকে৷ কেবল শুয়ে থাকে৷ জঙ্গলে আগুন লাগলেও যেমন সজারুর দল ভুলে যায় নদীর দিকে ছুটে চলার কথা। ঝাঁক ঝাঁক শকুন উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করে পোড়া মাংসের গন্ধ নাকে আসার, সেই তীব্র মোদ্দাফরাসের ন্যায় কিছু হিংস্র হায়না দাপিয়ে বেড়ায় হলুদ ফুলের মধ্য দিয়ে। বাতাসে বাতাসে ছাইয়ের সঙ্গে ফুলকি সখা পাতায় কখনও সখনো৷ মাল্যবান ভাবে৷ মিহি সেই সুরের তালে তালে তার চোখের সামনে কোনও কাগজের অবয়ব ফুটে ওঠে। অমিত শাহ কি জানে তার কথা? তার এই অন্ধকার ঘরের ভিতর উৎপলার এক মুহূর্তের ভালবাসার আখাঙখা, অথবা ভালবাসা নয়, শুধু বেঁচে থাকা। একটা অন্ধকার ঘরের ভিতর, সামান্য বেঁচে থাকা ইচ্ছে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ 

আমি ভাবিতাম, দেশছাড়া হওয়ার আশঙ্কা বুঝি শুধু আমার। আর কারও হৃদয়গহ্বরে তেমন কোনও উৎকণ্ঠার কারণ, তাহাদের উতলা করিতে পারে নাই আজও৷ তবু আজ এত লোকের সমবেত কণ্ঠস্বর আমাকে সামান্য একটু বল দিল৷ শুস্তা নদীটির উপলমুখরিত পথে নর্তকীর ন্যায় জলবারি, নৃত্য করিয়া চলিয়া যাইতেছে ক্রমাগত। নদীর কিনারে শৈলপদমূলে জড়ো হইয়াছে প্রায় দেড়শত লোক। গগনভেদী কণ্ঠে তাহারা সোচ্চারিত হইতেছে "হাম ছিনকে লেঙ্গে আজাদী..." 

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ 

ব্যোমকেশ সযত্নে খবরের কাগজটি পাট করিয়া টেবিলে রাখিল। একটি সিগারেট জ্বালাইয়া অন্যমনস্ক ভাবে তাকাইয়া রহিল কাগজটির দিকে৷ 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, "কী হল? নতুন কোনও কেস পেলে?" 

বাইরে হ্যারিসন রোডের উপর নবোদবুদ্ধ নগরীর পথে মানুষের ঢল৷ আমাদের এই বসিবার ঘরটির গবাক্ষপথে রাস্তার কিয়দংশ দেখা যায়। কাতারে কাতারে মানুষ নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে মিছিলে পথ হাঁটিতেছে। 

ব্যোমকেশ আমার প্রশ্নে সজোরে মাথা নাড়াইয়া কহিল, "আমি একটি পণ করেছি অজিত। যতদিন না সরকার এই আইন ফিরিয়ে নিচ্ছে, সরকারের কোনও কেসে ব্যোমকেশ বক্সী মাথা ঘামাবে না।" 

সত্যজিত রায়ঃ 

লালমোহনবাবু উত্তেজিত স্বরে বললেন, "বলেন কী মশাই! এই এন.আর.পি আইন সত্যিই লাঘু হবে নাকি?" 

আমি আড়চোখে ফেলুদার দিকে তাকালাম৷  রাস্তায় এত যানজট এর আগে আমরা দেখিনি৷ লালমোহনবাবুর সাম্প্রতিক উপন্যাসটা প্রায় ২০০০ কপি বিক্রি হওয়ায় তিনি আমাদের চাঙোয়া নিয়ে চলেছেন। সামনের লরিটা থেকে বেরোনো কালো ধোঁয়া মাঝেমধ্যেই গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন কালো করে দিচ্ছে। 

"ওটা এন-আর-সি। এন-আর-পি নয় লালমোহনবাবু। আর হ্যাঁ, লাঘু হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ করতে দেবে না৷" 

"সেটাই তো।" লালমোহনবাবু উত্তেজিত হয়ে সিটের পিছনে একটা পেল্লাই ঘুষি চালিয়ে বললেন, "একি ইয়ার্কি নাকি মশাই। আমার ভোটার আইডি আছে, ভোট দিয়েছি, এখন বলছে সেটা আমার প্রমাণপত্র নয়? ভাই তপেশ, তুমিই বল, এ কী সম্ভব?" 

শিবরাম চক্রবর্তীঃ 
বাড়ি থেকে বেরিয়েই হর্ষবর্ধন ভাবিত হন। ভাইকে ডেকে বলেন, "হ্যাঁ রে গোবরা, ধর আমাদের ধরে ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দিল। তারপরে কলকাতা ফিরতে পারব তো আবার?" 

গোবর্ধন বললে, "অত ভেব না তুমি৷ আসামে আমাদের সবাই চেনে৷ তোমারও গোটা আসাম নখদর্পনে৷ একটা কাগজ তুমি জোগাড় করতে পারবে না?"
"তা চেনে বইকি। যুদ্ধেও তো গিয়েছি আমি। যাইনি নাকি? এবার বলবে যে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাও? এমন টেনশনে কি ফেলতে পারবে আমাদের?" 

" না না।" তুমি ভয় পেও না দাদা। বাড়ির দলিলের বন্দোবস্ত করে আমরা আমাদের বস্তিতে ফিরে আসব৷ চিন্তা হয় শিব্রামবাবুকে নিয়ে।" 

"তাকে নিয়ে আবার কিসের চিন্তা?" হর্ষবর্ধন মাথা নেড়ে বলেন, "তার আবার চিন্তা কী? তার পিছুটান বলতে তো বোন আর ভাইপোরা। সম্পত্তি বলতে তার আছে কী? ওই বইগুলো? সে নাহয় বই নিয়েই উনি বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। এমনিও এখানে কেউ পড়ে না৷" 

"এমন বোল না৷ বন্ধু হয় কিনা আমাদের? তার জন্যেও নাহয় একটা কাগজ বের করে ফেলি আমরা। বলব, উনি হলেন বৌদির ভাই। কেমন হয়?"
"মন্দ বলিসনি তা। তবে এইসব ঝক্কি আমার পোষায় না বাপু। এইসব বন্ধ করলেই ভাল হয় সবথেকে৷ মোদীর জন্যে আমোদই করতে পারছি না শান্তিতে৷" 

"ঠিক বলেছ দাদা। তোমার সর্বধর্ম সমন্বয়ের পরিবর্তে এই ধর্মসর্বস্ব ঝঞ্ঝাট। এ কি ভাল লাগে বল?"

শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২০

প্রোটোকল ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য


দিল্লির  রাজা,সঙ্গে পেয়াদা সাথে সভাসদবর্গ
হবিদা বলেন আপনি তো স্যার ভারতবাসীর গর্ব।
এগোচ্ছে দেশ হইহই করে আপনি একাই একশো 
আরে রামরাম সিপিএম বাম হারামির হাতবাক্স।
দিলুদা হবিদা করে খুনসুটি ধনকর পান দুঃখ 
ভাবেন এসব ইনসাল্টিং কাঁটা বেধে অতি সূক্ষ্ম। 
ওদিকে তখন কিছু তিনোমূল গড়িয়াহাটার মঞ্চে
রাজাজি হাঠাও স্লোগান তুলেছে বিরিয়ানি খেয়ে লাঞ্চে।
রাজাজি শুধালো হাকিম সাহেব এসব যা শুনি সত্যি
হবিদা বলেন এসব গুজব নিউজ পেপার ভর্তি।
আছে সি বি আই, সাথে দেশি গাই দিলুদার মুখে স্বস্তি 
বিরোধীরা পাজি অপবাদ দেয় এসব সেটিং দোস্তি।
কত গ্যাড়াকল সাথে প্রোটোকল রাজভবনের কক্ষে
বাবু বলিলেন বুঝেছ উপেন পানি এসে যায় চক্ষে।।

