শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

নিজের দেশে রিফিউজি হব? ~ পিপল্‌স স্টাডি সার্কেল

"নিজের দেশে রিফিউজি হব? : প্রশ্নোত্তরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব বিল (সিএবি)" (প্রকাশক পিপল্‌স স্টাডি সার্কেল, নভেম্বর ২০১৯) থেকে কিছু তথ্য --

পশ্চিমবাংলায় এনআরসি কি আদৌ প্রয়োজন?

সারা রাজ্যের মানুষকে যদি এখন সত্তর বছরের পুরনো দলিল দেখিয়ে নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করতে হয়, তাহলে জনজীবনে ঘোর সংকট তৈরি হবে। কে "সন্দেহভাজন নাগরিক" আর কে সাচ্চা নাগরিক, সেই নিয়ে সমাজে ব্যাপক ভীতি আর বিভেদ তৈরি হবে। এসব করে মানুষের কী লাভ হবে? বর্তমানে আমাদের রাজ্যে ৯ কোটি ৩৯ লাখ মানুষের আধার কার্ড আছে, ৬ কোটি ৯৭ লাখ মানুষের ভোটার তালিকায় নাম আছে। এছাড়াও রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, পাসপোর্ট, ব্যাংকের খাতা ইত্যাদির মত কোনও না কোনও পরিচয়পত্র বেশিরভাগ মানুষের কাছেই আছে। এটাই তো নাগরিকত্বের জন্য যথেষ্ট। এর ওপর আবার একটা জাতীয় পরিচয়পত্র বানানোর কোনও প্রয়োজন তো নেই-ই। উপরন্তু ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মত একটা উদ্বাস্তু-বিরোধী একুশে আইনের অধীনে কোনওরকম এনপিআর, এনআরসি, বা এনআরআইসি প্রক্রিয়া চালানোর সর্বাত্মক বিরোধিতা করা দরকার। এই আইনটাকেই বাতিল করতে হবে।
       
বিজেপি বলছে হিন্দুদের ভয় নেই। আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি পাশ করা হবে, তারপর এনআরসি হবে। এই সিএবি (ক্যাব) বিল ব্যাপারটা কি?

মোদী সরকার ২০১৬ সালে এই বিলটা আনে। এই বিল অনুযায়ী পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, শিখ বা খ্রিস্টান হলে তিনি আর ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের সংজ্ঞা মোতাবেক "অবৈধ অভিবাসী" হিসেবে গণ্য হবেন না, এবং ছ'বছর এদেশে থাকার পর ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। কিন্তু এই দেশগুলি থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ যদি মুসলমান হন তাহলে তিনি এই ছাড় পাবেন না, তাঁকে "অবৈধ অভিবাসী" হিসেবেই গণ্য করা হবে। 

তার মানে ক্যাব বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন/বিল সমস্ত হিন্দু উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিক বানিয়ে দেবে?      

ভুল প্রচার। সিএবি (ক্যাব) বিল কাউকেই সরাসরি নাগরিকত্ব দেবে না। অন্যের মুখের কথা না শুনে নিজে সরকারের পাতা থেকে ডাইনলোড করে পড়ে দেখুন। বিল কী বলছে? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের "অবৈধ অভিবাসী" অর্থাৎ বিদেশি হিসেবে গণ্য করা হবে না, শরণার্থী হিসেবে দেখা হবে। এটুকুই বিলের বক্তব্য। ধরে নিলাম সংসদে বিল পাশ হল, ধরে নিলাম বিল আইনও হয়ে গেল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশ থেকে এতদিন ধরে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। তাঁরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে থাকার আইনি সুরক্ষা পাবেন, এইটুকু। তাঁদের পুলিশ তক্ষুণি জেলে পুরে দেবে না বা বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেবে না।

কিন্তু নাগরিকত্ব পেতে হলে আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে আপনি ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত হয়ে ভারতে এসেছেন। ধরা যাক, আপনার পরিবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৬৫ সালে এসেছিল। ১৯৬৫-এর পর ৫৪ বছর চলে গেছে। এত বছর পর প্রমাণ করতে পারবেন যে ৫৪ বছর আগে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মের কারণে অত্যাচারিত হয়েছিলেন? মানুষ তো এদেশে নানা কারণে এসেছেন। অনেকেই চাকরি বা রোজগারের কারণে এসেছেন। অনেকেই জ্ঞাতি-গুষ্টি বা গ্রামের লোক চলে আসাতে এসেছেন। অনেকে এসেছেন দাঙ্গার কারণে। অনেকে এসেছেন ভয়ে। অনেকে এসেছেন নিরাপত্তার খোঁজে। অনেকে সরাসরি নিপীড়িত হয়েও এসেছেন। কিন্তু সেই অত্যাচারের সেলফি অথবা লাইভ ভিডিও তুলে ফেসবুকে তো আপলোড করে রাখেননি। সে সময়ে থানায় ডায়েরি তো করেননি। কীসের প্রমাণ দেবেন? দ্বিতীয় কথা হল এই যে আপনাকে নাগরিকত্বের জন্য ছ'বছর পর আলাদা আবেদন করতে হবে। সেই আবেদন সরকার খারিজও করতে পারে। 