সব চরিত্র কাল্পনিক 😐

রবিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২০

এনারসি ~ ডঃ কৌশিক দত্ত

সাগরমেলার আগে বাবুঘাটে একটা  ক্যাম্প হয় সন্ন্যাসী আর তীর্থযাত্রীদের জন্য। সেখানে আমি যাই সুযোগ পেলে। আগে যেতাম ভারত চিনতে। এখন তার সঙ্গে অন্য কিছু আকর্ষণও থাকে। সেখানে বাবাজি আসেন প্রায় প্রতিবছর। আমার যে গণিতজ্ঞ বন্ধুটি তাঁর বিশেষ অনুরক্ত, তিনি খবর দেন, "বাবাজি এসে গেছেন।" মানুষটির সারল্য এবং সদানন্দ ভাব আমাদের টানে। ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, এলোমেলো দাড়ি। গায়ে ময়লা চাদর। ক্যাম্পের ভেতরে যেখানে আরামদায়ক তাঁবু হয়, সেখানে থাকেন না। ক্যাম্পের ঠিক বাইরে একটা গাছতলায় খড় বিছিয়ে ধ্যানাসনে বসে থাকেন। সেখানেই রাত্রিবাস। মনকে স্থির করার জন্য এনার গঞ্জিকা প্রয়োজন হয় না, যোগের মাধ্যমেই পারেন। মেলার ক্যাম্পে তীর্থযাত্রীদের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত থাকে। কেউ রুটি তরকারি এনে দিলে খান মাঝেমাঝে। অন্য কোনো সামগ্রী গ্রহণ করতে দেখিনি। একবার একজন একটা কম্বল দিয়েছিল লাল রঙের ফুল আঁকা। শীতের রাতে তিনি সেটা আমাকে দিয়েছিলেন। গায়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাও, পরে অন্য কাউকে দিয়ে দিয়ো। এই ছিল নির্দেশ। আমি কম্বল গায়ে মেট্রোয় চড়েছি সেই একবারই। বাবাজি কথা বলেন খুব কম লোকের সঙ্গে৷ ঘটনাচক্রে আমাদের সঙ্গে বলেন। কথাগুলো সাধারণ্যে আলোচ্য নয়। 

এন আর সি হলে বাবাজির নাম উঠবে না, কারণ তাঁর কোনো কাগজই নেই। গোবর্ধন অঞ্চলে একসময় একটি আশ্রম কুটির বানিয়েছিলেন। সেটা ঝড়ে ভেঙে যাবার পর ওঁর মনে হল কৃষ্ণ বলছেন, এসব ঘরদোর ভালো না। প্রকৃত গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীকে নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র দেবার হিম্মত রাষ্ট্রের এখনো হয়নি। কিন্তু তাঁর দেশ, মাটি, আকাশ কেড়ে নেবার ক্ষমতা অবশ্যই আছে। এন আর সি হলে বাবাজি কয়েদ হবেন। "সি এ এ", যা নাকি হিন্দুদের রক্ষাকবচ, তা এই হিন্দু সন্ন্যাসীর কাজে আসবে না, কারণ তিনি বাঙলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসেননি। তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয়। 

"তাহলে কী হবে বাবাজি?" 

"কিষণ ভগবান জানে।" হাসেন বাবাজি। "আরে বো কানহাইয়া বড়া অটোমেটিক হ্যায়। সব জান লেতা হ্যায়।"

বোঝা গেল। সন্ন্যাসীর প্রাণে ভয় নেই, কারণ সেখানে কৃষ্ণ আছেন। হয়ত কারাগারেই তিনি কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাবেন, যেমন পেয়েছিলেন দেবকী-বসুদেব। কারাগারটি যে আদতে কংসের, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকবে না। কারাগারে কৃষ্ণ আবির্ভূত হলে কংসের কী গতি হয়, তাও আমরা জানি। তবু আমরা সামান্য মানুষ। বাবাজির জন্য চিন্তা হয়। যদি দেখি এন আর সি-র পর আর তিনি সাগরমেলায় আসছেন না… 

ও হরি! তখন আর কেই বা আসবে মেলায়? তীর্থযাত্রীদের যা দেখেছি এত বছর ধরে, কটা কাঠকুটো বস্তায় নিয়ে গঙ্গা মাঈয়ার ভরসায় বেরিয়ে পড়েছে রাজস্থানের গ্রাম থেকে… কীভাবে ফিরবে জানে না, কাগজপত্র না থাকায় এরা অনেকেই পাকিস্তানি বলে চিহ্নিত হবে। সন্ন্যাসীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। নিরঞ্জনী আখড়া, জুনা আখড়া, ভোলা গিরির আশ্রম উজাড় হয়ে যাবে। হৃষিকেশ, বদ্রিনাথ, নর্মদার তীর থেকে পুলিশ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে সহস্র সন্ন্যাসীকে। থাকবে শুধু মোদী-আম্বানি-আদানি-শাহী। আমেরিকা, সৌদি আরব থেকে তাঁরা আমদানি করবেন শকুন। রপ্তানি করবেন ভারতবর্ষ।

রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯

সত্যি কি বহু বাঙালি অনুপ্রবেশকারী? ~ বাঁচার লড়াই

সত্যি কি বহু বাঙালি অনুপ্রবেশকারী?? Census কি বলে??

যদি পশ্চিমবঙ্গে গত ৩-৪দশক ধরে কোটি কোটি লোকজন ঢুকে কার্ড পেয়ে বসবাস শুরু করে থাকেন তাহলে এই রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার  (population growth rate) সারা দেশের তুলনায় বেশি হত, তাই তো? হিন্দু বাঙাল অথবা মুসলমান কারুর না কারুর  জনসংখ্যা তো খুব বাড়বে? কারণ  তাহলে জন্ম-মৃত্যু বৃদ্ধি ছাড়াও immigrationর জন্যেও অনেকটা যোগ হবে। তাই না?? ...এইটা এমন একটা hypothesis যেটা সহজেই পরীক্ষা করা যায়.....😊... 
শীতের ছুটির দুপুরে এইটা একটু দেখাই যায়। census তথ্য তো হাতের কাছেই আছে.... 😊 গুগল থেকে বেরোল 1981, 1991, 2001 আর 2011র census। আর ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে রিপোর্ট।

পশ্চিম বঙ্গ জনসংখ্যা:
1981: 54580647.
1991: 68077965
2001: 80176197
2011: 91276115

বৃদ্ধির হার: 
(1981-91) : 24.7%;  (1991-2001) :17.8%;  (2001-2011) :13.8%. 
কি দেখছেন? হার বাড়ার কোন লক্ষণ নেই। দিব্বি কমছে। গত তিন দশক ধরে কমছে। 

আচ্ছা , বাঙালি হিন্দুরা? তাদের জনসংখ্যা  কেমন?
1981: 42005266
1991: 50866624
2001:58104835
2011: 64385546
বাঙালি হিন্দুর বৃদ্ধির হার কেমন?
(1981-91) 21.1%; 
(1991-2001) 14.2% ;  (2001-2011)  10.8 %. 
আবার দেখুন। কমছে। গত তিন দশক ধরে কমছে। কুড়ি বছরে 21 থেকে 10এ নেমেছে। 

মুসলমানগুলোর দেখি। জনসংখ্যা
1981: 11740297
1991: 16075836 
2001: 20240543
2011: 24654825 
বাঙালি মুসলমানের বৃদ্ধির হার?
(1981-91) 36.9%; 
(1991-2001)  25.9% ;  (2001-2011) 21.8 %. 
এও কমছে! 36 থেকে 21শে নেমেছে।

এবার এর পাশে সারা দেশের হিসেব ফেলুন। জাতীয় স্তরে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার।
1981 (24.1%), 1991 (22.7%), 2001 (19.9%), 2011 (16.8%) 
মুসলমানের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার।
1981 (30.9%), 1991 (32.9%), 2001 (29.5%), 2011 (22.6%)

কি দাঁড়াল ব্যাপারটা? ওরা যতই বলুক, 

১. গত ৩০-৪০ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিশ্চিতভাবে কমছে।  কোন সন্দেহ নেই।

২.   গত ৩০-৪০ বছরে পশ্চিমবঙ্গ'র  জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বভারতীয় গড়ের থেকেও বেশি কমেছে।  জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিম বঙ্গ একদম one of the best. 

৩. বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান দুজনেই জাতীয় গড়ের থেকে কম । 1991 থেকে বাঙালি হিন্দুরা ব্যাপারটা কন্ট্রোল আনতে ভাল শুরু করেছেন, 2001 থেকে বাঙালি মুসলমানরা। আর এটা কিছুটা বোঝাও যায়। উত্তর ভারতের অনেক লোকের থেকে বাঙালি ঘরে কম ছেলেমেয়ে হয় কি না?না না কারনে বাঙালি এই বিষয়ে বেশি সচেতন, সে তো নিজেদেরকেই আমরা চিনি।

৪.  কোটি কোটি লোক বর্ডার পার করে এলে ফলাফল যে অন্য রকম হত বুঝতেই পারছেন।

৫. যাদের ঝগড়া লাগানো কাজ তারা বলতেই পারে যে বর্ডারের পাশের জেলাগুলো'র জনসংখ্যা ভাল করে দেখতে হবে।আচ্ছা, তাই হোক।  পরিসংখ্যান তো আছেই। প্রথমেই যেটা নজরে আসে সেটা হল এই জেলাগুলির কোন নির্দিষ্ট প্রবণতা নেই। কোন কোন জেলায় বৃদ্ধির হার পশ্চিমবঙ্গের গড় হারের থেকে বেশি ( যেমন উত্তর দিনাজপুর, মালদা ); কোন কোন জেলায় গড় হারের চেয়ে কম  ( যেমন নদীয়া, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ). আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যে জেলায় হিন্দুদের বৃদ্ধির হার বেশি, সেখানে মুসলমানদের বৃদ্ধির হার ও বেশি; যেখানে হিন্দুরা কম সেখানেও মুসলমানরাও কম।  

৬. এই বৃদ্ধির হার কি ভাবে কমে যাচ্ছে সেটা পশ্চিমবঙ্গের গড় মহিলার total fertility rate (এক মহিলার জীবনে কটা ছেলেমেয়ে হয়) দেখলেও বোঝা যায়। গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। এই ব্যাপারে কেরলা যে  আরেক দারুন সচেতন রাজ্য সবাই জানি। এই দেখুন । পাশাপাশি পঃবঃ, কেরলা আর উত্তর প্রদেশ দেখুন। 

হিন্দু TFR: wb (1.64), up (2.67), kerala (1.42), India (2.13)

মুসলমান: wb (2.08), up (3.10), kerala ( 1.86), India (2.61)। UP (আর বিহার , রাজস্থান...) উচিত বাঙালি আর মালায়লিদের  দেখে শেখা!! আমরা সব ব্যাপারেই মুসলমানদের দোষ দিই। কিন্তু দেখুন, বাঙালি মুসলমান মহিলার চেয়ে বেশি বাচ্ছা হয় UP হিন্দু মহিলার !!

৭. তাহলে ব্যাপারটা ধর্মভিত্তিক নয়। রাজ্য ভিত্তিক। পড়াশোনা, মহিলাদের শিক্ষা, রাজ্যের সার্বিক চিন্তাভাবনার পরিবেশের সঙ্গে চলে। সারা পৃথিবী জুড়ে who আর unicef  জানিয়েছে যে যত মহিলারা  শিক্ষিত হবেন, কাজকর্ম চাকরিবাকরি করবেন তত এক গাদা ছেলেমেয়ে হওয়া কমে যাবে। আর দেখুন, পঃবঃ আর কেরলা সেই প্রগতিশীল পথেই হেঁটেছে। আর বাঙালি মুসলমানরা যে এখনো পিছিয়ে আছে তার অন্যতম কারণ মহিলাদের মধ্যে অশিক্ষার হার এখনো বেশি । তবে শিক্ষা বাড়ছে। বাইরে বেরোচ্ছেন। পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছেন। censusএ তার ফল দেখাই যাচ্ছে। একই জিনিস পঃবঃ 'র জেলাগুলির জন্যেও প্রযোজ্য।  মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর গড় শিক্ষার হার কম; অন্য জেলায় বেশি।  আর এ বিষযে বেস্ট হল কলকাতা - শিক্ষার হার সর্বোচ্চ, হিন্দু এবং মুসলমান দুজনেরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম; কলকাতার  মুসলমানদের তো  হিন্দুদের থেকেও কম! 

৯. তার মানে কি এই যে কেউ আসেনি? নিশ্চয়ই এসেছেন। পেটের দায়ে এসেছেন । আত্মীয়স্বজন ডেকেছেন চলে এসেছেন। আর বাঙালি তো দুবার দেশভাগ-ভোগা জাত, এই কষ্ট আর কে বুঝবে?? কিন্তু, যাবতীয় সমীক্ষা পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে যে এমন বিশাল সংখ্যায় কেউ আসেননি যে পশ্চিমবঙ্গের জনমানচিত্র আমূল পাল্টে যাবে। ওটা ভোটের জন্যে ঢপ! ওই 15 লাখ আর গরুর দুধে সোনার মত আরেকটা গাঁজা! তাই, বাঙাল-ঘটি-বামুন-লেড়ে -কায়েত-বদ্যি-নমশূদ্র সবাইকে অনুপ্রবেশকারী না বলে নিজেরা তো ভাল করে নিজের রাজ্যে বার্থকন্ট্রল করতে পারে !!

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মিছিল ~ শতাব্দী দাস

লাল পতাকার পিছনে তো অনেক বার হেঁটেছি। কিন্তু লক্ষ্য করেছেন কি, যে রাগী ছেলেমেয়েগুলো স্বাধীনতা দিবস এলেই 'আমি তো দেশদ্রোহী' থিমে স্টেটাস দেয়, তাদের হাতে কাল জাতীয় পতাকাও ছিল? 

তাদের আগেও বলেছিলাম, দেশ বিজেপির বাপের নয়,  গোসন্তানদের উপর রাগ করে তিরঙ্গার অধিকার ছেড়ে দিতে নেই । বোঝাতে পারিনি৷  বিজেপি দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়ে দিল। ধন্যবাদ বিজেপি। 

লক্ষ্য করেছেন কি, প্রধানমন্ত্রী যে 'পোষাকের' হাতে শুধু পাথর দেখেন, সে পোষাকের হাতেও কাল জাতীয় পতাকাই ছিল? কাল ছিল প্রকৃত অর্থেই জাতীয় পতাকা রিক্লেইম করার দিন৷ কোনো বাধ্যতামূলক স্বাধীনতা দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবস পালনে তিন-রঙা  ততটা খোলতাই হয় না, যতটা কালকের মিছিলে হয়েছিল। 

 লক্ষ্য করেছিলেন কি, এখানে-ওখানে দুয়েকটা রামধনু নিশানও উড়ছিল?  মানে সাতরঙা জেন্ডার স্পেক্ট্রামের মানুষজন নিজেদের 'দেশ' বুঝে নিতে এসেছিলেন! 

লক্ষ্য করেছিলেন কি  ' মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে'-র পরের লাইন হয়ে গেছে 'মোদী দূর হঠো'? লক্ষ্য করেছিলেন কি, ওরা রাস্তায় আটকে পড়লেই বৃত্ত রচনা করে নিচ্ছিল, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাচছিল? লক্ষ্য করেছিলেন কি, এস এন ব্যানার্জি রোডে ম্যাটাডোরের মাথায় বসা স্থানীয় শিশু ওদের নাচের তালে তালি দিয়েছিল? 

লক্ষ্য করেছিলেন কি, রাস্তা  যেন কলেজ ক্যান্টিন? চা আসছে, বাদামভাজা, সিগ্রেট...কিছু অ্যান্টি ন্যাশনাল দোকানদার বিনে পয়সাতেও চিপস বিস্কিট খাইয়েছেন! কাউন্টারে সিগ্রেট খেয়েছি অনেক, কাউন্টারে এগরোল এই প্রথম।  সেই রোল যে হাতে দিয়ে গেল, তাকে চিনিনা। তাকে যে দোকানী দিয়েছিল,  পয়সা নিয়েছিল কি  সে-ও? 