তার মানে কী দাঁড়াল, একবার ভেবে দেখুন। এতদিন আপনি ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, বিপিএল কার্ড ইত্যাদি এতগুলো কাগজের সাহায্যে ন্যূনতম নাগরিক অধিকারটুকু পাচ্ছিলেন। বিলের এক খোঁচায় নাগরিক থেকে শরণার্থী হবেন। তারপর ছ'বছর পর নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবার ভিক্ষে করতে যাবেন সরকারের কাছে। এ এক বিরাট ধাপ্পা। এতে হিন্দু উদ্বাস্তুদের চরম ক্ষতি আর নাগরিক অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া ছাড়া আর কিছু নেই।

তাহলে মোদী সরকার সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ করাতে চাইছে কেন?

সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ করানোর একটাই উদ্দেশ্য। গোটা দেশে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভেদ আর মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করা। এই বিলে যেভাবে ইসলাম বাদ দিয়ে সমস্ত ধর্মের নাম নেওয়া হয়েছে, সেটা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বিরোধী। মানুষে মানুষে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা কানুন করা যাবে না এটা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মৌলিক কথা। এর উল্টোদিকে হেঁটে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করার আইন বানানো চলে না।

কেন্দ্রীয় সরকার যদি সত্যিই আমাদের পড়শি দেশগুলির সমস্ত নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের শরণার্থী হিসেবে ভারতের নাগরিকত্ব দিতে উদ্যোগী হত, তাহলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে থাকা আহমদী, সুফি সহ সংখ্যালঘু বা গৌণধর্মের যে মুসলমান গোষ্ঠীগুলি আছে, তাঁদের কথাও বিলে রাখত। যে নাস্তিকরা ধর্ম বিশ্বাস করেন না বলে সারা উপমহাদেশ জুড়ে আক্রান্ত, যে মুক্তমনা-রা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, তাঁদের কথাও বিলে থাকত। তাছাড়া এই বিলে মায়ানমার (বার্মা), নেপাল, ভূটান আর শ্রীলঙ্কার নাম বাদ কেন? কারণটা সহজ। মায়ানমারে রোহিঙ্গারা আক্রান্ত এবং তাঁরা মুসলমান। আক্রমণকারীরা বৌদ্ধ। নেপাল বা ভুটান থেকে যে গোর্খারা এসেছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের আক্রমণকারী হিসেবে দেখানো যাবে না। তাই এই দেশগুলি বাদ। 

তাছাড়া, ভারতের পড়শি দেশগুলিতে সংখ্যালঘু নিপীড়ন শুধুই ধর্মের নামে হয় না, ভাষা বা জাতিগত কারণেও হয়। যেমন শ্রীলঙ্কা থেকে নিপীড়িত হয়ে অনেক তামিল উদ্বাস্তুরা ভারতে এসেছেন। তাঁদের এই আইনের আওতায় আনা হয় নি কেন? বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী যে অত্যাচার চালিয়েছিল, সেটা তো ধর্মের ভিত্তিতে ছিল না। ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিদের ওপর দমন হয়েছিল এবং বাঙালি মুসলমানেরা চরম নিপীড়নের শিকার হন। সে অত্যাচার থেকে পালিয়ে কোনও বাঙালি মুসলমান যদি ভারতে এসে আশ্রয় নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনিও শরণার্থীর মর্যাদা পাবেন না কেন?

বোঝাই যাচ্ছে যে বিজেপি সরকার তার সাম্প্রদায়িক মুসলিম-বিদ্বেষী মতাদর্শ অনুসারেই এই বিলটা নিয়ে এসেছে। গরিব হিন্দু উদ্বাস্তুদের মিথ্যে আশা দিয়ে ঠকিয়ে বিষাক্ত হিন্দু-মুসলমান বিভাজন তৈরির কল ছাড়া এই বিলকে আর কী বলবেন?  
        
বিজেপি বলছে এগুলো বিরোধীদের অপপ্রচার। সিএবি (ক্যাব) বিল দিয়ে যে হিন্দু উদ্বাস্তুদের কোনও উপকার হবে না তার সরকারি প্রমাণ আছে?