দুটো মিছিলে হেঁটে ক্লান্ত পা টেনে মেট্রোয় ঢুকছি। গালে 'নো এনআরসি' দেখে পুলিস বলছে,  'বেশ করেছ'!  পুলিশের জন্য কষ্ট হয়। রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে এই পুলিসকেই ফাইবারের লাঠি দিয়ে মিছিল পেটাতে হত। 

বাড়ির স্টেশন।  যে লটারি টিকিটওয়ালাকে কোনোদিন লক্ষ্য করিনি, সে গালের লেখা দেখে বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ'। প্রথমবার  জিগ্যেস করলাম, 'নাম কী আপনার?' একটি হিন্দু নামই বলল। 

 বাড়িতে 'নো-এন-আর-সি' গালে একটা চুমু খেল সাতবছর, 'নো সি-এ-এ' গালে আরেকটা। টিভিতে দেখলাম, মহামান্য দিলীপবাবু রামচন্দ্র গুহ সম্পর্কে বলছেন, 'কে বুদ্ধিজীবী আর কে নয়, তা সরকার ঠিক করবে।' স্পষ্ট ফ্যাসিবাদী উচ্চারণ। 

ফ্যাসিবাদ  ঘেন্না করি, ফ্যসিবাদ ভয় পাই। কিন্তু শীতের মিছিলের এমন সে আগুন, সেই মুহূর্তে আমি আর সাতবছর দু'জনেই এক বোকা অপোগণ্ডের কথায় ফ্যাক করে হেসে ফেললাম!

মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

আপনি কি হিন্দু? ~ সুশোভন পাত্র

এক্সকিউস মি! আপনি কি হিন্দু? তাহলে চাপ নেবেন না প্লিজ। বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
দেখলেন না কেমন কায়দা করে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানে ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার 'হিন্দু শরণার্থীদের' নাগরিকত্ব দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল। মাস্টারস্ট্রোক! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার বলছেন "দেশ জুড়ে NRC হবে।" হুইস্কি অন দি রক্স। জাস্ট ভাবুন, কাল সকালে পশ্চিমবঙ্গে NRC চালু হচ্ছে। এক লহমায় আপনি-আমি, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ রাজ্যের ৯কোটি মানুষ অ-নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। ঘরে রাত জেগে চলছে পুরনো নথি জোগাড়ের চিরুনি তল্লাশি। আপনি অফিস-স্কুল-কাছারি ছেড়ে, আপনার বৌ ছোলার ডালটা সেদ্ধ করতে ওভেনে বসিয়ে, আপনার বুড়ো বাপ হাঁপানি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে, আপনার মা বাতের ব্যথা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, দিনের পর দিন সরকারী অফিসের চক্কর কাটছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের সম্ভাব্য নথি হাতে নিয়ে আর পরিচয় হারানোর দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে। কি থ্রিলিং ব্যাপার তাই না? আমার তো মশাই ভেবেই কেমন একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে! আর আপনার?
জমা দেওয়া নথি বিজেপির পছন্দ হলেই কেল্লাফতে। আপনি হলেন গিয়ে 'নাগরিক'। আর বাদ পড়লে 'অ-নাগরিক'। ঐ যেমন আসামে বাদ পড়া ১৯লক্ষের ১২ লক্ষই হিন্দু। কিন্তু আপনি একদম ঘাবড়াবেন না! মনে মনে ১০৮বার বলবেন 'মাস্টারস্ট্রোক।' তারপর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আবেদন করবেন। সিম্পল! 
ধরুন আপনি ৫পুরুষ ধরে এদেশে আছেন, রেশন তুলেছেন, পড়াশুনা করেছেন, চাকরি পেয়েছেন, এমনকি এই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কে ভোটও দিয়েছেন; কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি আপনি গুগল সার্চ করেও জোগাড় করতে পারেন নি। তাহলে আর কি? 'পুরানো সেই দিনের কথা' ভুলে গিয়ে, নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আবেদন করে, জাস্ট স্বীকার করে নিতে হবে যে আপনি এতদিন এদেশে ছিলেন 'অবৈধ শরণার্থী' হয়ে আর বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ধর্মীয় নিপীড়নের তাড়া খেয়ে। ব্যাস! তারপর ধর্মীয় নিপীড়নের ছোট্ট একটা প্রমাণ ঠুকে দিলেই ল্যাঠা চুকে গেলো। এবার বিজেপির আশীর্বাদ পেলেই আপনি কমপক্ষে ৫বছরের জন্য হয়ে যাবেন 'বৈধ শরণার্থী'। মানে ছিলেন 'নাগরিক' হবেন 'বৈধ শরণার্থী'। কিউট ব্যাপার না? হিন্দু হয়ে এইটুকু স্যাকরিফাইস করবেন না মশাই? কাম-অন। মনে রাখবেন বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
অমিত শাহ বলেছেন, নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনের ফলে "লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি" মানুষ উপকৃত হবেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হিসেব, সুবিধা পাবেন গোটা দেশে মাত্র ৩১,৩১৩ জন। ২৫,৪৪৭ জন হিন্দু, ৫,৮০৭ জন শিখ, খ্রিস্টান ৫৫ জন, ২ জন বৌদ্ধ, ২ জন পার্সি। তা শুধুমাত্র এই ৩১,৩১৩ জন মানুষ কে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য দেশের ১৩২ কোটি মানুষ কে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা কি মশা মারতে কামান দাগার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে স্কুলের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে? এরকম প্রশ্ন যদি কেউ করে তাহলে বুঝবেন সে 'দেশদ্রোহী'। হিন্দু হিসেবে আপনার কর্তব্য চোখ-কান বন্ধ রেখে, বুদ্ধি-বিবেক বেচে দিয়ে, দিনের দু-বার গোমূত্র সেবন করে, বিজেপির উপর পূর্ণ আস্থা বজায় রাখা। 
আপনার নোট বাতিল মনে নেই? আচ্ছা বুকে হাত রেখে একজনও হিন্দুর নাম আপনি বলতে পারবেন যাকে নোট বাতিলের সময় ATM-র লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল? পারবেন না। কারণ, হিন্দুরা তো তখন শীতের সকালে ব্যালকনির মিঠে রোদ্দুরে বসে গ্রিন টি খাচ্ছিল আর ব্যাঙ্ক গুলো হিন্দুদের বাড়ি বয়ে নগদ জোগান দিয়ে গিয়েছিল। সে RBI যতই বলুক নোট বাতিলে কোন কালো টাকা উদ্ধার হয়নি, জাল নোট ধরা পড়েনি, দেশকে ক্যাশলেশ করা যায়নি। রঘুরাম রাজন যতই চিৎকার করুক নোট বাতিলে কারও কোন লাভ হয়নি। খবরদার বিশ্বাস করবেন না। কারণ আপনি চোখের সামনে দেখেছেন নোট বাতিলের পরই জয় শাহ'র কোম্পানির রেভিনিউ বেড়েছিল ১৬,০০০%। আর অমিত শাহ পরিচালিত সমবায় ব্যাঙ্কে জমা পড়েছিল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩,১১৮ কোটির বাতিল নোট। তাহলে কোন হরিদাস পাল বলে যে নোট বাতিলে হিন্দুদের লাভ হয়নি? এঁরা দুজন কি হিন্দু নয়? বললাম না, বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
নিন্দুকে বলছে, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার নাকি ৪.৫%। ৬বছরে সর্বনিম্ন। এতে কি হিন্দুদের কোন ক্ষতি হচ্ছে? এক্কেবারেই না। হিন্দুদের জিডিপি তো মোদীজি আলাদা করে ক্যালকুলেশন করছেন। এই যে দেশে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। কি ভাবছেন হিন্দুদের বেকারত্বের জ্বালায় ভুগতে হচ্ছে? এক্কেবারেই না। দেশে হিন্দু বেকার গ্যালিলিও নিজেও দূরবীন দিয়ে খুঁজে পাবেন না। এই যে অটো-মোবাইল সেক্টরে সেল ২১বছরে সর্বনিম্ন, কারখানার ঝাঁপ পড়ছে। এই যে ঋণের দায়ে দেশে ১২হাজার কৃষক বছরে গড়ে আত্মহত্যা করেছ। চেষ্টা করলেও এতে আপনি একজনও ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু শ্রমিক-কৃষক দেখাতে পারবেন না!
রাম রাজত্বে বাজারে পেঁয়াজের ১৫০টাকা/কেজি বিক্রি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু হিন্দুরা আজকাল পেঁয়াজ ফ্রিতেই পাচ্ছে। উচ্চ-শিক্ষার ফিস দেশে আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু হিন্দুদের তো কলেজে ফ্রিতেই অ্যাডমিশন দিচ্ছে। বিদেশি অপশক্তির হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতে ১১৭ দেশের মধ্যে ১০২-এ ঠিকই, কিন্তু গুপী-বাঘার মত তালি ঠুকলেই সরকার হিন্দুদের মণ্ডা-মিঠাই সাপ্লাই দিচ্ছে। গ্যাস সিলিন্ডারে এক্সট্রা ভর্তুকি দিচ্ছে, PF-এ বর্ধিত হারে সুদ বসাচ্ছে। এমনকি হিন্দুদের পাম্পের আশে পাশে দেখতে পেলেই সরকার ধরে বেঁধে সস্তায় গাড়িতে পেট্রোল-ডিজেল ফুল টাঙ্কি করে দিচ্ছে। 
বিশ্বাস না হলে সম্প্রতি ফোর্বসে প্রকাশিত ১০০জন ধনীতম ভারতীয়দের তালিকা দেখুন। ৮ধাপ উঠে দ্বিতীয় স্থানে আছেন গৌতম আদানি। আর এই নিয়ে টানা ১২বছর প্রথম স্থানে মুকেশ আম্বানি। ২০১৪-২০১৯, মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি ১.৬৮লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ৩.৬৫লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১১৮%। আর  গৌতম আদানির সম্পত্তি ৫০.৪ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১.১লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১২১%। তাহলেই বুঝুন, আদানি কিম্বা আম্বানির মত হিন্দুরা মোদীজির আশীর্বাদে এই পাঁচ বছরে কত্ত উন্নতি করেছেন। 
ও! বাই দা ওয়ে, আপনিও তো মশাই হিন্দু। তা এই ৫ বছরে মোদীজির আশীর্বাদ আপনার সম্পত্তি কত শতাংশ বেড়েছে? ১১৮%? ১২১%? না অমিত শাহ'র ব্যাটা জয় শাহর মত এক্কেরে ১৬,০০০%?

শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

নিজের দেশে রিফিউজি হব? ~ পিপল্‌স স্টাডি সার্কেল

"নিজের দেশে রিফিউজি হব? : প্রশ্নোত্তরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব বিল (সিএবি)" (প্রকাশক পিপল্‌স স্টাডি সার্কেল, নভেম্বর ২০১৯) থেকে কিছু তথ্য --

পশ্চিমবাংলায় এনআরসি কি আদৌ প্রয়োজন?

সারা রাজ্যের মানুষকে যদি এখন সত্তর বছরের পুরনো দলিল দেখিয়ে নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করতে হয়, তাহলে জনজীবনে ঘোর সংকট তৈরি হবে। কে "সন্দেহভাজন নাগরিক" আর কে সাচ্চা নাগরিক, সেই নিয়ে সমাজে ব্যাপক ভীতি আর বিভেদ তৈরি হবে। এসব করে মানুষের কী লাভ হবে? বর্তমানে আমাদের রাজ্যে ৯ কোটি ৩৯ লাখ মানুষের আধার কার্ড আছে, ৬ কোটি ৯৭ লাখ মানুষের ভোটার তালিকায় নাম আছে। এছাড়াও রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, পাসপোর্ট, ব্যাংকের খাতা ইত্যাদির মত কোনও না কোনও পরিচয়পত্র বেশিরভাগ মানুষের কাছেই আছে। এটাই তো নাগরিকত্বের জন্য যথেষ্ট। এর ওপর আবার একটা জাতীয় পরিচয়পত্র বানানোর কোনও প্রয়োজন তো নেই-ই। উপরন্তু ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মত একটা উদ্বাস্তু-বিরোধী একুশে আইনের অধীনে কোনওরকম এনপিআর, এনআরসি, বা এনআরআইসি প্রক্রিয়া চালানোর সর্বাত্মক বিরোধিতা করা দরকার। এই আইনটাকেই বাতিল করতে হবে।
       
বিজেপি বলছে হিন্দুদের ভয় নেই। আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি পাশ করা হবে, তারপর এনআরসি হবে। এই সিএবি (ক্যাব) বিল ব্যাপারটা কি?

মোদী সরকার ২০১৬ সালে এই বিলটা আনে। এই বিল অনুযায়ী পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, শিখ বা খ্রিস্টান হলে তিনি আর ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের সংজ্ঞা মোতাবেক "অবৈধ অভিবাসী" হিসেবে গণ্য হবেন না, এবং ছ'বছর এদেশে থাকার পর ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। কিন্তু এই দেশগুলি থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ যদি মুসলমান হন তাহলে তিনি এই ছাড় পাবেন না, তাঁকে "অবৈধ অভিবাসী" হিসেবেই গণ্য করা হবে। 

তার মানে ক্যাব বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন/বিল সমস্ত হিন্দু উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিক বানিয়ে দেবে?      

ভুল প্রচার। সিএবি (ক্যাব) বিল কাউকেই সরাসরি নাগরিকত্ব দেবে না। অন্যের মুখের কথা না শুনে নিজে সরকারের পাতা থেকে ডাইনলোড করে পড়ে দেখুন। বিল কী বলছে? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের "অবৈধ অভিবাসী" অর্থাৎ বিদেশি হিসেবে গণ্য করা হবে না, শরণার্থী হিসেবে দেখা হবে। এটুকুই বিলের বক্তব্য। ধরে নিলাম সংসদে বিল পাশ হল, ধরে নিলাম বিল আইনও হয়ে গেল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশ থেকে এতদিন ধরে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। তাঁরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে থাকার আইনি সুরক্ষা পাবেন, এইটুকু। তাঁদের পুলিশ তক্ষুণি জেলে পুরে দেবে না বা বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেবে না।

কিন্তু নাগরিকত্ব পেতে হলে আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে আপনি ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত হয়ে ভারতে এসেছেন। ধরা যাক, আপনার পরিবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৬৫ সালে এসেছিল। ১৯৬৫-এর পর ৫৪ বছর চলে গেছে। এত বছর পর প্রমাণ করতে পারবেন যে ৫৪ বছর আগে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মের কারণে অত্যাচারিত হয়েছিলেন? মানুষ তো এদেশে নানা কারণে এসেছেন। অনেকেই চাকরি বা রোজগারের কারণে এসেছেন। অনেকেই জ্ঞাতি-গুষ্টি বা গ্রামের লোক চলে আসাতে এসেছেন। অনেকে এসেছেন দাঙ্গার কারণে। অনেকে এসেছেন ভয়ে। অনেকে এসেছেন নিরাপত্তার খোঁজে। অনেকে সরাসরি নিপীড়িত হয়েও এসেছেন। কিন্তু সেই অত্যাচারের সেলফি অথবা লাইভ ভিডিও তুলে ফেসবুকে তো আপলোড করে রাখেননি। সে সময়ে থানায় ডায়েরি তো করেননি। কীসের প্রমাণ দেবেন? দ্বিতীয় কথা হল এই যে আপনাকে নাগরিকত্বের জন্য ছ'বছর পর আলাদা আবেদন করতে হবে। সেই আবেদন সরকার খারিজও করতে পারে। 

তার মানে কী দাঁড়াল, একবার ভেবে দেখুন। এতদিন আপনি ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, বিপিএল কার্ড ইত্যাদি এতগুলো কাগজের সাহায্যে ন্যূনতম নাগরিক অধিকারটুকু পাচ্ছিলেন। বিলের এক খোঁচায় নাগরিক থেকে শরণার্থী হবেন। তারপর ছ'বছর পর নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবার ভিক্ষে করতে যাবেন সরকারের কাছে। এ এক বিরাট ধাপ্পা। এতে হিন্দু উদ্বাস্তুদের চরম ক্ষতি আর নাগরিক অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া ছাড়া আর কিছু নেই।

তাহলে মোদী সরকার সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ করাতে চাইছে কেন?

সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ করানোর একটাই উদ্দেশ্য। গোটা দেশে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভেদ আর মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করা। এই বিলে যেভাবে ইসলাম বাদ দিয়ে সমস্ত ধর্মের নাম নেওয়া হয়েছে, সেটা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বিরোধী। মানুষে মানুষে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা কানুন করা যাবে না এটা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মৌলিক কথা। এর উল্টোদিকে হেঁটে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করার আইন বানানো চলে না।

কেন্দ্রীয় সরকার যদি সত্যিই আমাদের পড়শি দেশগুলির সমস্ত নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের শরণার্থী হিসেবে ভারতের নাগরিকত্ব দিতে উদ্যোগী হত, তাহলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে থাকা আহমদী, সুফি সহ সংখ্যালঘু বা গৌণধর্মের যে মুসলমান গোষ্ঠীগুলি আছে, তাঁদের কথাও বিলে রাখত। যে নাস্তিকরা ধর্ম বিশ্বাস করেন না বলে সারা উপমহাদেশ জুড়ে আক্রান্ত, যে মুক্তমনা-রা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, তাঁদের কথাও বিলে থাকত। তাছাড়া এই বিলে মায়ানমার (বার্মা), নেপাল, ভূটান আর শ্রীলঙ্কার নাম বাদ কেন? কারণটা সহজ। মায়ানমারে রোহিঙ্গারা আক্রান্ত এবং তাঁরা মুসলমান। আক্রমণকারীরা বৌদ্ধ। নেপাল বা ভুটান থেকে যে গোর্খারা এসেছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের আক্রমণকারী হিসেবে দেখানো যাবে না। তাই এই দেশগুলি বাদ। 

তাছাড়া, ভারতের পড়শি দেশগুলিতে সংখ্যালঘু নিপীড়ন শুধুই ধর্মের নামে হয় না, ভাষা বা জাতিগত কারণেও হয়। যেমন শ্রীলঙ্কা থেকে নিপীড়িত হয়ে অনেক তামিল উদ্বাস্তুরা ভারতে এসেছেন। তাঁদের এই আইনের আওতায় আনা হয় নি কেন? বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী যে অত্যাচার চালিয়েছিল, সেটা তো ধর্মের ভিত্তিতে ছিল না। ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিদের ওপর দমন হয়েছিল এবং বাঙালি মুসলমানেরা চরম নিপীড়নের শিকার হন। সে অত্যাচার থেকে পালিয়ে কোনও বাঙালি মুসলমান যদি ভারতে এসে আশ্রয় নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনিও শরণার্থীর মর্যাদা পাবেন না কেন?

বোঝাই যাচ্ছে যে বিজেপি সরকার তার সাম্প্রদায়িক মুসলিম-বিদ্বেষী মতাদর্শ অনুসারেই এই বিলটা নিয়ে এসেছে। গরিব হিন্দু উদ্বাস্তুদের মিথ্যে আশা দিয়ে ঠকিয়ে বিষাক্ত হিন্দু-মুসলমান বিভাজন তৈরির কল ছাড়া এই বিলকে আর কী বলবেন?  
        
বিজেপি বলছে এগুলো বিরোধীদের অপপ্রচার। সিএবি (ক্যাব) বিল দিয়ে যে হিন্দু উদ্বাস্তুদের কোনও উপকার হবে না তার সরকারি প্রমাণ আছে?

প্রমাণ আছে। ২০১৬-র ক্যাব বিল নিয়ে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) আড়াই বছর ধরে আলাপ-আলোচনা এবং বিতর্ক চালিয়েছিল। বিতর্কে বিরোধী দলেরা নানা রকম প্রশ্ন করে, কেন্দ্রীয় সরকার তার জবাব দেয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সমস্তটা নিয়ে জেপিসি রিপোর্ট সংসদে পেশ হয়।

এই জেপিসি রিপোর্টের ৩৯ এবং ৪০ পাতার প্রতিটি বাক্যে যেন উদ্বাস্তুদের দুর্ভাগ্য জ্বলন্ত অক্ষরে লেখা। সরকারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে কীভাবে নাগরিকত্ব আবেদনের সত্যি-মিথ্যে যাচাই করা হবে, আর কোন উদ্বাস্তুরা এই আইনের সুবিধে পাবেন? তারা জবাব দেয় যে এ দেশে আসার আগে থেকেই যে উদ্বাস্তুরা জানিয়ে রেখেছেন যে তাঁরা অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে এসেছেন এবং যাঁদের লং টার্ম ভিসা দেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র তাঁদেরকেই এই আইনের সুবিধে দেওয়া হবে। নতুন করে এখন যাঁরা নিজেদের অত্যাচারিত হওয়ার ইতিহাস জানাবেন, তাঁদের কেসগুলো ইনটেলিজেন্স বুরো এবং রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা "র" (RAW)-এর গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখবেন। এই আধিকারিকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে মোট কতজন মানুষ এই আইনের সাহায্যে নাগরিকত্ব পেতে পারেন? তাদের জবাব, "হিন্দু – ২৫,৪৪৭, শিখ – ৫,৮০৭, খ্রিস্টান – ৫৫, বৌদ্ধ – ২, পার্সি -২, সব মিলিয়ে সারা দেশে ৩১,৩১৩ জন"। এটা আমাদের কথা নয়, সরকারের জবাব। জেপিসি কমিটির সদস্যরা আইন বিভাগের আমলা-মন্ত্রীদের জিজ্ঞেস করেছিলেন যে দেশজুড়ে শুধুমাত্র ৩১,৩১৩ জন মানুষ এই আইনের উপকৃতের আওতায় আসবেন, না সংখ্যাটা পরে বদলাতেও পারে? এতে সরকারের জবাব, মোট ওই ৩১,৩১৩ জনকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বাকিদের বরং বিদেশি ট্রাইবুনাল এর সামনে হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা কাগজ নকল করে নাগরিকত্ব পান নি। 

তার মানে যদি সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ হয়, তাহলে সারা ভারতে মাত্র ৩১,৩১৩ জন উদ্বাস্তু এখন নাগরিকত্ব পাবেন। আর ২০০৩-এর একুশে আইনটার ফাঁদে বানানো এনআরসি-র ছাঁকনিতে যে ১৯ লক্ষ মানুষ আসামের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁদের জন্য কাঁচকলা। এছাড়া নতুন করে যে মানুষেরা ২০০৩ আইনের "বেআইনি অভিবাসী"-র ফাঁদে পড়ে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়বেন, তাদের জন্যও কাঁচকলা। তাঁদের ভাগ্যে থাকবে ট্রাইবুনাল, কোর্টকাছারি, ডিটেনশন ক্যাম্প আর আবেদন-নিবেদন। 

তাহলে নাগরিকপঞ্জি বা ক্যাব করে কোনও লাভ নেই। কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়লেও তাদের বাংলাদেশে পাঠানো সম্ভব না। খালি সাধারণ মানুষকেই হয়রানি করা হবে। তার ওপর ভারতীয়দের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। মোটের ওপর এটা বলা যায়? 

হ্যাঁ। ২০০৩-এ পাতা ফাঁদে এনআরসি-র ছাঁকনিতে ধরা যদি পরেন, তবে ২০১৬-এর নাগরিকত্বের কল আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। আসামের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটাও শিখলাম যে যদি কোনওক্রমে আপনার নাম একবার নাগরিকপঞ্জিতে উঠেও যায়, তাহলেও শান্তি নেই। দেশপ্রেমিকরা সন্দেহ করে নালিশ করলে আবার সে নাম বাদও পড়তে পারে। দেশপ্রেমিকদের সন্দেহের ভিত্তিতে আপনার পিছনে নালিশের ফেউ এবং ঝুটা অবজেকশন দু'টোই লাগতে পারে। তারপর "র"-এর গোয়েন্দা বাহিনী এবং "ইন্টেলিজেন্স বুরো" আপনার ঠিকুজি কুষ্ঠি ঘাঁটতে বসবে। সবশেষে পড়ে থাকবে একটাই প্রশ্ন। বাঙাল বেলতলায় যায় কয়বার? 

এনআরসি আর ক্যাব নিয়ে মিথ্যে প্রচারটা বুঝলাম। কিন্তু একটা খটকা আছে। পশ্চিমবাংলায় কি সত্যিই দু' কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আছেন? 

না, এটা বিজেপি-র ছড়ানো গুজব। আসলে "বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী"-দের কোনও নির্দিষ্ট তথ্য বা সংখ্যা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা স্পষ্ট করে লিখিত ভাবেই এটা জানিয়ে দেয়।

সিটিজেন আইন ও এনআরসি ~ রোহন কুদ্দুস

যে মুসলমান সহনাগরিকের দিকে পাঁথর ছোঁড়েন, যে মুসলমান রাস্তায় আগুন জ্বালান, যে মুসলমান ক্যাবের বিরোধিতায় ভাঙচুর করেন, তাঁদের উসকানি দেয় রাজনীতি। সেই রাজনীতি, যা সংখ্যালঘুদের উন্নতির কথা আওড়ে তাদের বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করে নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে চায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে এ রাজ্যে মুসলমানদের কী উন্নতি হয়েছে সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই, কিন্তু সংখ্যাগুরু সমাজ থেকে তাদের আলাদা করে এনে তাদের প্রতি রাজ্যের অবশিষ্ট মানুষের অবিশ্বাস তৈরিতে মমতা পুরোপুরি সফল। রাজ্যটা তিনি সোনার থালায় বসিয়ে বিজেপি-র হাতে তুলে দিচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ যা মুসলমানদের নিয়ে করেছেন, বিজেপি সেই একই জিনিস হিন্দুদের নিয়ে করছে। আমার ছোটবেলায় 'ভোটব্যাঙ্ক' কথাটা মুসলমান শব্দের সঙ্গে জুড়ে ছিল। এখন দেখি সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু সবাই ভোটব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছে। ফলে মূল্যবৃদ্ধি থেকে বেকারত্ব, অর্থনীতির বৃদ্ধির হার থেকে কৃষকের দুর্দশা-- এসব নিয়ে একজোট হয়ে রাজাকে প্রশ্ন করার মতো মানুষ আর অবশিষ্ট নেই। তার ওপর বস্ত্র, বাসস্থান, খিদে-- এগুলোর থেকেও আরও গভীরে গিয়ে নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিয়ে রাজা নিশ্চিন্ত।

ক্যাবের ফলে হিন্দু 'শরণার্থী'রা নিরাপদ, ফলে ক্যাব সমর্থন করাই যায়-- এমন আগুনে হাত না সেঁকাই ভালো। ক্যাব কোনও বিচ্ছিন্ন আইন নয়। এর প্রয়োগ করা হচ্ছে আসামের এন আর সি-তে বিজেপি-র প্রতি তৈরি হওয়া অবিশ্বাসকে প্রশমিত করতে। আর এই এন আর সি কাকে ঘরছাড়া করবে আমরা কেউই জানি না। আবার ক্যাব মুসলমান 'রিফিউজি'দের প্রত্যাখ্যান করবে, অতএব মুসলমান হিসাবে রাস্তায় নামা দরকার, এমন চিন্তাও পাশে সরিয়ে রাখা আশু প্রয়োজন। ক্যাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হোক ধর্মনির্বিশেষে। মানুষের একজোট হওয়া জরুরি, তৃণমূল বা বিজেপি-- দু-দলেরই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে 'না' বলা জরুরি। রাজ্যটা 'নারায়ে তকবির' আর 'জয় শ্রীরাম'-এর মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে আগুন জ্বলবে সাধারণ মানুষের ঘরে, এই সহজ সত্যিটা আমাদের মাথায় ঢুকছে না!

বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৯

ডিটেনশন ক্যাম্পের আগে-পরে ~ সুস্মিতা ওঝা

হঁ আইজ্ঞা, হামিই ফালু দাসের বিটি, সন্ধ্যা দাস।
ঠিকানা নলবাড়ি, বরক্ষেত্রী ।
আর হঁ, লাশট  হামার বাপেরই ত বঠে!
তুমরা জীয়ন্ত মানুষটকে ক্যাম্পে লেগল্যে, 
বিদেশি ছাপ মার‍্যে! 
তারপর অত্যাচার কর‍্যে, গরু-মরা কর‍্যে 
লাশট হামদের কাছ আনল্যে! 
আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, সবই ত দিখাইনছিল,
ঘরের জমিন ট বন্ধক দিয়্যেঁ, কেস লড়ল্য বাপট।
তবু তুমরা মানল্যে নাই! 
কাঁদ্যে তুমাদের পায়ে পড়ল্যম, 
"বাপের আমার পেসার আছে, শরীলট ভাল নাই!"
তুমরা বিন চিকিচ্ছায় মার‍্যে ফেলল্যে হামার বাপ কে!
আজ তবে,  জীয়ন্ত বাপের বদলি
ই লাশট, ক্যেনে দিছ হামকে? 
ই বিদেশীটকে বিদেশে পাঠাইন দিছ নাই ক্যেনে? 
হামরা গরীব, পরের জমিতে খাট্যে খাই,
হামদের নিজদের জমিন হব্যেক কুথা লে? 
ই দেশট কি শুধই বড়লকের বঠে?
আর হামরা যারা গরীব, যাদের জমিন নাই,
খাট্যে খাই, দেশট তাদের লয়? 
হা রে, রাজার বেটারা, তুরা জমিন পালিস কুথা? 
হাজার হাজার বছর ধর‍্যে, যখন পাথর ভাঙ্যে, 
জঙ্গল কাট্যে জমিন বানাল্যম হামরা,
তুরা তখন ছিলিস কুথা? 
আজ তুরা জাত-ধম্মের লড়াই লাগাইঁ 
উঁচ'-নীচ'র বিচার সাজাইঁ,
হামদের জমিন লুঠেছিস, ঘরবাড়ি লুঠেছিস,
ইখন লুঠছিস দেশ! তবে জান্যে রাখ, 
ই দেশ ছাড়্যে হামরা কুথাকে নাই যাব।
ই লুঠেরা আইন হামরা জানতক্ মানব্য নাই! 
এদ্দিন একতরফা মার খাঁয়্যেছি হামরা,
ইবার সময় আসেছ্যে উট ফিরাইন দিবার,
তুদের ঐ ডিটেনশন্ ক্যাম্পট গুঁড়াইঁ দিয়্যেঁ, 
ইবার লড়্যে লুব হামদের দেশ, হামদের অধিকার।
           

বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৯

এনআরসি ও আপনি ~ শতদ্রু দাস

- আপকা স্ত্রীকা নাম এনআরসি মে নেহি হ্যায়, আপকা স্ত্রী হিন্দু হ্যায়?
- হ্যাঁ স্যার, ওঁর বাবা আসলে ১৯৭১-এ পালিয়ে এসেছিলেন, জানেনই তো সেই সময়ে কী হয়েছিল, কী করবে বলুন? হিন্দু হয়ে তখন বেঁচে থাকাই মুশকিল বাংলাদেশে, সঙ্গে যুবতী স্ত্রী থাকলে তো কথাই নেই...
- ম্যারেজ সার্টিফিকেট হ্যায়?
- হ্যাঁ স্যার। এই যে..
- ইসমে তো লিকখা হ্যায় "স্পেশ্যাল ম্যারেজ এক্ট", মুসলমান থি ক্যা?
- না স্যার, হিন্দু। ওরা নমশূদ্র, আমরা ব্রাহ্মণ। আমার বাবা রাজি ছিলেন না বিয়েতে। তাই বাধ্য হয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছি। স্পেশ্যাল ম্যারেজ এক্ট সেই জন্যই।
- উনকা বাপ কো বুলাইয়ে... বিশ্বাস, মন্ডল ইয়ে সব তো মুসলমান কা ভি নাম হোতা হ্যায়।
- ওঁর বাবা তো আর বেঁচে নেই স্যার, মা-ও আগের বছর গত হলেন...
- তো ফির ক্যায়সে পাতা করে কি ইয়ে হিন্দু থি?
- স্যার, সিঁদুর দেয়, শাঁখা পরে, এরপরেও হিন্দু নয়?
- উও সব তো দিখানে কে লিয়ে কোই ভি পেহেন সকতা হ্যায়, মেরে পাস এক মুসলিম ফ্যামিলি আয়া থা, উও কৃষ্ণ কা ফোটো রাখতা হ্যায় পার্স মে, বোলতা হ্যায় কে বাউল ইয়া কুছ হ্যায়, তো ফির উসকো ভি হিন্দু বোলনা পড়েগা। আপকে পাস ঔর কই প্রুফ হ্যায়?
- স্যার আর কী প্রমান দেব বলুন? কোনোদিন তো ভাবিনি যে প্রমান লাগবে, আপনি মাই বাপ, একবার বুঝুন যে প্রমান করা কতটা মুশকিল..
-  আপকা বেটা সরকারি নৌকরি করতা হ্যায়?
- হ্যাঁ স্যার, বিএসএফের অফিসার..
- দেখিয়ে, সুপ্রিম কোর্ট বোলা হ্যায় কি বাংলাদেশি কা বেটা ভি বাংলাদেশি মানা যায়গা জিতনা দিন ভি ইস দেশ মে রাহা হো, আপকা বেটা কা নৌকরি রাহেগা কি নাহি বোল নাহি সকতে..
- স্যার আমরা মরে যাবো, অনেক কষ্ট করে ছেলে এই চাকরিটা পেয়েছে, রাত জেগে লেখাপড়া করেছে স্যার।
- বেজাত কো শাদি করনে কে পেহলে সোচনা থা আপকো... 

নেক্সট!!!

বাংলায় এনআরসি ~ সেঁজুতি দত্ত

যেদিন প্রথম আসামে এনআরসির লিস্ট বেরোল, খুব সম্ভবত শতাক্ষীর "স্ট্রেঞ্জ ফ্রুট"-এর প্রথম শো দেখে বাড়ি ফিরেছি। এক বছর বা দুবছর আগে…মনে পড়ছে না। বাড়ি আসতে আসতেই ভাবছিলাম ওর কাজটা নিয়ে লিখবো। কিন্তু আসামের খবর পড়ে এতটাই অপমানিত লেগেছিল যে কয়েকদিন আর কিছু করতেই পারলাম না। হয়ত তখনও এতটাই সরল ছিলাম যে রাগের থেকে অপমানটা বেশি গায়ে লেগেছিল। হয়ত ভেবেছি যে বাংলায় এনআরসি হওয়া তো দূরের কথা, ভাবাও যাবে না। একটা গোটা জাতি, যারা নিজেদের উদ্বাস্তু সত্তা নিয়ে গর্ব করেন, সেখানে এধরণের কিছু ঘটাতে চাইলে রাজপথে আগুন জ্বলবে। তাই আসামের পসিবল ঠাইহীন মানুষগুলির পক্ষ নিয়েছিলাম শুধু। ভেবেছিলাম, আমার মত ওই মানুষগুলোরও বেঁচে থাকার অধিকার, নাগরিকত্বের অধিকার থাকা উচিৎ। 

কিন্তু রাজনীতি বড়ই চালাক জিনিস। তখন অনেকেই এটাকে শুধু বাংলাবিদ্বেষী তকমা দিয়ে থেকে গেলেন। এই রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীও তাই করলেন যতদূর মনে আছে। এই যে এখন এনআরসি নিয়ে এত আলোচনা, কথা, আমাদের দৈনন্দিনতায় চলে এসেছে, সেরকম যে হতে পারে সেটা নিয়ে কেউ চিন্তিত হলেন না, পাবলিক ওপিনিয়ন তৈরি করতেও সাহায্য করলেন না। ওদিকে যখন এই থ্রেট ঘরের দোরে চলে এসেছে তখনও, এবছর ভোটের সময়, লেফট দলগুলো এটাকে নির্বাচনি প্রচারের হাতিয়ার করলেন না। তার ফলস্বরূপ, ঠিক পূজার আগে শাহবাবুকে এ রাজ্যে আসতে হয় নন-মুসলমান মানুষদের আশ্বস্ত করবার জন্য।

আসা করি আমরা এবারে নিশ্চিন্তে আছি। সবই ভোটের খেলা। একের পর এক মানুষ আতংকে আছেন, আত্মহত্যা করছেন আর ওদিকে ঘোষিত সংখ্যাগুরুর দলনেতা বলছেন মানুষের লাশের ওপর দিয়ে এনআরসি হবে। তবে আমার বিশ্বাস, যে দল উনি করেন এবং সেখানে জাতপাত এবং 'বিধর্মী' নিয়ে প্রকাশ্যেই তাদের যে রূপ দেখা যায়, সেখানে হয়ত তারা ওই লাশের মধ্যেও দলিত আর মুসলমানের লাশ এড়িয়ে যাবেন। এটাই আশার, যে ওই মৃত মানুষগুলিকে হয়ত মরণোত্তর সাবর্ণ-হিন্দু-লাথি খাবার মত অপমান সইতে হবে না।

মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, সেই আসাম এনআরসির সময় থেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন। তারা এখনও গলায় রক্ত তুলে বিরোধিতা করে চলেছেন। একটু যদি চেষ্টা করে হিন্দু আর নন-হিন্দু বাইনারি থেকে বেরনো যায় তাহলে কিন্তু এই লড়াই যেতা সম্ভব। যারা সংবিধানে বিশ্বাস রাখেন তারা অন্তত আর্টিকেল ১৫র দোহাই দিয়ে এই রক্তের দাগ নিজেদের হাতে লাগতে দেবেননা প্লিজ। যারা এই সংবিধান নির্মাণের কাণ্ডারি আম্বেদকরের ভাবনা এবং দর্শন শুধুই জেনারেল নলেজের মধ্যে আটকে রেখেছেন, তারাও অন্তত শুধুই ঠিকভুলের লজিকে এর বিরোধিতা করুন। যারা হই হই করে কাল গান্ধী বাবার নাম করলেন তারা একটু ভেবে দেখুন এরকম স্বচ্ছ ভারত আপনারা চান কিনা। আর যারা প্রকৃত উদ্বাস্তু অথবা বেআইনি ঘুসপেটিয়া, একবার ধর্মের লাথি খেয়ে নিজের দেশ ছেড়েছেন, তারা অন্তত ওই একই জিনিস একইভাবে আপনার পাশের মানুষটির সাথে হতে দেবেন না। 

শুনলাম শাহবাবু বলেছেন বাংলায় এতো ভোট না পেলে কাশ্মীরের এই হাল নাকি করে উঠতে পারতেন না। বুঝে দেখুন একবার, আর 'নট ইন মাই নেম' বলতে পারবেন না কিন্তু। এই মেজরিটি নিয়েই কিন্তু সিএবি (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) আনতে চলেছে ওরা। দায় কিন্তু আছে। এই অ্যাক্ট না আনলে কিন্তু আইনত 'মুসলমান'দের 'তাড়ানো'-ই সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই 'তাড়ানো'-র আকাঙ্খা মানুষ খুন করার মতই অসাংবিধানিক এবং আইনবিরুদ্ধ। সংবিধান কিন্তু ধর্মভিত্তিক সেগরিগেশনের অধিকার দেয় না। একমাত্র এই সংবিধানকে পাল্টে ফেললেই স্বচ্ছ হিন্দু রাষ্ট্র বানানো সম্ভব। কাশ্মীর থেকে এনআরসি, গণতান্ত্রিক দেশের সরকার কিন্তু বাংলার ভোটদাতাদেরই ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আবার বাংলার কিন্তু ইতিহাসে নাম লেখাবার সময় হয়ে এসেছে। আজকে বুড়ো আঙুল দেখালে, কে জানে, কাল আপনাকে নিয়েই স্বাধীন ভারতের আরেক ইতিহাস রচিত হবে। একবার লাথি খেয়েছেন, এবারে আর লাথি দেবেন না। পেছন থেকে ছুরি না মারলে দেখবেন হাত শক্ত হবে, সবাই পাশে থাকবে। 
বাঙালি সংখ্যাগুরুর পুজো ভালো কাটুক।