প্রমাণ আছে। ২০১৬-র ক্যাব বিল নিয়ে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) আড়াই বছর ধরে আলাপ-আলোচনা এবং বিতর্ক চালিয়েছিল। বিতর্কে বিরোধী দলেরা নানা রকম প্রশ্ন করে, কেন্দ্রীয় সরকার তার জবাব দেয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সমস্তটা নিয়ে জেপিসি রিপোর্ট সংসদে পেশ হয়।

এই জেপিসি রিপোর্টের ৩৯ এবং ৪০ পাতার প্রতিটি বাক্যে যেন উদ্বাস্তুদের দুর্ভাগ্য জ্বলন্ত অক্ষরে লেখা। সরকারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে কীভাবে নাগরিকত্ব আবেদনের সত্যি-মিথ্যে যাচাই করা হবে, আর কোন উদ্বাস্তুরা এই আইনের সুবিধে পাবেন? তারা জবাব দেয় যে এ দেশে আসার আগে থেকেই যে উদ্বাস্তুরা জানিয়ে রেখেছেন যে তাঁরা অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে এসেছেন এবং যাঁদের লং টার্ম ভিসা দেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র তাঁদেরকেই এই আইনের সুবিধে দেওয়া হবে। নতুন করে এখন যাঁরা নিজেদের অত্যাচারিত হওয়ার ইতিহাস জানাবেন, তাঁদের কেসগুলো ইনটেলিজেন্স বুরো এবং রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা "র" (RAW)-এর গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখবেন। এই আধিকারিকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে মোট কতজন মানুষ এই আইনের সাহায্যে নাগরিকত্ব পেতে পারেন? তাদের জবাব, "হিন্দু – ২৫,৪৪৭, শিখ – ৫,৮০৭, খ্রিস্টান – ৫৫, বৌদ্ধ – ২, পার্সি -২, সব মিলিয়ে সারা দেশে ৩১,৩১৩ জন"। এটা আমাদের কথা নয়, সরকারের জবাব। জেপিসি কমিটির সদস্যরা আইন বিভাগের আমলা-মন্ত্রীদের জিজ্ঞেস করেছিলেন যে দেশজুড়ে শুধুমাত্র ৩১,৩১৩ জন মানুষ এই আইনের উপকৃতের আওতায় আসবেন, না সংখ্যাটা পরে বদলাতেও পারে? এতে সরকারের জবাব, মোট ওই ৩১,৩১৩ জনকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বাকিদের বরং বিদেশি ট্রাইবুনাল এর সামনে হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা কাগজ নকল করে নাগরিকত্ব পান নি। 

তার মানে যদি সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ হয়, তাহলে সারা ভারতে মাত্র ৩১,৩১৩ জন উদ্বাস্তু এখন নাগরিকত্ব পাবেন। আর ২০০৩-এর একুশে আইনটার ফাঁদে বানানো এনআরসি-র ছাঁকনিতে যে ১৯ লক্ষ মানুষ আসামের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁদের জন্য কাঁচকলা। এছাড়া নতুন করে যে মানুষেরা ২০০৩ আইনের "বেআইনি অভিবাসী"-র ফাঁদে পড়ে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়বেন, তাদের জন্যও কাঁচকলা। তাঁদের ভাগ্যে থাকবে ট্রাইবুনাল, কোর্টকাছারি, ডিটেনশন ক্যাম্প আর আবেদন-নিবেদন। 

তাহলে নাগরিকপঞ্জি বা ক্যাব করে কোনও লাভ নেই। কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়লেও তাদের বাংলাদেশে পাঠানো সম্ভব না। খালি সাধারণ মানুষকেই হয়রানি করা হবে। তার ওপর ভারতীয়দের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। মোটের ওপর এটা বলা যায়? 

হ্যাঁ। ২০০৩-এ পাতা ফাঁদে এনআরসি-র ছাঁকনিতে ধরা যদি পরেন, তবে ২০১৬-এর নাগরিকত্বের কল আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। আসামের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটাও শিখলাম যে যদি কোনওক্রমে আপনার নাম একবার নাগরিকপঞ্জিতে উঠেও যায়, তাহলেও শান্তি নেই। দেশপ্রেমিকরা সন্দেহ করে নালিশ করলে আবার সে নাম বাদও পড়তে পারে। দেশপ্রেমিকদের সন্দেহের ভিত্তিতে আপনার পিছনে নালিশের ফেউ এবং ঝুটা অবজেকশন দু'টোই লাগতে পারে। তারপর "র"-এর গোয়েন্দা বাহিনী এবং "ইন্টেলিজেন্স বুরো" আপনার ঠিকুজি কুষ্ঠি ঘাঁটতে বসবে। সবশেষে পড়ে থাকবে একটাই প্রশ্ন। বাঙাল বেলতলায় যায় কয়বার? 

এনআরসি আর ক্যাব নিয়ে মিথ্যে প্রচারটা বুঝলাম। কিন্তু একটা খটকা আছে। পশ্চিমবাংলায় কি সত্যিই দু' কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আছেন? 

না, এটা বিজেপি-র ছড়ানো গুজব। আসলে "বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী"-দের কোনও নির্দিষ্ট তথ্য বা সংখ্যা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা স্পষ্ট করে লিখিত ভাবেই এটা জানিয়ে দেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন